যাকে চিনি না, তাকেই কেন এত আপন মনে হয়

প্যারাসোশ্যালের সহজ বাংলা—একপক্ষীয় প্রেম বা বন্ধুত্ব। এমন কোনো মানুষের সঙ্গে গভীর মানসিক সংযোগ, যাকে আপনি ভালোবাসেন, চেনেন, অনুভব করেন, অথচ সে আপনার অস্তিত্বের কথাও জানে না। ১৯৫৬ সালে সমাজবিজ্ঞানীরা যখন প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, তখন তাঁরা টেলিভিশন আর রেডিওর দর্শকদের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু এক শ বছর পর, শব্দটি মানুষের নিঃসঙ্গতার এক বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কোনো কারণ ছাড়াই ‘তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধ হয় চিনি’ অনুরণিত হচ্ছে। আর মনে পড়ছে কমলদার কথা। ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় কমল ঘোষরা থাকতেন। তাঁদের ঘরে ঢুকলেই মনে হতো ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছি। দেয়ালজুড়ে পোস্টার—রবিন হুড থেকে অঞ্জন দত্ত। টাইটানিক জাহাজে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, গিটার হাতে জন লেলন। কমলদা মাঝেমধ্যে সেই পোস্টারের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতেন। লিওনার্দোর জন্মদিনে কেক কাটতেন, লেলন-অঞ্জনের গানে চোখ বন্ধ করে এমনভাবে দুলতেন, যেন বণিকপাড়ার মন্দির চত্বরে অঞ্জন গাইছে ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব’।

আমরা তখন ছোট। হাসাহাসি করতাম। ভাবতাম, হয়তো কমলদা একটু পাগল। যাকে কখনো দেখা যাবে না, যার সঙ্গে বাস্তবে কোনো সংযোগ নেই, তার জন্য এত আবেগের বিচ্ছুরণ।

কিন্তু আজ, পঁচিশ বছর পরে, যখন দেখলাম কেমব্রিজ ডিকশনারি ২০২৫ সালের সেরা শব্দ হিসেবে ঘোষণা করেছে ‘প্যারাসোশ্যাল’, হঠাৎ মনে হলো—কমল ঘোষ পাগল ছিলেন না। তিনি কেবল সেই একপক্ষীয় সংযোগের জগতে বসবাস করতেন, যাকে আজ আমরা প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক হিসেবে আবিষ্কার করছি।

প্যারাসোশ্যাল। শব্দটি শুনতে অদ্ভুত। তবে এর অনুভূতিটা কমল ঘোষদের পথ ধরে আমি সহজে বুঝতে পারছি। প্যারাসোশ্যালের সহজ বাংলা—একপক্ষীয় প্রেম বা বন্ধুত্ব। এমন কোনো মানুষের সঙ্গে গভীর মানসিক সংযোগ, যাকে আপনি ভালোবাসেন, চেনেন, অনুভব করেন, অথচ সে আপনাকে চেনে না। আপনার অস্তিত্বের কথাও জানে না। ১৯৫৬ সালে সমাজবিজ্ঞানীরা যখন প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, তখন তাঁরা টেলিভিশন আর রেডিওর দর্শকদের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু এক শ বছর পর, শব্দটি মানুষের নিঃসঙ্গতার এক বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু আজ, পঁচিশ বছর পরে, যখন দেখলাম কেমব্রিজ ডিকশনারি ২০২৫ সালের সেরা শব্দ হিসেবে ঘোষণা করেছে ‘প্যারাসোশ্যাল’, হঠাৎ মনে হলো—কমল ঘোষ পাগল ছিলেন না। তিনি কেবল সেই একপক্ষীয় সংযোগের জগতে বসবাস করতেন, যাকে আজ আমরা প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক হিসেবে আবিষ্কার করছি।

আমাদের অতীতটা ছিল দূরত্বের। কিংবা সুদূরের। সেই সময়ের তারকারা আকাশের নক্ষত্রের মতো আমাদের থেকে দূরে ছিলেন। সালমান শাহর মৃত্যুতে যে কিশোরী ভাত খাওয়া বন্ধ করেছিল বা হুমায়ুন ফরীদিকে দেখে যে ছেলেটি ভিলেন হওয়ার স্বপ্ন দেখত—তাদের ভালোবাসা ছিল পবিত্র, নীরব, ব্যক্তিগত। সে সময় লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের ভিড় ছিল না। ভিউ দিয়ে কোনো কিছুর মান নির্ধারিত হতো না। ছিল শুধু অনুভব। কিন্তু সেই অনুভবের তীব্রতা এতটা গভীর ছিল যে সালমান শাহর ট্র্যাজিক মৃত্যুর পরে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক ভক্ত আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিলেন। এই একপক্ষীয় সম্পর্কের গভীরতা, যেখানে মানুষ তাদের নিজের জীবনের বাস্তবতা বিসর্জন দিয়ে এক স্ক্রিনের চরিত্রের সঙ্গে গভীর একপক্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অতীতের উদাহরণগুলো আমার চোখে এখনো স্পষ্ট।

কিন্তু আজকের পরিস্থিতি আরও জটিল। জেন–জি প্রজন্ম—সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, রিল, কে–পপ তারকা—এরা প্রতিদিন একই ধরনের একপক্ষীয় সংযোগ তৈরি করছে। ভিডিওতে চোখে চোখ রেখে সময়ের তারকারা বলছে, ‘তোমরা আমার ফ্যামিলি।’ এবং আমরা বিশ্বাস করছি। মনে হয় আমরা তাদের ড্রয়িংরুমে বসে আছি। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। এই একপক্ষীয় সংযোগ এখন মানুষের জীবনের এমন জায়গায় প্রবেশ করেছে, যেখানে তারা পরিবারের সঙ্গে, মা–বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে সংযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ ঘর ছাড়ছে, পরিবার-পরিজনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিজের ভার্চ্যুয়াল পরিচয়ের সন্ধান করছে।

এটি শুধু চরমতম নিঃসঙ্গতার প্রতিফলন নয়, এটি মানুষের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতি–প্রতিবেশের প্রতি দায়বোধ থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত মনে করছে। আমাদের চারপাশ, প্রকৃতির ক্ষতি—সবকিছুকে আমরা কম গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা এমন এক জগতে বসবাস করছি, যেখানে প্রতিবেশীর চেয়ে স্ক্রিনের চরিত্র আমাদের কাছে বেশি প্রিয়। আমরা আমাদের মা–বাবা, সহকর্মীর সঙ্গেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাই, অথচ বাস্তব সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

প্যারাসোশ্যাল পুঁজিকে নতুন বাস্তবতায় পুষ্ট করছে
ছবি: সংগৃহীত

প্যারাসোশ্যাল সম্পর্কের এই নেতিবাচক প্রভাব অতীতের সূত্র থেকে স্পষ্ট। সালমান শাহর সময়ে যেমন কিছু ভক্ত নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, আজকের প্রজন্মও কিছুটা সেই একই পথ অনুসরণ করছে—কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। তারা ভার্চ্যুয়াল চরিত্রের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত হচ্ছে, বাস্তব জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ ঘরে থাকার পরিবর্তে শহরের এক কোণ, ক্যাফে বা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে—এটি আর পরিবারের সঙ্গে সংযোগ নয়, এটি ভার্চ্যুয়াল আত্মনির্ভরতার জন্য বাস্তবতা ত্যাগ করা।

আমরা প্রযুক্তির উন্নতিতে বিভোর। কিন্তু মানবিক সংবেদনশীলতা, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা—সবকিছু বিসর্জন দিতে বসেছি। কমলদা যখন জন লেলনের ‘ইমাজিন’ গানটির কথা বলতেন তখন মনে হতো তিনি এক ঘোরের মধ্যে বাস করছেন। তিনি আমাদের এমন এক পৃথিবীর কথা বলতেন, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, নেই ক্ষুধা বা দারিদ্র্য, নেই মানুষে মানুষে বিভেদ।

কিন্তু আজকের প্রজন্মের জন্য এই একপক্ষীয় সংযোগ হয়ে উঠেছে একান্ত ব্যক্তিগত। যেখানে মানুষের নিজস্ব বাস্তব সম্পর্ক, পরিবারের উপস্থিতি, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ—সবই বুদ্‌বুদ আকারে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই মনে করছেন মা–বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে থাকা মানে নিজেকে অনেকটা খাটো করে রাখা। অনলাইন স্টারদের সঙ্গে এক অলীক কথোপকথনের আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি। এই ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে আমরা সংযোগ হারাচ্ছি। পাশাপাশি থেকেও মানুষ মানুষের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এটাই আমাদের প্যারাসোশ্যাল বাস্তবতা। যাকে আমরা ভালোবাসি, যাকে আমরা চাই, তাকে কিন্তু আমরা সত্যিকার অর্থে চিনি না। কিন্তু তার প্রতি আমাদের অনুভূতি এতই গভীর যে আমরা বাস্তব জীবন, বাস্তব সংযোগ—সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এবং সেই বিসর্জন পুঁজিকে নতুন বাস্তবতায় পুষ্ট করছে।

অনেকে মনে করছেন প্যারাসোশ্যাল সম্পর্কের একমাত্র ‘সান্ত্বনা’ একাকিত্ব থেকে মুক্তি। কিন্তু বাস্তব জীবনের মূল্য হ্রাস পাচ্ছে। মানুষের প্রতি সহানুভূতি কমছে। অন্যের ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতা কমছে। প্যারেন্টস বা ভাই-বোন, বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে। প্রকৃতির যেকোনো ক্ষতি—বৃক্ষ নিধন, নদীদূষণ—সবকিছু আমাদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, ভার্চ্যুয়াল জগতে আবদ্ধতা সব আবেগকে ওভার রাইট করে দিচ্ছে।

এটাই আমাদের প্যারাসোশ্যাল বাস্তবতা। যাকে আমরা ভালোবাসি, যাকে আমরা চাই, তাকে কিন্তু আমরা সত্যিকার অর্থে চিনি না। কিন্তু তার প্রতি আমাদের অনুভূতি এতই গভীর যে আমরা বাস্তব জীবন, বাস্তব সংযোগ—সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এবং সেই বিসর্জন পুঁজিকে নতুন বাস্তবতায় পুষ্ট করছে।

কমল ঘোষদের কেউ কেউ ওপারে। কেউ বাসা বেঁধেছে সুদূর আমেরিকায়। তবু আমার সেই ঘোর লাগা দুপুর কিংবা শঙ্খ বাজানো গোধূলির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তাঁর পোস্টারের সঙ্গে কথোপকথন। তাঁর একপক্ষীয় আবেগ। কিন্তু আজকের বাস্তবতা আরও তীক্ষ্ণ আরও সুচালো। আমরা বর্তমানে এমন এক জগতে বসবাস করছি, যেখানে স্ক্রিনের মানুষ আমাদের সবচেয়ে কাছের। কিন্তু বাস্তব মানুষ, পরিবার, প্রকৃতি—সবকিছু ধীরে ধীরে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই একপক্ষীয় ভালোবাসার ভেতর লুকিয়ে আছে নিঃসঙ্গতা। সবকিছু ভেঙে পড়ার নিদারুণ বাস্তবতা। ভাঙা সম্পর্ক, হ্রাসপ্রাপ্ত সংবেদনশীলতা। প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক আমাদের প্রাচীন আবেগকে আবার নতুনভাবে চিত্রিত করছে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মানবিক শক্তি, সংবেদশীলতা—সবকিছু নিঃশেষ করছে। কিন্তু এই ঘটমান বর্তমান থেকে পালিয়ে থাকার উপায় নেই। ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হ্যাভেন…