শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ—বাংলাদেশের কবিতায় এক বাইনারি বাস্তবতা। একজন থাকবেন তো আরেকজন থাকবেন না। যদি থাকেন, তাহলে দুজনই থাকবেন মুখ ফিরিয়ে—পরস্পরের বিপরীতে; ‘সাক্ষাতে’ নয়, থাকবেন ‘তফাতে’। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের সমান্তরাল সহাবস্থান? অসম্ভব, যেন ‘এক ঘরে দুই পীরের’ আসন। আদতে এটি অত্যন্ত সমস্যাজনক প্রবণতা।
বহু বছর ধরে বাংলাদেশে এই বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যে কাব্যতাত্ত্বিক অহং থেকে সোনালি কাবিন–এর উৎসর্গপত্রে আল মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘আমাদের এককালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্যহিংসা অমর হোক’, জনপরিসরে তা ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ ঈর্ষার আকারে। বন্ধুত্ব রূপ নিয়েছে বিচ্ছেদে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দুই কবিকে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, বন্ধুত্বের সমস্যা কোথায়? দুজনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জবাব দিয়েছেন, দুলে উঠেছে অভিমানের কাঁটা। কিন্তু সমস্যা অন্য কোথাও।
সমস্যাটা যত না কাব্যিক, তার চেয়ে রাজনৈতিক। মোটাদাগে সেই বিবাদের বিবরণী এ–ই, শামসুর রাহমান মানেই জাতীয়তাবাদী, আল মাহমুদ মানেই ইসলামপন্থী। অতএব দুই ভুবনের দুই বাসিন্দার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অথচ দুজন কবিই উঠে এসেছেন বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পরম্পরা থেকে; দুজনই তৈরি করেছেন কবিতার নিজস্ব খাত। দুঃখজনকভাবে দুজন কবির ক্ষেত্রেই কাব্যকলার সৌন্দর্যের চেয়ে মুখ্য হয়ে গেল রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা। প্রশ্ন জাগে, তাঁরা কি রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন? অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ উৎপাদন ও তার বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেমে পড়েছিলেন মাঠে-ময়দানে? তরুণ আল মাহমুদের রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্টতা মনে রেখেও বলতে হবে, আদতে তা নয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা কবিতাকেই নমস্য মনে করেছিলেন।
মোটাদাগে বিবাদের বিবরণী—শামসুর রাহমান মানেই জাতীয়তাবাদী, আল মাহমুদ মানেই ইসলামপন্থী। অতএব দুই ভুবনের দুই বাসিন্দার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অথচ দুজন কবিই উঠে এসেছেন বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পরম্পরা থেকে; দুজনই তৈরি করেছেন কবিতার নিজস্ব খাত।
শামসুর রাহমান বাঙালির জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের পটভূমিতে প্রচুরসংখ্যক কবিতা সৃষ্টি করেছেন। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন আল মাহমুদ নিজেও। যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেকের প্রশ্নবিদ্ধ আকুতি, সেই জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে সোনালি কাবিন–এরও মর্মসার। কিন্তু আল মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রধান অনুযোগ ওঠে যে তিনি ইসলামি আদর্শের অনুগামী হয়ে কবিতা রচনা করেছেন; ইসলামপসন্দ মতাদর্শ উৎপাদনকারী সংবাদপত্রে লেখালেখি করেছেন। অর্থাৎ বাঙালির জাতীয়তাবাদী খাত থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, ধর্মভাব ও বোধের অনুপস্থিতি কি জাতীয়তাবাদের প্রধান শর্ত? নিশ্চয়ই তা নয়।
অন্যদিকে কোনো কবির জন্য জাতীয়তাবাদে আস্থা স্থাপন কি সমস্যাজনক? একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজন ও তাড়না থেকেই উত্থিত হয়েছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদ। এই সত্য অস্বীকার করা হবে অনৈতিহাসিক উন্মাদনা ও স্বেচ্ছাচারিতার দুর্বল নিদর্শন। বিশেষত শামসুর রাহমানের লেখালেখি সামনে রেখে এসব কথা বলার কারণ এই যে শামসুর রাহমান জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হননি, যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে মতাদর্শিক যন্ত্রে পরিণত করতে চেয়েছে। একইভাবে ইসলামপসন্দ ব্যক্তিবর্গও আল মাহমুদকে ইসলামি গরিমায় আটকাতে চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই দুই অংশ একই প্রবণতার দুই অন্ধকার খোঁয়াড়—যেখানে বৈচিত্র্যের জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কারণে জাতীয়তাবাদীরা আল মাহমুদের এক ভাগ কবিতা গ্রহণ করতে আগ্রহী। অন্যদিকে ইসলামপসন্দ ভাবুকসমাজ শামসুর রাহমানের জাতীয়তাবাদ গ্রহণে নিতান্ত অনিচ্ছুক।
সত্যিকার অর্থে, শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ—কেউই প্রচারণামূলক সাহিত্য লিখতে কবিতার দুয়ারে কড়া নাড়েননি। তাঁরা দুজনই ছিলেন কবিতার নিবিষ্ট পাঠক। কবিতার ভাব-ভাষাকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করার তৎপরতায় তাঁরা ঘোরতরভাবে মত্ত ছিলেন। সে ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ কিংবা ইসলাম-সংশ্লিষ্টতা একটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ আকারে হাজির হয়েছিল। কবি হিসেবে সেই সব প্রপঞ্চ থেকে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিছু প্রসঙ্গ, বিষয় ও চিন্তা বাছাই করেছেন মাত্র। আর তাই শামসুর রাহমানকে বাংলা কবিতার ইতিহাস থেকে বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ নেই। যেমনভাবে বাতিল করার অপচেষ্টা ব্যাহত হয়েছে আল মাহমুদের ক্ষেত্রে। বাতিল করার নামে একচক্ষু হরিণপনা যে কাজে দেয় না, তার বড় প্রমাণ আল মাহমুদ স্বয়ং; জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন তাঁর উপস্থিতিকে নগণ্য করে তুলতে চাইলেও সে প্রকল্প অব্যর্থভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কবিতার জোরে বেঁচে গেছেন আল মাহমুদ।
এর বিপরীতে বলা যায়, শামসুর রাহমানের বড় ক্ষতি করেছেন জাতীয়তাবাদীরাই। তাঁরা জাতীয়তাবাদের স্তাবকতা করতে গিয়ে দল বেঁধে শামসুর রাহমানকে ঠেলে দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গারদে। এ ধরনের বিদ্যায়তনিক গবেষক ও ভাষ্যকারেরা আলোচনার শিরোভাগে তুলে এনেছেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’-এর মতো কবিতা। গণমাধ্যম আর পাঠ্যপুস্তকজুড়ে শামসুর রাহমানের এই সব কবিতাই উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হয়েছে। সেই সূত্রে সাংস্কৃতিক রাজনীতির দিক থেকে শামসুর রাহমান ও তাঁর কবিতার একটি প্রধান অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে, তা হলো শামসুর রাহমান বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদের কবি’। কিন্তু রাহমান কি পুরো কবিতাজীবনে জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত প্রতিক্রিয়াই লিখে গেছেন? লেখেননি মাতাল ঋত্বিক এবং আরও সনেটগুচ্ছ? অক্ষরবৃত্তের শাসন এড়িয়ে গদ্যের ধরনে, সংলাপে, সম্ভাষণে লেখেননি দীর্ঘ পয়ার? দৈনন্দিন জীবনকে কবিতায় রূপান্তরিত করার খেলায় মাতেননি তিনি? খুঁজে দেখেননি লৌকিক জীবন ও জবানের সম্পর্ক? আমরা কি জানি, বাংলা কবিতায় একগুচ্ছ অভাবিত ড্রামাটিক মনোলগ তাঁরই লেখা?
প্রকৃতপক্ষে এই দুই অংশ একই প্রবণতার দুই অন্ধকার খোঁয়াড়—যেখানে বৈচিত্র্যের জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কারণে জাতীয়তাবাদীরা আল মাহমুদের এক ভাগ কবিতা গ্রহণ করতে আগ্রহী। অন্যদিকে ইসলামপসন্দ ভাবুকসমাজ শামসুর রাহমানের জাতীয়তাবাদ গ্রহণে নিতান্ত অনিচ্ছুক।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশের কাব্যভোক্তারা কাব্যতাত্ত্বিক প্রশ্নের মীমাংসা করার আগে কবিকে দেখতে চান প্রধানত রাজনীতির ঠুলি পরে। আর তাই, কাব্যের আলোচনা থেকে হারিয়ে যেতে বসে কবিতার ‘কবিতা হয়ে ওঠা’র প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের গড় পাঠকেরা ‘স্বাধীনতা তুমি’-জাতীয় কবিতার নাম জানেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কাছে অচেনা লাগে শামসুর রাহমানের ‘সেই ঘোড়াটা’, ‘কবর খোঁড়ার গান’, ‘খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি’, ‘শৈশবের বাতি-অলা আমাকে’, ‘জনৈক সহিসের ছেলে বলছে’, ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’, ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’র মতো কবিতাকে।
তবে সাহিত্যের দীক্ষিত পাঠকমাত্র জানেন, শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার জন্য মৌলিক এক ভাষা তৈরি করেছেন, যেখানে কবির ব্যক্তি ‘আমি’ মিশে যায় বহির্জগতের অন্য অনেক ‘আমি’র দৈনন্দিনতার সঙ্গে। সে কারণেই রাহমান তাঁর পাঠককে স্থাপন করতে চেয়েছেন অনিঃশেষ বর্তমানে। বর্তমানের ধারাবাহিকতায় পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় ধাবমান এক সময়। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ও স্বপ্নগ্রস্ততা মিলিয়ে পাকিস্তান-উত্তর যে মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহরে, তার এক কাব্যবিবরণ হয়ে উঠেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। তাঁর কবিতায় ঢুকে পাওয়া যায় শহুরে জীবনের এক সারি প্রতীক ও ভাবপ্রপঞ্চ—সব মিলিয়ে উঠে আসে ঢাকা শহরের টুকরো টুকরো জীবন।
শহর বেড়েছে, বেড়েছে শামসুর রাহমানের কবিতার পরিসর। শহর ভেঙেছে, কবিতায় উঠে এসেছে তার দীর্ঘশ্বাস। শহরের বুকজুড়ে শোনা গেছে রাজনীতির হট্টগোল, রাহমান লিখেছেন সেই হট্টগোলের বৃত্তান্ত। রাহমানের শহুরে গল্পে চরিত্র হয়ে আসে ভিখিরি, মাতাল, বেশ্যা, গোরখোদক, সহিস, বাতিওলা, ভবঘুরে, কেরানি। তিনি নিজেও থাকেন কথক অথবা চরিত্র হয়ে। কখনো কখনো নিজেই নিজেকে ডাক দেন নিজের ডাকনাম ধরে, নাম নেন লুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো দয়িতার।
বাংলা কবিতায় কোন কবি এতটা অনুপুঙ্খতায় শহরকে ধারণ করেছেন? তিরিশের দশকের যে কবিদের সঙ্গে শামসুর রাহমানের তুলনা টানা হয়, দেখানো হয় প্রভাবের প্রতিমা, সেই কবিরা শহরকে ঢেকে ফেলেছেন প্রতীক-চিত্রকল্পের আচেনা আচ্ছাদনে। কবিতা থেকে হারিয়ে গেছে নুন আনতে পান্তা ফোরানোর গল্প। অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে কিংবা সমর সেন, এমনকি মার্ক্সবাদী কবিদের দল—কেউই শহরবাসীর নিত্যদিনকার ইতিকথা লেখেননি; হয়তো তা আরাধ্যও ছিল না তাঁদের। কিন্তু রাহমান চিনিয়ে দিয়েছেন বিকাশমান শহরের অলিগলি, গড়ন ও ভাঙন। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে ইতিহাস, স্মৃতি, নস্টালজিয়ার হাহাকারও যুক্ত করেছেন।
এই বাস্তবতা নির্মাণ ও উপস্থাপনের জন্য শামসুর রাহমান তৈরি করেছেন নিজের কবিতার উপযোগী এক ভাষাকাঠামো। কেননা, এই ভাষা ছাড়া গড়ে উঠবে না উদ্দিষ্ট বাস্তবতা, অভিজ্ঞতাকে বর্ণনাও করা যাবে না। শামসুর রাহমানকে তাই কবিতায় জুড়ে দিতে হয় মাতালের ভাষা, চলতি পথের স্ল্যাং, পুরোনো ঢাকার বুলি, কথ্যভঙ্গি। বাংলা কবিতায় এই ভাষা-স্বভাব নিতান্তই রাহমানীয়। যদিও তাঁর এই উদ্যোগের ভেতর আমেরিকার বিট জেনারেশনের কবিদের ছাপ পড়েছে। তাতে করে রাহমানের গুণপনার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে না। কেননা, উপনিবেশিত আধুনিকতা সংকরায়ণের পথ ধরেই এগিয়ে গিয়েছে।
জাতীয়তাবাদের একদেশদর্শী খোঁয়াড় থেকে শামসুর রাহমানকে বের করে নিয়ে আসার এটিই মোক্ষম সময়। এই পর্বে তাঁর মৌলিকত্বকে আরও বেশি শনাক্ত করা দরকার; চিহ্নিত করা দরকার তাঁর আধুনিকতাকে। কবি ও কবিতার রাজনীতিকে বুঝতে গিয়ে কবিতার আঙ্গিকগত নিজস্বতাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা থেকে বের হওয়া জরুরি।
গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কারও কারও মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লোকে আর শামসুর রাহমানের কবিতা পড়বে কি? কেননা, রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদের পতন ঘটেছে। শামসুর রাহমানের জাতীয়তাবাদী প্রতিমূর্তি তৈরি হওয়ায় এই সংশয় আরও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে দেখা যেতে পারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও; বলা যেতে পারে, জাতীয়তাবাদ সত্য, জাতীয়তাবাদের ফ্যাসিবাদী রূপও সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি মৃত ঘোড়া, যার রাজনৈতিক প্রয়োজন ফুরিয়েছে; কে না জানে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে মৃত ঘোড়া তাৎপর্যহীন। আর এখান থেকেই শুরু হতে পারে শামসুর রাহমানের কবিতার নতুন পাঠ এবং পুরোনো পাঠের নতুন মূল্যায়ন।
জাতীয়তাবাদের একদেশদর্শী খোঁয়াড় থেকে শামসুর রাহমানকে বের করে নিয়ে আসার এটিই মোক্ষম সময়। এই পর্বে তাঁর মৌলিকত্বকে আরও বেশি শনাক্ত করা দরকার; চিহ্নিত করা দরকার তাঁর আধুনিকতাকে। কবি ও কবিতার রাজনীতিকে বুঝতে গিয়ে কবিতার আঙ্গিকগত নিজস্বতাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা থেকে বের হওয়া জরুরি। কবিতার ভাষিক ও গাঠনিক ইতিহাসকেও পাঠ করতে হবে। শহর ঢাকাকে কেন্দ্র করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের যে জীবনচক্র আবর্তিত হয়েছে গত চার-পাঁচ দশক ধরে, তার সাংস্কৃতিক পাঠও প্রস্তুত করা দরকার। মূলত বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকায়নের মৌলসূত্রগুলোর চিহ্নায়ন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে শামসুর রাহমানের কবিতা হতে পারে প্রধান সহায়ক।
মনে রাখতে হবে, শামসুর রাহমানের হাত ধরেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে ইউরো-আমেরিকান উপাদান। উপনিবেশিত বাস্তবতা মেনে বাংলা কবিতায় ইউরোপের অভিঘাতকে বিভিন্ন সময় আমরা মূল্যায়ন করেছি। কিন্তু আমেরিকান ও লাতিন আমেরিকান কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের কবিতার সংযোগ বিষয়ে আমাদের বিশ্লেষণের ভাগ খানিকটা কম। নেরুদার একনিষ্ঠ ভক্ত শামসুর রাহমানের কবিতা সেই পর্যালোচনাও দাবি করে।
শেষমেশ বলতে চাই, মতাদর্শ ফুরিয়ে যায়, কবিও কি ফুরিয়ে যান? যদি তা-ই হতো, বৈষ্ণব ভাবোচ্ছ্বাস ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতেন জ্ঞানদাস; সেই কোন যুগের বিদ্যাপতি এখনো কেন উচ্চারিত হন? রবীন্দ্রনাথের হাতেই–বা কেন বিনির্মিত হয়ে দেখা দেবে ভানুসিংহের পদাবলী? কেন হারিয়ে গেলেন না মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ? বড় লেখকেরা ফিরে আসেন সময়ের তাৎপর্যে; তাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন, প্রয়োজনে ইতিহাস দ্বারা বিনির্মিতও হন। আল মাহমুদের ‘হারিয়ে যাওয়া’ আর ‘প্রত্যাবর্তনে’র মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই সংকেত।
শামসুর রাহমান কোন নতুন তাৎপর্যে গৃহীত হবেন কে জানে? কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, শামসুর রাহমানের কবিতা ছাড়া বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস হয়ে ওঠে খণ্ডিত। আমরা কি ইতিহাসের খণ্ডতাকে উসকে দেব, নাকি খণ্ডগুলো জোড়া দিয়ে নির্মাণ করব নতুন অবয়ব? উগ্র জাতীয়তাবাদসৃষ্ট যে সংকট আল মাহমুদকে বিব্রত ও বিপর্যস্ত করেছে, জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে শামসুর রাহমানের কাঁধেও কি চাপিয়ে দেব সেই একই ধরনের বিপর্যস্ততা? বাংলাদেশের কবিতামুগ্ধ পাঠক নিশ্চয়ই একদিন এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবেন নিজস্ব পন্থায়।