অন্তর্ধানের ৮০ বছর
সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে এ সময়ের জার্মান গবেষকেরা কী ভাবছেন
১৯৪৫ সালে ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে বিমান দুর্ঘটনার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান ঘটে। তাঁর মূল্যায়ন করেছেন জার্মান গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা।
১৯৪১ সাল। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া। ভারতে ব্রিটিশরা চাপের মুখে। একদিকে তাদের সবচেয়ে বৃহত্তম উপনিবেশ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। অন্যদিকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচের তেলখনিসমৃদ্ধ ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো অক্ষশক্তির দুই বড় দেশ জার্মানি ও ইতালির কাছে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
এই সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নতুন একটি ফ্রন্ট খুলতে গোপনে ভারতবর্ষের আলোচিত নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ছাড়েন। শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে আর কাজ হবে না, সশস্ত্র লড়াই করে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে—এই ছিল তাঁর ভাবনা। ভারত ছেড়ে প্রথমে তিনি যান জার্মানি।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। বিতর্কের বড় কারণ, তিনি নাৎসি নেতা হিটলারের সহায়তায় ভারতকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে ইতালির ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
যে জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র বসু ‘নেতাজি’ নামে ভূষিত হয়েছিলেন এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সে দেশের গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা তাঁর কী মূল্যায়ন করেছেন, একবার দেখা যাক।
‘ডের স্পিগেল’–এর স্মৃতিচারণা
জার্মানির স্বনামধন্য সাময়িকী ডের স্পিগেল পত্রিকাটি ৮০ বছর আগেকার সেই ঘটনা স্মরণ করেছে।
১৯৪৫ সালে ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অনুসন্ধান করে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ লিখেছেন সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল। তিনি লিখেছেন, ‘জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।’
১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বার্লিনে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু।
বার্লিন শহরের প্রায় কেন্দ্রে হাউস অব দ্য এভিয়েটরস, বর্তমানে ফেডারেল কাউন্সিল ভবন। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি সেখানে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে তিনি বলেন, ভারতীয়রা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দাবি করায় ব্রিটিশরা ভারতজুড়ে সন্ত্রাসী শাসন কায়েম করেছে। তাঁর জার্মান ভাষায় দেওয়া বক্তৃতাটি রেডিওতে সম্প্রচারিত হয় এবং পরদিন জার্মানির বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জানুয়ারির সেই সন্ধ্যাতেই বার্লিনে শেষবারের মতো তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ইয়োসি বার্টেল লিখেছেন, জার্মানি, ইতালি ও জাপান—এই তিন অক্ষশক্তির দৃষ্টিতে উপনিবেশিত বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বার্লিনে আসার বছর কয়েক আগেও তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি এবং দলের সমাজতান্ত্রিক ধারার নেতৃত্বে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বলপ্রয়োগসহ শর্তহীন স্বরাজের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের সৃষ্টি হয়। তিনি তাঁর সভাপতি পদের বিরোধিতা করেন। সুভাষ ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু গান্ধী তাঁকে তাঁর নিজস্ব পরিষদ গঠন করার পরামর্শ দেন। এ ঘটনা সুভাষ ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটায়। সুভাষ কংগ্রেস সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।জার্মান সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল
ডের স্পিগেল লিখেছে, ১৮৯৭ সালে জন্ম নেওয়া সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর নীতিকে বহুবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। গান্ধীর বিপরীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
১৯৪১ সালে ১৬ জানুয়ারি রাতে কলকাতার এলগিন রোডে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে চলে যান। ভিন্ন নাম–পরিচয় ব্যবহার করে আড়াই মাস পরে মস্কো হয়ে ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল তিনি জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এসে পৌঁছান। ব্রিটিশ শাসনে কুড়ি বছরের মধ্যেই ১১ বার জেল খেটেছিলেন। বুঝেছিলেন, সাধারণ পথে ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব নয়। বিকল্প পথ খুঁজতে শেষ পর্যন্ত তিনি থিতু হলেন বার্লিনে।
স্মারকলিপিতে প্রবাসী সরকার
বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। ভোরম্যান সুভাষের পরিকল্পনা শুনে সব লিখে দিতে বলেন।
সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে সুভাষের আবার সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন। সম্পূরক প্রস্তাবটির শিরোনাম ছিল ‘অক্ষশক্তি ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার পরিকল্পনা’। পরিকল্পনাটির মধ্য দিয়ে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সহজ হয়।
বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন।
স্মারকলিপিটির শুরুতেই সুভাষ একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেন এবং নির্বাসিত ভারতীয় সরকারের প্রতি কূটনৈতিক স্বীকৃতির দাবি জানান। তিনি বলেন, জার্মানি ও তার মিত্ররা ভারতে ব্রিটিশদের পতন ঘটাতে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে পারে। তার পরিকল্পনায় আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী উপজাতীয় অঞ্চলে একটি সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে ভারতে কার্যক্রম চালানোর প্রস্তাব ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে। জার্মানির মাটিতে যুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ব্রিটিশ–ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী গড়ে তোলার বিষয়টি আরও পরে আসে।
ডের স্পিগেল–এর প্রবন্ধে ২০১১ সালে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ রোমেন হেইসের বই সুভাষচন্দ্র বোস ইন নাজি জার্মানি থেকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, ‘জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াখিম ফন রিবেনট্রপ ও ইতালির নেতা বেনিতো মুসোলিনির কাছে সুভাষ ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য অক্ষশক্তির সমর্থন চেয়েছিলেন, কিন্তু এতে সাফল্য পান কিঞ্চিৎ।’
বেঞ্জামিন জাকারিয়ার মূল্যায়ন
একই প্রবন্ধে নেহরুর জীবনীকার বেঞ্জামিন জাকারিয়া বলেছেন, ‘সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে ফ্যাসিবাদের আদর্শগত সামঞ্জস্য আছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘এরই মধ্যে বিশের দশকের শেষ দিকে তিনি মুসোলিনির আদলে পোশাক তৈরি করিয়েছেন।’ সুভাষ তাঁর লেখায়ও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে ভারত যথেষ্ট পশ্চাৎপদ, সেখানে একনায়কতন্ত্র প্রয়োজন। ইউরোপের বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন।’
জাকারিয়া একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘ক্রিস্টালনাখট, অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের ৯-১০ নভেম্বর জার্মানিতে নাৎসি অনুসারীদের হাতে ইহুদিদের দোকান ও প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসসাধন এবং শত শত মানুষকে হত্যার পর, সুভাষ বসু জার্মান ইহুদিদের প্রতি সংহতি জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি এমনকি ভারতীয় ভূখণ্ডে ইহুদি শরণার্থী গ্রহণের বিরুদ্ধেও মত দিয়েছিলেন, যা সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী নেহরুকে বিস্মিত করে। বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। কারণ, মাত্র কয়েক বছর আগে নাৎসি বর্ণবাদী আইনে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরে সুভাষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছিলেন।’
১৯৩৮ সালের ৯-১০ নভেম্বর জার্মানিতে নাৎসি অনুসারীদের হাতে ইহুদিদের দোকান ও প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসসাধন এবং শত শত মানুষকে হত্যার পর, সুভাষ বসু জার্মান ইহুদিদের প্রতি সংহতি জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি এমনকি ভারতীয় ভূখণ্ডে ইহুদি শরণার্থী গ্রহণের বিরুদ্ধেও মত দিয়েছিলেন।নেহরুর জীবনীকার বেঞ্জামিন জাকারিয়া
জাকারিয়া বলছেন, সুভাষ জার্মান অপরাধ ও হলোকস্ট সম্পর্কে কতটা জানতেন, তা অস্পষ্ট। তবে নাৎসি শাসন ও জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন উচ্চপর্যায়ের নির্বাসিত রাজনীতিক হিসেবে তাঁর কাছে তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ ছিল। এমনকি হিটলারের সঙ্গেও তাঁর একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সাক্ষাতে তিনি কেবল হিটলারকে তাঁর লেখা ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইটি থেকে ভারতের সমালোচনার অংশটুকু মুছে ফেলার কথা বলেছিলেন। হিটলার তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পরও ‘ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে জার্মান জাতিকে সমর্থনের জন্য’ সুভাষ গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সুভাষ বসুর মেয়ের বক্তব্য
ডের স্পিগেল লিখেছে, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মেয়ে অনিতা ফাফ-বসুর বয়স ৮২ বছর। তিনি দক্ষিণ জার্মানির আউগ্সবুর্গ শহরের কাছে বাস করেন। অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের সাবেক নারী রাজনীতিবিদ ঠান্ডা মাথায় তাঁর বাবার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বিশ্লেষণ করেন। তিনি সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তাঁর বাবার কাছে ভারতের স্বাধীনতাই ছিল সবকিছু। এর বাইরে আর কিছু আসলে স্থান পায়নি। নাৎসিদের সঙ্গে চুক্তি বা সংশ্লিষ্টতা সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবনের একটি দুর্বল দিক হিসেবেই থেকে গেছে, যা অস্বীকার করা যায় না বলে অনিতা মন্তব্য করেছেন।’
ডের স্পিগেল আরও লিখেছে, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যেই সুভাষ–কন্যা অনিতা কাফ–বসু আর তাঁর মা এমিলি শেঙ্কল সুভাষ বসুর ভারতবাসী পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। প্রথমবার ভারত ভ্রমণের সময়ই অনিতা উপলব্ধি করেন, তাঁর পিতা সেখানে স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে কতটা সম্মানীত। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “তাঁর বাবার নাৎসি জার্মানিতে আগমন আসলে একাধিক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফল। তিনি আসলে কাবুলে সোভিয়েত দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন। একজন বামপন্থী হিসেবে সোভিয়েতদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল, কিন্তু সোভিয়েতরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। কাবুলে তখন তিনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিলেন। জায়গাটি ছিল এক গুপ্তচরকেন্দ্র। বার্লিনে পৌঁছনোর সামান্য পরেই জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ চালায়, তখন তিনি পুরোপুরি বিস্মিত হন।”’
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মেয়ে অনিতা ফাফ-বসু সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তাঁর বাবার কাছে ভারতের স্বাধীনতাই ছিল সবকিছু। এর বাইরে আর কিছু আসলে স্থান পায়নি। নাৎসিদের সঙ্গে চুক্তি বা সংশ্লিষ্টতা সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবনের একটি দুর্বল দিক হিসেবেই থেকে গেছে, যা অস্বীকার করা যায় না বলে অনিতা মন্তব্য করেছেন।’
বর্তমান লেখক নিজেও সুভাষ–কন্যা অনিতা ফাফ-বসু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী ব্রজলাল মুখোপাধ্যায়ের সন্তান কিরণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডের স্পিগেল–এর প্রবন্ধটি নিয়ে কথা বলেন। তাঁদের বক্তব্য, পরাধীন ভারতবর্ষের বৃহত্তর স্বার্থে সুভাষ বসুর এই কৌশল যথাযথ ছিল। অনিতা ফাফ-বসু ৩০ আগস্ট ২০২৫ বর্তমান লেখককে বলেছেন, জার্মানিতে বা ভারতে নানাজনের নানা মত আছে। সুভাষ বসু জাতিবিদ্বেষী বা ইহুদিনিধনের পক্ষে ছিলেন না। ইয়োসি বার্টেল জন্মসূত্রে জেরুজালেমের। সুভাষ বসুর সঙ্গে নাৎসি সরকারের সখ্য তাঁর পক্ষে সহজভাবে নিতে পারার কথা নয়। পত্রিকাটিতে দুই ইতিহাবিদ এবং গবেষকের মন্তব্য পড়লে মনে হয়, সুভাষ বসু হিটলারের নৃশংসতার সহযোগী ছিলেন। বস্তুত তা নয়।
জার্মানির অন্য গবেষকেরা যা বলছেন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে সম্প্রতি ডক্টরাল থিসিস করেছেন ইয়ান কুলম্যান। সুভাষচন্দ্র বসু এবং অক্ষশক্তির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বইটি কার্যত তাঁর এক দশকের গবেষণার ফসল।
সুভাষ বসু ইউরোপে ঠিক কীভাবে তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন, ইয়ানের গবেষণার আগে এত বিশদভাবে তা জানা যায়নি। ইয়ান লিখেছেন, ভারতের স্বাধীনতার স্বার্থে সুভাষ তাঁর ‘শত্রুর শত্রু’র কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে প্রস্তুত থাকলেও তিনি নিজে ফ্যাসিস্ট সমর্থক ছিলেন না। সুভাষ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে অক্ষশক্তির নেতাদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে কাজ করতেন এবং বার্লিন থেকে আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের মাধ্যমে বিপুল মানুষের সহানুভূতি লাভের প্রচেষ্টা করেছিলেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজের দোভাষী ছিলেন রুডলফ হার্টগ নামের এক ব্যক্তি। জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে বাঘের চিহ্নের নিচে: জার্মান পক্ষের ভারতীয় সৈন্যদল ১৯৪১-১৯৪৫ নামে তাঁরও একটি বই আছে। দোভাষী হিসেবে কাজ করায় আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্দর ও সদরের সবাইকে তিনি চিনতেন। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘একটি অখণ্ড ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের জন্য জাতি–ধর্ম–ভাষা–নির্বিশেষে স্বাধীন ভারত গঠনে তাঁদের দেশপ্রেম ও উদ্যম ছিল দেখার মতো।’
পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য, পরাধীন ভারতবর্ষের বৃহত্তর স্বার্থে সুভাষ বসুর এই কৌশল যথাযথ ছিল। অনিতা ফাফ-বসু ৩০ আগস্ট ২০২৫ বর্তমান লেখককে বলেছেন, জার্মানিতে বা ভারতে নানাজনের নানা মত আছে। সুভাষ বসু জাতিবিদ্বেষী বা ইহুদিনিধনের পক্ষে ছিলেন না। ইয়োসি বার্টেল জন্মসূত্রে জেরুজালেমের। সুভাষ বসুর সঙ্গে নাৎসি সরকারের সখ্য তাঁর পক্ষে সহজভাবে নিতে পারার কথা নয়।
বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনের মাত্র ১৩ দিন পর সুভাষ বসু উত্তর জার্মানির কিল সাবমেরিন–বন্দর থেকে জার্মান ইউবোট–১৮০–তে করে পূর্ব এশিয়ার দিকে যাত্রা করেন। জার্মানিতে তিনি বিভিন্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা প্রায় তিন হাজার ব্রিটিশ–ভারতীয় সৈন্য রেখে যান। এঁরা সৈন্যরা আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়ে সুভাষ বসু ও হিটলার উভয়ের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। জার্মানি ছাড়ার আগে সুভাষ বসু এঁদের দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর বিশ্বাসভাজন কেরালার আরথিল কান্দেথ নারায়ণন নাম্বিয়ারের হাতে। রেখে যান তাঁর স্ত্রী ও সচিব অস্ট্রিয়ান এমিলি শেঙ্কল এবং তাঁদের দুই মাস বয়সী মেয়ে অনিতাকে। তাঁদের সঙ্গে সুভাষ বসুর আর কখনো দেখা হয়নি।
রহস্যময় অন্তর্ধান
ইয়োসি বার্টেল সুভাষ বসুর অন্তর্ধান বা মৃত্যুরহস্যকে কেন্দ্র করে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর জার্মানি ছেড়ে জাপানের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল যুদ্ধপরিস্থিতির সঙ্গে যৌক্তিক। জার্মানির মিত্রশক্তি জাপান তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঢুকে ভারতের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
সুভাষ বসু এই সময়টায় সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। বস্তুত তিনি মাসের পর মাস ভারতের কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। কিল বন্দর থেকে তিনি গোপনে সাবমেরিনে চড়ে ভারত মহাসাগরের মাদাগাস্কার যান। সেখান থেকে জাপানি সাবমেরিনে করে ১৯৪৩ সালের মে মাসে টোকিও পৌঁছান। স্বল্প সময়ে ৪০ হাজারের বেশি সদস্য নিয়ে সেখানে তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি প্রতিষ্ঠা করেন, সিঙ্গাপুরে অক্ষশক্তি–স্বীকৃত একটি নির্বাসিত সরকার গঠন করেন এবং জাপানের সমর্থনে ভারত আক্রমণ করেন। সে আক্রমণ ব্যর্থ হয়।
যাঁদের আদর্শগত পূর্বসূরিরা গান্ধীকে হত্যা করেছিল, তাঁরা এখন সুভাষ বসুকে স্বাধীনতার বিকল্প নায়ক হিসেবে স্মরণ করে, গান্ধীকে যেখানে স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রনায়ক বলে মনে করা হয়। সুভাষ বসুর মেয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, ‘সুভাষ আজ বেঁচে থাকলে ডানপন্থা ও হিন্দু-জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করতেন।’ইয়োসি বার্টেল
ইয়োসি বার্টেল লিখেছেন, ‘১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে সুভাষ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তবু আজও বহু ভারতীয় তাঁকে মুক্তির অগ্রনায়ক হিসেবে দেখেন। যাঁর কঠোর পন্থা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল। যাঁদের আদর্শগত পূর্বসূরিরা গান্ধীকে হত্যা করেছিল, তাঁরা এখন সুভাষ বসুকে স্বাধীনতার বিকল্প নায়ক হিসেবে স্মরণ করে, গান্ধীকে যেখানে স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রনায়ক বলে মনে করা হয়। সুভাষ বসুর মেয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, “সুভাষ আজ বেঁচে থাকলে ডানপন্থা ও হিন্দু-জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করতেন।” তাঁর কাছে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সহনশীলতা কেবল মুখের বুলি ছিল না, বরং আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি তা প্রয়োগ করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, শিখ ও মুসলমানরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এলেও একই ইউনিটে কাজ করত। এটি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর কাঠামোর বিপরীত। এমনকি তাঁর বাহিনীতে নারী সৈনিকও ছিলেন। ইন্ডিয়া গেটের পেছনে সুভাষের ৮ দশমিক ৫ মিটার উঁচু একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। অথচ তাঁর দেহাবশেষ এখনো টোকিওর একটি ছোট্ট মন্দিরে সংরক্ষিত। তাঁর মেয়ের প্রত্যাশা, অন্তত মৃত্যুর পর তাঁর ‘মুক্ত ভারতে প্রত্যাবর্তন’ ঘটুক এবং তাঁর মৃত্যুপরিস্থিতি নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হোক। তবে সুভাষ–কন্যা বলেন, ভারত সরকার এতে উৎসাহী নয়।’
সুভাষ বসুর মেয়ে ইয়োসিকে আরও বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচলিত। অনেকের বিশ্বাস, তিনি ভারতে মারা গেছেন অথবা কয়েক দশক ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দী ছিলেন।’ তিনি এতে বিস্মিত নন। কারণ, ‘সুভাষ বসু অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে মারা গেছেন, ছিলেন আকর্ষণীয় রোমান্টিক বীর, নানা গুজব ও রহস্যময় কল্পনা ভারতীয় মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়। কারণ, ভারতে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করা হয়।’
🖱️: ̗̀➛ অন্য আলোর ফেসবুক পেজ
সুভাষ বসুর অন্তর্ধান সম্পর্কে তাঁর মেয়ে অনিতা কাফ-বসু বর্তমান লেখকের কাছে স্মৃতিচারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার বয়স তখন তিন বছরও হয়নি। মা আর দিদার কাছে শুনেছি, তখন আমার ছোট একটা বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম। রান্নাঘরে রেডিও চলছিল। মাত্র তিন মাস আগে ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবু প্রতিদিন সবাই আগ্রহভরে রেডিওতে সন্ধ্যার খবর শুনত। ঘরে আমার মা, দিদা আর খালা। হঠাৎ খবর শুনে তারা স্থবির হয়ে যান। সবাই বাক্রুদ্ধ হয়ে বসে পড়েন। খবরে বলা হয়, ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। মা আমার বিছানার পাশে এসে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকে।’
অনিতা বলছেন। তাঁর চোখ দুটি ছলছল করছে।