একজনই রাজীব আশরাফ

অকালপ্রয়াত গীতিকবি রাজীব আশরাফ স্মরণে চারুকলার বকুলতলায় আজ ‘হোক কলরব’ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাঁর বন্ধুরা। বিকেল পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে অনুষ্ঠানটি চলবে রাত অবধি। অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার, তরুণ কবি রাজীব আশরাফ মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে কেমন ছিলেন—এ লেখায় সে কথাই লিখেছেন তাঁর এক বন্ধু।

রাজীব আশরাফ
ছবি: হোসেন আতাহার

আমি আর আমাদের বন্ধু পল জেমস গোমেজ বসে ছিলাম আজিজ মার্কেটের দোতলার বারান্দায়। পাঠক সমাবেশের ওপরে যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, হঠাৎ সেখান থেকে রাস্তার ওইপারের ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকা একটা ছেলেকে দেখে চিৎকার করে ডাকল পল, ‘এই রাজীব, কই যাস?’

ছেলেটা ডাক শুনে পলকে দেখতে পেয়ে উজ্জ্বল একটা হাসি হেসে হাত নেড়ে বোঝাল, সে আসছে। এসেই ব্যাগ থেকে একটা ক্যামেরা বের করে দেখাল পলকে। পল ফটোগ্রাফি করত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আমাদের চেয়ে খানিকটা সিনিয়র। রাজীব আশরাফের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল পল। জানলাম, রাজীব চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগে পড়ে। আমরা একই ব্যাচ, ফার্স্ট ইয়ার।

আমিও তখন ফটোগ্রাফি শুরু করেছি। আমাকে ছবি তোলা শিখিয়েছিল পলই। রাজীবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্যামেরাটা কিনলেন?’ ও বলল, ‘না, এটা আমার গার্লফ্রেন্ডের, আসলে গার্লফ্রেন্ড না, বউই। আমরা বিয়ে করে ফেলছি, ভদ্রতা করে গার্লফ্রেন্ড বলি।’ বলে খুব একগাল হাসল। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! বলে কী এই ছেলে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, বিয়ে করে ফেলেছে! কী সাহস!

রাজীব ইউনিভার্সিটিতে যেত ঠিকই, তবে ক্লাস করত না। কারণ, তার মাথায় ঢুকেছে সিনেমা বানানোর ভূত, তত দিনে ওর প্রথম ছবি ‘জলচর’ বানানোও শেষ। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর পড়াশোনা করবে না, সিনেমাই বানাবে। পরদিন দেখা হলে আমি যখন রেগেমেগে বললাম, ‘তোর জন্য তোর মাকে মিথ্যা বললাম,’ ও তখন খুব করে হেসে বলল, ‘ভালো করছিস, এইটুকু না করলে কিসের বন্ধু!’

পরে বুঝেছি, ওটা ওর জন্য এমন কোনো সাহসের কাজ ছিল না। রাজীবের সাহস ছিল আকাশছোঁয়া। নিজের জীবন নিয়ে কোনো রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও বাদ রাখেনি। ওর সঙ্গে যখন মিশতে শুরু করি, ওর কাছে সব সময় ইনহেলার থাকত। অ্যাজমার অ্যাটাক হতো প্রায়ই। যাঁদের শ্বাসকষ্ট থাকে, তাঁদের ধুলাবালু থেকে দূরে থাকতে হয়, ধূমপান করতে হয় না আর রোজ গোসল করতে হয়। রাজীব এর কোনোটাই মানত না। না মানার পেছনে ও যেসব যুক্তি দিত, তার কোনোটাই খুব কাজের না, অ্যাবসার্ড সব কথাবার্তা।

কিন্তু ও বলতেই থাকত, বলতেই থাকত! এত কথা বলতে পারত ছেলেটা!
একদিন রাজীবকে খুঁজতে ওর বাসায় গেলাম। আন্টি দরজা খুলে বললেন, ‘রাজীব তো বাসায় নাই, কই কই যে থাকে! তুমি তো ওর সাথেই পড়ো, চারুকলাতেই? ও কি ইউনিভার্সিটিতে যায়?’

আমি বললাম, ‘না আন্টি, আমি চারুকলায় না, কলাভবনে পড়ি, কিন্তু চারুকলায় যাই। রাজীব যায় তো ইউনিভার্সিটিতে।’ রাজীবের আম্মাকে কথাটা আমি বললাম বটে, কিন্তু এটা একটা অর্ধসত্য কথা। রাজীব ইউনিভার্সিটিতে যেত ঠিকই, তবে ক্লাস করত না। কারণ, তার মাথায় ঢুকেছে সিনেমা বানানোর ভূত, তত দিনে ওর প্রথম ছবি ‘জলচর’ বানানোও শেষ। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর পড়াশোনা করবে না, সিনেমাই বানাবে।

রাজীব আশরাফ
ছবি: বিজয়

পরদিন দেখা হলে আমি যখন রেগেমেগে বললাম, ‘তোর জন্য তোর মাকে মিথ্যা বললাম,’ ও তখন খুব করে হেসে বলল, ‘ভালো করছিস, এইটুকু না করলে কিসের বন্ধু!’
এরপর বহুবার ওর হাত–পা ধরতে বাকি রেখেছি, পড়াশোনাটা যেন চালিয়ে যায়। ক্লাসটাস করার দরকার নেই, পরীক্ষাগুলো তো দিক, কাজ জমা দিক। তখনো চারুকলা ফ্যাকাল্টি হয়নি, ইনস্টিটিউট ছিল। শিক্ষকেরা চাইলে বিশেষ বিবেচনা করতে পারতেন।

কিন্তু সে জন্য তো শিক্ষকদের কাছে যেতে হবে, বলতে হবে। রাজীব সম্ভবত ছাত্রত্ব ধরে রাখার তেমন কোনো চেষ্টাও করেনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর থেকে ওর মন উঠে গেছে, আর পড়বে না, কথা শেষ!

ওইবারও ওর সাহস দেখে আমি মুগ্ধ হই। চারুকলায় পড়ার জন্য সুযোগ পায় না লোকজন, আর ও কিনা ছেড়ে দিচ্ছে! আসলে রাজীবের সবকিছুই ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। লোককে মুগ্ধ করতে পছন্দও করত ও। শুধু মুগ্ধ নয়, খুশি করতে, আনন্দে রাখতে চাইত সবাইকে। রাজীবকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের মধ্যে এমন মানুষ খুব কমই আছেন, যাঁরা রাজীবের নিজের হাতে বানানো কোনো না কোনো উপহার পাননি। আর্ট আর ক্র্যাফট—দুটোই ও করত খেলার মতো করে। ছড়া লেখা, কবিতা লেখা, গান লেখাও ওর কাছে মজার খেলা। ও যেন একটা শিশু, সারাক্ষণ খেলছে!

ফেসবুক আসার পর কবিতা লিখত ফেসবুকে। কোনো ব্যাকআপ রাখত না। বারবার বলতাম, প্লিজ লেখাগুলো একত্র করো। কাউকে ই–মেইল করে রাখো।’ ও ‘করব করছি’ করে আর করত না। কোনো এক জুনিয়র বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়েছিল, সেখান থেকে কিছু পাওয়া গেছে কি না, জানি না। আমি নিজের ফেসবুকে ২০১০ পর্যন্ত খুঁজে দেখেছি। কোথাও কিচ্ছু নেই—না কোনো ছবি, না কোনো লেখা। এখনকার আইডিটা ও পরে খুলেছিল আগেরটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে। শত শত লেখা, হাজার হাজার শব্দ হারিয়ে গেছে।

এ নিয়ে ওর কোনো আফসোসও ছিল না। শব্দ তো ওর হাতের পুতুল। হারিয়ে গেছে তাতে কী? আবার আসবে, আবার হবে অনেক অনেক লেখা!

আমাকে ও ডাকত প্রেমিকা বলে। বলত, ও আগে থেকে বিবাহিত না হলে নাকি আমার সঙ্গেই ওর প্রেম হতো! এমন মুখে মুখে প্রেম ওর আরও কয়েকজনের সঙ্গে ছিল। এটাও ওর আরেক খেলা। আমাকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছিল রাজীব।

কাগজের ওপর কলম দিয়ে মুক্তার মতো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা সেসব কবিতাও আমার কাছে আর নেই। শুধু উদ্ধার করতে পেরেছি ওর অ্যাক্রস্টিক কবিতার বিপরীতে ওকে নিয়ে লেখা আমার একটা অ্যাক্রস্টিক—
‘রাখো সব কাজ ফেলে
জীবনের মতো আড়ি হয়ে যাবে
বলে দিলাম আজ, ছেলে।
আমাদের ছিল, শেষ বর্ষার জল
শরীর ছাড়িয়ে মনে মনে চলাচল
রাতজাগা নেই, দিনের আলোয় দেখা
ফসিল প্রেমের অক্ষরে লেখাজোকা।’

আশরাফের ‘ফ’ বর্ণটি দিয়ে আর কোনো শব্দ কি ছিল না! ‘ফসিল’ কেন লিখলাম! ওর জন্য ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, মায়া সব ফসিল হয়ে আমার বুকে আটকে থাকবে বলেই কি? আজীবনের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে বলেই কি? অনেক শক্ত, অনেক অনড় বলেই কি?

একদিন শুনলাম, রাজীবের মা মারা গেছেন। ওদের বাসায় ঢুকতেই মিতুল আপুর সঙ্গে দেখা, ওদের সঙ্গেই ও তখন কাজ করে সম্ভবত। আপু বলল, ‘রাজীব কেমন যেন শকড হয়ে আছে, ওর কাছে একটু যা তো!’ আমি ওকে খুঁজে বের করলাম, একটা ঘরের একটা পড়ার টেবিল আর খাটের মাঝখানে সংকীর্ণ একটা জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে গায়ে হাত রাখতেই ও ‘মুমু’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘কাঁদে না’। মিতুল আপু আমাকে বলল, ‘ওকে কাঁদতে দে মুমু, একটু কাঁদুক।’

রাজীব মরে গেছে শুনে আমিও কাঁদিনি। যে কয়জন আমাকে ওর মৃত্যুসংবাদ জানানোর জন্য বা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ফোন করেছে, সবাই ভেবেছে, আমি একজন শক্ত মানুষ। নইলে বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ এত শান্তভাবে কেউ গ্রহণ করতে পারে? তা ছাড়া ২০২১ সালে ফুসফুস অপারেশনের পর কেউই ওর বাঁচার আশা করেনি। সবাই–ই মানসিকভাবে প্রস্তুত, যে কোনোদিন শোনা যাবে, রাজীব আর নেই। আমিও প্রস্তুত ছিলাম।

কিন্তু আসলেই কি ছিলাম? হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ওর অমলিন হাসি দেখে আমিও কি ভাবিনি, আরে এটা রাজীব, ও তো পারবেই। যমের সঙ্গে লড়াই করে নিজের জান ফিরিয়ে আনবে ও নিজেই। আমরা বন্ধুরা শুধু পাশে থাকলেই হবে। বাকিটা ও একাই এক শ! শুধু একাই এক শ নয়, ও ছিল হাজারে একজন, না, লাখে একজন! তা-ও নয়, রাজীব আশরাফ আসলে একজনই।

যে চলে গেলে পৃথিবীটা অনেকটা খালি হয়ে যায়! ১ সেপ্টেম্বর আমার ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে। দেখলাম ৫টা ৪৪ বাজে। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে বন্ধু দম্পতি। বলেছে ঘুম থেকে উঠে চলে যেতে। শুক্রবার, ছুটির দিন, ওরা তো ঘুমাবে একটু। তাই ১১টা নাগাদ বের হব ভেবেছি। এখনো হাতে অনেক সময়।

কিন্তু ঘুম আর এল না। সেদিনই একটা জাতীয় দৈনিকে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হওয়ার কথা। অনলাইনে খুঁজে পেলাম, ফেসবুকে শেয়ার করলাম। একটু সকাল হলে বের হয়ে প্রিন্ট পত্রিকাও কিনে আনলাম। তবু সময় তো কাটে না। গান শুনতে শুনতে কী জানি কী ভেবে ‘বাংলা ফাইভ’ ব্যান্ডের ‘আমি লাস্টবেঞ্চ আমি ব্যাকডোর’ গানটা বাজিয়ে দিলাম লুপে। শেয়ার করলাম ফেসবুকেও। লিখলাম, আমি মরে গেলে লাভ বেশি তোর।

রাজীবের লেখা আরও অনেক গানের মতো এই গানও ভীষণ জনপ্রিয়। রাজীব মরে গেলে কার কী হয়, আমি জানি না। আমার মনে হয়, রাজীব মরলে আমার অশৌচ হয়। আমি বা রাজীব কেউই সনাতন নই, আমাদের রক্তের সম্পর্কও নেই।

তবু আমার ইচ্ছা করে, সেলাই ছাড়া সাদা কাপড় পরে মাটিতে শুই, পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে আলোচালের ভাত আর সবজি সেদ্ধ করে ঘি মেখে হবিষ্যি খাই, মৌন হয়ে পালন করি শোক।

কিন্তু আমি তো মৌন থাকতে পারছি না। সারা দিন সারা রাত থেকে থেকে চিৎকার করে করে কাঁদছি আর কাঁদছি। বন্ধুদের ফোন করে করে কাঁদছি। বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি, কাঁদছি পোষা কুকুরকে ধরেও।

আমার মতো রাজীবও খুব কুকুর ভালোবাসত। রাস্তায় কুকুর দেখলেই আদর করত! ‘কুত্তার মতো’ ফ্রেইজটা আমি ওর কাছেই শিখেছিলাম। যেকোনো কিছু খুব প্রচণ্ড হলেই ও বলত ‘কুত্তার মতো’। আমার কাছে রাজীবও কুত্তার মতো। অল্প সময় বাঁচল, প্রতিদিন বাঁচল এক–একটা জীবন। সে হিসেবে ওর জীবন মোটেই ছোট নয়। আমরা যারা বুড়ো হয়ে মরব, তাদের চেয়ে অনেক বেশি বড় আর প্রচণ্ড ওর এই অল্প দিনের জীবন। শুধু প্রচণ্ডই নয়, ভীষণ সুন্দরও!

রাজীব ভালোবাসত সৌন্দর্য! ও যা করত, সব সুন্দর হতো! সুন্দর দেখতে দেখতে আর সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে আমাদের প্রচণ্ড মেধাবী আর কান্তিমান বন্ধুটার ছোট্ট জীবনটা শেষ হলো। ওকে না চিনলে পৃথিবীর রং আমার কাছে অনেকটাই কম হতো! কী ভাগ্য আমাদের! রাজীব আশরাফ আমাদের বন্ধু! একটা মাত্র রাজীব আশরাফ!