নারী দেহ নিয়ে ক্ষমতার খেলা, ইতিহাসে ‘গণধর্ষণের’ রাজনীতি
নারী কণ্ঠরোধের ইতিহাস নতুন নয়। শুধু কি ইতিহাসে? প্রাচীনতম সাহিত্যে, লোককথায়, ধর্মীয় আখ্যান কিংবা সামাজিক রীতিতেও আমরা দেখতে পাই নারীর উচ্চারণকে বারবার সীমিত করা হয়েছে। একসময় তা ঘটেছে পারিবারিক বা ধর্মীয় শাসনের মাধ্যমে, আবার কখনো ঘটেছে সামাজিক বর্জন ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে। আধুনিক যুগে এই একই প্রক্রিয়া নতুন প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে। অনলাইন সহিংসতা, গণধর্ষণের হুমকির মতো নির্মম ভাষা আজ আমাদের চোখের সামনে। এটা নারীকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পুরোনো কৌশলেরই সমকালীন রূপ।
পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদেহকে নিয়ন্ত্রণ ও গণধর্ষণের হুমকি—রাজনৈতিক দমন ও ক্ষমতার পুরোনো অস্ত্র হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে লক্ষাধিক নারীর ওপর ধর্ষণ চালায়। বসনিয়া যুদ্ধের সময় ‘রেপ ক্যাম্প’-এ মুসলিম নারীদের বন্দী করে সার্ব বাহিনী ধর্ষণকে জাতিগত নিধনের অংশ করে তোলে। রুয়ান্ডার গণহত্যায় হুতু মিলিশিয়া কয়েক লাখ তুতসি নারীকে ধর্ষণ করে, যাতে ভয়ের সংস্কৃতি গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত বিভাজনের সময় নারী শরীরকে প্রতিপক্ষের সম্মানহানির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল; হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীরা সেই ভয়াবহতার শিকার হন। আফ্রিকার কঙ্গো ও লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধেও ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানো হয়, এমনকি জাতিসংঘ কঙ্গোকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস রেপ ক্যাপিটাল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
গণধর্ষণ ও তার হুমকি কোনো বিচ্ছিন্ন সহিংসতা নয়, বরং রাজনীতির ইতিহাসে এক গভীর কৌশল—যা নারীর কণ্ঠরোধ করে সমাজকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যায়।
প্রাচীন ইতিহাসে ট্রোজান যুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ইউরোপ পর্যন্ত—বিজিত নগরের নারীরা যৌনদাসত্বে আবদ্ধ হয়েছে। এসব উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণধর্ষণ ও তার হুমকি কোনো বিচ্ছিন্ন সহিংসতা নয়, বরং রাজনীতির ইতিহাসে এক গভীর কৌশল—যা নারীর কণ্ঠরোধ করে সমাজকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যায়।
ইতিহাসে নারীর শরীর তাই সব সময়ই একধরনের রাজনৈতিক ক্ষেত্র। দেহের ওপর কর্তৃত্বের মানে কেবল জৈবিক নিয়ন্ত্রণ নয়; এর ভেতর নিহিত থাকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য। মিশেল ফুকো তাঁর ক্ষমতার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করাই আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যতম প্রধান কৌশল। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ আরও বহুমাত্রিক।
সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’–এ লিখেছিলেন, ‘নারী জন্মগ্রহণ করে না, নারী হয়ে ওঠে।’ এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি আসলে শরীরকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই ঘটে। কিশোরী থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে নারীকে শেখানো হয়, তার দেহ কেবল অন্যের মন্তব্য, অন্যের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আবদ্ধ। তাই সাম্প্রতিক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার ঘটনা নিছক কটূক্তি নয়, বরং নারী হয়ে ওঠার এই সামাজিক প্রক্রিয়াটিকে আরও দৃঢ় করার ঘোষণা।
গণধর্ষণ কখনো কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, এটি সমষ্টিগত ক্ষমতার প্রদর্শন। নারীকে ভীত করার জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র, কারণ এর ভেতরে নিহিত আছে শরীরকে ধ্বংস করে কণ্ঠকে স্তব্ধ করার বার্তা। নারীবাদী গবেষক ক্যাথরিন ম্যাককিনন বলেছেন, যৌন সহিংসতা আসলে যৌন প্রবৃত্তির প্রকাশ নয়; এটি ক্ষমতার একধরনের অনুশীলন। গণধর্ষণের হুমকি সেই অনুশীলনের প্রতীকী ভাষা।
গণধর্ষণ কখনো কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, এটি সমষ্টিগত ক্ষমতার প্রদর্শন। নারীকে ভীত করার জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র, কারণ এর ভেতরে নিহিত আছে শরীরকে ধ্বংস করে কণ্ঠকে স্তব্ধ করার বার্তা।
অনলাইন স্পেসে যখন এ ধরনের ভাষা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা শুধু একজন নারীকে ভয় দেখায় না; বরং অন্য সব নারীকেও এই সতর্কবার্তা দেয়—এই মঞ্চ তোমাদের জন্য নিরাপদ নয়। নারীবাদী দার্শনিক লুস ইরিগারাই যেমন বলেছেন, নারীকে নীরব করা মানে কেবল একটি কণ্ঠকে নয়, বরং সমগ্র নারী অভিজ্ঞতাকে ভাষাহীন করে ফেলা।
নারীকে নীরব করার কৌশল সময়ের সঙ্গে বদলেছে। একসময় যা ঘটেছে সামাজিক লজ্জা, পরিবারের দমন বা ধর্মীয় শাসনের ভেতর দিয়ে। এখন তা ঘটছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নারীর কণ্ঠ প্রকাশের নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত করলেও, একই সঙ্গে তা হয়ে উঠেছে নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের নতুন মঞ্চ।
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?’–এ দেখিয়েছেন, নিপীড়িতের কণ্ঠ বারবার ইতিহাসের পাতা থেকেও মুছে দেওয়া হয়। সৌন্দর্যের ধারণাও দীর্ঘদিন ধরে নারীকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সাধারণত সৌন্দর্যকে শাশ্বত আদর্শ ধরে নারী শরীরকে তার বাহক বানানো হয়। কিন্তু সৌন্দর্য আসলে নশ্বর—চেরি ফুলের মতো অল্প সময়ের জন্য বিকশিত হয়। নারীর শরীরকে সৌন্দর্যের মানদণ্ডে বেঁধে রাখার মানে হলো তাকে চিরকাল অন্যের চোখে বিচার্য করে রাখা।
সিলভিয়া ফেডেরিচি তাঁর ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ’–এ বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ নারীর শরীরকে শ্রম ও প্রজননের যন্ত্রে পরিণত করেছে। সেই একই ধারায় আজও নারীদেহকে সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র বানানো হয়। গণধর্ষণের হুমকি নারীর শরীরকে ‘শাসনযোগ্য সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করার এক প্রতীকী উচ্চারণ।
তবে নীরবতা সব সময় সমর্পণ নয়। শেক্সপিয়ারের নাটক কিংবা ভার্জিনিয়া উলফের লেখায় আমরা দেখি, নীরবতার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা। আজকের নারীরা অনলাইন সহিংসতার ভেতর থেকেও নিজেদের কণ্ঠ তৈরি করছে, একত্রিত হচ্ছে, যৌথ অভিজ্ঞতা ভাগ করছে। জুডিথ বাটলার যেমন বলেন, দেহ প্রকাশ্যে একত্র হলে তা নিজেই একধরনের প্রতিবাদ হয়ে ওঠে। অনলাইন স্পেস যেমন ভয় ছড়ায়, তেমনি নতুন প্রতিরোধের মঞ্চও তৈরি করে।
সৌন্দর্যের ধারণাও দীর্ঘদিন ধরে নারীকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সাধারণত সৌন্দর্যকে শাশ্বত আদর্শ ধরে নারী শরীরকে তার বাহক বানানো হয়।
অনলাইন সহিংসতাকে তাই নিছক প্রযুক্তিগত বিপদ হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়। এটি নারীকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিরন্তন কৌশলের সমকালীন রূপ। গণধর্ষণের হুমকি নারী শরীরকে নিয়ন্ত্রণের ভাষা, আর সেই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা নিজের আসন মজবুত করে। কিন্তু একই সঙ্গে এই সহিংসতার ভেতর দিয়েই নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশের নতুন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে, প্রতিরোধকে সাংস্কৃতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করছে।
চূড়ান্ত প্রশ্নটি তবু অপরিবর্তিত থাকে; আমরা কি নারীর দেহকে নিয়ন্ত্রণের পুরোনো ভাষাকে সামাজিক স্বাভাবিকতা হিসেবে মেনে নেব, নাকি তার ভেতর থেকে একটি নতুন নৈতিক ও রাজনৈতিক কণ্ঠ উদ্ভূত করব—যা নারীকে শুধু দেহ নয়, স্বাধীন, পূর্ণাঙ্গ ও দায়িত্বশীল মানব হিসেবে স্বীকৃতি দেবে?