বাংলার পাখিদের ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু

আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু, আমাদের বাংলার প্রাণের মানুষ আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। যিনি তাঁর সমস্ত জীবনটাকেই উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের কল্যাণে, বাংলাদেশকে রক্ষায়, বাঙালি জাতির মুক্তিতে। এই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বাংলার মাটি পর্যন্ত সবকিছুই ছিল যাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। আর প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর আর নান্দনিক অংশ পাখিদের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙ্গালির, যাঁর আপ্রাণ চেষ্টায় প্রণয়ন হয় বনের পাখিদের রক্ষার আইন। বাংলার আকাশে পাখিদের মুক্ত বিচরণ, মনের আনন্দে বনের সবুজকে কলকাকলিতে মাতিয়ে রাখা, তাদের হাজারো রংমাধুরীর বর্ণময়তা আজও বলে দেয় পাখিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। একজন রাষ্ট্রনায়কের এই পাখিদের প্রতি ভালোবাসা পৃথিবীর সবার কাছে অনুকরণীয়।

বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলা কাটে সবুজে ঘেরা পদ্মা অববাহিকার প্লাবনভূমির জেলা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, যা তৎকালীন সময়ে ফরিদপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মধুমতীর তীরে টুঙ্গিপাড়া ছিল, নদী, বাঁওড়, সবুজ বনলতা, বিল, প্লাবনভূমিতে পরিপূর্ণ। এককথায় সুন্দর এই পৃথিবীর মায়াময় প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ বাতাসে, পাখপাখালির কলকাকলিতে পরিপূর্ণ এক আবহে, যেখানে শৈশবে ছুটে বেড়িয়েছেন আমাদের প্রাণের নেতা।

টুঙ্গিপাড়ার জলজ পরিবেশ ঠাঁই দিয়েছে অজস্র জলজ পাখিকে। শীতে এখানে আসে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। বর্তমান সময়েও এখানে শীত মৌসুমে আসে, পিয়াং, মৌলভি, তিলি, সিঁথি, গিরীয়া, ভূতিসহ অসংখ্য বুনো হাঁসের প্রজাতি। আসে পরিযায়ী সৈকত পাখি। এ ছাড়া জলশয়গুলো, ডাহুক, জলপিপি, পানমুরগি, জলময়ূর, মাছরাঙা, কোড়া, কালেম, ডুবুরি, বগা-বগলা, বকসহ অসংখ্য পাখি। আর বিল, বাঁওড়কে কেন্দ্র করে উড়ে বেড়ায় জীবনানন্দের সেই সোনালি ডানার শঙ্খচিল, বিভিন্ন প্রজাতির ইগল, শিকরা, কাবাসি আর বাজপাখিরা। দেখা মেলে দেশি বালিহাঁস, সরালির বিশাল ঝাঁক।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এটাও জানা যায়, পূর্বে এই এলাকা আরও বেশি সমৃদ্ধ ছিল পাখি এবং বন্য প্রাণীর সম্ভারে। এ ছাড়া সবুজ বনগুলো, দোয়েল, কোয়েল, ময়না, শ্যামা, রাজন, ছাতিঘুরানী, দুধরাজে, বুলবুলি, সুইচোর, চুটকি, ফুটকি, মুনিয়া, টিয়া, হাঁড়িচাচার সমাহারে ছিল পরিপূর্ণ। প্রকৃতির এই মায়ায় ধীরে ধীরে বড় হন আমাদের বঙ্গবন্ধু। প্রকৃতিও আপন মনে লালন করে গড়ে তোলে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতৃত্বকে।

ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর পাখিদের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। অসুস্থ পাখিদের শুশ্রূষা করা, পাখির বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির বাচ্চাদের লালন পালন, সেবা করে বনে উন্মুক্ত করতেন আমাদের এই প্রিয় মানুষ। আর হয়তো এই পাখিদের স্বাধীনচেতা মনোভাব, পাখিদের লক্ষ্যে অবিচলতা, সুশৃঙ্খলা, নেতৃত্ব হয়তো এই মহান মানুষটিকে ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে বাঙালি জাতির মুক্তির নেতৃত্ব হতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু লাগাতেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, যা আশ্রয়স্থল হতো আমাদের বাংলার পাখিদের।

বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়েও কিন্তু পাওয়া যায় দুটি হলুদ পাখির গল্পের কথা। এ ছাড়া আরও রয়েছে চড়ুই আর কাকের কথাও। এত বিষয়ের মধ্যেও তিনি কিন্তু পাখিদের কথা সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করে গেছেন তাঁর লেখায়। বইয়ের ২২৭ পৃষ্ঠায় তিনি জেলখানায় হলদেপাখি আর চড়ুইয়ের কথা তুলে ধরেন। তিনি তার একাকী বন্দিজীবনে এই পাখিদের বন্ধু হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন, ‘আমার ঘরটার কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়। বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু, যারা কারাগারে একাকী বন্দী থাকেন নাই, তাঁরা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।’

বেনেবউ বা হলদে পাখি বাংলাদেশের নান্দনিক এক পাখি। তাদের সুরমাধুরীও প্রাণজুড়াবে যেকোনো মানুষের। জেলখানায় তিনি বাগান করতেন, নিজ হাতে পরম যত্নে পরিচর্যা করতেন। সেখানে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে দুটি হলদে পাখির, যাঁদের তিনি নিয়মিত খেয়াল রাখতেন। কিন্তু পরবর্তীবার যখন তিনি আবার জেলখানায় যান আর ওই পাখিদের দেখতে পান না, এবং ব্যথিত হন।

জেলখানায় থাকাকালে পায়রা ও মোরগের কথাও তিনি উল্লেখ করেন তাঁর বইয়ে। বঙ্গবন্ধু জেলখানায় মুরগি পালন করতেন। বাবুর্চি থেকে খাবার জোগাড় করে বঙ্গবন্ধু খাওয়াতেন এই মুরগি ও পায়রাদের। তিনি বাবুর্চির পালন করা পায়রা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জেলখানায়। মোরগটির স্বাধীনচেতা মনোভাব বঙ্গবন্ধুকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি পায়রার ছানাদের উড়তে শেখা উচ্ছ্বসিত করে বঙ্গবন্ধুকে প্রবলভাবে।

জেলখানার বাইরেও পায়রাদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীতে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ‘শান্তির দূত’ পায়রা পালন করতেন। প্রতিদিন ভোরে তিনি পরম মমতায়, পায়রাগুলোকে খাবার দিতেন। তার সঙ্গে এই পায়রাদের তৈরি হয় এক মিতালি। তাঁর সেই পায়রার বাসা স্মৃতিস্বরূপ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় রেখে দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতেন। তিনি গণভবনের পতিত জমিতে প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন। দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন গাছ লাগাতে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গাছ লাগিয়েছেন, উপকূলীয় বনায়নে গুরুত্ব দিয়েছেন আর এই বনায়নের ফলে এই স্থানগুলোতে আশ্রয় পেয়েছে হাজারো বুনো পাখি। পেয়েছে তাদের জীবনের নিরাপত্তা।

বঙ্গবন্ধু বনখেকোদের হাত থেকে বনকে রক্ষা করতে এবং পাখি তথা অন্যান্য জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে দেশের জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকাকে আইনের আওতায় আনেন এবং সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা শুরু করেন। এতে করে নিরাপদ হয় বনের পাখিদের তথা জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করেন।

বাংলার প্রতিটি প্রান্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুন্দরবন থেকে সিলেট। তিনি প্রতিটি এলাকায় গিয়ে স্বাদ নিয়েছেন প্রকৃতির। তাঁর দূরদৃষ্টি অনুভব করেছিল আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃতির গুরুত্ব। বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও প্রকৃতির উপাদান যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সুন্দরবন যে বাংলাদেশ কে প্রকৃতিক দুর্যোগ থেকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে, সামুদ্রিক ভাঙন থেকে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে রক্ষা করছে, তার গুরুত্ব তিনি জানতেন। সুন্দরবনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, এখানকার বন্য প্রাণীর, পাখির পরিবেশ যে মানুষের সৃষ্টি সম্ভব নয়, তা তিনি বুঝেছিলেন।

তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়—তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই।’ তাঁর দূরদৃষ্টিতে রক্ষা পায় সুন্দরবন এবং তার পাখপাখালি, বন্য প্রাণী, হাজারো উদ্ভিদসহ বিভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্য।
বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড়, নদ–নদী, জলাভূমি, বিল, পাখি তথা জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বিশাল এক প্রাকৃতিক সম্পদের অভয়ারণ্য এই জলাভূমি। প্রতিবছর শীতে অসংখ্য জলচর পাখিতে পরিপূর্ণ হয় এই জলাশয়। বঙ্গবন্ধু প্রথম এই জলাশয় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন এবং জলাভূমি উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করেন।

বঙ্গবন্ধুর যে কাজটি পাখি তথা বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তা হলো বাংলাদেশের পাখি, বন্য প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্যর সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৭৪ প্রবর্তন করেন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্য প্রাণীরা এবং প্রকৃতি পায় তাদের নিরাপত্তার সনদ।

বঙ্গবন্ধু যে শুধু বাংলার মানুষকে সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন তা কিন্তু নয়, তিনি ভালোবেসেছেন বাংলার প্রকৃতিকেও আর এই প্রকৃতির সুন্দরতম সৃষ্টি পাখিদেরও। দিয়ে গিয়েছেন পাখিদের নিরাপত্তার সনদ। বনের মুক্ত পাখির গানে, কলকাকলিতে স্বতঃস্ফূর্ত উড়ে বেড়ানো আর স্বাধীনতা চিরকাল এই মহান রাষ্ট্রনায়কের পাখিদের প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্তই প্রকাশ করবে।

ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক
আশিকুর রহমান সমী: সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যন্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের বন্য প্রাণী পরিবেশবিদ।