১৯৭৩ সাল। সবে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছি। আমার স্বপ্নের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে বসবাস করছেন। আমার স্কুল ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুল পেরিয়ে একটু সামনে এগোলেই শৈশবকাল থেকেই অতিপরিচিত ধানমন্ডি ২৮ নম্বর। জাতীয় কবিকে সামনাসামনি দেখার অদম্য বাসনায় কবির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।
তখন বেলা ১১টা হবে। জাতীয় কবিকে সামনাসামনি দেখতে পারব তো! চরম এক উত্তেজনা কাজ করছে মনে। আমি গান জানি বলে আমার সঙ্গে আমার এক নিকট আত্মীয় আমার সঙ্গী হয়েছে। কারণ, শুনেছি যাঁরা নজরুলসংগীত গাইতে জানেন তাঁদের সাক্ষাতের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই নজরুলসংগীত গাইছি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সংগীত প্রতিযোগিতায় নজরুলসংগীতে স্বর্ণপদক পাওয়ায় তখন নজরুলসংগীত ভুবনের প্রায় সবাই আমাকে চিনত এবং ভালোবাসত। কাজী নজরুল ইসলামকে কখনো দেখতে পারব, তা–ও আবার মুখোমুখি, এটা স্বপ্নেও ভাবিনি। অনেক সময় স্বপ্নও তো সত্যিই হয়। সেদিন তা-ই হলো।
ধানমন্ডিতে বাসার দরজার সামনে আসতেই আমাকে উপস্থিত অনেকেই চিনল। তারপর আমি আমার সঙ্গীসহ রুমে ঢোকার অনুমতি পেলাম। কবি তখন বসে ছিলেন। পাশেই মায়ের মতো ভালোবাসায় নির্বাক কবির সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজী বসে ছিলেন। সামনেই একটা হারমোনিয়াম রাখা ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো গান করে গেছে। উমা কাজী হারমোনিয়ামটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমার হাত–পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে এল। মনে হচ্ছিল এক মহাপুরুষ আমার সামনে বসে আছেন আর বলছিলেন—‘গান শুরু করো। আমার লেখা আর সুর করা গান করো’। কবির অভিব্যক্তিতে সে রকমই যেন মনে হচ্ছিল আমার।
আমি হারমোনিয়ামের রিডে সি মাইনর কড বাজাতেই আমার প্রিয় গানটি আমার মানসপটে ভেসে উঠল। আমি গান শুরু করলাম। আমি কি গানটা আগে থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম? না—একেবারেই নয়। কবির সামনে কেন যেন এই গানটাই গাওয়ার ইচ্ছে হলো। অথচ ‘দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিনি’—যেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে আমি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সংগীত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক লাভ করি, সেই গানটির কথা কিন্তু তখন মনে আসেনি। সেই অসাধারণ মেলোডিয়াস গান ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে। ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’ গানটি শুরু করার পরেই কবির মধ্যে একধরনের আনন্দ এবং চাঞ্চল্য লক্ষ করলাম। মাঝেমধ্যে অস্থিরতার ভাবও দেখতে পেলাম। আমার হারমোনিয়ামের ওপর মাঝেমধ্যে হাত রাখছিলেন। মন উজাড় করে সর্বোচ্চ দরদ দিয়ে গানটি গাইছি। কবির নির্বাক চঞ্চলতা দেখে হঠাৎ ভাবলাম কবি আমার গান পছন্দ করছেন তো? এভাবে এক স্বর্গীয় আনন্দ অনুভূতি নিয়ে গানটা শেষ করলাম। এটুকু বুঝতে পারলাম, গানটি উপস্থিত সবাই পছন্দ করেছে। আমি পরের গানটি শুরু করার জন্য ডায়েরির পাতা ওলটাতেই কবি নিজেই আমার ডায়েরির পাতা ওলটাতে থাকলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না এখন আমি কী করব। উমা কাজী তখন বললেন, কবি গানটি আপনাকে আবার গাইতে বলছেন। তিনি আরও বললেন, কবি যখন কোনো গান পছন্দ করেন, তখন তিনি এভাবেই তাঁর অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। তাঁর কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেল। সব টেনশন যেন একনিমেষে উধাও হয়ে গেল।
কবির বৈবাহিক জীবনের তত দিনে ১৬ বছর পার হয়ে গেছে। সেদিন নার্গিসের কাছ থেকে একটি চিঠি এল। বন্ধু শৈলজানন্দকে চিঠিটি পড়তে বললেন কবি। ১৬ বছর পর নার্গিসের চিঠি পেয়ে বন্ধু শৈলজানন্দ কবিকে চিঠির উত্তর দিতে বললেন। কবি কলম ধরলেন আর তাৎক্ষণিক এই বিখ্যাত গানটি রচনা এবং সুর করলেন।
তখনো আমি জানি না গানটির সৃষ্টির ইতিহাস। শুধু এটুকু বুঝতাম প্রেম ও বিরহের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ এই গান। দ্বিতীয়বার গানটি শেষ করার পর আবার কবির একই রকম ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেলাম। কবির হাত আমার হারমোনিয়ামের ওপর থাকা ডায়েরির পাতার ওপর। আবারও পাতা উল্টাচ্ছেন। কবির পুত্রবধূর ইশারায় আবার গাইলাম। উপস্থিত সবাই খুব আনন্দচিত্তে বিষয়টি উপভোগ করলেন। ১৭ বছরের এক তরুণ শিল্পীর কাছে এর চেয়ে বেশি আনন্দের, গৌরবের আর কী হতে পারে। পরিণত বয়সে যখন গানটির সৃষ্টির পটভূমি জানলাম তখন আমি অনুধাবন করেছি কেন কবি সেদিন তিনবার গানটি শুনেছিলেন। কবি সেদিন নির্বাক হলেও অনুভূতি হয়তো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো কবি কিছু কিছু গান কিছু কিছু ঘটনা মনে করতে পারতেন। না হলে কেন তিনি তিনবার গানটি শুনবেন। হয়তো সেই মুহূর্তে কবির মনে পড়ে গিয়েছিল কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির মহড়াকক্ষের কথা। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মহড়াকক্ষে আছেন কবির নিকট বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। শৈশব, কৈশোর এবং তরুণ বয়সে শৈলজানন্দ ছিলেন কবির অকৃত্রিম বন্ধু, সহপাঠী এবং সহচর। দুজনের মধ্যেই একের অপরের প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ।
কবির বৈবাহিক জীবনের তত দিনে ১৬ বছর পার হয়ে গেছে। সেদিন নার্গিসের কাছ থেকে একটি চিঠি এল। বন্ধু শৈলজানন্দকে চিঠিটি পড়তে বললেন কবি। ১৬ বছর পর নার্গিসের চিঠি পেয়ে বন্ধু শৈলজানন্দ কবিকে চিঠির উত্তর দিতে বললেন। কবি কলম ধরলেন আর তাৎক্ষণিক এই বিখ্যাত গানটি রচনা এবং সুর করলেন। গানটি কিছুদিন পরেই জনপ্রিয় শিল্পী সন্তোষ সেন গুপ্তের কণ্ঠে এইচএমভি থেকে রেকর্ড করিয়েছিলেন।
বহুমাত্রিক, বিস্ময়কর ও অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী সংগীতস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফোন রেকর্ডের গান নিয়ে ৪ হাজারের মতো গান সৃষ্টি করেছেন। নজরুলের গানগুলো তাঁর পুরো হৃদয়ের গভীরতম শিল্পসুষমায় ফুটে উঠেছে। সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টিক্ষমতা পৃথিবীর যেকোনো সংগীতস্রষ্টার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। নজরুল একমাত্র সংগীতস্রষ্টা যিনি বিভিন্ন বিদেশি শব্দ এবং সুর সমন্বয় করে আমাদের বাংলা গানকে করেছেন সমৃদ্ধ।
সংগীতের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কোনো বিশেষণই কাজী নজরুল ইসলামের জন্য যথেষ্ট নয়। কাজী নজরুল ইসলাম শুধু সাম্যবাদী গণসংগীতের স্রষ্টাই নন। তিনি বাংলা গজল গানের প্রবর্তক। এই দুই ধারার সংগীতে সুরের যে বৈচিত্র্য, তা বিস্ময়কর। বিশেষ করে ১৯২৬-১৯২৭ সালে যে ‘গজল’ গানগুলো সৃষ্টি করেন, তা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত আধুনিক এবং বর্তমান সুরস্রষ্টাদের কাছে অনুকরণীয়। বর্তমান সময়ের সুরস্রষ্টারা তাঁর গজলকে অনুসরণ করে নতুন নতুন গান সৃষ্টি করে চলেছেন। নজরুল তাঁর গজলের সুরে প্রচলিত অনুশাসন থেকে বের হয়ে গজলের মধ্যে শায়েরের অনুপ্রবেশ ঘটান। ‘শায়ের’ হলো গানের মধ্যে হঠাৎ কয়েকটি পঙ্ক্তির আবৃত্তি এবং আবৃত্তির পর পুনরায় গানের মূল তাল ও লয়ে ফিরে আসা। আমরা যতই তাঁর সৃষ্টির গভীরে প্রবেশ করি, ততই অবাক হই।
নজরুল ইসলাম তাঁর সংগীতে যত রাগ ব্যবহার করেছেন বাংলা গানে আর কোনো সংগীতস্রষ্টা তা করেননি। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন এবং সুচারুভাবে তার প্রয়োগ করেছেন। একই গানে একাধিক রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অসাধারণ সুর সৃষ্টি করেছেন। কথার সঙ্গে কোন রাগের সংমিশ্রণ ঘটালে সুরের মায়াজাল সৃষ্টি হবে, সম্ভবত তার চেয়ে ভালো কেউ বুঝতেন না। প্রচলিত রাগরাগিণীর সীমানা পেরিয়ে তিনি নিজেই অনেক রাগরাগিণী এবং তাল সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বৈচিত্র্যময় গানের ভান্ডারে রয়েছে আধুনিক, দেশাত্মবোধক, সংগ্রামী ও উদ্দীপনামূলক, ইসলামি গান, শ্যামা, ভজন, কীর্তন, পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, হাসির গানসহ বিভিন্ন শ্রেণির গান।
তিনি চলচ্চিত্রের গানের সুর করেছেন, নিজে কণ্ঠ দিয়েছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন এবং নিজে অভিনয় করেছেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নজরুল একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর গাওয়া ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
আজ কবির মৃত্যুদিনে এই মহাপুরুষকে আমার পরম শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক, শিক্ষক।