আমার তথ্য ফাঁস করিয়া তাহাদের কী লাভ!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিকের নাম, ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পেশা ইত্যাদি তথ্য নাকি সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। তথ্য বলতে মানুষের নাম, ঠিকানা, জন্মনিবন্ধন, মুঠোফোন ও পাসপোর্ট নম্বর, আঙুলের ছাপসহ এমন যেকোনো তথ্যকে বোঝায়, যা দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়।

আমিও যেহেতু বঙ্গভূমির সন্তান, তাই ধরেই নিতে পারি, আমার তথ্যও ফাঁস হয়েছে। আর তথ্য ফাঁসের খবর শোনার পর থেকেই আমার কেমন যেন লাগছে। মাঝেমধ্যে খুব চালাক চালাক লাগছে। আবার মাঝেমধ্যে খুব বোকা বোকা লাগছে। কেন এমন চালাক-বোকা, চালাক-বোকা লাগছে, বুঝতে পারছি না।

আমার তথ্য ফাঁস হয়েছে। খবরটি শুনে প্রথমেই মনে হয়েছে, কী আশ্চর্য আমার আবার তথ্য কী? আমার নাম, পরিচয়, লিঙ্গ, পেশা ইত্যাদি জেনে ফাঁসকারীর কী লাভ হবে? জি জনাব, আজ আপনাদের বলবে আমার বা আমাদের তথ্য ফাঁস করে বা চুরি করে হ্যাকার সম্প্রদায় কীভাবে লাভবান হতে পারে, সেই গপ্প।

ব্যক্তিগত তথ্যের প্রথমেই রয়েছে আমার নাম। তাই নামের ওপরই প্রথম ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওরা আমার নামটিই প্রথমে চুরি করবে। যেমন হ্যাকার সাহেব তার ছেলে বা নাতির নাম রাখবে নূর সিদ্দিকী। এমন সুন্দর নাম ওরা আর কোথায় পাবে?

আচ্ছা নাম নাহয় কাজে লাগালে, আমার ঠায়–ঠিকানা দিয়ে কী করবে? ঠিকানা! হুম, কাজে লাগতে পারে। ধরা যাক হ্যাকার সাহেবরা মিলে নতুন একটা গ্রাম গড়ে তুললেন। গ্রামের নাম রাখবেন আমার গ্রামের নামে। পোস্ট অফিস চালু করলে আমার পোস্ট অফিসের নামে; থানা করলে আমার থানার নামে। জেলার নামও হবে আমার জেলার নামে।

আমার পাসপোর্ট দিয়ে হ্যাকার জাতি কীভাবে তাদের দেশটাকে বদলে দিতে পারে, তা–ই জানাচ্ছি এখন। প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, আমার পাসপোর্টের পোস্টমর্টেম করতে হবে। ওদের ভোঁতা বুদ্ধির পোস্টমর্টেমে যদি বিশেষ কিছু না পায়, তবে পাসপোর্ট নম্বরটির ওরা ফরেনসিক রিপোর্ট বের করতে পারে। তাহলেই ওরা জানতে পারবে, এই পাসপোর্ট পেতে আমার কত দিন লেগেছে, আর কত দিন লাগার কথা ছিল। এই পাসপোর্ট পেতে আমি কাকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছি।

এটা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আমার নামে শিশু বড় হবে, আমার গ্রাম, পোস্ট অফিস আর জেলার নাম হবে সেখানে। তার মানে একটুকরো বাংলাদেশই তো চলে গেল অন্য কোথাও। তাহলে বাংলাদেশের পরিধি কি বাড়বে না? খুব ভালো লাগছে আমার।

এখন বাকি থাকলে জন্মনিবন্ধন নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর আর আঙুলের ছাপের কথা। জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারবে ওরা। ধরা যাক, আমার জন্মনিবন্ধন নম্বরের প্রথম তিন সংখ্যা ২১২। এই সংখ্যাকে ওরা ওদের জাতীয় নম্বর ঘোষণা করতে পারে। বিশ্বের সব দেশেরই জাতীয় পশু আছে, জাতীয় পাখি আছে, জাতীয় ফল আছে, জাতীয় ফুল আছে। তাহলে একটা জাতীয় নম্বর বা সংখ্যা থাকলে দোষ কী? হ্যাকার সাহেবরা হয়তো জাতীয় নম্বরই খুঁজছিলেন। কোথাও না পেয়ে আমার গোপন তথ্যই চুরি করেছেই।

আমার পাসপোর্ট নম্বর দিয়েও অনেক কিছু করা সম্ভব। আমার পাসপোর্টের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনা। যদিও সেই সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়ার মতো ঘিলু ওদের মাথায় আছে কি না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে।

যাকগে, আমার পাসপোর্ট দিয়ে হ্যাকার জাতি কীভাবে তাদের দেশটাকে বদলে দিতে পারে, তা–ই জানাচ্ছি এখন। প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, আমার পাসপোর্টের পোস্টমর্টেম করতে হবে। ওদের ভোঁতা বুদ্ধির পোস্টমর্টেমে যদি বিশেষ কিছু না পায়, তবে পাসপোর্ট নম্বরটির ওরা ফরেনসিক রিপোর্ট বের করতে পারে। তাহলেই ওরা জানতে পারবে, এই পাসপোর্ট পেতে আমার কত দিন লেগেছে, আর কত দিন লাগার কথা ছিল। এই পাসপোর্ট পেতে আমি কাকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছি। এই দুইটা তথ্য পেলেই তো কম্মকাবাড়। একটা দেশের পাসপোর্ট–ব্যবস্থার উন্নয়নে আর কী লাগে? হ্যাকাররাও তাঁদের দেশে আমাদের পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু করতে পারেন। বাংলাদেশকে শুধু মুখে মুখে রোল মডেল মানলে তো হবে না, বাংলাদেশের ব্যবস্থাও চালু করতে হবে। পাসপোর্টই হতে পারে যার প্রথম ধাপ।

আরেকটা বস্তু হ্যাকাররা আমার তথ্য চুরি করে খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। সেটি হচ্ছে, আমার আঙুলের ছাপ। বলা হয়, পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গেই অন্য কোনো মানুষের আঙুলের ছাপের মিল পাওয়া যাবে না বা পাওয়া যায়নি এখনো। তাহলে আমার আঙুলের ছাপ হতে পারে তাঁদের জন্য মহামূল্যবান বস্তু।

আমার আঙুলের ছাপ যদি বিশ্লেষণ করতে পারে, তাহলে জাতি হিসেবেও হ্যাকাররা অনেকটা এগিয়ে যাবে। আঙুলের ছাপের মধ্যে পাওয়া যাবে আমার চারিত্রিক বিষয়াদি। আমি কেমন? আমার চরিত্র কেমন? খুলেই বলি। হ্যাকার যদি হয় ইউরোপ বা আমেরিকার বা অস্ট্রেলিয়ার, তাহলে সোজাসাপটা বলে দেয়া যায়, এই হ্যাকিং ছাড়া ওদের আর তেমন কোনো বদ গুণ নেই। কিন্তু আমার আঙুলের ছাপে লুকিয়ে আছে আমার যত দুষ্টপনার নীলনকশা।

এই যে আমি কথায় কথায় মিথ্যা বলি, অফিসে মিথ্যা বলে ছুটি কাটাই, বউয়ের কাছে মিথ্যা বলে বান্ধবীর কাছে যাই, বন্ধুর কাছে মিথ্যা বলে টাকা ধার নিয়ে ফতুর হওয়ার ভান করে আর তা ফেরত দিই না। এই সব গুণ আমার আঙুলের ছাপই বলে দেবে। এখান থেকেই হ্যাকাররা শিখতে পারবে এই সবকিছু।

আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছি। চাকরি নিয়ে ঘুষ খাচ্ছি। শুধু ঘুষই যে একটা জাতিকে কতটা উচ্চতায় নিতে পারে, তা–ও হ্যাকাররা রপ্ত করতে পারবে আমার আঙুলের ছাপ থেকে।

আমি রাস্তায় থুতু ফেলি। খোলা জায়গায়ই প্রস্রাব করি। গোটা দেশটাকেই আমার কাছে ডাস্টবিন মনে হয়। আমি মোটরযান চালালে অকারণ হর্ন বাজাই। রাস্তায় প্রতিযোগিতা করি। পথচারীদের পিষ্ট করে মারি। এসব গুণ কি হ্যাকাররা আমার আঙুলের ছাপ থেকে শিখতে পারবে না?

আরও আছে। আমি শিক্ষক, ক্লাসে পড়াই না। বাসায় প্রাইভেট পড়াই। আমি কেজির দরে তরমুজ বিক্রি করি। আমি ঈদ-পূজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়াই। আমি অপ্রয়োজনে সব মজুত করি। আমি মানুষ ও পশুর সঙ্গে অসভ্য আচরণ করি। আমি নিজে যা করি না, অপরকে সেই কাজের উপদেশ দিই। আমি কথায় কথায় ফেসবুকে বিপ্লবী স্ট্যাটাস দিয়ে লাইক গুনতে থাকি।

আমি ঋণখেলাপ করি। আমি টিজ করি, আমি বুলি করি। অফিসের কাজে আমি চরম ফাঁকিবাজ, বাইরে খ্যাপের ধান্ধায় ওত পেতে থাকি। আমি নিজের পেশার বাইরে সব পেশায় জ্ঞান জাহির করি। আমি অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে দখলে রাখি। আমি খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট করি। আমি নির্বিচার বৃক্ষ নিধন করি। পরিবেশ নষ্ট করি। দখল আর দূষণে হত্যা করি নদী।

আমি অন্যের বিপদে বগল বাজাই। নিজের কষ্টকেই মনে করি সবচেয়ে বড়। নিজের সুখকে তুচ্ছ ভাবি।

আরও যত শত বদ গুণ আছে, সবই জানা যাবে আমার আঙুলের ছাপে। যদি সত্যিই আঙুলের ছাপ থেকে সব জানা যায়, তাহলে হ্যাকারদের কপাল খুলবে না বলুন?

এক আমার তথ্য চুরি করেই যদি হ্যাকারের পোয়াবারো হয়, তবে কোটি কোটি মানুষের তথ্যে হ্যাকারদের কতটা লাভ হবে, একবার ভেবেছেন?

ইশ! আমি বা আমরা যদি কোনো আমেরিকান, ইউরোপিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ানের তথ্য চুরি করতে পারতাম! না না! আমি কেন তথ্য চুরি করতে যাব? ওপরের কোনো কথার সঙ্গেই আমার এবং আমাদের জাতির কারও ব্যক্তিগত চরিত্রের মিল নেই। আমরা আর যা–ই হোক, চোরের খাতায় নাম লেখাতে চাই না।