বদরুদ্দীন উমরের লেখা
ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবকে নিয়ে
বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী জনবুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি প্রয়াত হলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতি ছিল তাঁর ভাবনার মূল বিষয়। বদরুদ্দীন উমরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০২৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখা তাঁর এই অপ্রকাশিত রচনা প্রকাশ করা হলো।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এবং অন্য সময়েও শেখ হাসিনা প্রায়ই বলে থাকেন যে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘একুশে পদক ২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারও নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কী অবদান ছিল? উনি তো জেলেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে ওনার কোনো অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি। আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই উদ্যোগে ভাষাসংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।’ পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধজন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি।’
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান মুছে ফেলার ‘অপচেষ্টা’ যে আমি করেছি, এটা শেখ হাসিনা কখনো আমার নাম উল্লেখ করে এবং কখনোবা নাম উল্লেখ না করে (যেমন ওপরের উদ্ধৃতি) সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে বলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে আমি আমার লেখায় কোনো ক্ষেত্রেই কোনো দল বা ব্যক্তিকে বড় বা ছোট করার চেষ্টা কখনো করিনি।
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান মুছে ফেলার ‘অপচেষ্টা’ যে আমি করেছি, এটা শেখ হাসিনা কখনো আমার নাম উল্লেখ করে এবং কখনোবা নাম উল্লেখ না করে (যেমন ওপরের উদ্ধৃতি) সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে বলে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে আমি আমার লেখায় কোনো ক্ষেত্রেই কোনো দল বা ব্যক্তিকে বড় বা ছোট করার চেষ্টা কখনো করিনি। আমি সব সময় তথ্যের ভিত্তিতেই লিখেছি, তথ্যের বাইরে কোনো আন্দাজি কথাবার্তা বলার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। এ দেশের এবং দেশের বাইরে আমার পাঠকেরা এটা ভালো করেই জানেন। নিজের কাছে সৎ থাকাকে আমি গুরুত্ব দিই। কারণ, সেটাই হলো একজনের সৎ চিন্তা ও আচরণের অপরিহার্য শর্ত। এই আত্মমর্যাদাবোধের অভাবই বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, লেখক–সাহিত্যিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন।’ এ কথা ঠিক নয়। শেখ মুজিব একবারই, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের সময় জেলে গিয়েছিলেন। শুধু তিনি নন। সে সময় মোহাম্মদ তোয়াহা, রণেশ দাশগুপ্তসহ অনেকেই জেলে গিয়েছিলেন। চার–পাঁচ দিন পরই তাঁদের সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের জন্য জেলে ছিলেন না।
শেখ মুজিব শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, এ দেশে অনেক আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় তাঁর জেল হয়েছিল। জেল থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এরপরও তিনি নানা আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে বারবার জেলে গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই উদ্যোগে ভাষাসংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৮ সালে।’ এই বক্তব্য ঠিক নয়। পরবর্তী জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান একজন বড় মাপের রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৪৮ সালে ঢাকার রাজনীতিতে তাঁর এমন কোনো অবদান ছিল না, যাতে তিনি ভাষা আন্দোলন বা অন্য কোনো আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন।
এটা সবাই জানেন এবং এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত যে ১৯৪৮ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবদুল মতিন। এ জন্য তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। আবদুল মতিনের সঙ্গে সেই কমিটি গঠনের ব্যাপারে অন্যরাও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে শেখ মুজিবের কোনো উদ্যোগ, এমনকি উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততা ছিল না। অন্য অনেকের মতো তিনি ১১ মার্চ মিছিলে রাস্তায় ছিলেন এবং জেলে গিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে যখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়, তখন শেখ মুজিব জেলে ছিলেন।
এটা সবাই জানেন এবং এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত যে ১৯৪৮ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবদুল মতিন। এ জন্য তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। আবদুল মতিনের সঙ্গে সেই কমিটি গঠনের ব্যাপারে অন্যরাও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে শেখ মুজিবের কোনো উদ্যোগ, এমনকি উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততা ছিল না।
শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের উল্লেখ আছে। শেখ মুজিবকে শাস্তিযোগ্য লোক প্রমাণ করার জন্যও এভাবে লেখা হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া গোয়েন্দা পুলিশরা অনেক মিথ্যা রিপোর্ট নিজেরাও তৈরি করে থাকে। মোনায়েম খানের আমলে একবার কুমিল্লার ধীরেন দত্ত, অজিত গুহ এবং আমাকে জড়িয়ে এক গোয়েন্দা রিপোর্ট দিয়েছিল। এটা নিয়ে মোনায়েম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শামসুল হক সাহেবের ওপর আমাকে বরখাস্ত করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। এরপরই ওই গোয়েন্দা রিপোর্ট মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ গোয়েন্দাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় মণি সিংহের বিরুদ্ধেও এক মিথ্যা গোয়েন্দা রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল এবং সেটাও ধরা পড়েছিল।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখা যায়, তা হলো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদদের সংগৃহীত তথ্যের পরিবর্তে গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টই কি অধিকতর নির্ভরযোগ্য? ইতিহাসবিদদের পরিবর্তে পুলিশের গোয়েন্দারাই কি প্রকৃত অর্থে সত্যের ধারক–বাহক?
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, এটা শেখ হাসিনার নিজস্ব বক্তব্য। বাস্তবত দেখা যাবে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের নায়কোচিত ভূমিকার কথা বলে এ দেশে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। অজস্রই বলা যেতে পারে। এ ধরনের একটি লেখার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। কারণ, এটি প্রকাশিত হয়েছে কয়েক দিন আগে, ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায়। আওয়ামী ঘরানার এক সাহিত্যিক ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভাষা আন্দোলনের মহানায়ক হিসেবে উপস্থিত করে অনেক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু জনগণের ভূমিকার কোনো উল্লেখমাত্র এই লেখায় নেই। বলা হয়েছে, ভাষা আন্দোলন ছিল শেখ মুজিবের আন্দোলন। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।’ বাস্তবত শেখ মুজিবের ভূমিকা কোথায় কীভাবে ছিল, এর কোনো উল্লেখ না করে তিনি বলেছেন ভাষা আন্দোলন যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে, তাতে তাঁর ‘নেপথ্য ভূমিকার অবদান’–এর কথা। এই রচনায় ইতিহাসকে যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। এভাবে ইতিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখাতে তিনি বলছেন, ‘তিনি না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন কত শতাব্দী পিছিয়ে যেত, তা পরিমাপ করা যায় না।’ দেখা যাচ্ছে পূর্ব বাংলায় জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের শোষণ–নির্যাতন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জনগণের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক সশস্ত্র আক্রমণ, তার বিরুদ্ধে জনগণের বিশাল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলন, তাঁদের আত্মত্যাগ—এসবের কোনোই গুরুত্ব নেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে! শেখ মুজিব না থাকলে জনগণের সেই প্রতিরোধ ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী’ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারত না! এ ধরনের লেখালেখি ও ভুল ইতিহাসচর্চাই এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী, লেখক, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক করছেন। এর ফলে বিভিন্ন পদ অধিকার করে এবং নানা প্রকার সুযোগ–সুবিধা লাভ করে তাঁরা ভালোই আছেন।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি লেখার সময় ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। (সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ আছে আমার আত্মজীবনী আমার জীবন–এর তৃতীয় খণ্ডে)। একদিন তাঁকে ফোন করে বললাম, আমি ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে একটা বই লিখছি, তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তিনি বললেন, ‘আগামীকাল সকাল সাতটায় চলে এসো।’ আমি যথাসময়ে গেলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তাঁর বাড়িতে। সেই একবারই আমি ওই বাড়িতে গেছি। গিয়ে দেখলাম সেই সাতসকালেই সেখানে লোকের ভিড়। আমি খবর দেওয়ায় তিনি বেরিয়ে এসে আমাকে তাঁর সঙ্গে ভেতর দিকের একটা কামরায় নিয়ে গেলেন। কাজের লোকদের বললেন, কেউ যেন ঘরের মধ্যে না আসে। এরপর তিনি নিজেই দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আমি তাঁর সঙ্গে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট আন্দোলন, ১৯৪৯ সালের খাদ্য আন্দোলন, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তীকালের রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। তিনি তো আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। আগ্রহের সঙ্গে আমাকে অনেক সময় দিয়েছিলেন। কথাবার্তার মধ্যে আমাকে রসগোল্লাও খাইয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিষয় আলোচনার সময় তিনি বললেন, সেই আন্দোলনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। আমি বললাম, সেটা কী করে হয়। আপনি তো তার আগে কলকাতায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছিলেন। ঢাকার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক তো থাকেনি। সে সময় ঢাকায় নবাগত ছিলেন। তিনি বললেন ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ও জেলে যাওয়ার কথা। আমি বললাম, সে সময় তো শত শত ছাত্র এবং সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী রাস্তার আন্দোলনে ছিলেন। তাঁদের অনেকেরই জেল হয়েছিল। তাঁদের সবার একটা ভূমিকা থাকলেও অল্পসংখ্যকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এ ছাড়া আমি তাঁকে বললাম, আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যও ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের ঠিক পরপরই জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে এবং ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অনেকে সেই দুই সাক্ষাতের সময় ছিলেন, কিন্তু আপনি তো তাঁদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি তাজউদ্দীন ও নজরুল ইসলামকে আমার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলাম।’ কায়েদে আজমের সঙ্গে নিজে দেখা করতে না গিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন, এ কথায় আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। তাঁকে বললাম, সেটা কী করে হয়? এখন আপনি তাঁদের আপনার প্রতিনিধি হিসেবে কোথাও পাঠাতে পারেন। কিন্তু তখন ঢাকার রাজনীতিতে তো তাজউদ্দীন ও নজরুল ইসলামের গুরুত্ব আপনার থেকে বেশি ছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তো ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি)। সেই হিসেবে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। তাজউদ্দীন ছিলেন একটি গ্রুপের সদস্য এবং তখনকার ঢাকার রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি এরপর আর কিছু বললেন না, চুপ করে থাকলেন। আমার এসব কথার পর তিনি যে আমার ওপর রাগ করেছিলেন বা বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন মনে হলো না।
ভাষা আন্দোলন বিষয়ে আমার লেখার বিরুদ্ধে লেখালেখি ও বিষোদ্গার শুরু হয়েছিল অনেক আগে। এর সূচনা করেছিলেন অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী, পরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। দৈনিক ইত্তেফাক–এ ১৯৭৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যা ও পরবর্তী রবিবাসরীয় একাধিক সংখ্যায় একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম ‘ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ রচনা প্রকাশ করেন। এ রচনাটিতে তাঁর বক্তব্য ছিল, আমি ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে অস্বীকার করে কৌশলের সঙ্গে তাঁকে খাটো করার চেষ্টা করেছি। বস্তুতপক্ষে তাঁর রচনায় সঙ্গে তথ্য ও সত্যের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেটা ছিল তোষামোদের উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে এক বড় মিথ্যাচার। সে সময় তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।
মুস্তাফা সাহেব ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে পরোক্ষভাবে এসব কথা বলতে থাকার সময় শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘কী বলছিস সোজা করেই বল না। এত ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে কথা বলার কী দরকার?’ শেখ মুজিবের এ কথার পর মুস্তাফা সাহেব আমার বিরুদ্ধে মযহারুল ইসলামের লেখালেখির কথা, বিশেষ করে তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামক বইটির কথা উল্লেখ করেন। এ কথা শুনে শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘তুই কি মনে করিস, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না।’
আমি মযহারুল ইসলামের সেই রচনার একটি দীর্ঘ জবাব দিয়ে ইত্তেফাক পত্রিকায় পাঠালাম। দুই কিস্তিতে সেটা ছাপা হয়েছিল। এখানে বলা দরকার যে ইত্তেফাক–এ ড. মযহারুল ইসলাম আমার বিরুদ্ধে যা লিখেছিলেন, সেসব কথা ছিল তাঁর দ্বারা লিখিত ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামে একটি বৃহদাকার বইয়ে। বইটি ছিল মিথ্যায় পরিপূর্ণ। মযহারুল ইসলাম তাঁর লেখাটিতে এমন এক কাজ করেছিলেন, যা ছিল বিস্ময়কর। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারী একজন লোক যে কতখানি মূর্খ, অসৎ ও ধান্দাবাজ হতে পারেন, তাঁর দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছিলেন। তিনি নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করেছিলেন ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ভূমিকার কথা। লিয়াকত আলীর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। এ নিয়ে তখন চারদিকে মহা হইচই হয়েছিল।
মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ার পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়েছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা বাংলা বিভাগে সহকর্মী থাকার সময় তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম একদিন শেখ মুজিবের সঙ্গে একাডেমির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তখন রাত প্রায় ১২টা। অন্যান্য বিষয় আলোচনার পর তিনি শেখ মুজিবকে বলেন, তাঁকে নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এসবের দ্বারা তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী শুধু নন, জাতির পিতা। কাজেই তাঁর ভাবমূর্তি এভাবে নষ্ট হওয়া ঠিক নয়। মুস্তাফা সাহেব ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে পরোক্ষভাবে এসব কথা বলতে থাকার সময় শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘কী বলছিস সোজা করেই বল না। এত ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে কথা বলার কী দরকার?’ শেখ মুজিবের এ কথার পর মুস্তাফা সাহেব আমার বিরুদ্ধে মযহারুল ইসলামের লেখালেখির কথা, বিশেষ করে তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামক বইটির কথা উল্লেখ করেন। এ কথা শুনে শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘তুই কি মনে করিস, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না।’ এই বলে তিনি বইয়ের একটি শেলফ দেখিয়ে বলেন, ‘ওটার ওপর যে ফাইলটা আছে, সেটা নিয়ে আয়।’ ফাইল নিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘দেখ, ওতে কী আছে।’ দেখা গেল, সেই ফাইলে আমার ও ড. মযহারুল ইসলামের ইত্তেফাক–এ প্রকাশিত বিতর্কমূলক রচনাগুলো একসঙ্গে সাজিয়ে রাখা আছে। খুব সম্ভবত প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফাইলটি তৈরি করে তাঁর কাছে দেওয়া হয়েছিল।
ফাইলে লেখাগুলো দেখে মুস্তাফা সাহেব বলেন, ‘আপনি তো এগুলো দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘উমর যা লিখেছে, তার তথ্যগুলি ঠিক, সে বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই। তবে তার মূল্যায়নের সাথে আমি একমত নই।’ মুস্তাফা সাহেব বললেন, ‘ডক্টর মযহারুল ইসলামের বই যদি ভুল তথ্যে এভাবে ভরা থাকে, তাহলে সেটা তো আপনার ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। আপনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা। কিন্তু আপনি যদি বলেন, তাহলে বইটির যে হাজার হাজার কপি গুদামে আছে, সেগুলো আমি স্কুল–কলেজে ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে দিতে পারি। তবে সেটা তো ভালো হবে না। কিন্তু যদি এভাবে বিক্রি করা না হয়, তাহলে আবার বাংলা একাডেমির বিরাট ক্ষতি।’
মুস্তাফা সাহেব এ কথা বলার পর শেখ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘যা, বইগুলো ফেলে দেগা। কোনো অসুবিধা হবে না। ওপরে আল্লাহ, নিচে শেখ মুজিব।’ এর পরদিন সকালের দিকে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ড. মযহারুল ইসলামের নধরকান্তি বইটির হাজার হাজার কপি গুদাম থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত আমার আত্মজীবনী আমার জীবন–এর (প্রকাশক বাঙ্গালা গবেষণা) চতুর্থ খণ্ডে। হাজার হোক, নিজের একটা বৃহদাকার জীবনীগ্রন্থ এভাবে ফেলে দেওয়ার মধ্যে যে শেখ মুজিবের সততার একটা পরিচয় ছিল, এতে সন্দেহ নেই।
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা মুছে ফেলা তো দূরের কথা, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে আমি বাঙলাদেশের অভ্যুদয় নামক আমার দুই খণ্ডে প্রকাশিত (প্রকাশক বাতিঘর) বইয়ে অনেক লিখেছি। এক শ ভাগ তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত বিবরণে তাঁর ভূমিকা যা–ই হোক না কেন, তা মুছে ফেলার কোনো চেষ্টা আমি করিনি।
ইতিহাসে যেকোনো ব্যক্তির ভূমিকা আলোচনার জন্য ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ, কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে কে কী মনে করে, তার দ্বারা কোনো ব্যক্তির সঠিক ভূমিকা নির্ণয় করা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক এবং প্রকৃত ইতিহাসচর্চার পথে মস্ত অন্তরায়। এ কথা সত্য যে একজন বড় মাপের ঐতিহাসিক ব্যক্তি তাঁর নিজের বিশেষ ক্ষেত্রে সমাজকে, সমাজের চিন্তাভাবনা, সাহিত্যকর্ম, বিজ্ঞানচর্চা, রাজনীতি ইত্যাদিকে অল্পবিস্তর প্রভাবিত করে থাকেন। কিন্তু তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তাঁদের প্রত্যেকেই নিজের সময়ের সমাজকাঠামোর অধীন। প্রত্যেক মানুষের—তিনি যতই সামান্য বা বিরাট হোন—চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপ তাঁর পরিপার্শ্ব এবং তাঁর সময়কার সমাজ সম্পর্ক ও বিদ্যমান পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আঠারো শতকের সমাজে সম্ভব ছিলেন না। ডারউইন ও মার্ক্সও সম্ভব ছিলেন না আঠারো শতকে। উনিশ শতকে সম্ভব ছিল না গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরুর মতো রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী সম্ভব ছিলেন না উনিশ শতকে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের মতো চিত্রপরিচালক সম্ভব ছিলেন না বিশ শতকের প্রথম দিকেও। শুধু তা–ই নয়, এসব বিরাট পুরুষ ছাড়াও সাধারণ রাম–রহিমের জীবনও এভাবে তাঁদের বিদ্যমান সমাজ দ্বারাই গঠিত। যেকোনো মানুষের—তিনি ছোট, বড়, মাঝারি যে মাপেরই হোন না কেন—জীবন, চিন্তাভাবনা ও কর্ম তাঁর সময় ও সমাজ দ্বারা নির্ধারিত। কাজেই কে কার সম্পর্কে কী মনে করছে বা মনে করতে চায়, তার দ্বারা কোনো ব্যক্তির ঐতিহাসিক ভূমিকা নির্ধারণ প্রচেষ্টা বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে মার্ক্স, প্লেখানভ ও লেনিনের তাত্ত্বিক রচনা আছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কারও কারও মতো আমিও ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা বিষয়ে লিখেছি।
ইতিহাসে দেখা যায়, যাঁরা নিজের বিশেষ ক্ষেত্রে বড় মাপের মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, ভূমিকা পালন করেছেন, সেটা রাতারাতি হয়নি। ছোট থেকে বড় হওয়ার জন্য তাঁদের চেষ্টা করতে হয়েছে। বড় হয়ে তিনি যেসব কাজ করেছেন, ছোট থাকা অবস্থায় সেসব কাজ তাঁর দ্বারা সম্ভব ছিল না।
সমাজ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই প্রতিটি সমাজ অগ্রসর হয়। এভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রই বিকশিত হয়। এ জন্য সময়ের একপর্যায়ে যা হয় বা পাওয়া যায়, অন্য পর্যায়ে তা হয় না, তা পাওয়া যায় না। আবার একই সময়ে বা একই পর্যায়ের প্রয়োজনের তাগিদে দেখা যায় একই ধরনের মানুষ, তাঁদের একই ধরনের কাজ। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, একাধিক ব্যক্তির একই রকম কাজ। একই বিন্দুতে তাঁদের অবস্থান। নিউটন এবং জার্মান দার্শনিক ও গণিতবিদ লাইবনিৎস একই সময়ে স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন ডিফারেনশিয়াল অ্যান্ড ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস; একই সময় আবির্ভাব হয়েছিল মার্ক্স ও এঙ্গেলস এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্ত; আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা খুব কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন আণবিক বোমা।
সমাজের বিবর্তন সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিনিরপেক্ষ। বিবর্তনের প্রক্রিয়াই নির্ধারণ করে কখন সমাজে কী ঘটবে, কী ধরনের সব নতুন নতুন শক্তির উত্থান হবে, কী ধরনের ব্যক্তির আবির্ভাব হবে। এসবের সঙ্গে ব্যক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। সবই ব্যক্তিনিরপেক্ষ। এভাবেই ইতিহাসে আবির্ভাব হয় একেক সময়ে, একেক পর্যায়ে বিশেষ ধরনের ব্যক্তির। এখানে ব্যক্তি নির্ধারক নয়, ইতিহাসই আবির্ভাব ঘটায় প্রয়োজনীয় ব্যক্তির। প্লেখানভ লিখেছিলেন, নেপোলিয়ন যদি না থাকতেন, তাহলে তৎকালে ফ্রান্সে নেপোলিয়নের মতো অন্য এক সামরিক নায়কের আবির্ভাব ঘটত। শেখ মুজিব না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দু–চার বছর বা দু–দশ বছর নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী পিছিয়ে যেত—এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে অন্য যে জ্ঞানই থাকুক, সামান্যতম ইতিহাসজ্ঞান নেই।