পাকিস্তানমুক্ত হলো বাংলাদেশ
বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। নাম পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এ প্রদেশের লোকেরা উন্মুখ হয়ে আছেন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারণে তাঁরা চালকের আসনে বসবেন। সেইমতো একটি সংবিধান তৈরি হবে। তারপর বাঙালিরা প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবে।
পালাবদলের পালা মঞ্চস্থ হচ্ছে। হঠাৎ ছন্দপতন। ১ মার্চ বেলা একটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি বেতার ঘোষণা সব হিসাব ওলটপালট করে দেয়। ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা চলছিল। সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা হোটেলের সামনে পিআইএ ভবনের পোর্টিকোর ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের একটি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়। কোনো নেতার ডাকের অপেক্ষা না করে একটি জনপদের আমজনতা যে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিতে পারে, ইতিহাসে এটি সম্ভবত এর আগে দেখা যায়নি।
অধিকাংশ বাঙালির মন থেকে মুছে যায় পাকিস্তান। জন্ম নেয় নতুন একটি রাষ্ট্রসত্তা—বাংলাদেশ। পরদিন থেকে সব জায়গায় উড়তে থাকে ছাত্রদের তৈরি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা—গাঢ় সবুজ জমিনে রক্তলাল সূর্য, তার মধ্যে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
২৫ মার্চ মাঝরাতে বাঙালির ওপর নৃশংস আক্রমণ চালায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তারা একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়ে যায় পুলিশ, ইপিআর আর সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের প্রতিরোধযুদ্ধ। এটাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধ।
পালাবদলের পালা মঞ্চস্থ হচ্ছে। হঠাৎ ছন্দপতন। ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা হোটেলের সামনে পিআইএ ভবনের পোর্টিকোর ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের একটি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়।
রাজনীতিসচেতন তরুণদের কেউ কেউ অনেক দিন ধরেই একটি সশস্ত্র লড়াই বা বিপ্লবের কথা বলে আসছিলেন। মূলধারার রাজনীতিবিদেরা চেয়েছেন ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেই আশা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায়। দেশের প্রধান নেতা গ্রেপ্তারের জন্য স্যুটকেস গুছিয়ে বসে থাকেন। একটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ও অপ্রস্তুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছুটে যায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। সেখানে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও সিদ্ধান্তে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।
ঠিক হয়, যুদ্ধ করে দেশ মুক্ত করা হবে। কিন্তু কোথায় যুদ্ধ? দুমাস পেরিয়ে যায়। যুদ্ধে আর গতি আসে না। অনেক তরুণ ভারতের নানান শিবিরে অপেক্ষায় আছেন একটু প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রের আশায়। এই সম্বলটুকু নিয়ে তাঁরা একটি প্রশিক্ষিত ও সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করবেন। সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দৃশ্যপটে গরহাজির। তিনি পাকিস্তানে কারাবন্দী। অন্যরা কলকাতায়-আগরতলায় বসে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করছেন। তাঁদের মধ্যে বনিবনা নেই। কেউ কাউকে মানেন না। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা বাঙালিরা সীমান্তের নানান জায়গায় প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের হাতে সীমিত অস্ত্র। গুলি ফুরিয়ে গেছে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সামান্য সাহায্য নিয়ে তাঁরা কোনোমতে টিকে আছেন।
ভারত সরকারের মনে হলো বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা আসলেই কি স্বাধীনতা চান? ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরের ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্রের আয়োজনে ৫ ও ৬ জুলাই হিমালয়ের পাদদেশে শিলিগুড়িতে প্রথমবারের মতো বসে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠক। বৈঠকে অনেক হইচই হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্থবিরতা নিয়ে কেউ কেউ আক্ষেপ জানান। সরকারের সক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারত পর্যাপ্ত সাহায্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠে। ভারত কেন এখনো কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিচ্ছে না, এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। আবার অনেকেই মাসিক ভাতার বরাদ্দ নিয়ে উদ্বেগ জানান। ৬ জুলাই পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দলের নাম বদলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাখে।
দেশের প্রধান নেতা গ্রেপ্তারের জন্য স্যুটকেস গুছিয়ে বসে থাকেন। একটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ও অপ্রস্তুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছুটে যায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। সেখানে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও সিদ্ধান্তে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।
এই বৈঠকের কয়েক দিন পর কলকাতায় প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। যুদ্ধে গতি আনতে দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। নিয়োগ পান ১১ জোন সেক্টর কমান্ডার। একটি কমান্ড কাঠামো তৈরি হয়। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে যান কর্নেল এম এ জি ওসমানী। চিফ অব স্টাফ হন কর্নেল এম এ রব। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদ আর যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
তত দিনে বাংলাদেশ ভূখণ্ড ঘিরে তিনটি যুদ্ধের পরিষ্কার আভাস পাওয়া যাচ্ছে: পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, পুরোনো হিসাব চুকিয়ে দিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পেতে মার্কিন-সোভিয়েত লড়াই। সব ছাপিয়ে ভারতের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। এটি ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের উত্তরাধিকার। ১৯৪৭ সালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কূটনীতিক জোসেফ করবেলকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান অনিবার্যভাবেই একদিন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে।’
অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল ভারত। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী দল পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো আসনে জয় পায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়ী দল পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন পায়নি। নির্বাচনী ফলাফলের এই মেরুকরণ পাকিস্তান ভাঙার পটভূমি তৈরি করে দেয়। ভারত আসন্ন যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে থাকে।
একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি ভারতীয় গোয়েন্দারা ‘গঙ্গা’ নামের ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটের একটি বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যায়। কাশ্মীরি মুজাহিদের ছদ্মবেশে ওই গোয়েন্দারা লাহোর বিমানবন্দরের টারমাকে বিমানটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। এ রকম একটা ছুতো পেয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ভারত তাদের আকাশসীমায় পাকিস্তানের সব ধরনের বিমানের উড়াল নিষিদ্ধ করে। ফলে পাকিস্তানের আন্তপ্রদেশ যোগাযোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়। ভারত যুদ্ধটা এভাবেই শুরু করে দেয়।
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, পুরোনো হিসাব চুকিয়ে দিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পেতে মার্কিন-সোভিয়েত লড়াই। সব ছাপিয়ে ভারতের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। এটি ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের উত্তরাধিকার।
১ মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণের পর চালচিত্র পাল্টে যায়। শুরু হয়ে যায় ভারতের যুদ্ধ পরিকল্পনা। ২ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশকে কীভাবে সাহায্য দেওয়া যায়, তা তাৎক্ষণিকভাবে খতিয়ে দেখে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে’ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি বানিয়ে দেন। পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব পান গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পরিচালক আর এন কাও। কমিটি দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়:
১. ভারত যদি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে দেশে ও বিদেশে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে?
২. ভারত যদি বাংলাদেশকে সাহায্য দেয়, তাহলে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে?
সম্ভাব্য সাহায্যের মধ্যে ছিল হালকা ও মাঝারি অস্ত্র, ৩০ লাখ টন খাদ্য সরবরাহ, ওষুধ, যোগাযোগ ও বার্তা পাঠানোর যন্ত্রপাতি, বাংলাদেশের সীমান্ত ঘিরে ভারতের ভেতরে দ্রুত চলাচলের জন্য একটি যাত্রীবাহী বিমান ও একটি হেলিকপ্টারসহ যানবাহন এবং বাংলাদেশে সম্প্রচারের সুবিধাসহ একটি বেতার ট্রান্সমিটার।
এটা বেশ চমকপ্রদ যে মার্চের ২ তারিখেই স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদের সামরিক পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে। এপ্রিলেই ভারতের সামরিক নীতি নির্ধারিত হয়ে যায় যে বর্ষা শেষ হলে নভেম্বরের দিকে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে সামরিক অভিযান চালাবে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত এই পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে প্রচার করা হয়।
ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সবার অগোচরে কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যান। ২ ডিসেম্বর তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ৩ ডিসেম্বর সকালে ভারতের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান একযোগে হামলা চালায়। ওই রাতে নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে সেনা সদরের অপারেশন রুমে যান ইন্দিরা গান্ধী। এক বেতার ভাষণে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের যুদ্ধ আজ ভারতের যুদ্ধ।’ জানা যায়, ভারতের এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং তিনি হচ্ছেন ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর প্রধান।
মাত্র ১২ দিনের মাথায় ভারতীয় বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বড় একটি অঞ্চলের সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। এটাকে তুলনা করা হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের সঙ্গে, যা ‘ব্লিৎসক্রিগ’ নামে খ্যাত। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ সবার অগোচরে কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যান। ২ ডিসেম্বর তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ৩ ডিসেম্বর সকালে ভারতের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান একযোগে হামলা চালায়। ওই রাতে নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে সেনা সদরের অপারেশন রুমে যান ইন্দিরা গান্ধী।
এপ্রিল থেকেই ভারতের রণকৌশল ছিল মুক্তিবাহিনীকে সীমিত সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং বিধ্বংসী তৎপরতা চালিয়ে পাকিস্তানিদের সরবরাহ লাইন ধ্বংস করে দেওয়া। ফলে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা তলানিতে পৌঁছায় এবং তারা বড় বড় শহরে ও সেনানিবাসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারতের সেনাবাহিনী সাঁজোয়া যান আর ভারী অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে ৩ ডিসেম্বর রাতে। চারদিক থেকে তারা এগোতে থাকে ঢাকার দিকে।
ত্রিপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুদ্ধে আহত কে ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফকে দেখতে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তিনি যখন কলকাতায় ফিরে আসেন, তত দিনে যশোর মুক্ত হয়ে গেছে। তিনি যশোর যান। দেখেন, ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে ব্যস্ত। ৮ ডিসেম্বর তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে নালিশ জানান। অসহায় তাজউদ্দীন মন্তব্য করেন, সব আর্মির একই চেহারা!
ভারতের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেকশর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল ওসমানীর কাউন্টার পার্ট হিসেবে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। তিনি একটি হেলিকপ্টার নিয়ে এলেন। তাতে আরোহণ করলেন ওসমানী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কর্নেল রব, রবের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল্লামা, ওসমানীর এডিসি শেখ কামাল এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সঙ্গে দুজন ভারতীয় পাইলট। তাঁরা ১১ ডিসেম্বর রওনা হয়ে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর তখন মুক্ত। পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
ওসমানী ও তাঁর সঙ্গীরা যান কুমিল্লা সার্কিট হাউসে। সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান তিনজন আইএএস কর্মকর্তা। ওসমানীর সঙ্গে তাঁদের কথোপকথন ছিল এ রকম:
আপনারা এখানে কী করছেন?
উই হ্যাভ বিন পোস্টেড টু টেকওভার সিটিজ।
নো।
ইউ হ্যাভ ভিআইপি রুম। আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
আমি থাকব না।
ওসমানী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে চলে যান ওয়াপদা রেস্টহাউসে। ১৫ তারিখে তাঁরা শুনলেন, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে। সঙ্গীরা তাকিয়ে ওসমানীর দিকে।
তিন মেজরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তিনটি ব্রিগেড। তাঁরা সবাই উদ্গ্রীব, ঢাকার দিকে যাত্রা করবেন, রাজধানী মুক্ত করার গৌরবের অংশীদার হবেন। জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের অপারেশন প্ল্যানও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
আমরা কখন যাব?
আই ডোন্ট নো।
আই ডোন্ট নো মানে? ইউ আর দ্য কমান্ডার ইন চিফ।
বোঝার চেষ্টা করো। আমি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারি। কিন্তু আত্মসমর্পণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আমি তাঁর কমান্ডের অধীন।
তাহলে ফোন করেন।
ওসমানী ফোন করলেন তাজউদ্দীনকে। তাজউদ্দীন বললেন, ওয়েট। আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বললেন, সিলেটে সারেন্ডার হয়ে গেছে। আপনারা সেখানে যান। ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের কাছে সঠিক তথ্য ছিল না। সিলেটে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল ১৭ ডিসেম্বর।
১৬ ডিসেম্বর বেলা দুইটায় সিলেটের পথে উড়াল দিল হেলিকপ্টার। বিকেল চারটার দিকে ফেঞ্চুগঞ্জের কাছে হেলিকপ্টারটি গুলিবিদ্ধ হয়। ফুয়েল ট্যাংক ফুটো হয়ে যায়। একটা গুলি এসে লাগে কর্নেল রবের ঊরুতে। তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। কামাল আর ব্রিগেডিয়ার গুপ্তের গায়েও গুলির আঁচড় লাগে। পাইলট বাধ্য হয়ে বেলি-ল্যান্ডিং করেন।
জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিন্যাসে রূপান্তর ঘটছিল। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ আর মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তিনটি ব্রিগেড। তাঁরা সবাই উদ্গ্রীব, ঢাকার দিকে যাত্রা করবেন, রাজধানী মুক্ত করার গৌরবের অংশীদার হবেন। জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের অপারেশন প্ল্যানও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির সঙ্গে আলাপ করতে ঢাকার সেনা সদরে আসেন। ঠিক হয়, ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে। ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার অরোরা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একটি হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসেন। বিমানঘাঁটিতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান জেনারেল নিয়াজি। খালেদ মোশাররফের কে ফোর্সের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর হায়দারও সেখানে আসেন।
আত্মসমর্পণ দলিলে সই দেন নিয়াজি। প্রতিস্বাক্ষর করেন অরোরা। ওসমানী তখন স্থানীয় লোকদের সাহায্যে আহত সহকর্মী রব ও অন্যদের নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে সিলেটের পথে। ঢাকায় আসার অনুমতি না পেয়ে মেজর জিয়া লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীকে নিয়ে সিলেটের এক অতিথিশালায়।
আত্মসমর্পণ হবে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। সেভাবেই আত্মসমর্পণের দলিলটি লেখা হয়। ঠিক হয়, এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে উপস্থিত থাকবে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল: মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী, সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল খালেক (সারদা পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ), সাবেক সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস। ভারতীয় কমান্ডারকে নিয়ে তাঁরা ঢাকায় আসবেন।
১৬ ডিসেম্বর দুপুরে কলকাতার উপকণ্ঠে দমদম বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির হন খালেক ও কুদ্দুস। ওসমানীর দেখা নেই। তাঁরা জানতেন না ওসমানী কলকাতায় নেই। তাঁদের জানানো হলো, পরিকল্পনায় রদবদল হয়েছে। তাঁদের আর ঢাকায় যেতে হবে না। শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় গেলেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার।
আধা ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। একটা ছোট টেবিল। তাঁর একদিকে দুটি চেয়ার। একটাতে বসলেন অরোরা, অন্যটাতে নিয়াজি। টেবিলের অন্য ধারে আরেকটি চেয়ারে বসলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর একজন প্রতিনিধি। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতের তিন বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় কাতারে ঠাঁই হলো এ কে খন্দকারের। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ। কোনো কোনো ছবিতে খন্দকারের মাথা দেখা গেল, কোনো কোনো ছবিতে সেটিও নেই। পাদপ্রদীপের আলোয় তখন উদ্ভাসিত হচ্ছেন অরোরা এবং অন্যান্য ভারতীয় জেনারেল।
আত্মসমর্পণ দলিলে সই দেন নিয়াজি। প্রতিস্বাক্ষর করেন অরোরা। ওসমানী তখন স্থানীয় লোকদের সাহায্যে আহত সহকর্মী রব ও অন্যদের নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে সিলেটের পথে। ঢাকায় আসার অনুমতি না পেয়ে মেজর জিয়া লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীকে নিয়ে সিলেটের এক অতিথিশালায়। সারা দুনিয়ায় রটে যায়, পাকিস্তানি জেনারেল ভারতীয় জেনারেলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে ভারত।
১৬ ডিসেম্বর কলকাতার প্রধান বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা আট কলামব্যাপী শিরোনাম করে—ঢাকা আজ আনন্দবাজার। তাজউদ্দীন ও তাঁর সহকর্মীরা কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের দপ্তরে বসে রেডিওতে শুনলেন সব।
ঢাকার নিয়ন্ত্রণে ভারতের সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা সেনানিবাসে ভারতীয়দের নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন। নিয়াজির সরকারি বাসভবনে থাকছেন অরোরা। ইস্টার্ন কমান্ডের পতাকা এবং ভারতের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঢাকার রাস্তায় বিজয়ীর বেশে ছুটে বেড়াচ্ছে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর গাড়ি। সেনানিবাস থেকে লরিবোঝাই দ্রব্যসামগ্রী যেতে থাকে কলকাতায়। প্রায় এক সপ্তাহ পর বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী একটি হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকায় এসে নামেন। শেষ হয় উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। বাংলাদেশ পাকিস্তানমুক্ত হয়।