জন্মদিনে শ্রদ্ধা
পিটার সিঙ্গারের দর্শন: মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত ইশতেহার
অস্ট্রেলীয় দার্শনিক পিটার সিঙ্গার (Peter Singer) এক ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ, যাঁর নৈতিক দর্শন আধুনিক পৃথিবীতে ন্যায়, করুণা এবং দায়িত্ববোধের নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে। যা তাঁকে একাধারে পশু অধিকার আন্দোলনের পথিকৃত, দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর নৈতিকতার প্রবক্তা এবং প্রজাতিবাদের (speciesism) তীব্র সমালোচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ ৬ জুলাই, পিটার সিঙ্গারের ৭৯তম জন্মদিনে তাঁর জীবন, দর্শন এবং মানবতা ও সকল সংবেদনশীল জীবের কল্যাণে তাঁর অসাধারণ অবদান নিয়ে এই লেখা।
১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর, সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশযান স্পুৎনিক-২ প্রবেশ করে পৃথিবীর কক্ষপথে। সেই মহাকাশযানে কোনো মানুষ ছিল না। ছিল মাত্র একটি কুকুর। নাম লাইকা। সেই কুকুরই পৃথিবীর কক্ষপথে যাওয়া প্রথম প্রাণী। লাইকা ছিল এক ভবঘুরে পথের কুকুর। মস্কোর অলিগলিতে বেড়ে ওঠা এক অবাঞ্ছিত জীব। যাকে ধরে আনা হয়েছিল বিজ্ঞানচর্চার নামে এক মৃত্যুমুখী অভিযানে পাঠাতে। লাইকা পৃথিবীর কক্ষপথে উত্তপ্ত মহাকাশযানে ঘুরতে ঘুরতে মারা গিয়েছিল।
লাইকার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালের ১১ জুন ‘অ্যালবার্ট’ নামে এক বানরকে মহাকাশে পাঠানোর চেষ্টা করে। পৌঁছানোর আগেই সে মারা যায়। ১৯৪৯ সালে ‘অ্যালবার্ট–২’ মহাকাশের কারমান রেখা পেরোলেও, ফিরে আসার আগেই মারা যায়। ফরাসিরা পাঠিয়েছিল ‘ফেলিসেট’ নামের এক বিড়ালকে। ফিরে আসার পর যার মস্তিষ্কচিত্র নেওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়।
এসব প্রাণীর কেউই জানত না তারা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। কষ্ট, ভয়, মৃত্যু, সবই তারা পেয়েছে। পেয়েছে এমন এক অভিযানে গিয়ে, যেখানে সম্মতি ছাড়া তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এ ঘটনাগুলো আমাদের নৈতিক বোধের সামনে নিয়ে আসে এক অপরিহার্য প্রশ্ন। প্রজাতিভেদে একেক প্রাণীর সঙ্গে নিজেদের স্বার্থে একেক রকম আচরণ করার অধিকার আমাদের আছে কি না? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েই অস্ট্রেলীয় দার্শনিক পিটার সিঙ্গার ১৯৭৫ সালে তাঁর বিখ্যাত বই ‘অ্যানিমেল লিবারেশন’ প্রকাশ করেন।
পিটার সিঙ্গার বলেন, আমরা যদি কোনো প্রাণীর কষ্টকে শুধু তার প্রজাতিগত পরিচয়ের কারণে কম গুরুত্ব দিই, তাহলে তা একধরনের নৈতিক পক্ষপাত তৈরি হয়। আর সেই পক্ষপাতের নাম স্পিসিজম।
স্পিসিজম হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষ নিজ প্রজাতির ও পছন্দের প্রাণীদের নৈতিকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং অন্য প্রজাতির প্রাণীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে ন্যায়সংগত ভাবতে শেখে। ‘স্পিসিজম’ শব্দটি প্রথম চালু করেন ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ডি রাইডার এবং সিঙ্গার তা জনপ্রিয় করে তোলেন।
‘অ্যানিমেল লিবারেশন’ বইয়ে সিঙ্গার বলেন, একসময় মানুষ গায়ের রঙের বিচারে অন্য মানুষদের দাস বানিয়েছে, বা জেন্ডারের বিচারে কাউকে অধিকার বঞ্চিত করেছে, তেমনই আজ মানুষ প্রাণীর প্রজাতি দেখে তাদের কষ্টকে তুচ্ছ মনে করছে। অথচ অনেক প্রাণীই অনুভব করতে পারে ব্যথা, ভয়, সুখ কিংবা অপমান।
সিঙ্গার উপযোগবাদী দর্শনের অনুসারী। তাঁর মতে, সমস্ত সংবেদনশীল প্রাণীর সুখ-দুঃখ নৈতিকভাবে সমান গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, যে কষ্ট অনুভব করতে পারেন, তাঁর কষ্টকে গুরুত্ব না দিলে তা হবে অন্যায়। যেমন জেরেমি বেনথাম বলেছিলেন, প্রশ্নটা ওরা যুক্তি করতে পারে কি না, সেটা নয়, বরং ওরা কি কষ্ট পেতে পারে?
পিটারের প্রস্তাব অনুযায়ী, কেবল স্বাদের জন্য কোটি কোটি প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে মাংস খাওয়া বা বিলাসের জন্য পশমের কোট পরা, ন্যায়সংগত হতে পারে না। বিশেষ করে যখন বিকল্প উপায় সহজলভ্য। অপ্রয়োজনীয় ভোগের জন্য অপর প্রজাতির প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া সিঙ্গারের প্রস্তাবে ছিল এক গুরুতর নৈতিক অপরাধ।
সিঙ্গারের দৃষ্টিতে, ন্যায়বিচার মানে কেবল মানুষে-মানুষে সমতা নয়; বরং যার যন্ত্রণা যত গভীর, তার কষ্টকে তত গুরুত্ব দেওয়া। এমনকি একজন বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জির যন্ত্রণা একটি কম সচেতন মানবশিশুর চেয়ে বেশি হতে পারে—সে ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জির যন্ত্রণার মূল্য কম ধরে নেওয়া নৈতিকভাবে অযৌক্তিক। সিঙ্গারের অ্যামিলেল লিবারেশন আমাদের শেখায়, অন্যান্য প্রাণীর অনুভূতির মর্যাদা রক্ষা করা কোনো দয়ার ব্যাপার নয়, বরং ন্যায়ের প্রশ্ন।
সিঙ্গারের স্পিসিজমবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের একটি বৃহত্তর ন্যায়ের চেতনার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে মানব ও অমানব জীব একটিই নৈতিক বৃত্তে অন্তর্ভুক্ত হয়, অনুভূতির ভিত্তিতে।
ধরুন, একটি পরিবার তাদের কুকুরকে সন্তানের মতো ভালোবাসে, কিন্তু একই পরিবারের রান্নাঘরে প্রতিদিন খাওয়া হয় হরিণ বা খরগোশের মাংস। শিশু বয়স থেকে আমরা শিখি কুকুর আমাদের বন্ধু, কিন্তু ছাগল খাদ্য। অথচ কুকুর আর ছাগল দুটোই নিজ নিজ অনুভূতির জায়গায় সমান। এ কারণে দেখা যায়, কুকুরকে আঘাত করা হলে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, কিন্তু ছাগলের মৃত্যু আমরা সাধারণ ঘটনা মনে করি। এই দ্বৈত মানদণ্ড স্পিসিজমেরই আরেক রূপ।
প্রতিটি সমাজে এর প্রকাশ ভিন্ন। কোনো সংস্কৃতি ঘোড়াকে পবিত্র মনে করে। কারও কাছে আবার ঘোড়া সুস্বাদু খাদ্য। কারও কারও কাছে গরু দেবতা, কারও কাছে খাবারের উপাদান। অথচ সব প্রাণীর যন্ত্রণা অভিন্ন। এসবই সমাজ কর্তৃক তৈরি করা সাংস্কৃতিক পক্ষপাত।
আইনেও স্পিসিজম স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে মুরগি ও পোলট্রির ওপর নির্যাতন অনেক সময় বৈধভাবে করা যায়, আবার কুকুরের ওপর করলে তা অপরাধ হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও শূকর বা বাছুরের লেজ কাটা কিংবা খোজা করা বৈধ, কিন্তু কুকুরের ক্ষেত্রে তা নিষিদ্ধ।
যেসব বন্য প্রাণী বিলুপ্তপ্রায়, তাদের জন্য কঠোর আইন আছে, কিন্তু ফার্মে বন্দী লাখ লাখ প্রাণী, যাদের প্রতিদিন মানুষ খায়—তাদের নিরাপত্তা নেই। অধিকারও নেই। সিঙ্গারের চিন্তা শুধু বইয়ের পাতায় থেমে নেই। তাঁর কাজের ফলেই গড়ে ওঠে প্রাণী অধিকার আন্দোলন। ‘অ্যানিমেল লিবারেশন’ বইটি প্রকাশের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণী-মুক্তির ডাক।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই নতুন নয়। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও জৈন চিন্তায় প্রাণীদের প্রতি দয়া ও সম্মানের ভিত্তি রয়েছে। বৌদ্ধরা মনে করে, সব প্রাণীই দুঃখ-বেদনা অনুভব করে, তাই তাদের প্রতি মৈত্রীর আচরণ জরুরি। জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ সর্বোচ্চ নীতি। তারা সচেতনভাবে এককোষী প্রাণী পর্যন্ত হত্যা থেকে বিরত থাকে। তাদের কাছে প্রতিটি প্রাণী আত্মার অধিকারী, যার কষ্টের মর্যাদা প্রজাতির ওপর নয়, অনুভবের সত্যতার ওপর নির্ভর করে।
সেই প্রাচীন সম্মানবোধ আজও কিছু আদিবাসী শিকারিদের মধ্যে জীবিত। দক্ষিণ আফ্রিকার বসোথু বা জুলু শিকারিরা শিকার করার আগে প্রাণীকে উদ্দেশ করে বলে, ‘আমি তোমাকে মেরেছি, কারণ আমার বাঁচতে হবে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’ তারা মাটিতে নুয়ে পড়ে শিকারের রক্ত ছুঁয়ে তা নিজের গালে মাখে।
এই আচরণ হয়তো প্রাণীটিকে বাঁচাতে পারে না, কিন্তু তা জানায় এক স্বীকারোক্তি, যে তারা প্রাণীটির কষ্টকে অস্বীকার করছে না। পিটার সিঙ্গারের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই সম্মানবোধই সভ্যতার ভবিষ্যৎ নৈতিক শিক্ষা হতে পারে। কারণ এটি স্বীকার করে, যন্ত্রণা প্রজাতির দ্বারা নির্ধারিত হয় না। লাইকার মহাকাশ জয় প্রয়োজন ছিল না, তবু মানুষের আগ্রহে তাকে মহাকাশে গিয়ে মরতে হয়েছে। মরতে হয়েছে অ্যালবার্ট কিংবা ফেলিসেটকে।
এই প্রাণীরা আমাদের কাছে কেবল ইতিহাসের পাতায় থাকা তথ্য নয়, নৈতিক ভুলের প্রতীক। পিটার সিঙ্গার আমাদের শেখান—প্রাণীর কষ্টকে অস্বীকার নয়, বরং স্বীকার করতে হবে; সম্মান দিতে হবে। স্পিসিজম পরিহার করে যদি আমরা এক বিস্তৃত ন্যায়ের বৃত্ত গড়ে তুলতে পারি—তবে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান শুধু কার্যকর হবে না, মানবিকও হবে।
পিটার সিঙ্গারের দর্শন আমাদের সামনে এক নতুন নৈতিক মানচিত্র খুলে দেয়, যেখানে প্রাণীর প্রতি দয়া কেবল সহানুভূতির নয়, বরং ন্যায়ের দাবি। সিঙ্গারের ভাবনা আমাদের শেখায়, কুকুর, গরু বা মানুষের কষ্টের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। তারা সবাই অনুভব করতে সক্ষম। তাঁর দর্শন আধুনিক সভ্যতাকে আহ্বান জানায় প্রজাতির সীমানা পেরিয়ে সব সংবেদনশীল জীবের প্রতি সমবেদনা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আচরণ করতে। এটি মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিধি প্রসারিত করার আহ্বান।