ছেলেটা কী করে খাবে: ঝিনেদার মিজান কাকাকে মনে পড়ে

একসময় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মফস্‌সল শহরেই এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা ছিলেন সাহিত্যসেবী, সংস্কৃতিপ্রেমী। জেলা শহরের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য তাঁদের প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। শহরে কেউ কবিতা–গল্প লিখছে, গান করছে—তাকে বিকশিত করার দায়িত্ব নিয়ে নিতেন তাঁরা। দিনে দিনে মফস্‌সল থেকে কমতে শুরু করেছে এসব আন্তরিক মানুষ। তাঁদের মধ্যে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে কেউ কেউ হয়তো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ বা মারা গেছেন। ঝিনাইদহ শহরের শেখ মিজানুর রহমান ছিলেন এমনই একজন। ২৫ এপ্রিল সকালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। ঝিনাইদহের সাংস্কৃতিক বিকাশে তাঁর রয়েছে বিস্তর অবদান।

শেখ মিজানুর রহমানছবি: সংগৃহীত

গীতাঞ্জলি সড়ক আর অগ্নিবীণা সড়ক—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী দুটি কবিতার বইয়ের নামে দুটি সড়ক আছে শহরে। ওই দুই সড়কের কোনো একটি দিয়ে হেঁটে চলেছেন টিংটিঙে গড়নের এক মানুষ। পান খেয়ে লাল হয়ে আছে পাতলা দুটি ঠোঁট। হাতে এক বান্ডিল কাগজ। হনহন করে হেঁটে চলেছেন। ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলি কি অগ্নিবীণা সড়ক পার হয়ে কোথায় যাচ্ছেন তিনি? কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘চলন্তিকা’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি কপি দিয়ে বলছেন, ‘আসছে শুক্রবার আসবেন কিন্তু সাহিত্য আসরে।’

শেখ মিজানুর রহমান—মিজান কাকার কথা মনে হলে এমন ছবিই বারবার ভেসে ওঠে আমার চোখে।

মিজান কাকা—ঝিনাইদহের আলো–হাওয়ায় বড় হওয়া মানুষ শেখ মিজানুর রহমান ২৫ এপ্রিল সকালে মারা গেছেন। মফস্‌সলের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা যেমন একটু নীরবে প্রস্থান করেন, জাতীয় গণমাধ্যমে তাঁদের প্রয়াণের খবরটি প্রকাশিত হয় টুটাফাটাভাবে, তিনিও অনেকটা সেভাবেই চলে গেলেন। তাঁকে কি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলতে পারি? নবগঙ্গা নদীর পেট চিরে বের হওয়া ঝিনাইদহ—আঞ্চলিকভাবে বলা হয় ঝিনেদা—শহরে শেখ মিজানুর রহমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন। মফস্‌সলের গন্ধঘেরা এই শহরে যদি কেউ কবিতা লেখে বা গল্প লেখে, অবধারিতভাবে তিনি সেই নতুন কবি বা গল্পকারের সহায়। গত ত্রিশ বছর এমনই ছিল দৃশ্যপট। তবে এখন থেকে সেই দৃশ্য আর থাকবে না। কারণ, মিজান কাকা এখন কবরে শুয়ে আছেন।

২৫ এপ্রিল সকালে ঢাকায় বসে ফেসবুক মারফত যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানলাম, সে সময় আমার কেবলই মনে পড়ছিল আমার ভয়ংকর শৈশবের কথা। স্মৃতির অতল খুঁড়ে ভেসে আসছিল এক ঘোরতর মফস্‌সলের কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর:
‘এই ছেলে কী করে খাবে... নয়ন কী করে খাবে... ওর জীবনে কী যে হবে... আহা রে...!’

এসব বলত পাড়া–প্রতিবেশীরা। বলত আমার পরিবারের লোকজনও। খুব ছোটবেলায়, আমার বয়স যখন আট–নয়, তখন থেকে এমন কথা শুনতে শুনতে কীভাবে যে কুঁকড়ে যেতাম! প্রতিদিনই একটু একটু করে ছোট হয়ে যেতাম যেন!

যে বয়সে সবাই হাঁটতে শেখে, ওই বয়সে আমি হাঁটতে পারতাম না। আমার হণ্টন শুরু হয়েছে খানিকটা বড় হয়ে, ১০-১১ বছরে। আমার বাঁপায়ের শিরা একটু ছোট। ঠিক সময়ে তাই হাঁটতে পারিনি। কিন্তু এক পা, দুই পা করে একসময় যখন হাঁটতে শিখলাম, আমার সেই ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ চলা মোটেই আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো ছিল না, আমি হাঁটতাম খানিকটা পা টেনে টেনে, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটা যাকে বলে। (এখনো সেভাবেই হেঁটে চলেছি)। তাই খুব শিশুকাল থেকেই ‘অসুস্থ’, ‘খোঁড়া’, ‘প্রতিবন্ধী’—এসব আমি বেশুমার শুনেছি। এখন যাকে ‘বুলিং’ বলে, তখন তো এই শব্দের মর্ম বুঝতাম না, কিন্তু বুলিংয়ের শিকার আমি হয়েছি। কেউ যে বুঝে এটা করতেন, এমন নয়। আর সেই আশির দশকে এ বিষয়ে এখনকার মতো এত সচেতনতাও ছিল না। সংগত কারণে প্রায় নিয়মিতই আমাকে শুনতে হতো, ‘ও তো হাঁটতে পারে না, ফুটবল খেলবে কী’ অথবা সেই চিরচেনা বাক্য, ‘এই ছেলে কী করে খাবে?’

আমি যখন মিজান কাকাকে প্রথমবার দেখি, কত সাল তখন—১৯৯৪? ‘চলন্তিকা’ নামে নিউজপ্রিন্ট কাগজে চার পৃষ্ঠার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন তিনি। নিজেই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক। সংবাদ সংগ্রহ ও লেখা, বিজ্ঞাপন জোগাড় থেকে শুরু করে ‘চলন্তিকা’য় তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন ‘ওয়ানম্যান আর্মি’। এর বাইরে আরেকটি কাজ তিনি করতেন—নিয়মিত প্রতি শুক্রবার ‘চলন্তিকা সাহিত্য আসর’ নামে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করতেন।

ফলে সেই ছেলেবেলায়ই কীভাবে কীভাবে যেন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের আমি এড়িয়ে চলতে শিখে গেলাম। তাঁদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম।

আমার কোনো জগৎ ছিল না। তখন ঢাকাগামী সোহাগ ও সৌখিন পরিবহনের বাসগুলো শোঁ শোঁ শব্দে রাস্তা কাঁপিয়ে চলে যেত শেরেবাংলা সড়কে আমাদের ভাড়া বাড়ির সামনে দিয়ে। নয়-দশ বছর বয়সের আমি প্রতিদিন আমাদের বাড়ির সামনে বসে গাড়ির আসা-যাওয়া দেখতাম আর গাড়ি গুনতাম। গাড়ি গুনতে গুনতে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো বড় হব কী, নানাজনের নানা কথা শুনে হররোজই গভীর হীনমন্যতায় খানিকটা ‘বাটুল’ হয়ে যেতাম। স্বাভাবিকভাবেই আমার মানসিক অবস্থা তলানিতে পৌঁছাচ্ছিল তখন। এসব দেখে আব্বা তাঁর বইয়ের আলমারি খুলে দিলেন আমাকে। সে সময় তিনি মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ছিলেন বলেই বোধ হয় তাঁর আলমারিতে আমি পেলাম রাশি রাশি প্রগতি-রাদুগার বই। রেবতী মোহন বর্মণ ও আব্দুল হালিমের লেখা বই আর সুদৃশ্য ‘উদয়ন’ পত্রিকা। বুঝে এবং বেশির ভাগই না বুঝে সেসব পড়ছিলাম। বড় হচ্ছিলাম একটু একটু করে। আমার অজান্তেই আমার জগৎ গড়ে উঠছিল।

এরপর একসময় ‘বাড়ি’র সঙ্গে ‘গাড়ি’ মিল দিয়ে লিখতে শুরু করলাম। সেগুলো কি কবিতা না ছড়া?

না, এমন কিছুই নয়, সেসব ছিল নিছক হাবিজাবি। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া আমি তত দিনে ছড়া–কবিতা নামের ‘হাবিজাবি’ লিখে লিখে স্কুলের বাংলা ও অঙ্ক খাতা তো ভরিয়ে ফেলেছি! এ সময় একদিন আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন মিজান কাকা, মানে শেখ মিজানুর রহমানের কাছে। তিনি ছিলেন আব্বার স্কুলের সহপাঠী। তো মিজান কাকার হাতে আমাকে দিয়ে আব্বা বলেছিলেন, ‘দোস্ত, আমার ছেলেটা লেখে। ওকে তোর কাছে দিয়ে গেলাম।’

সেই মিজান কাকা অপ্রত্যাশিতভাবে মারা গেলেন। বেশ পরিণত বয়সেই চলে গেলেন।

আমাদের ঝিনেদা শহরে শেখ মিজানুর রহমান ছিলেন অকৃতদার। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ মানুষ। মফস্‌সলের বাস্তবতায় কবিতা-সাহিত্য তথা সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রদূতের মতো। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তাঁর বাবা শেখ হাবিবুর রহমান শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ডাক বিভাগ থেকে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছবিসংবলিত ডাকটিকিট ছাপা হয়েছে।

ঝিনাইদহ শহরে এ বছরের একুশের বইমেলায় অনেকের সঙ্গে শেখ মিজানুর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: সংগৃহীত

আমি যখন মিজান কাকাকে প্রথমবার দেখি, কত সাল তখন—১৯৯৪? ‘চলন্তিকা’ নামে নিউজপ্রিন্ট কাগজে চার পৃষ্ঠার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন তিনি। নিজেই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক। সংবাদ সংগ্রহ ও লেখা, বিজ্ঞাপন জোগাড় থেকে শুরু করে ‘চলন্তিকা’য় তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন ‘ওয়ানম্যান আর্মি’। এর বাইরে আরেকটি কাজ তিনি করতেন—নিয়মিত প্রতি শুক্রবার ‘চলন্তিকা সাহিত্য আসর’ নামে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করতেন। কোনো এক শুক্রবার বিকেলে আব্বা আমাকে ওই সাহিত্য সভায় নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছিলেন মিজান কাকার হাতে।

চলন্তিকা সাহিত্য আসর নিয়ে মিজান কাকার স্বপ্ন আর উদ্দীপনার কোনো কমতি ছিল না। ‘চলন্তিকা’ সাপ্তাহিকের কার্যালয়ে এ সাহিত্য সভাকে কেন্দ্র করে কী ঝকমারি মচ্ছবই না বসত! জেলা শহরে যাঁরা কবিতা-গল্প–প্রবন্ধ লিখতেন, প্রায় সবাই–ই আসতেন এখানে। নিজেদের লেখা পড়তেন। সেসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতো। ক্লাস সিক্সে পড়া আমি ছিলাম সে সভার কনিষ্ঠতম সদস্য।

প্রতি শুক্রবার আমি ‘মাছ’-এর সঙ্গে ‘গাছ’ অন্ত্যমিল দিয়ে ছড়া লিখি, অথবা লিখি, ‘একুশ তুমি শহীদ মিনারের লাল সূর্য’—টাইপের কবিতা। আর সাহিত্য সভায় সেগুলো পড়ার পর সবার কী প্রশংসা! আজ বুঝি, সেগুলো আদতে কোনো কবিতা ছিল না, এক কিশোরের কবিতা লেখার চেষ্টাকে সবাই উৎসাহিত করছেন। ঘটনা ছিল এটুকুই।

তবে সেই উৎসাহই হয়তো আমার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বলা চলে, ওই আসরে গিয়ে আমি দাঁড়ানোর মতো নিজের একখণ্ড জমি পেয়েছিলাম। এর আগে কখনো কেউ তো আমার কোনো কাজের প্রশংসা করেনি, তাই সাহিত্য সভার সদস্যদের প্রশংসায় জীবনে প্রথমবারের মতো উত্তেজনায় চার হাত উঁচু হয়ে উঠেছিল আমার বুকের ছাতি। ভেতরকার হীনমন্যতা কেটে গিয়ে মনে হয়েছিল, আমিও তো কিছু পারি! ‘নয়ন কী করে খাবে?’ —চারপাশের মানুষজনের সহানুভূতি ও করুণাভারাতুর এ কথা শুনতে শুনতে সেই শৈশব-কৈশোরে আমি যখন প্রায় প্রতিদিনই মাটির সঙ্গে মিশে যাই, সে সময় মিজান কাকা আর তাঁর চলন্তিকা সাহিত্য আসরের সাহিত্যিকদের উৎসাহই আমার পরবর্তী জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বুঝে না–বুঝে আপনমনেই নিজেকে বলেছিলাম, নয়ন কবি হবে, কবিতা লিখে খাবে।

একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই শেখ মিজানুর রহমানের মতো মানুষ ছিলেন, যাঁরা মানুষের মধ্যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা চাগিয়ে দিয়ে অন্যতর কিছু ‘মানুষ’ তৈয়ার করতেন। যুগের হাওয়ায় এ সময়ে এসে আমাদের সবার ভেতর এখন ‘সফল’ হওয়ার খুব চাপ, তাড়াও। এই ইন্টারনেট-এমবির যুগে সবাই এখন নিজে নিজেই ‘স্টার’ বনে যেতে চায়। ফলে প্রবল আত্মকেন্দ্রিক এই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ আকাশের তারার দিকে চোখ তুলে দুদণ্ড তাকানোর অবকাশ কোথায় আমাদের!

বলার অপেক্ষা রাখে না, চলন্তিকা সাহিত্য আসর থেকে পাওয়া উৎসাহই আমাকে ‘কবি’ করে তুলেছিল। কোনো এক বাংলা নববর্ষের আগে আগে মিজান কাকা আমাকে বললেন, ‘পত্রিকায় ছাপার জন্য একটা লেখা দিয়ো তো, বাবা।’

আমি লেখা দিলাম। ‘বেকার’ শিরোনামে ছড়া টাইপের একটা লেখা। সে লেখার কয়েকটি লাইন মনে আছে এখনো:
‘আমি একজন বেকার
চাকরি না পেয়ে হয়েছি হকার
সারা দিন ঘুরে বেড়াই আর খাই
চাকরি কোথায় পাই
চাকরি পেতে গেলে অনেক টাকা চাই
টাকা কোথায় পাই, মামা-খালুও নাই
এখন কী উপায়!’

সাপ্তাহিক ‘চলন্তিকা’র নববর্ষ সংখ্যায় লেখাটি ছাপা হলো। কোনো পত্রিকায় সেই আমার প্রথম লেখা।

স্মৃতির মধ্যে এখনো ঘাঁই মারে সেই উজ্জ্বল দিন, লেটারপ্রেসে ছাপা হওয়া নিউজপ্রিন্টের সংখ্যাটি উল্টেপাল্টে দেখছিলাম বারবার। সেখানে আমার শিশুকালের মাজুল লেখাটি জ্বলজ্বল করছিল! লেখার শিরোনামের নিচে গোটা গোটা অক্ষরে ছিল মো. শাহনেওয়াজ—আমার তখনকার নাম এবং তার নিচে ফাস্ট ব্র্যাকেটের মধ্যে ছোট হরফে লেখা, ‘ষষ্ঠ শ্রেণি, ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়’।

লেখা ছাপার পর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো আমার মধ্যে। যে আমার কাছে স্কুলের পরিবেশ দুর্বিষহ লাগে এবং সেখানে যেতেই চাই না, সেই আমিই শুক্রবার এলেই প্রহর গুনতে থাকি, কখন বিকেল হবে, যাব সাহিত্য আসরে।

মাধ্যমিকে পড়া অব্দি চলন্তিকা সাহিত্য আসরে নিয়মিতই গেছি। শুধু লেখালেখি করি বলে কত মানুষ ভালোবেসেছেন আমাকে, স্নেহ করেছেন! সোনার অক্ষরে মোড়া কতশত নাম, বয়োবৃদ্ধ আকবর আলী স্যার, হোসনে আরা খোন্দকার, কাজী গিয়াস আহমেদ, খোন্দকার হাফিজ ফারুক, বি এম রেজাউল করিম, অতীন অভিক, আহমদ রাকিব, আশোক ধর, হাশিম মিলন, আলমগীর কবির...। এ বাদে জানা-অজানা এন্তার কবির সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে এই সাহিত্য আসরের মাধ্যমে।

স্বীকার করতেই হবে যে ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল মফস্‌সলের ‘অনাধুনিক’ চলন্তিকা সাহিত্য আসর ও তার কর্ণধার শেখ মিজানুর রহমান।

শেখ মিজানুর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘চলন্তিকা’র সাইনবোর্ড
ছবি: সংগৃহীত

বছর দুয়েক বাদে এখানে দেখা পেয়েছিলাম সেদিনের জুপিটার টোকন—এখনকার টোকন ঠাকুরের। আমি তখন আট ক্লাসের ছাত্র। দেখলাম, ঝাঁকড়া চুল আর সবুজ রঙের টি–শার্ট পরা এক তরুণ কথায় কথায় সিগারেট ফুঁকছেন, হই–হট্টগোল করছেন। জুপিটার টোকন একটি কবিতা পড়লেন। তাঁর কবিতা শোনার পর দারুণ এক উপলব্ধি হলো আমার। বুঝলাম, এত দিন আমি যেসব কবিতা পড়েছি, এই কবিতা তার চেয়ে আলাদা।

মিজান কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কে?

বললেন, ‘ওর নাম টোকন। আমাদের ঝিনেদার মানুষ। গাড়াগঞ্জে বাড়ি। খুলনা আর্ট কলেজে পড়ে। ভালো কবিতা লেখে। আধুনিক কবিতা বোঝে। ঢাকার পত্রিকায় ওর কবিতা ছাপা হয়। আধুনিক কবিতা বুঝতে চাইলে তুমি ওর কাছ থেকে তালিম নাও।’

মিজান কাকা সেদিন নিজের অজান্তেই আমাকে জুপিটার টোকন, মানে টোকন ঠাকুর, মানে টোকনদার হাতে সোপর্দ করলেন। আর আমিও ‘আধুনিক কবিতা’র ভেতর-বাহির বোঝার নেশায় একেবারে অন্ধের মতো তাঁকে অনুসরণ করলাম।

আজ যদি নবগঙ্গা-লাগোয়া ঝিনেদা শহরের বিস্তৃর্ণ আসমানে হৃদয় খুলে কেউ তাকায়, দেখা যাবে, সেখানে হাটের রাস্তা কি দেবদারু অ্যাভিনিউয়ের নীল আকাশগগনে ডাকহরকরা স্বাতী তারাটির পাশে সফেদশুভ্র বেশে ফুটে আছে নতুন একটি কালপুরুষ, সদ্য ফোটা তারকা। সেই ‘স্টার’-এর নাম, শেখ মিজানুর রহমান।

টোকনদা ‘আধুনিক কবিতা’র বিস্তর ‘তালিম’ আমাকে দিয়েছেন। তাঁর সূত্র ধরে বাংলাদেশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আহমদ ছফা তো বটেই, ওপার বাংলার বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, জয় গোস্বামী থেকে শুরু করে ভিনভাষী শার্ল বোদলেয়ার বা জঁ আর্তুর র‍্যাঁবো—বিশ্বকবিতার এই মনীষাদের তাঁর কাছ থেকেই চিনেছিলাম।

আবারও বলি, টোকনদার সঙ্গে সংযোগটা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন মিজান কাকাই; নাকি প্রকারান্তরে তিনি ‘আধুনিক কবিতা’র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন আমার!

শুধু আমি কেন, আমাদের শহরের আরও অনেকের জীবনেই শেখ মিজানুর রহমানের অবদান আছে।

সেই মিজান কাকা এখন প্রয়াত। ঈদে–চান্দে, ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে আর দেখা হবে না তাঁর সঙ্গে। অবশ্য আমি পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার পর তাঁর সঙ্গে খুব যে দেখা হতো, এমন নয়। শেষ দিকে খুব অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ মিজান কাকাকে দেখতে যেতে কখনো তেমন ইচ্ছা করেনি আমার। যে মানুষের জীবনীশক্তি আর উৎসাহ একদিন আমাকে ‘জীবন’ দিয়েছিলেন, তাঁকে ম্রিয়মাণ ও শয্যাশায়ী দেখতে ভালো লাগত না আমার। আবার এ–ও সত্য যে মিজান কাকা আর আমার জগৎ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল, জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে সাহিত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল দুজনের পথ। এমন হতেই পারে। অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হয়। একদিন যে ‘আধুনিক’ কবিতা বোঝার জন্য তিনি আমাকে টোকন ঠাকুরের কাছে পাঠিয়েছিলেন, সেই ‘আধুনিক’ কবিতার উড়োজাহাজে চেপে কখন যে তাঁর থেকে যোজন যোজন দূরে চলে এসেছি আমি! আদতেই কি দূরবর্তী হয়েছি? তাহলে তাঁর মৃত্যু আমাকে এখন এতটা ব্যথাতুর করছে কেন? তিনি তো আমার আপন কেউ নন, তবুও মৃত্যুগন্ধী হাওয়ায় স্মৃতির সলমাজরি আজ কেবলই দিগ্বিদিকে উড়ছে। কেন?

একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই শেখ মিজানুর রহমানের মতো মানুষ ছিলেন, যাঁরা মানুষের মধ্যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা চাগিয়ে দিয়ে অন্যতর কিছু ‘মানুষ’ তৈয়ার করতেন। যুগের হাওয়ায় এ সময়ে এসে আমাদের সবার ভেতর এখন ‘সফল’ হওয়ার খুব চাপ, তাড়াও। এই ইন্টারনেট-এমবির যুগে সবাই এখন নিজে নিজেই ‘স্টার’ বনে যেতে চায়। ফলে প্রবল আত্মকেন্দ্রিক এই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ আকাশের তারার দিকে চোখ তুলে দুদণ্ড তাকানোর অবকাশ কোথায় আমাদের!

তবে আজ যদি নবগঙ্গা-লাগোয়া ঝিনেদা শহরের বিস্তৃর্ণ আসমানে হৃদয় খুলে কেউ তাকায়, দেখা যাবে, সেখানে হাটের রাস্তা কি দেবদারু অ্যাভিনিউয়ের নীল আকাশগগনে ডাকহরকরা স্বাতী তারাটির পাশে সফেদশুভ্র বেশে ফুটে আছে নতুন একটি কালপুরুষ, সদ্য ফোটা তারকা। সেই ‘স্টার’-এর নাম, শেখ মিজানুর রহমান। হয়তো মিজান কাকা আকাশে, ঝিনেদায় ফুটে থাকা অনালোচিত এক তারা।

তো সেই মিজান কাকা কি আদতেই মারা গেছেন? তিনি সত্যিই ‘নাই’ হয়ে গেছেন?
আচমকা প্রশ্নটি কার উদ্দেশে করলাম, জানি না।

তবে জানি, নিশ্চিত জানি, যাঁরা প্রকৃত তারা, যাঁরা আকাশে ঠাঁই নেওয়া তারকা...মাটির পৃথিবীতে তাঁদের এত দ্রুত ‘নাই’ হওয়ার নিয়ম নেই। কারও না কারও হৃদয়ে, পিঞ্জরে; কোনো না কোনো মানবজমিনে সন্তর্পণে আলো হয়ে তাঁরা জেগে থাকেন; এবং থাকবেনও!