উপন্যাসের জন্ম ও প্রধান চরিত্র দন কিহোতের মধ্যস্থতা

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বাইবেলের পরে সবচেয়ে অনূদিত ও পঠিত বই মিগেল দে সেরভানতেস সাভেদরার ‘দন কিহোতে দে লা মানচা’ কিংবা ‘দন কিহোতে’। রচনাটির আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়বস্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বোদ্ধারা। কেননা বিষয়গত কারণেই সোয়া চার শ বছর ধরে তা সারা দুনিয়ার সাহিত্যরসিকের মন জয় করে আসছে। বিশেষ করে আখ্যানের প্রধান চরিত্র খ্যাপাটে দন কিহোতের উদ্ভট, হাস্যকর, অত্যাশ্চর্য ও রোমাঞ্চকর খেয়ালি কর্মকাণ্ডগুলো। সেরভানতেস তাঁর আখ্যানে ‘যুক্তিহীনের যুক্তি’ দিয়ে এমন এক জগৎ উন্মোচন করেন, যা শুধু বিস্ময়কর নয়, আধুনিক ও চিরকালীনও। উদ্ভবের পর থেকে যে জীবন মানুষ যাপন করে আসছে সেই অসহায়ত্ব, প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা, নিয়তির দুর্লঙ্ঘনীয় রহস্য, সম্পর্কের জটিলতা, বৈপরীত্য আর সীমাহীন নির্বোধতা প্রভৃতি নানা মাত্রিকতায় এতে হাজির হয়েছে। তাই সচেতন পাঠকমাত্রই দন কিহোতের দুনিয়ায় নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন, তিনি যে দেশের যে কালের হোন না কেন। এমন সৃষ্টি সেরভানতেসের পক্ষে সম্ভব হয় এই কারণে যে তাঁর কালটা ছিল একদিকে স্পেনের সমৃদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বর্ণযুগ এবং অন্যদিকে কলহ, যুদ্ধ, আত্মম্ভরী ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগও। জীবনাভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও নিজ জীবনের ট্র্যাজেডি থেকেও সারভানতেস জীবনকে এমন নির্মোহভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন—জীবন ও জগৎকে ঠাট্টা-রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, কাহিনি শেষে দন কিহোতের গভীর জীবনোপলব্ধি—একটা গভীর সত্যে পৌঁছানো। স্পেনের অপর বিখ্যাত লেখকেরা, যেমন নাট্যকার লোকে দে ভেগা, কবি ফ্রাই লুইস দে লেওন, কেভোদা প্রমুখ এমন সময় ও অভিজ্ঞতা ফুঁড়েই বেরিয়ে এসেছিলেন। এঁরা সবাই সম্মিলিতভাবে রেনেসাঁর আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবমনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। পুরোনো যুগের ভাঙন এবং নতুন যুগের আবির্ভাবে স্পেন তখন সত্যি দিশাহারা ছিল।

বাইবেলের পরে সবচেয়ে অনূদিত ও পঠিত বই মিগেল দে সেরভানতেস সাভেদরার ‘দন কিহোতে দে লা মানচা’ কিংবা ‘দন কিহোতে’। রচনাটির আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়বস্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বোদ্ধারা। কেননা বিষয়গত কারণেই সোয়া চার শ বছর ধরে তা সারা দুনিয়ার সাহিত্যরসিকের মন জয় করে আসছে।

আখ্যানে দেখা যায়, মধ্যযুগের ইউরোপীয় নাইটদের নিয়ে লেখা শিভালরিক রোমান্স পড়ে নিজের ভেতর এক কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন লা মানচার গ্রামের জনৈক আলোনসো কিহানো। ফলে গরিব এই ভদ্রলোক নিজে নাইট হয়ে ওঠেন একদিন দন কিহোতে নাম নিয়ে। তাই কিহানোর হাড় জিরজিরে ঘোড়াটা হয়ে গেল ডাকসাইটে রোসিনান্তে, বাড়ির পুরোনো পোশাক পেল নাইটদের পরিচ্ছদের মর্যাদা। এটা-সেটা দিয়ে বর্ম, হাত-পায়ের সুরক্ষার কভার, এমনকি শিরস্ত্রাণও জোগাড় হয়ে গেল তাঁর। হয়তো বাড়ির কেউ আগে সৈনিক বা ডাকাত ছিল, তাই সহজে মিলে গেল এত সব। দন কিহোতে একদিকে যেমন ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’ গোছের, অন্যদিকে জীবনে গুটিকয় মানুষ ছিল তাঁর নামমাত্র পরিজন। যেমন উনিশ বছর বয়সী এক ভাতিজি/ভাগনি, চল্লিশোর্ধ্ব এক গৃহপরিচারিকা, মাঠে কাজ করার এক লোক আর দুই বন্ধু: একজন গ্রামের অধস্তন পাদরি, অপরজন এক নাপিত। দন কিহোতের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, আপাত যৌনতায় অনভিজ্ঞ, নিজের ধারণায় নাইটদের শুদ্ধ প্রতিনিধি তিনি। যদিও কাছাকাছি থাকেন এমন এক গাট্টাগোট্টা চাষি মেয়ে আলদোনসা লোরেনসোর দিকে তাঁর বিশেষ নজর আছে। এই নারীকেই দন কিহোতে দুলসিনিয়া দেল তোবোসো নামক জনৈক অভিজাত ও মহীয়সী হিসেবে ভাবতে থাকেন। যিনি আবার তাঁর সুখস্বপ্নের আদর্শ নায়িকা। দন কিহোতে সব ধরনের পাগলামির ঊর্ধ্বে উঠে একসময় পরিচালিত করেন উদ্ভট সব নাইটসুলভ অভিযান।

স্পেনের জাতীয় গ্রন্থাগারের বাইরে সেরভানতেসের ভাস্কর্য
ছবি: উইকিপিডিয়া

দন কিহোতের আবির্ভাবের কারণ ছিল সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, আশপাশের অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান করা—বিশেষত অসহায় মানুষ ও নারীদের সুরক্ষা। কারণ, তিনি মনে করতেন, নাইটদের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির কারণে সমাজে এত দুর্ঘটনা। অথচ এটা দন কিহোতে ভাবেননি যে সে যুগ আর নেই পৃথিবীতে। দিগ্বিজয়ের শুরুতে অর্থাৎ প্রথম অভিযানে তিনি বর্শা উঁচিয়ে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে একদল বণিকের হাতে খেলেন বেজায় মার। অভিযানটি তাঁর একার ছিল; তবে দ্বিতীয় অভিযান থেকে অনুচর হয়ে পড়েছিল ভালো মানুষ ও বাহ্যত বোকাসোকা ধরনের সানচো পানসা—নিজ গ্রামের এক চাষি। অনুচরের পেশায় সানচো দাবি করেছিল সামান্য মাইনে, কিন্তু দন তাকে দিতে চাইলেন পুরোনো এক দ্বীপের জমিদারি। লোভে কুপোকাত হলো সানচো, আর পিছু ধরল মনিবের নিজের গাধাটা নিয়ে। দনের প্রতিটি অভিযান পাঠকের চোখে মামুলি ও হাস্যকর হলেও নিজের কাছে ছিল রোমহর্ষক, অভূতপূর্ব ও নিদারুণ। লড়াইগুলোও ছিল মানুষকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা, মানুষকে মুক্তি দেওয়ার মতো মহৎ কাজে। তবে প্রতিটি অভিযানে ব্যর্থ হলেন তিনি; সানচোসহ বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হলেন, পরাজয় বরণ করলেন। কিন্তু দমেননি কখনো, বরং সব সময়ে মনে করেছেন একজন মহান নাইটের জীবনে যা ঘটে, তা-ই ঘটছে তাঁর জীবনে। দন কিহোতের ধারণা ছিল, পূর্বসূরিদের চেয়ে যত বেশি তিনি আঘাত পাবেন, তত সুনামের ভাগী হবেন। তাঁর চোখে হাওয়া—কলের ভয়ংকর ও অকল্পনীয় লড়াইয়ে সফলতা নিজ জীবনের বড় অর্জন। এমনকি এই বিশ্বাসও তাঁর মনে রয়েছে যে অসমসাহসী তিনি নিতান্ত কম ঝুঁকি নিয়ে একেকটা অভিযানে যে বিজয় আনেন, তা কখনো বিশ্ববিখ্যাত নাইটরাও পারেননি।

অবশেষে এক প্রতিবেশী হিতৈষীর দয়া হয়, দন কিহোতেকে তিনি থামালেন এবং রক্ষা করলেন। আরেক নাইটের ছদ্মবেশ ধারণ করে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাস্ত করলেন দনকে, শর্তানুযায়ী তাঁকে এবার গ্রামে ফিরতে হবে। আদর্শ নাইট হিসেবে দন তাঁর কথা রাখলেন, সানচোকে নিয়ে ফিরলেন নিজ গ্রামে। ভালোই হলো নাইটের জন্য—এবার থেকে ভেড়া চরাবেন দুজনে। কিন্তু বিধি বাম, অসুস্থ হয়ে পড়লেন দন। অবশেষে পাদরি ও অন্যদের সামনে স্বীকারোক্তিও দিলেন; নাইটদের ওপর বই পড়ে তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল, এখন বোধশক্তি ফেরত পেয়েছেন। পরে মৃত্যুপথযাত্রী দন উইল করে সানচোকে কিছু অর্থ দিলেন, ভাতিজি/ভাগনিকে দিলেন সব সম্পত্তি। তবে তাতে শর্ত জুড়ে দিলেন একটা—এমন লোককে বিয়ে করতে হবে তার, যে কখনো নাইটদের নিয়ে লেখা বই পড়েনি। নয়তো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।

অভিযানে ব্যর্থ হলেন তিনি; সানচোসহ বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হলেন, পরাজয় বরণ করলেন। কিন্তু দমেননি কখনো, বরং সব সময়ে মনে করেছেন একজন মহান নাইটের জীবনে যা ঘটে, তা-ই ঘটছে তাঁর জীবনে। দন কিহোতের ধারণা ছিল, পূর্বসূরিদের চেয়ে যত বেশি তিনি আঘাত পাবেন, তত সুনামের ভাগী হবেন।
১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘দন কিহোতে’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
ছবি: উইকিপিডিয়া

এই হচ্ছে দন কিহোতের সংক্ষিপ্ত কাহিনিসূত্র; আর এর ভেতরে রয়েছে নানা ঘটনা, চরিত্র ও বিচিত্র সব বিষয়ের বিস্তার। লেখক এসবের ভেতর দিয়ে নিজের যা বক্তব্য, তা বলে দিয়েছেন অতি কৌশলে। অবশ্য সেরভানতেসের যা কিছু বক্তব্য, তার অভিমুখও সেই দন কিহোতে—দনের ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখেছেন কিংবা দেখিয়েছেন। দন কিহোতেকে তাঁর মানসপুত্র হিসেবে অভিহিত করে বইয়ের ভূমিকাতে লিখেছিলেন, ‘আমার বন্ধ্যা এবং অসংস্কৃত মস্তিষ্ক থেকে জন্ম নিয়েছে এক মানসপুত্র, যে কাঠখোট্টা, অবাধ্য, আহাম্মক এবং অসুন্দর; এর জন্ম হয়েছে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে, যেখানে শুধুই রিক্ততা আর বিষণ্ন চিৎকার।’ আসলেও দন কিহোতের জন্ম হয়েছে সেরভানতেসের জীবনের অন্ধকার সময়ে, কেননা বছর দুয়েক তাঁকে কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল। এ সময়ে তিনি কারাকুঠরির আলোছায়া ও নিঃসঙ্গতায় জীবনকে অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে। মানবচরিত্রের গভীর অন্তরাল পর্যবেক্ষণে মগ্ন ছিলেন—তার ফল এই দন কিহোতে। সুতরাং সাধারণ দৃষ্টিতে দন কিহোতের মধ্যে যে সরলতা কিংবা নির্বোধতা দেখা যায়, তা ছদ্মাবরণমাত্র, অন্তরালে রয়েছে বুদ্ধির চমক ও জীবনের গূঢ় সত্য।

স্পেনে জনপ্রিয় ভ্রাম্যমাণ নাইটদের ওপর লেখা বইয়ে সত্যমাত্র কিছু ছিল না; তা ছিল নাইটদের নিয়ে যত কাল্পনিক ও অলীক উপাখ্যানে ভরপুর। অথচ শিভালরিক রোমান্সের কতই না প্রভাব ছিল সাধারণ মানুষের ওপর। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় মনের ভেতরে একটা কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করে বসবাস করছিল, আর আত্মগৌরব ও আস্ফালনপূর্ণ জীবনের অধিকারী হয়ে উঠেছিল। তখন স্পেনের জাতীয় চরিত্রও ছিল তেমন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে সেরভানতেস তাই প্রহসনমূলক রচনাটি লিখেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় জীবনে এই সত্য উপস্থাপন করা যে জীবন কল্পনার সমষ্টি নয়, তা বাস্তব। কর্মের ভেতর দিয়ে জীবনকে নির্বাহ করতে হয়, আর এটাই জীবনের মহত্ত্ব। অন্যদিকে সৎকর্মের জন্য দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে হয় না, মানুষের নিত্যকার কাজের মধ্যে এবং তার আশপাশে কর্তব্যকর্মে মহত্ত্বের বিপুল উপস্থিতি বিদ্যমান। তাই গল্পাকারে সেরভানতেস তাঁর মানসপুত্রকে এমনভাবে হাজির করতে চাইলেন, যাতে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিষণ্ন মানুষ যেন হাসতে পারে। আরও যা চাইলেন—দন কিহোতেকে দেখে সরল মানুষ যাতে ক্রুদ্ধ না হয়, বুদ্ধিমান মানুষ যেন তারিফ করে, গম্ভীর মানুষ যেন অবজ্ঞা না করে আর সুবিবেচক মানুষ যেন এর প্রশংসা করে। দন কিহোতে হলেনও তা-ই—সেরভানতেসের প্রজ্ঞাজাত সরস এক সৃষ্টি।

সেরভানতেস দেখালেন, দন কিহোতের মূল সমস্যা হচ্ছে অজ্ঞতা—নিজেকে তিনি জানেন না। জানেন না বলে তাঁর পাগলামি কিংবা যত নির্বোধতা; আর এ জন্য তাঁকে কম ভোগান্তির শিকারও হতে হয়নি। হবেন না কেন? যাঁর চোখে হাওয়া-কল রূপান্তরিত হয় দৈত্যে, মেষপাল পরিণত হয় যুযুধমান সেনায়, চাষিকন্যা হয়ে ওঠে অভিজাত নারী—তাঁর পক্ষে বাস্তবকে মোকাবিলা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। তাই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নাইট সেজে কী কাণ্ডই না ঘটল একেকটা অভিযানে। যেমন সরাইখানার উঠানে খচ্চরওয়ালা বর্শার ডান্ডা দিয়ে বেহুদা পিটুনি দিল বাতুল বীরপুরুষটিকে, চাষির ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে মুটেদের হাতে মার খেতে হলো বেদম, হাওয়া-কলের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যাপক পিটুনিতে পতন, পুরুত ও তাদের সহচরদের সঙ্গে লড়াইয়ে কাঁধে আঘাত পেয়ে অর্ধেক কান খোয়ানো, রোসিনান্তের দুর্দশা ঘোচাতে গিয়ে একদল বাহক কর্তৃক মারধর খেয়ে সানচোসহ মাটিতে তক্তা হয়ে যাওয়া, সরাইখানায় জনৈক রাজপুরুষের দ্বারা নিগৃহীত এবং টাকা না দিয়ে সরাই থেকে পালাতে গিয়ে প্রহার, ভেড়ার পালে আক্রমণ করে মেষপালক দ্বারা প্রহৃত, রাজসেনাদের সঙ্গে খামোখা লড়াইয়ের পর পাথর নিক্ষেপে জর্জরিত, এক পাগলের হাতে প্রভু-ভৃত্যের বেপরোয়া ঠ্যাঙানি ইত্যাদি দুর্বিষহ ঘটনার ইয়ত্তা নেই দন কিহোতের জীবনে। এসব ঘটনার মূলে দেখা যায় নায়কের অজ্ঞতা, অহংবোধ আর যত অন্ধবিশ্বাস। প্রায় প্রতিবার দনকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে, কিন্তু নিজের আত্মগৌরবে নিবৃত্ত হননি কখনো।

গল্পাকারে সেরভানতেস তাঁর মানসপুত্রকে এমনভাবে হাজির করতে চাইলেন, যাতে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিষণ্ন মানুষ যেন হাসতে পারে। আরও যা চাইলেন—দন কিহোতেকে দেখে সরল মানুষ যাতে ক্রুদ্ধ না হয়, বুদ্ধিমান মানুষ যেন তারিফ করে, গম্ভীর মানুষ যেন অবজ্ঞা না করে আর সুবিবেচক মানুষ যেন এর প্রশংসা করে। 

তাহলে তখন অজ্ঞতার অন্ধকারে কি নিমজ্জিত ছিল স্পেন বা ইউরোপ? দন কিহোতেকে তাই হাজির করেন একটা প্রকল্প আকারে সেরভেনতেস? হতেও পারে এই মার খাওয়ার ভেতর দিকে একদিকে প্রবল অজ্ঞতা ও অহং, অন্যদিকে ইউরোপীয় বর্বরতার চরম প্রকাশ। সেরভানতেস তাঁর কালের সাক্ষী ছিলেন—স্পেন ও ইউরোপের লোক হিসেবে ইউরোপের চরিত্র দেখেছেন কাছ থেকে। নিজ চোখে দেখেছেন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান—বিভিন্ন জাতিকে শাসন করার নামে ইউরোপের লুটপাটের স্বরূপ। দুর্বলকে বেহিসাবি পেটানো যাবে, অপরের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া যাবে, আর শক্তিমত্তায় সবকিছু দখল ও প্রতিষ্ঠা করা যাবে—এই হলো সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি। তখন স্পেনীয় সাম্রাজ্যও বিস্তৃত হচ্ছে, আর তার অন্তরালে দখল, রক্তপাত, ধর্ষণ, লুটপাট চলছে—শনৈ শনৈ করে বাড়ছে আধিপত্যবাদ। এখানে কোনো ন্যায়-অন্যায় নেই, নীতি-নৈতিকতা নেই, শুভ-অশুভ নেই। আধুনিকার উন্মেষে এ ছাড়া ইউরোপজুড়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন রূপ পাচ্ছিল, যেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, গণতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি তাতেও জারি থাকল পুরোনো আদর্শ। সেরভানতেস দেখলেন উন্নতি বা সমৃদ্ধি হচ্ছে ঠিক, তবে তা হিংস্রতার রকমফের কিংবা বলপ্রয়োগের মতাদর্শ নবায়নের মাধ্যমে। আদপে তাতে গির্জা, রাজতন্ত্র, প্রশাসন, সেনাবাহিনী প্রভৃতির ব্যাপক প্রভাব ও আধিপত্য। লুটপাটের যুদ্ধে সেরভানতেসও অংশগ্রহণ করেছিলেন হোলি লিগের হয়ে, একখানা হাতও হারিয়েছিলেন তিনি। উপলব্ধি করেছিলেন হিংসা ও লোভ চতুর ইউরোপের মনে জেঁকে বসে আছে, আর তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন ব্যাপার।

অন্যদিকে ইউরোপীয় অজ্ঞতার রকমফের এবং নিজে অসভ্য ও বর্বর থেকে অন্যকে সভ্য করার দায়িত্ব পালনের মতো হঠকারিতা দেখে সেরভানতেস কিংবা তাঁর মতো বিদগ্ধরা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন তখন। অথচ ইউরোপের রয়েছে দীর্ঘদিনের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও কর্মভিত্তিক মানবিক ঐতিহ্য। তাই চলমান উন্মাদনা ও অহংকারের দুর্গে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে আঘাত হানাকে উপযুক্ত কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। সুতরাং প্রয়োজন এমন একটি চরিত্র এবং তার প্রতিপক্ষ নির্মাণ করা, যাতে নিজ জাতি ও গোটা ইউরোপ আপনাকে দেখতে পায়। এই প্রেক্ষাপটে দন কিহোতে সেরভানতেসের বিদগ্ধ মনের এক ঠাট্টা বটে। এমন বিদ্রূপ যে, শত্রুনিধনকে একপ্রকার স্বার্থত্যাগের কাজ হিসেবেও চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। আবার, সানচো পানসার মুখে দন কিহোতে একবার শুনলেন যে কিছু দোষী ব্যক্তিকে রাজা জোর করে একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। শোনার পর দন কিহোতে দুঃসাহসিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা কি সম্ভব? রাজা কারও ওপর জোর করতে পারে?’

সেরভানতেসের ঠাট্টা শুধু জাতি–চরিত্রের প্রতি ছিল না, ছিল শিভালরিক রোমান্সের প্রতিও। কারণ, এ ধরনের রচনা যুবসমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করতেন। তাই অলীক ও কল্পনার বিপরীতে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন যা কিছু বাস্তব ও সত্য; যদিও শিলাভরিক উপাদান দিয়ে সেরভানতেস পাঠককে দিয়েছেন সূক্ষ্ম ধোঁকাও। এই ধোঁকার মধ্যেই জন্ম হয় আধুনিক আখ্যান বা উপন্যাসের, যা নয়া যুগের শিল্প। কে না জানে উপন্যাসের জন্ম হয়েছে সেরভানতেসের হাত ধরেই—‘দন কিহোতে’র মাধ্যমে। শেক্‌সপিয়ার হ্যামলেট চরিত্রে অন্তর্দ্বন্দ্ব আরোপ করে যেমন আধুনিক মানুষের চিত্তের ভিত্তি স্থাপন করেন, একইভাবে রোমান্স পড়ে কল্পনার জগতে বিচরণকারী দন কিহোতে চরিত্রকে গ্রামের বাইরে এনে যে বাস্তব পৃথিবীতে ছেড়ে দিলেন, সেটিও এক আধুনিক পৃথিবী। শিভালরিক রোমান্সের কল্পকাহিনির বিপরীতে দন কিহোতেতে সেরভানতেস হাজির করেন অসভ্য-নৃশংস ইউরোপের বাস্তব রূপ। সতেরো শতকে দন কিহোতে হাস্যকর বলে পরিগণিত হলেও ‘এজ অব সেনসিবিলিটি’র যুগে এসে তিনি জ্ঞান ও সূক্ষ্মচিন্তার উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন।

চলমান উন্মাদনা ও অহংকারের দুর্গে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে আঘাত হানাকে উপযুক্ত কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। সুতরাং প্রয়োজন এমন একটি চরিত্র এবং তার প্রতিপক্ষ নির্মাণ করা, যাতে নিজ জাতি ও গোটা ইউরোপ আপনাকে দেখতে পায়। এই প্রেক্ষাপটে দন কিহোতে সেরভানতেসের বিদগ্ধ মনের এক ঠাট্টা বটে।

সূক্ষ্মতাই দন কিহোতের মূল বিষয়। তাই দেখা যাবে, ঠাট্টা-মশকরার ভেতর দিয়ে একটা স্থির আদর্শ নিয়ে কঠোর বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়াই সেরভানতেসের। আদর্শবাদী ছিলেন দন কিহোতেও, যা তাঁর অনুচর সানচো পানসার মধ্যে ছিল না। এ ছাড়া দন কিহোতে ছিলেন কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা, আর সানচো পানসা বাস্তবজগতের মানুষ। অর্থাৎ বিপরীত পেশার এবং বিপরীত মানসের দুই চরিত্র দিয়ে পরিচালনা করলেন সেরভেনতেস তাঁর অভিযান। অবশ্য এই বৈপরীত্যের সঙ্গে মিলে যায় সমকালীন স্পেনের বিপরীত আদর্শের দুই গোষ্ঠী-চরিত্র। একটি গোষ্ঠী ঔপনিবেশিকতার তোষক—স্পেনের বহিঃশত্রুর দ্বারা পরাজয়ের গ্লানি দিয়ে উদাসীন—এরাই আবার নিজের মহানতা নিয়ে স্ফীত ও গর্বিত। অন্যদিকে খেটে খাওয়া কৃষক সম্প্রদায়, যারা নিষ্পেষিত এবং সাম্রাজ্যের গৌরব দেখিয়ে অপর পক্ষ তাদের নিঃস্ব করে নিচ্ছে দিনের পর দিন। এই সূক্ষ্মতা অনুধাবন করতে না পারলে দন কিহোতেও শিভালরিক রোমান্সের গণ্ডিতে আটকা পড়ে যেতে পারে পাঠকের কাছে। কিন্তু বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে সেরভানতেসের শ্লেষ ও ব্যঙ্গ ঢাকা পড়ে না।

সেরভানতেস বাস্তববাদের স্রষ্টাদের একজন; তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র দন কিহোতেকে তাই নিজের আদলে গড়ে তুলেছেন। যদিও আখ্যানে কখনো তিনি একাত্ম, কখনো-বা নিরাসক্ত ছিলেন। একপর্যায়ে অপর চরিত্র বেনেনগালির জবানিতে বলেছেন, ‘আমার জন্যই দন কিহোতে জন্ম নিয়েছিল এবং আমিও তার জন্য জন্ম নিয়েছি। সে জানত কীভাবে ভূমিকা পালন করতে হয়, আমি জানি কীভাবে লিখতে হয়। আমরা দুজনে এক।’ অবশ্য আখ্যানের শেষে এসে তাঁরা দুজনে এক হয়ে গিয়েছিলেন। দেখা যায়, দন কিহোতের অধিবিদ্যক বাসনা পরিণত হয় জীবনের সত্যে। এই রূপান্তর সেরভানতেসের ঠাট্টাকে মহৎ করে তোলে।

সেরভানতেসের জীবনদর্শনের মূলে ছিল জীবন ও সত্যের উপলব্ধি; তাঁর কাছে জীবন ও সত্য বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না। তবে সত্য অনুসন্ধানের বিষয়, তাই তিনি দন কিহোতেকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলেন এবং চরম জীবনাভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এবং দর্শনের কষ্টিপাথরে সত্যের কাছে পৌঁছালেন যখন দন মৃত্যুর মুখোমুখি। দন কিহোতে স্বীকারোক্তি দেন এই বলে, ‘এখন আমার বিচার-বুদ্ধি স্বচ্ছ এবং স্বাধীন, তার ওপর থেকে অজ্ঞতার আচ্ছাদন সরে গেছে।...তবে তার জন্য আমাকে মূল্য দিতে হয়েছে আমার জীবন দিয়ে।’ ঠাট্টার জমকালো সমাবেশ ছাড়া এই সত্য প্রকাশের সুযোগ হয়তো সেরভানতেসের কালে ছিল না।