সমকালীন কবিতা যেভাবে উঠে এল সঞ্জীবের কণ্ঠে

সঞ্জীব চৌধুরী [২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪–১৯ নভেম্বর ২০০৭]গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সঞ্জীব চৌধুরীকে চেনেন অথচ তাঁর ‘এই নষ্ট শহরে/ নাম না জানা যে কোনো মাস্তান’ গানটি শোনেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। একটা সময় ঢাকাসহ সারা দেশে পাড়াভিত্তিক মাস্তানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এখনো নেই, তা বলা যাবে না, তবে সঞ্জীবের এই গানের দৃশ্যকল্প মুহূর্তেই আমাদের নিয়ে যায় এক নস্টালজিক সময়ে। ’৯০–এর দশকের শুরুর দিকে বিটিভিতে যাঁরা হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথা কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে বাকের ভাই চরিত্রটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয় গানটির সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারবেন।

তবে কি নাটকটি থেকে বা ওই সময়ের পাড়াভিত্তিক মাস্তানি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই সঞ্জীব গেয়েছিলেন, ‘সকালে ঠিক খিস্তিখেউড় রাজা-উজির মেরে/ মাস্তানি সব সেরে/ বিকেল বেলা তোমার বাড়ির লাগোয়া পথ ধরে/ যাচ্ছে যখন ফিরে/ ভুলে না হয় দিয়েছিল শিস’?—মোটেও নয়। গানটির জন্ম আরও আগে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় নিজের লেখা গানটি গেয়েছিলেন কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার। আন্দোলনে তো কত গান তৈরি হয়! জমা পড়ে হাজারও স্মৃতি। সেই স্মৃতির কথা শোনা যাক ফরহাদ মজহারের কণ্ঠে—‘সঞ্জীব আমার এই গানটি (এই নষ্ট শহরে) শুনেছিল, ইউনিভার্সিটির সামনে আমি গাইছিলাম এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন ওর গানটি ভালো লেগেছে। সঞ্জীব আরও গান চেয়েছে, আমি আর দিই নাই।’

ফরহাদ মজহার কেন সঞ্জীব চৌধুরীকে আর লিরিক দেননি, সে আলাপ ভিন্ন। তবে তরুণদের মুখে মুখে ফেরা এই গান সারা দেশের মানুষের শোনার সুযোগ হয়েছে আরও পরে। ২০০২ সালে রিলিজ হয় ‘দলছুট’ ব্যান্ডের তৃতীয় অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’। সেই অ্যালবামে জায়গা করে নেয় ‘এই নষ্ট সময়ে’। এই লিরিকটি মজহারের কোনো কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়নি। গানটি জনপ্রিয় হওয়ার পর একটি গুঞ্জন ওঠে যে এটি নাকি ‘ফেনীর গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারীকে নিয়ে রচিত। তবে এই গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন, জয়নাল হাজারীর সঙ্গে ‘এই নষ্ট সময়ে’ গানের কোনো সম্পর্কই নেই।

সঞ্জীব চৌধুরীর আরেকটি মাস্টারপিস ‘বয়স হলো সাতাশ’। কীভাবে লেখা হলো এই গান? লিখেছেনই–বা কে? ২০০৫ সালে রিলিজ হওয়া সঞ্জীবের একমাত্র একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’ বাংলা গানের ধারায় অনন্য এক সংযোজন। ষাটের দশকের অন্যতম কবি ফরহাদ মজহারের লিরিক নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি সঞ্জীব সুর বসাতে সমকালীন কবিদের কাছ থেকেও চেয়ে নিয়েছেন লিরিক বা কবিতা। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘জলরংপদ্য’। সেই বইয়ের দীর্ঘ এক কবিতা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ‘বয়স হলো সাতাশ’।

আনিসুল হক
সৌজন্যে: প্রথমা

আনিসুল হকের এই একটি গানই করেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। ছিলেন দুজন সহকর্মী। কীভাবে সৃষ্টি হলো এই গান, সেই কথা শোনা যাক আনিসুল হকের কাছে—‘সঞ্জীব চৌধুরী আমার সহকর্মী ছিলেন। আমরা ভোরের কাগজে একসঙ্গে কাজ করতাম। আজকের কাগজেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। উনি টেবিল চাপড়ে গান করতেন। তখন সেটা ১৯৯১ সাল। আমাদের যখন গান শুনতে ইচ্ছে হতো, আমরা তাকে বলতাম, সঞ্জীবদা গান করেন। এরপর জলরংপদ্য নামে আমার একটা কবিতার বই বের হয়, ১৯৯৫ সালের পর। ওখানের “বয়স হলো সাতাশ”... ওটা অনেক বড় কবিতা। কবিতাটা যখন সঞ্জীবদা দেখলেন, বললেন, আপনার কবিতাটা দেন গান করি। খুব খুশির খবর, সঞ্জীব চৌধুরী গান করবেন। তত দিনে তাঁর অ্যালবাম বের হয়েছে, অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছেন।’

এই অ্যালবাম প্রকাশের দুই বছর পর ১৯ নভেম্বর মাত্র ৪২ বছর বয়সে থেমে যায় সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠ। শারীরিক সমাপ্তি ঘটে নগরের এক বোহেমিয়ান সুরের জাদুকরের। মৃত্যুর দিন চারেক আগে স্ট্রোক করে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আর ফিরে আসেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, আজিজ মার্কেট, পত্রিকা পাড়ায় ‘ঘুরিয়া ঘুরিয়া/ সন্ধান করিয়া’ স্বপ্নের ওই পাখি ধরতে চাওয়া সঞ্জীব চৌধুরী। স্বপ্নবাজি অ্যালবামের দীর্ঘ লিরিকটি লিখেছিলেন নিজেই। কবি না হলে কি এমন লেখা যায়! সত্যিও তা–ই, সঞ্জীব চৌধুরী নিজেই ছিলেন কবি। করেছেন ছোটকাগজ সম্পাদনা। ১৯৮৩ সালে সম্পাদনা করেন ‘মৈনাক’। আশির দশকে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের হাওয়া বেশ জোরেশোরে বইতে শুরু করে। সে সময়ের অনেক ছোটকাগজেই কবিতা লিখেছেন তিনি। একাধারে কবি, গল্পকার, সংস্কৃতিকর্মী, গায়ক, সুরকার, অভিনেতা, সাংবাদিক—আমাদের ভূমিতে এমন বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় বেশ বিরল। তাঁর কণ্ঠে প্রেম, বিরহ, সমকালীনতা যেমন খেলে গেছে তেমনি এসেছে বিদ্রোহের কথাও। ছেলেবেলা থেকেই যে জড়িয়ে পড়েছিলেন গান আর বামপন্থী রাজনীতিতে!

শুধু ষাট দশকের ফরহাদ মজহার বা আশির কবি আনিসুল হকের গানই করেননি সঞ্জীব। ’৯০–এর দশকের আরও বেশ কয়েকজন কবির কবিতা ও লিরিক নিয়ে কাজ করেছেন। নিজেও লিখেছেন ‘সমুদ্রসন্তান’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘জোছনাবিহার’, ‘ভরদুপুর’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকে বলে দেব’সহ অসংখ্য শ্রোতৃপ্রিয় গান।

গানের জগতের পাশাপাশি ’৮০-’৯০ দশকের কবিদের সঙ্গে সঞ্জীবের ছিল দারুণ সম্পর্ক। সে সময় সাহিত্যের তীর্থস্থান হয়ে ওঠা আজিজ মার্কেটে আড্ডা দিতেন তিনি। সে আড্ডায় কে আসতেন না? আহমদ ছফা থেকে মারজুক রাসেল—এখানেই তো সতীর্থ বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে দলছুট ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ। দুজনের ব্যান্ড। সেই ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ্’ প্রকাশিত হয় পরের বছর। এমনিতে ছিলেন প্রচারবিমুখ। তার মধ্যে অ্যালবাম প্রকাশিত হলেও খুব একটা প্রচারণায় যাননি। তারপরও মোস্তফা জামানের লেখা ও সঞ্জীবের গাওয়া ‘সাদা ময়লা রঙিলা পালে’ গানটি বেশ শ্রোতৃপ্রিয় হয়। নিজস্ব এক গায়কি ছিল সঞ্জীবের। ব্যান্ডের ভেতর থেকেও ছিলেন ঝংকারবিহীন। একটু নাকি সুরের স্পষ্ট কণ্ঠে পপের পাশাপাশি গণসংগীতও গেয়েছেন তিনি।

২০০০ সালে প্রকাশিত হয় দলছুটের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘হৃদয়পুর’। এই অ্যালবামও দারুণ সফল। শাহ আবদুল করিমের গান ‘গাড়ি চলে না’ নতুনভাবে ধরা দেয় সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠে। ২০০২ সালে আসে তৃতীয় অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’। এই অ্যালবামে তিনজন কবির কবিতা ও লিরিক থেকে গান করেছেন সঞ্জীব। ফরহাদ মজহারের ‘এই নষ্ট সময়ে’র কথা তো আগেই বলেছি। সঙ্গে ছিল ’৯০–এর দশকের কবি কামরুজ্জামান কামুর ‘হৃদয়ের দাবি’ ও ‘বায়োস্কোপ’। এ ছাড়া ছিল আশির দশকের কবি সাজ্জাদ শরিফের ‘ছুরিচিকিৎসা’। সঞ্জীব ও বাপ্পার যুগলবন্দীতে ‘বায়োস্কোপের নেশা’ আজও যেকোনো আড্ডায় বেজে ওঠে।

সাজ্জাদ শরিফ
সৌজন্যে: প্রথমা

২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় সাজ্জাদ শরিফের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ছুরিচিকিৎসা’। নামভূমিকার কবিতাটি লেখা আরও আগে—১৯৮৭ সালে। প্রথম প্রকাশ ছোটকাগজ ‘গাণ্ডীব’-এ। কবিতার শুরুটা এমন, ‘কেটে নেয়া মাথা, রক্তের ফোঁটা,/ পিরিচে দু চোখ নড়েচড়ে ওঠে’। কোনো প্রকার শব্দের সংযোজন–বিয়োজন ছাড়াই কবিতাটি সুর করেন সঞ্জীব। কবিতা ও গীতিকবিতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কবিতা অবিকৃত রেখে সুরারোপ করা খুব কঠিন। এই গানে সেই কঠিন কাজ করেছেন সঞ্জীব।

সঞ্জীবের মৃত্যুর বছরে আসে দলছুটের চতুর্থ অ্যালবাম ‘জোছনাবিহার’। এই অ্যালবামের নামভূমিকার গানটি লেখেন সঞ্জীব নিজেই, গেয়েছেন বাপ্পা। অন্যান্য গানের মধ্যে আছে কামরুজ্জামান কামুর লেখা ‘হাতের পরশ’ ও শূন্য দশকের কবি শুভাশিস সিনহার ‘ভালো লাগে না’। দুটি গানই গেয়েছেন সঞ্জীব। ‘হাতের পরশ’ গানটি এমন—‘হাতের উপর হাতের পরশ রবে না রবে না/ আমার বন্ধু আমার বন্ধু হবে না হবে না’। সঞ্জীব গানটিতে সুর বসিয়েছেন দ্রুতলয়ের। তবে কামুর নিজের গাওয়া গানটি ধীরলয়ের।

দলছুট বা একক অ্যালবামের বাইরেও সঞ্জীবের বেশ কিছু গান ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় মিক্সড অ্যালবাম ‘বহুরূপী’। সেই অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, পার্থ বড়ুয়ার পাশাপাশি ছিল সঞ্জীবের গান ‘কালো পাখি’। ’৯০–এর দশকের কবি জাফর আহমদ রাশেদের লেখা—‘কালা পাখি শোন তোর/ চোখ কান কিছু নাই,/ মনেরও ভেতরে মাঝি/ তোমার রাঙা নাও বায়’ থেকে এই গান।

এ ছাড়া কামরুজ্জামান কামুর লেখায় আরেকটি গান করেন সঞ্জীব। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘ব্যাচেলর’। সেই সিনেমার অনেক গানের মধ্যে কামুর লেখা ও সঞ্জীব–বাপ্পার গাওয়া ‘তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও’ গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

সঞ্জীবের স্বভাবই ছিল এমন—কারও কোনো কবিতা বা লিরিক পছন্দ হলে বসে পড়তেন সুর দিতে। যেন সারা দিন সুরে নিমগ্ন হয়ে থাকতেন তিনি। স্বপ্নবাজি অ্যালবামে বেশ কয়েকজন কবির সম্মিলন ঘটান তিনি। রয়েছে ’৯০–এর দশকের আরেক কবি টোকন ঠাকুরের লেখা একটি গান—‘হাওয়া’। ‘হাওয়ারে তুই বাজা নূপুর/ হাওয়ারে তোর পায়ে ঘুঙুর’— কীভাবে সঞ্জীবের জন্য এই গান লেখা হলো? সেই কথা জানতে চাইতেই স্মৃতির দরজা খুলে দিলেন টোকন ঠাকুর, ‘একসঙ্গে (সঞ্জীবের সঙ্গে) মেশামেশি, একসঙ্গে চলাফেরার জীবন ছিল অনেক বছর। তো একদিন বললেন, আমার প্রথম অ্যালবাম বের করব, প্রত্যেকের একটা করে লিরিক নেব। সেভাবে আমার কাছেও চাইল, আমি দিলাম।’

সেই প্রত্যেকের মধ্যে কারা কারা ছিলেন? টোকন ঠাকুর বললেন, ‘কামু, আমি, সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হক, জাফর আহমদ রাশেদ, সঞ্জীব চৌধুরীর নিজের একটা। উনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন, রাসেলের (রাসেল ও’নীল) একটা… তারপরে মারজুক রাসেলের একটা।’ এই অ্যালবামে কামরুজ্জামান কামু লিখেছেন, ‘রিকশা’ ও ‘নেশা’ গান দুটি। ঢাকা শহরে যখন কোনো নারীকে নিয়ে বিমানের গতিতে রিকশা ছুটে যায় এখনো হয়তো কেউ কেউ গেয়ে ওঠে এই গান, ‘রিকশা কেন আস্তে চলে না’। এই অ্যালবামের ‘একটি চোখের কাজল’ গানটি লিখেছেন জাফর আহমদ রাশেদ। জয় শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনামা’র ডিস্কোগ্রাফি মতে, মারজুক রাসেলের লেখা কোনো গান করেননি সঞ্জীব। তবে হাসান মাসুদের ‘হৃদয়ঘটিত’ অ্যালবামের জন্য মারজুকের লেখায় সুর করেছেন।

কবিতা থেকে গান অনেকে গেয়েছেন। ওপার বাংলার কবীর সুমন, বাংলাদেশের জেমস, আইয়ুব বাচ্চ ও পার্থ বড়ুয়াও কবিতা থেকে অনেক পঙ্ক্তি নিয়ে গান করেছেন। তবে সঞ্জীব চৌধুরীর মতো আর কেউ এত কবিকে একসঙ্গে জায়গা দেননি গানে। সমকালীন কবিতাকে ছুঁয়ে দেখেননি এতটা। সেই কারণে হয়তো আজও মানুষের মুখে ফেরে সঞ্জীবের এসব গান।