কাফকার পৃথিবী ও তার লুকানো বিদ্রুপ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ফ্রানৎস কাফকাকে নিয়ে সবচেয়ে মোক্ষম ভাস্কর্যটি আছে প্রাগের ওল্ড টাউন আর ইহুদি কোয়ার্টারের একদম মাঝামাঝি জায়গায়। মাথাবিহীন একটা দেহের কাঁধে বসে আছেন মাথাওয়ালা কাফকা। ক্লান্ত চোখ। ডান হাতের তর্জনী কিছু নির্দেশ করছে।

ইয়ারোস্লাভ রোনার এই ভাস্কর্যটির অবস্থান খেয়াল করার মতো, যা একসঙ্গে ধারণ করেছে কাফকার দ্বৈততা ও দ্বিধার মনস্তত্ত্ব; পরিবার ও সমাজের প্রতি এক রকমের দায়বদ্ধতার বিপরীতে তার বিচ্ছিন্নতার ভারী বোধ। রোনা নির্মিত ভাস্কর্যটির কাছেই এক ধারে আছে স্প্যানিশ সিনেগগ, যেমন আরেক পাশে চার্চ অব দ্য হোলি স্পিরিট। দুটি কথোপকথন নামে লেখকের একটি ছোটগল্প থেকে অনুপ্রাণিত এই ভাস্কর্য আসলে তার নায়কদের নিয়ে আমাদের প্রচল ধারণাকেই ইশারা করে: সমাজ ও সিস্টেমের ইঁদুরধরা কলে ফেঁসে যাওয়া ভঙ্গুর সব মানুষ, যাদের জগৎ ধূসর ও মাথায় ব্যাপক যন্ত্রণা দৃশ্যত মাথাকেই গায়েব করে দিয়েছে, আবার চাকুরে জীবন তাকে দিয়েছে দায়িত্ব, নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য মাথা না থাকুক, সমাজের আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাই তাদের আরেকটি সত্তার অনুগত মাথা বহাল না থাকলে চলে না।

আমাদের অতি সিরিয়াস পাঠে, অতি পাঠে, অতিরিক্ত গবেষণায় কাফকা হয়তো প্রায় ছিবড়ে হয়ে গেছেন। তবু তিনি আজও প্রাসঙ্গিকতা হারাননি। বরং এই মিম কালচার ও গুজবের পৃথিবীতে আমাদের গ্লানি শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে যেই কালো কৌতুক ও অবিরাম বিদ্রুপের স্রোত—প্রায় একশ বছর ধরে পঠিত হতে থাকা জার্মানভাষী লেখক হয়তো তার লেখায় ডেডপ্যান কমেডির আবরণে ভারিক্কি কিছু নয়, বরং লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন জীবন নিয়ে আরও গভীর বিদ্রুপের ইশারা। একটু ভিন্নপাঠের চেষ্টা করলে তা ধরা যেতে পারে, যে, কাফকা হয়তো অত সিরিয়াসও নন, তার অস্বস্তিকর লেখাগুলো এক ধরনের রম্যই, জীবনের উপায়হীনতার প্রতি ছুড়ে দেওয়া বাঁকা হাসি।

মানুষ সিস্টেমের নিষ্পেষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নানান উপায়ে লড়াই করে। প্রতিবাদ, সমালোচনা, গোষ্ঠীগত লড়াই। কিন্তু যখন সে উপায়ও তার থাকে না, সে করে আত্মবিদ্রুপ। যেমন, এখানে বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে মানুষ নিজেও এক সময় বর্ণবাদিতে পরিণত হয়ে যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে আবিষ্কার করে সে নিজেই আর ভিন্নমত সহ্য করার অবস্থায় নেই; ব্যর্থতা ঢাকতে তখন সেও আত্মবিদ্রুপের বর্ম গায়ে তোলে। উন্মুক্ত পুঁজি ও তার মেকানিজম এমন একটা নাজুক জায়গায় নিয়ে মানুষকে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে ভালো ও মন্দের প্রভেদকে একটা অকার্যকর ধারণা মনে হয়, সকলেই যার যার জায়গা থেকে নিজেকে ভিকটিম মনে করতে পারে। জীবন নানান উপায়ে তাকে ট্র্যাজিকমেডির দিকেই ঠেলছে প্রতিনিয়ত। যেন বা কাফকায়েস্ক জগতেরই আরও একটা কানাগলিতে সে উপায়হীন ঢুকে পড়ছে।

প্রাগে কাফকার স্ট্যাচু
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের এই অ্যাবসার্ড যাপনের কথা লিখতে গিয়ে ‘রূপান্তর’-এর কথাই মনে পড়ে সবার আগে। একজন কেরানী শ্রেণীর প্রতিনিধি গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কি শুধুই নির্মমতার, নাকি পোকায় রূপান্তরিত সামসার নড়াচড়া ও উপলব্ধি আমাদের ভীতির পাশাপাশি হাস্যরসও দেয়? যে, একদিকে বাড়ির বড়ছেলে পোকা হয়ে গেছে, অথচ তার পরিবার সহমর্মী না হয়ে চিন্তা করছে সম্ভাব্য আর্থিক বিপর্যয়, ছেলের এই দশা তো লোকে কী বলবে, এমনকি ছেলের রুম থেকে বাজে গন্ধ আসছে—এসব নিয়ে। তাকে পত্রিকার রোল দিয়ে বাড়ি মারতে চাইছে খোদ তার বাবা, লাঠি নিয়ে তাড়া করছে। আচমকা এক সকালে যে লোক পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে, তার কেন এমন হলো এ নিয়ে ভাবনার সক্ষমতা নেই, বরং সে চিন্তিত যে অফিসের বস কী বলবে, পোকা হয়ে সে কি আর কাজ করে যেতে পারবে? পাশাপাশি সামসার দেয়াল জুড়ে বা মেঝেতে চলাফেরার বর্ণনা কৌতুকী, মার্কিন ঔপন্যাসিক ডেভিড ফসটার ওয়ালেস যে ব্যাপারটাকে বলেছিলেন, ‘মানুষ এই জায়গাগুলো পড়ে হাসবে, মানে নিজের অসহায়ত্বের সঙ্গে সামসার মিল আছে দেখেই, কিন্তু এই হাসাহাসি খাঁটিই, কোনো ভেজাল নেই।’

কাফকার বিচার উপন্যাস থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এখানে কৌতুকের আবহ আরও সরাসরি, এবং বর্তমান সময়ের সঙ্গে আশ্চর্য সমান্তরাল। জোসেফ কে’র বিচার হবে কিন্তু সে নিজের অপরাধ জানে না। এমনকি বিচারকেরাও জানে না কেন তারা কে’র বিচার করতে বসেছে। অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আসা পুলিশ এসে কে’র বাড়িওয়ালীর কাছে দাবি করছে, ‘সকালের নাস্তা করান।’ আত্মসমর্থনে কে যেই ভাষণটা দেয়, সেটাও কোনো অর্থ তৈরি করে না, সে বলে, ‘আমার কোনো দোষ নেই মহোদয়, আমরা তো মানুষই, আর একজন মানুষের কীভাবে কোনো দোষ থাকতে পারে?’ তার ভাষণে শেষ অব্দি বিচার দেখতে আসা দর্শকেরা পর্যন্ত রেগে কাঁই হয়ে যায়। জোসেফ কে যে উকিলকে নিয়োগ দেয়, সেও দেখা যায় শুধু অসুস্থ থাকে, কাজের কাজ কিছুই করে না।

এ উপন্যাসে কাফকা বিচার ব্যবস্থার অকার্যকর অর্থহীনতাকে কটাক্ষ করেন এটা সত্যিই। কিন্তু তার ন্যারেটিভ স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানদের মতোই নির্লিপ্ত। চরিত্রগুলোর আচরণই সোজাসাপটা হিউমারের উপাদান হিসেবে কাজ করে। যেখানে পরিষ্কার বুঝে নেওয়া যায় জোসেফ কে বুদ্ধিমান কিন্তু সে অসহায়, আর বিচারকেরা বুদ্ধিহীন কিন্তু তাদের হাতে সব ক্ষমতা। অর্থাৎ, মানব সমাজের এই গড়ন তো এক ধরনের স্টুপিডিটিই। কিন্তু অধিকাংশ লোকে এমন সিস্টেমে শুধু সন্তুষ্ট তা-ই নয়, এতে কোনো সমস্যা আছে বলেও মনে করে না। এই ভাবনাটা মাথায় নিয়ে যখন আবার ‘বিচার’ পড়তে বসি, তখন আবিষ্কার করি, তার সম্ভাব্য পাঠক নিয়ে কাফকা অসচেতন এমন না, তিনি আসলে পাঠকের কাছে এই আশাই করেন না, কেউ তার লেখা পড়ে বুঝবে, বরং পাতার পর পাতা তার নির্লিপ্ত অ্যাবসার্ডিটির ন্যারেটিভ যেন বলতে চায়, ‘যা পড়ছো এই, এর ভিতরে কী আছে জেনে কী করবে, ধরে নাও এক সকালে তুমি চা খেতে গেছ ক্যান্টিনে, আর পুলিশ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে সরাসরি কোর্টে চালান করে দিলো। সেখানে গিয়ে দেখলে, মহামান্য বিচারক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার সহকারী কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই বলল, ‘আগামীকাল আপনাকে কুকুরের মতো হত্যা করা হবে। এখন যান তো, ঘরে বসে অপেক্ষা করুন।’

কে তাও বোঝে যে সিস্টেমে ঘাপলা আছে। সামসা তা বোঝে না। কিন্তু এই বোঝা আর না বোঝা কোনো পার্থক্য তৈরি করে না শেষ অব্দি। তারা তাদের পরিস্থিতির বশ্যতাই স্বীকার করে নেয়, যেমন নেয় আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাও। সারা জীবন সে যে নিজের আত্মানুসন্ধানী সত্তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তা নয়, তার এই দাঁড়িয়ে থাকাটা আসলে বাধ্যবাধকতা। সিস্টেমের প্রতি যে আনুগত্যের ব্যাপারে ব্যক্তি নিজেও সচেতন না।

একাডেমিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজও অবশ্য কাফকার বিদ্রুপ থেকে রক্ষা পান না। ‘এক কুকুরের তদন্ত’ গল্পে আমরা দেখি স্বপ্রজাতির অন্যদের চেয়ে আলাদা বেশ চিন্তক ধরনের এক কুকুর নিজেকে বর্ণনা করছে অনুসন্ধানী, গবেষক ও যুগান্তকারী হিসেবে; আবার তার বিনয়েরও ভড়ং আছে, ‘আজ আমার বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতারও কমতি নেই, তবুও নিজেকে আমি আজও এক ছাত্রই মনে করি...’

জ্ঞানী কুকুরটি যথারীতি কুকুর সমাজের অন্যদের প্রতি সমালোচনাপ্রবণ। অন্যদিকে, নিজেকে সে খুব উঁচুতে রাখে, জীবন ও জগৎ নিয়ে তার নিশ্চিত সব ধারণা আছে। নিজের করা প্রশ্নকে সে খুবই গুরুত্ব দেয়, যেমন, ‘এ মহাপৃথিবী কীভাবে আমাদের জন্য খাদ্য তৈরি করে?’ এই ভাবনায় সে গম্ভীর সময় কাটায়, এ প্রশ্নের ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও বের করতে চায়। গান গাইতে থাকা একদল কুকুরের কাজকর্ম নিয়ে লিখতে গিয়ে সে টেকনিক্যাল জার্গন তৈরি করে, বিষয়টিকে বোধের অগম্য করে তোলে উদ্ভট শব্দ ব্যবহার করে।

পুরো গল্পে কোথাও মনে হয় না কাফকা আসলে কমেডি লিখছেন, দারুণ গম্ভীর এর ভাষা, কাফকায়েস্ক নির্লিপ্তিও অটুট। কিন্তু কুকুরটি বুঝতেই পারে না যে তাকে আসলে খাবার দিয়ে যায় মানুষ; খাদ্য কোথা থেকে আসছে এ বিষয়ে তার গর্বিত ও নিশ্চিত অনুসন্ধানের ফলাফল শূন্য।

কাফকার জগৎ ক্ষমাহীন, ক্ষত দগদগে, এবং দুরন্ত রাজনৈতিক—এটা সর্বস্বীকৃত পাঠ। এবং তাকে পড়তে শুরু করার আগে আমাদের মাথায় আসে কাফকার ট্র্যাজিক জীবন ও ক্ষয়, তার ওপর হওয়া অসংখ্য গবেষণা আর পুর্বানুমান আমাদের মাথায় বসে থাকে যে, তাকে পড়তে হবে এক টনটনে সচেতন মগজ নিয়ে, ধরে নিতে হবে তার সব লেখাই রূপক, আর খুঁজে বের করতে হবে লুকানো মানেগুলো।

কাফকার প্রায় সমস্ত লেখাই পুনর্পাঠযোগ্য, এবং তখন হয়তো খুব বেশি করেই মনে হবে মানব সমাজ টিকে আছে তার অব্যাখ্যাত হাস্যকর সব কর্মকাণ্ডের স্তূপের ওপর, নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাসও কিংবা দৃঢ় সচতেনতা দুই-ই অনেক সময় একটা সীমাহীন কৌতুক—আর একদম অকপটে নিজের লেখায় এসব ধরে রাখার ক্ষেত্রে কাফকা একজন মহান কমেডিয়ান।