হেমাঙ্গ বিশ্বাসের যে গান মণিপুরেও গাওয়া হয়
ভারতের মণিপুর রাজ্যে বাংলাদেশের সিলেটে জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি গান বেশ আয়োজন করেই গাওয়া হয়। কীভাবে মণিপুরে পৌঁছে গেল বাঙালি গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান?
দক্ষিণ এশিয়ায় ‘রায়ট’ পুরোনো এক বর্বরতা। এবার সহিংসতা ঘটল মণিপুরে। মণিপুর ‘ভারতভুক্ত’ হয় ১৯৪৯ সালে। এবারের সহিংসতার কারণ মইতই ও জো-জাতিগুলোর পারস্পরিক সংঘাত। যে যাকে যেখানে ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায় পাচ্ছে, মারছে। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। সব জাতিসত্তা মিলে উপনিবেশবিরোধী মুক্তির সাধনাই এ রকম অঞ্চলগুলোর মূল চাহিদা ছিল।
মণিপুরে সে রকম রাজনীতিও ছিল। তারই গোড়াপত্তন করেছিলেন হিজাম ইরাবত। সংগ্রাম করতে করতে জঙ্গলেই মারা গেছেন তিনি। কিন্তু ভুল রাজনীতির একালেও মণিপুরে ইরাবতকে সবাই বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করে। বিশেষ করে মইতইদের কাছে ‘জননেতা’ মানেই হিজাম ইরাবত। বিপুল উদ্দীপনায় উদ্যাপিত হয় তাঁর জন্মদিন।
বর্ণিল ও মহাকাব্যিক এক রাজনৈতিক জীবন ইরাবতের। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো, এই ইরাবতকে ‘নিখিল মণিপুর হিন্দু মহাসভা’র রাজনীতি থেকে আমূল পরিবর্তনবাদী রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন কয়েকজন বাঙালি। তাঁর সিলেট কারাগারে থাকার সময় সেই অধ্যায়টি ঘটে। এ সময় তিনি জ্যোতির্ময় নন্দী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। নন্দী ছিলেন সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘নয়া দুনিয়া’ কাগজের সম্পাদক। এই কাগজের একটা প্রবন্ধের জন্য তাঁর ৯ মাস সাজা চলছিল।
তবে নন্দী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগে ১৯১৩ সালে ইম্পল থেকে এসে ঢাকার পোগোজ স্কুলেও দুই বছর পড়েছিলেন হিজাম। এখানে তাঁর কাজিনরা থাকতেন। কৃষক সংগঠন করতে চেয়ে নেত্রকোনায়ও এসেছিলেন। সে যা–ই হোক, আজকে আলাপ মূলত নেত্রকোনায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে হিজাম ইরাবতের একটা গানকেন্দ্রিক সম্পর্ক নিয়ে।
তুখোড় একজন রাজনীতিবিদ হয়েও হিজাম ইরাবতের আগ্রহ ছিল বহু বিষয়ে। গান, নাটক ও খেলাধুলায় চৌকস ছিলেন তিনি। ইম্পলে এখন যত ক্রীড়া সংস্থা—তার অনেকগুলোর গোড়াপত্তনকারী ইরাবত। তিনি নাটক লিখতেন এবং অভিনয় করতেন। নারী-পুরুষ উভয় চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন। ১৯৪০-এ মণিপুরে ব্রিটিশবিরোধী যে নারী অভ্যুত্থান ঘটে, তাতে ইন্ধনের জন্য ইরাবতকে প্রথম কারারুদ্ধ করা হয়। তিন বছরের এই কারাজীবনের প্রথম বছর তাঁকে ইম্পল জেলে রাখা হলেও পরের দুই বছর তাঁকে রাখা হয় সিলেট জেলে। শাসকেরা ভেবেছিল সিলেটে থাকলেই ইরাবত রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন।
সিলেট জেলে তখন বন্দী ছিলেন জ্যোতির্ময় নন্দীসহ কয়েকজন সাম্যবাদী। হিজামের কাছে মণিপুরি সমাজের বিবরণ শুনে বাঙালি এই সাম্যবাদীরা তাঁকে কৃষক সংগঠন গড়ে মণিপুরের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য কাজ করতে বলেন। ১৯৪৩ সালের মার্চের দিকে এসব নিয়ে সেখানে তাঁদের দীর্ঘ আলাপ হয়। সেই আলাপের ফল হিসেবে মণিপুরি সমাজের নিচুতলায় সাংগঠনিক কাজে নামেন ইরাবত।
বর্তমানে মণিপুরে নিয়মিতই ইরাবতকে স্মরণ করা হয়, যা আগেই বলেছি। এ রকম স্মরণানুষ্ঠানগুলোয় অনিবার্যভাবে থাকে গান। তার মধ্যে একটা গান অবশ্যই থাকে, ‘থাঙল আদু মায়া থাঙু থাওনা ইয়া লাউবা’। উচ্চারণে হেরফের হতে পারে। আমি মণিপুরি জানি না। তবে বাংলায় গানটা হলো, ‘কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শাণ কৃষাণ ভাইরে..’।
জেল থেকে ছাড়া পেলেও অনেক দিন ইরাবতকে মণিপুরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সিলেট ও কাছাড়ে মণিপুরিদের মধ্যে কাজ করতেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তিনি মণিপুরে ঢোকার সুযোগ পান। এ সময় সংসদীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে বিজয়ী হলেও (১৯৪৮ সালে) তাঁকে আইনসভায় যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করার সুযোগ না পেয়ে ইরাবত এ সময় আত্মগোপনে যান; এবং ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে মণিপুরে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এটা ছিল মণিপুরসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মোড় বদলকারী এক ঘটনা। তবে পরবর্তীকালে পরিচয়বাদী রাজনীতিতে এ অঞ্চল এতটাই নিমজ্জিত হয় যে সাম্যবাদীরা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ধরে রাখতে পারেননি। আত্মগোপন অবস্থাতেই ১৯৫১ সালে ইরাবত মারা যান।
বর্তমানে মণিপুরে নিয়মিতই ইরাবতকে স্মরণ করা হয়, যা আগেই বলেছি। এ রকম স্মরণানুষ্ঠানগুলোয় অনিবার্যভাবে থাকে গান। তার মধ্যে একটা গান অবশ্যই থাকে, ‘থাঙল আদু মায়া থাঙু থাওনা ইয়া লাউবা’। উচ্চারণে হেরফের হতে পারে। আমি মণিপুরি জানি না। তবে বাংলায় গানটা হলো, ‘কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শাণ কৃষাণ ভাইরে..’। প্রশ্ন হলো, এই গান প্রথম কোন ভাষায় লেখা হয়েছিল? কারা এটা অনুবাদ করল?
বাংলার মতো এই গান কাছাড়েও খুব জনপ্রিয়। গানটি হিজাম ইরাবত ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের যৌথ কাজ। আদি রেকর্ডে এই গানের গায়ক হিসেবে চন্দ্রকলা দেবীর নাম আছে। কে লিখেছেন এবং শুরুতে এটা মণিপুরি, না বাংলায় লেখা (বা কে কোথা থেকে অনুবাদ করেছেন) সেসব তথ্য ছিল না। সবাই কেবল এটুকু জানতেন, এই গানের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ইরাবতের বন্ধুত্ব যুক্ত হয়ে আছে। যে বন্ধুত্বের শুরু রাজনৈতিকভাবে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কন্যা অর্থনীতিবিদ রঙ্গিলী বিশ্বাস বাবার আর্কাইভ সূত্রে কয়েক বছর আগে জানিয়েছেন, গানটি মণিপুরি থেকে বাংলায় হিজাম ইরাবতই অনুবাদ করে দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে। ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ নামে শিলচরের একটা কাগজ এ রকম তথ্যই দিচ্ছে। মূল গানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উপনিবেশবিরোধী কৃষক সমাবেশীকরণের অংশ হিসেবে ইরাবতের লেখা। সিলেট, কাছাড়, মণিপুরসহ বাংলা অঞ্চলে তখন জাপানি আগ্রাসনের শঙ্কা চলছিল। এ সময় চাষি সমাজকে একত্র হয়ে স্বরাজ সম্পন্ন করা দরকার—এ রকম থিম থেকে গানটি লেখা হয়। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষাণ সভার যে সম্মেলন হয়, সেখানে কাছাড় থেকে যাওয়া ইরাবতের দল প্রায় দুই লাখ কৃষকের সামনে এই গান গেয়ে শোনায়। ইউটিউবে বাংলা ও মণিপুরি উভয় ভাষায় বহু শিল্পীর কণ্ঠে এখন গানটি পাওয়া যায়।
এই গান তৈরির সময়ই আসাম ও সিলেট অঞ্চলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও হিজাম ইরাবত একসঙ্গে কাজ করেছেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ সংগঠনের হয়ে।
গানটির ইতিহাস এখানে তোলা হচ্ছে এ কথাটুকু বলার জন্য যে আজকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে জাতিতে জাতিতে হানাহানি। বাঙালিরাও সেখানে বেশ কোণঠাসা—‘বিদেশি’। এভাবে জাতিসত্তাগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা হয়েছে—যাতে মূল উপনিবেশিক শক্তি ‘এলিট’দের উপস্থিতি ও কাজকারবার আড়ালে থাকে। বেশ সফল কৌশল এটা। লুণ্ঠনও চলছে অবাধে।
ঠিক এ সময় প্রায় ৮০ বছর আগে হিজাম ইরাবত ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস বাঙালি-মণিপুরি-কুকি-নাগা-মিজোসহ সব জাতিসত্তার কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে যৌথ সংগ্রামের যে লাইন ঠিক করেছিলেন, তা আজও কত প্রাসঙ্গিক এবং আজও কত অবহেলিত।