শহীদ জননী রমা চৌধুরীর সঙ্গে এভাবেই বই নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন আলাউদ্দিন খোকন
ছবি: সংগৃহীত
গতকাল ৩ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন আলাউদ্দিন খোকন। অনেক জ্ঞানগম্যি বা বড় লেখক-সাহিত্যিক তিনি ছিলেন না। কিন্তু অনেকের চেয়ে হৃদয়বান ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল, দীর্ঘ ২৪ বছর শহীদ জননী রমা চৌধুরীর পাশে তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। চট্টগ্রাম শহরে তাঁর সঙ্গে বই নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন রমা চৌধুরী। এর কয়েক বছর বাদে ওই ৩ সেপ্টেম্বর রাতেই মারা গেলেন এই শহীদ জননীর সহচর আলাউদ্দিন খোকন।

রাত সাড়ে ১২টা হবে। ঘুম থেকে জাগিয়ে আমার স্ত্রী যে দুঃসংবাদটা দিলেন, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। সংস্কৃতিকর্মী, কবি ও লেখক আমাদের বন্ধু আলাউদ্দিন খোকন আর নেই। দ্রুত ফেসবুক খুলে দেখি সেখানে কোনো আলোড়ন নেই তখনো। আমাদের দুজনেরই মনে আশার আলো জাগে। হয়তো ভুল শুনেছি। এত রাতে কাকেই–বা ফোন করব! আলাউদ্দিনের স্ত্রী কবি রিমঝিম আহমেদকে ফোন করতে দ্বিধা হচ্ছিল। কীভাবে এমন কথা জানতে চাইব তাঁর কাছে। কিছুক্ষণ পর এক বন্ধু জানালেন, তিনি মেডিকেলেই আছেন। খবরটা সত্য। ফোনে রিমঝিমকে ধরিয়ে দিলেন, ওপাশ থেকে তাঁর কান্নার শব্দ। বললেন, ‘একি হলো, দুই বছর আগে কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে তাকে কত যুদ্ধ করতে হয়েছে। পুরোপুরিই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে!’

রিমঝিমকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা জানা ছিল না। আমি কেবল মুঠোফোনটা ধরে থাকি। খেয়াল হয়, কিছুক্ষণ আগেই ৩ সেপ্টেম্বর অতিক্রান্ত হয়েছে। আলাউদ্দিনের প্রিয় রমাদি, একাত্তরের বীর জননী রমা চৌধুরী পাঁচ বছর আগে এই দিনেই অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন। আর এমন দিনেই খোকনও চলে গেলেন।

আলাউদ্দিন খোকন
ছবি: সংগৃহীত

আলাউদ্দিন খোকন, রিমঝিম আহমেদ আর তাঁদের মেয়ে আজরা দীপান্বিতা তিতলির অনেক ছবি এখন ফেসবুকের ওয়ালে ভাসছে। সেসব ছবি দেখে বোঝা সম্ভব নয়, হাস্যোজ্জ্বল মুহূর্তগুলোর আড়ালে পরিবারটিকে কত ঝড়ঝঞ্ঝা সইতে হয়েছে। গত দুই বছর আগে কোভিডে আক্রান্ত খোকনের অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ছোটখাটো একটা স্ট্রোকও হয়েছিল। দীর্ঘ সময় কথাও বলতে পারছিলেন না। ভারতে বেশ কয়েকবার চিকিৎসা নিয়ে এসে মাত্র কিছুদিন আগে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ফিরে গেছেন আবার আগের জীবনে। কিন্তু গত রাতে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সাড়া দিলেন না আর এ যাত্রায়।

আলাউদ্দিন খোকনের মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষই শোকাহত হয়েছেন। বিশাল প্রতিপত্তি, জ্ঞানগম্যি বা অনেক বড় লেখক-সাহিত্যিক কোনোটাই ছিলেন না তিনি। তবু এত শোক তাঁকে ঘিরে, তার কারণ কী? আসলে সবকিছুর ভিড়ে এই দেশে সত্যিকারের হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। আলাউদ্দিন তাঁদেরই একজন। এই শহরের শিক্ষিত লোকমাত্রই তাঁকে চেনেন। আলাউদ্দিন খোকনের কথা ভাবলেই একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে, আর তা হলো বৃদ্ধা রমা চৌধুরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি।

স্ত্রী কবি রিমঝিম আহমেদ ও কন্যা আজরা দীপান্বিতা তিতলির সঙ্গে আলাউদ্দিন খোকন
ছবি: সংগৃহীত
আলাউদ্দিন খোকনের মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষই শোকাহত হয়েছেন। বিশাল প্রতিপত্তি, জ্ঞানগম্যি বা অনেক বড় লেখক-সাহিত্যিক কোনোটাই ছিলেন না তিনি। তবু এত শোক তাঁকে ঘিরে, তার কারণ কী? আসলে সবকিছুর ভিড়ে এই দেশে সত্যিকারের হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। আলাউদ্দিন তাঁদেরই একজন। এই শহরের শিক্ষিত লোকমাত্রই তাঁকে চেনেন। আলাউদ্দিন খোকনের কথা ভাবলেই একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে, আর তা হলো বৃদ্ধা রমা চৌধুরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি।

শহীদ জননী রমা চৌধুরীকে নিয়ে গতকালও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন। রমা চৌধুরীর মৃত্যুর পর আমার মনে হয়েছিল, এবার বুঝি আলাউদ্দিনের কাজ ফুরাল। দিদি নেই, তাঁকে রান্না করে খাওয়ানো, ওষুধ মুখে তুলে দেওয়া আর দিদির বই নিয়ে এর–ওর কাছে যাওয়া—এই তো ছিল আলাউদ্দিনের রুটিন। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের একটি প্রেসে বই ছাপাতে গিয়েছিলেন রমা চৌধুরী। সেই প্রেসেই চাকরি করতেন আলাউদ্দিন খোকন। সেখানেই পরিচয় দুজনের। সব হারানো এক বোন যেন খুঁজে পেলেন তাঁর ভাইকে। এরপর ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল, দীর্ঘ ২৪টি বছর দিদির পাশে ছিলেন আলাউদ্দিন খোকন। রিমঝিম আহমেদ নিজের প্রিয়তম স্বামীকে ঘরবন্দী করে রাখেননি। রমা চৌধুরীর প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছেন সব সময়। কিন্তু অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটা শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন সুখের সংসারের দিকে যে যাত্রা ছিল তাঁদের, আজ সেটিই ভেঙে খানখান হয়ে গেল।

হাসপাতালে অসুস্থ রমা চৌধুরীর সেবা করছেন আলাউদ্দিন খোকন,২০১৮
ছবি: সংগৃহীত

মনে আছে ২০১৮ সালে দিদির মৃত্যুর ঠিক দুই দিন আগে ছিল আলাউদ্দিনের একমাত্র কন্যাসন্তান তিতলির জন্মদিন। মেয়ের সাধ ছিল কেক কাটার সময় বাবা থাকবেন তার পাশে। কিন্তু সেই সময়টিতেও মেয়ের কাছে থাকতে পারেননি আলাউদ্দিন। হাসপাতালে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন দিদির শিয়রে বসে।

তবে এবার জন্মদিনে তিতলি তার বাবাকে পেয়েছিল। বাবার সঙ্গে এটাই ছিল তার শেষ জন্মদিন। এই মর্মান্তিক সত্য কী করে মেনে নেবে একরত্তি মেয়েটি!