আলোকচিত্রে গল্প
এক বিলুপ্ত পৃথিবীর চিত্র ও চেতনা
অতীত পাঠের অনেক ধরনের উপায় রয়েছে। তারিখ, দলিল, স্মৃতিচারণ বা বিবরণীর মধ্য দিয়ে যেমন, আবার এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যাদের সমস্ত ভার, আবেগ ও বাস্তবতা সবচেয়ে সংক্ষেপে ধারণ করে কেবল একটি আলোকচিত্র। সময়ের সীমানা ভেদ করে টিকে থাকা এসব ছবির পেছনে থাকে একাধিক গল্প। এই ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্বে আমরা তুলে ধরব এমনই কোনো বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রের অন্তরঙ্গ ইতিহাস।
বিশ শতকের সূচনালগ্নে ব্যাপক শিল্পায়ন, গণ-অভিবাসন এবং পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণের কারণে উত্তর আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ভূমি ও সংস্কৃতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। ফলে সমাজ, অর্থনীতি ও আদিবাসী জীবনযাত্রা আমূল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব বিশ শতকের শুরুতে পূর্ণ গতি পায়, যা উত্তর আমেরিকার ভূমি ও সামাজিক কাঠামোয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ফলে কলকারখানার ব্যাপক উত্থান হয়, গ্রামীণ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ কৃষক, আদিবাসী ও নতুন অভিবাসীরা কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবনের সন্ধানে শহরাঞ্চলে ভিড় করে। নতুন নতুন কারখানা, রেলপথ এবং খনির কাজের জন্য বিশাল বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হতে থাকে।
আমেরিকান আলোকচিত্রী ও নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড শেরিফ কার্তিস মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম আলোকচিত্র প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, যার নাম ‘দ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ান’। ১৯০৬ সালে তিনি বিখ্যাত শিল্পপতি জে পি মর্গানের কাছ থেকে এই প্রকল্পের জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পান।
১৮৮০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ (ইতালি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড) এবং এশিয়া (চীন, জাপান) থেকে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসীর আগমন ঘটে। সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূখণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নীতি জারি রেখে আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ করে শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারী, কৃষক ও রেলপথ কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেয়। নিজস্ব ভূমি থেকে আদিবাসীদের জোর করে সংরক্ষিত অঞ্চলে নির্বাসিত করা হয়। ফলে হাজার বছরের পুরোনো জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং ভূমির সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। আদিবাসী শিশুদের বোর্ডিং স্কুলগুলোতে ভর্তি করিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় কিংবা আমেরিকান সংস্কৃতিতে আত্তীকরণের চেষ্টা করা হয়।
এমন বহুবিধ ঘটনা যখন চলমান, সে সময়ে আমেরিকান আলোকচিত্রী ও নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড শেরিফ কার্তিস (১৮৬৮–১৯৫২) এক বিস্ময়কর উদ্যোগ নেন। কাজ শুরু করেন মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম আলোকচিত্র প্রকল্পের, যার নাম ‘দ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ান’।
কার্তিসের উদ্দেশ্য ছিল অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেতে থাকা একটি সময়ে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন, আচার ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে প্রকাশিত এই বিশাল কর্মযজ্ঞ কেবল একটি আলোকচিত্র সংকলনই নয়; প্রকল্পটি একদিকে যেমন শিল্প ও নান্দনিকতার অনন্য নিদর্শন, অন্যদিকে এক গভীর বিতর্কিত নৃ-সাংস্কৃতিক দলিলও, যা সেই যুগের আদর্শ ও ভ্রান্তি উভয়কেই বহন করছে শত বছর ধরে।
কার্তিসের দ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ান প্রকল্পের মূল অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর নিজস্ব একটি বিশ্বাস। তার মনে হয়েছিল আমেরিকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিনি একে ‘ভ্যানিশিং রেস’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
এ বিষয়ে কার্তিসের উক্তি, ‘তাদের জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সভ্যতার নির্মম দমনচাপের নিচে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আদিবাসী সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন।’ উক্তিটি মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গ সমাজের প্রতি গভীর নৈতিক সমালোচনা উপস্থাপন করে।
কার্তিসের দ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ান প্রকল্পের মূল অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর নিজস্ব একটি বিশ্বাস। তার মনে হয়েছিল আমেরিকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিনি একে ‘ভ্যানিশিং রেস’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
আবার ‘এটা অত্যাবশ্যক যে তারা ইতিহাসের কক্ষে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে প্রথম আমেরিকানদের আলোকচিত্রে ধারণ ও অধ্যয়ন করা হোক’—এই দাবি কার্তিসের নৃবিজ্ঞানভিত্তিক লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করে এবং সেই সঙ্গে অদৃশ্যমান হয়ে যাওয়া মিথকেও তুলে ধরে, যা তিনি জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছিলেন।
১৯০৬ সালে এডওয়ার্ড শেরিফ কার্তিস বিখ্যাত শিল্পপতি জে পি মর্গানের কাছ থেকে এই প্রকল্পের জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পান। জে পি মর্গান প্রকল্পটির জন্য ৭৫ হাজার ডলার অনুদান দেন। এই সহায়তায় কার্তিস গবেষক, দোভাষী ও সহকারী ফটোগ্রাফারদের একটি দল গঠন করেন এবং প্রায় দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও আলাস্কার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে থাকেন।
বিস্তৃত সময় ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের এই মহাকাব্যিক ডকুমেন্টারি কাজে ২০ খণ্ড এন্থোগ্রাফিক গ্রন্থ এবং ২০ খণ্ড ফোলিও ফটোগ্রাভিউর পোর্টফোলিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে প্রতিটি খণ্ডে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা জাতিগোষ্ঠীর ওপর আলোকপাত করা হয়। ফোলিও পোর্টফোলিও অব ফটোগ্র্যাভিউর হলো একটি বিশেষ ধরনের শৈল্পিক প্রকাশনা, যেখানে ফটোগ্র্যাভিউর নামক উচ্চমানের মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা বড় আকারের ছবিগুলোকে একটি আলগা বাঁধাই করা খামের মধ্যে সাজানো হয়। এটি মূলত শিল্পকলা ও মূল্যবান আলোকচিত্র প্রকাশের একটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি। কার্তিস মোট ৮০টির বেশি উপজাতি ও জাতিগোষ্ঠী যেমন—অ্যাপাচি, নাভাহো, হোপি, সিউ, চেয়েন, কওয়াকিউটল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। প্রতিটি খণ্ড ছিল চিত্র, লোককথা, গান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ভাষাগত তথ্য ও সামাজিক বর্ণনাসংবলিত পূর্ণাঙ্গ নৃতাত্ত্বিক সংরক্ষণ।
কার্তিসের ধারণ করা আলোকচিত্রগুলো কেবল দলিল নয় বরং একেকটি নান্দনিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে। কার্তিস আলোকচিত্র ধারণে ব্যবহার করেছেন নরম আলোর ছায়া, গাঢ় সেপিয়া টোন ও সুচিন্তিত কম্পোজিশন, যা তার ছবিগুলোকে এক প্রাচীন অথচ গভীর ভাবগাম্ভীর্য দান করেছে। তার প্রতিটি সাবজেক্টের মুখের অভিব্যক্তি যেমন এক নীরব মর্যাদা বহন করে, তেমনি তাদের চোখের গভীরে ইতিহাসের ভার, মুখের ভাঁজে গৌরব ও কষ্টের ছায়াও অনুভব করা যায়। ফটোগ্রাভিউর মুদ্রণ পদ্ধতির নিখুঁত দক্ষতায় কার্তিস যে গভীরতা ও টোনাল সমৃদ্ধি সৃষ্টি করেন, তা আজও দর্শককে মুগ্ধ করে।
কার্তিসের ধারণ করা আলোকচিত্রগুলো কেবল দলিল নয় বরং একেকটি নান্দনিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে। কার্তিস আলোকচিত্র ধারণে ব্যবহার করেছেন নরম আলোর ছায়া, গাঢ় সেপিয়া টোন ও সুচিন্তিত কম্পোজিশন, যা তার ছবিগুলোকে এক প্রাচীন অথচ গভীর ভাবগাম্ভীর্য দান করেছে।
তবে এই শিল্পরুচি মাঝে মাঝে বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কার্তিস অনেক সময় তাঁর ছবির আধুনিক উপাদান—যেমন ঘড়ি, পোশাক বা আগ্নেয়াস্ত্র—ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিতেন, যাতে দৃশ্যটি ‘অতীতের’ মতো দেখায়। এই কৃত্রিমতা ছিল তার যুগের রোমান্টিক মানসিকতার প্রতিফলন—যেখানে আদিবাসীকে বর্তমান সমাজের অংশ নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া এক ‘নির্মল প্রাচীন’ জাতি হিসেবে কল্পনা করা হতো। ফলে তার নথিপত্র যেমন অমূল্য, তেমনি আংশিকভাবে সৃষ্টি ও বাস্তবতার মিশ্র প্রতিচ্ছবি।
দ্য ভ্যানিশিং রেস
কার্তিসের অন্যতম বিখ্যাত ছবি ‘দ্য ভ্যানিশিং রেস’ (১৯০৪)—যেখানে কয়েকজন নাভাহো অশ্বারোহী দূরপ্রান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই আলোকচিত্রটি দ্বন্দ্বের প্রতীক। এটি একদিকে বিলুপ্তির শোকগাথা, অন্যদিকে এক অবিনশ্বর সৌন্দর্যের ধ্বনি। কার্তিস আদিবাসী জীবনের মর্যাদা সংরক্ষণ করতে চাইলেও, তাঁর দৃষ্টিতে সেই জীবন ছিল ইতিহাসের অংশ, চলমান বর্তমানের নয়। তবু, তাঁর প্রতিটি মুখাবয়ব যেন নীরবে ঘোষণা করে—আমরা আছি, আমরা বেঁচে আছি। এখানেই তার শিল্প জীবন্ত এবং নৃবিজ্ঞানের সীমানা পেরিয়ে মানবিক অস্তিত্বের গভীর অনুরণন হয়ে ওঠে। দ্য ভ্যানিশিং রেসের অশ্বারোহীরা যেন সময়ের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন, আধুনিকতার স্পর্শবিহীন এক অবিকৃত প্রান্তরের ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে। রেলপথ, টেলিগ্রাফ লাইন কিংবা বসতবাড়ির বিস্তারের যুগেও কার্তিসের ছবিতে এদের অনুপস্থিতি ছিল এক সচেতন ভিজ্যুয়াল কৌশল। তিনি ধারণ করেছিলেন ইতিমধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক পৃথিবীর সময়কে, যে সময়ে আদিবাসীরা বাস্তবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছিল।
কার্তিসের এই কর্মযজ্ঞ একদিকে যেমন সংরক্ষণের মহাপ্রয়াস, অন্যদিকে যুগ চেতনার প্রতিফলন। যা কোনো নির্দিষ্ট যুগের মানুষের চিন্তা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং তাদের সামগ্রিক মনন ও উপলব্ধিকে উপস্থাপন করে। তার নথিতে লিপিবদ্ধ আছে একাধারে বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর আচার, পৌরাণিক কাহিনি, স্থাপত্য ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, যার অনেক কিছুই পরবর্তীকালে হারিয়ে গেছে। তবে একই সঙ্গে কার্তিসের ‘বিলুপ্ত জাতি’ ধারণা আজকের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। যে সমাজগুলোকে তিনি চিরতরে হারিয়ে যেতে দেখেছিলেন, তারা আজও টিকে আছে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বন্দ্বই কার্তিসের প্রকল্পকে এক জটিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত করেছে, যা যেমন রোমান্টিক, তেমন গভীরভাবে রাজনৈতিক।
১৯৩০ সালে যখন দ্য নর্থ আমেরিকান ইন্ডিয়ানের শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয়, কার্তিস আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন। এর অন্যতম কারণ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি। কিন্তু মৃত্যুর বহু বছর পর গবেষক ও শিল্প ইতিহাসবিদেরা তাঁকে পুনরায় আবিষ্কার করেন এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পী হিসেবে। যিনি একাই নৃবিজ্ঞান ও আলোকচিত্রশিল্পকে ইতিমধ্যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।
কার্তিসের ধারণ করা ৪০ হাজার আলোকচিত্র, ১০ হাজার মোম-সিলিন্ডারে রেকর্ড করা সংগীত ও অসংখ্য নোট সংরক্ষিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গ্রন্থাগার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও বিভিন্ন ডিজিটাল আর্কাইভে। আধুনিক আদিবাসী সমাজ কার্তিসের প্রতি মিশ্র মনোভাব পোষণ করে। তারা একদিকে তাঁর রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে, অন্যদিকে তাঁর নথিপত্রের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের স্মৃতি পুনরুদ্ধারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানায়। শিল্পের ইতিহাসে কার্তিস আজ এক সেতুবন্ধকারী ব্যক্তিত্ব। নৃবিজ্ঞান ও আলোকচিত্রকলার সংমিশ্রণে তিনি গড়ে রেখে গেছেন এক অবিনশ্বর উত্তরাধিকার।