রায়েরবাজারে অচেনা এক নারীর মুখ

আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর কেটে গেছে। হতভাগী এই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু অচেনা এই নারীর ছবিই বাংলাদেশের গণহত্যার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বিজয়ের পরের দিন পড়ন্ত দুপুর। রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলায় একটি দৃশ্য দেখে রশীদ তালুকদারের রক্ত হিম হয়ে আসে। গর্তের কাদাপানিতে দেবে থাকা শরীর পুরোটা দেখা যায় না। চাপা মাটি আর কঠিন ইটের আস্তরণ ভেদ করে মমির মতো ভেসে উঠেছে এক নারীর মুখ। তাঁর বুকে বুলেটের ক্ষত। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। বাঁ চোখটা উপড়ে ফেলা হয়েছে। ডান চোখ বন্ধ। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। রোলিফ্লেক্সের শাটার টিপতে গিয়ে রশীদ তালুকদারের চোখ নোনা হয়ে আসে। অশ্রুতে ঝাপসা হয় তাঁর ভিউ ফাইন্ডার। নাকে প্যাঁচানো রুমাল দিয়ে ভিউ ফাইন্ডারের কাচ মোছেন তিনি। এরপর কাদাপানিতে নেমে এই নারীর মুখ বরাবর ক্যামেরা রেখে ভার্টিক্যাল ফ্রেমে কয়েকটা ছবি তোলেন। ৫৪ বছর কেটে গেছে। হতভাগী এই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু অচেনা এই নারীর ছবিই বাংলাদেশের গণহত্যার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতার শিকার হওয়া এই নারীর সাদাকালো ছবিটি আমাদের সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়। শিরশিরে অনুভূতি জাগানো ছবিটি দেখে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। পেছনে ফিরে তারা জানতে চায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে তাদের জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ফলে রশীদ তালুকদারের চোখ দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য-ইতিহাস পাঠ করতে হয়।

পাকিস্তানিদের প্রতি এই যে ঘৃণা আর মুক্তিযুদ্ধে নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে জানার যে আকুলতা; এই ছবির মাধ্যমে তার একটা দৃশ্যমান পটভূমি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। এই কালজয়ী ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা।

রশীদ তালুকদারের শেষজীবনের অন্তত এক যুগ সময় আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাঠে একসঙ্গে ছবি তুলেছি। তিনি আমার মোটরবাইকে চেপে অ্যাসাইনমেন্টে যেতে পছন্দ করতেন। ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে, অবসরে তিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা আর মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়গুলোর কথা বলতেন। ক্যামেরার মাধ্যমে সারা জীবন তিনি জীবনকে খুঁজে ফিরেছেন। এমন ছবি তুলতে চেয়েছেন, যা জীবনের কথা বলে। সেই সব স্মৃতি থেকেই রায়েরবাজারের এই করুণ অধ্যায়টা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।

রশীদ তালুকদার [২৪ অক্টোবর, ১৯৩৯-২৫ অক্টোবর, ২০১১]। আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ
দৃক–এর সৌজন্যে

১৬ ডিসেম্বর ভোরে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের মার্কিন আলোকচিত্রী মিশেল লারনেডকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলতে বের হন রশীদ তালুকদার। সারা দিন তাঁরা গোলাগুলি আর বিজয় উল্লাসের ছবি তোলেন। শাহজাহান নামে যে ছেলেটা তাঁর বাসায় থাকে, ওই দিন দুপুরে হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারায় সে-ও। ফলে রশীদ তালুকদারের বিজয়ের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। পরের দিন দুপুরে তিনি জানতে পারেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথা। খবর আসে রায়েরবাজার, কাটাসুর আর বছিলার বিলে পড়ে আছে শত শত বুদ্ধিজীবীর লাশ। মানুষের মুখে মুখে সে খবর বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তির আনন্দ ছাপিয়ে দুপুরের পর রায়েরবাজারে গিয়ে হাজির হন তিনি। কেবিএস নামের একটি পরিত্যক্ত ইটের ভাটার সামনে গিয়ে দেখেন শত শত লাশ। কারও চোখ বাঁধা, কারও হাত। কারও চোখ ওপড়ানো, কারও মুখের একাংশ কাটা, আবার কারও পেট চিরে ফেলা হয়েছে। কিছু মরদেহ কাক-চিল আর শকুন-শৃগালের আহারে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু দেহের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে বিলের ধারে। এসব ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা নেমে আসে।

১৬ ডিসেম্বর ভোরে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের মার্কিন আলোকচিত্রী মিশেল লারনেডকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলতে বের হন রশীদ তালুকদার। সারা দিন তাঁরা গোলাগুলি আর বিজয় উল্লাসের ছবি তোলেন। শাহজাহান নামে যে ছেলেটা তাঁর বাসায় থাকে, ওই দিন দুপুরে হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারায় সে-ও।
১ / ৪
ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বির মরদেহ [রায়েরবাজার, ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১]। আলোকচিত্র : রশীদ তালুকদারদৃক–এর সৌজন্যে

দৈনিক সংবাদ-এর নিজস্ব আলোকচিত্রী হিসেবে পরদিন সকালে আবার রায়েরবাজারে যান তিনি। দেশীয় সাংবাদিক ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। হারানো স্বজনের খোঁজে জোয়ারের মতো মানুষ ছুটে আসতে থাকে। বিজয়ের আনন্দ উদ্‌যাপনের বদলে তাঁদের বুকে নেমে আসে শোকের করুণ ছায়া। তাঁদের আহাজারিতে রায়েরবাজার ও এর আশপাশের এলাকা বিদীর্ণ হয়ে ওঠে। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে অনেকেই সেদিন মূর্ছা যান। ওই দিন এই এলাকার বিভিন্ন ডোবা, নালা ও গর্ত থেকে অসংখ্য লাশ উদ্ধার করা হয়। বেশির ভাগ লাশ গলিত-বিকৃত। দেখে চেনার উপায় নেই। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের, বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক আলীম চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হক ও আওয়ামী লীগ কর্মী মোহাম্মদ বদিউজ্জামান, মোহাম্মদ শাহজাহান ও মুহাম্মদ ইয়াকুব মিয়ার লাশ শনাক্ত করা হয়। এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবনের অন্তিম পর্বের মর্মন্তুদ মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় তুলে নেন রশীদ তালুকদার।

অচেনা নারীর মুখ [রায়েরবাজার, ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১]। আলোকচিত্র: রশীদ তালুকদার
দৃক–এর সৌজন্যে

১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালির বিজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের এক মহাপরিকল্পনা আঁটে। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে তারা দেড় হাজার বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরি করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিংস্র স্বাপদের নখর বিস্তার করে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে বহুসংখ্যক গুণী শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, গবেষক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও ছাত্রকে তুলে নিয়ে যায়। মোহাম্মদপুর ও রায়েরবাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে তাঁদের হাত বেঁধে, চোখ উপড়িয়ে, বেয়নেট চার্জ ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ইত্তেফাক লিখেছে, ‘ফেরাউনের আমল হইতে হিটলারের গ্যাস চেম্বার পর্যন্ত বহু অমানুষিক ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী আমরা শুনিয়াছি। কিন্তু সোনার বাংলার এই সোনার সন্তানদের হত্যাকাণ্ড বিশ্বের সকল জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডকে ম্লান করিয়া দিয়াছে।’

১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালির বিজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে দেড় হাজার বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরি করে।

ওই দিন দৈনিক বাংলা ‘কোন ভাষায় প্রকাশ করব “আলবদর” পশুদের এই নৃশংসতা’ শিরোনামের একটি হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে অবশ্য প্রতিবেদকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। দৈনিক বাংলার প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘গতকাল শনিবার সকালে কাটাসুর, রায়েরবাজার বিল, বসিলার বিল এলাকায় আমি যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তার আগে পর্যন্ত বেদনার তীব্রতা যে কত বিধ্বস্ত করে দিতে পারে, বুঝতে পারিনি। ১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়ের পর দুর্গত এলাকায় কখনো হাজার হাজার শবের একেকটি মিছিল দেখতে পেয়েছি। প্রকৃতির নিষ্ঠুর তাণ্ডবলীলা দেখে তখন বেদনাহত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়েছি। কিন্তু হানাদার পাকবাহিনীর সহযোগী আলবদর ও আলশামসদের এই বধ্যভূমিতে এসে মানুষের তাণ্ডবলীলার স্বাক্ষর দেখে বেদনায় আমি যেন স্থবির হয়ে পড়েছি। আমরা বহু সাংবাদিক নিজেদের গৃহত্যাগ করে অন্যত্র অবস্থান করে অল্পের জন্য এই বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমার প্রিয়জনদের মৃতদেহের ভীড়ে আমি যেন আমাদের ছায়া দেখতে পেলাম। এটা হতে যাচ্ছিল আমাদেরও বধ্যভূমি।’

রশীদ তালুকদারের সঙ্গে লেখক [বঙ্গভবন গেট, ঢাকা, ২ ডিসেম্বর, ২০০৬]। আলোকচিত্র: হাসান রহমান
দৃক–এর সৌজন্যে

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও এর ভয়াবহতা বুঝতে দৈনিক বাংলার ওই প্রতিবেদনের উপসংহারটি পাঠ করা খুবই জরুরি। পত্রিকাটির প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘বিস্তীর্ণ মাঠের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাশগুলো। কোথাও এক সাথে কয়েকটি লাশ স্তূপাকার করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। রায়েরবাজার বিল ও বসিলার বিল এলাকায় যে মৃতদেহগুলো দেখতে পেলাম, তার প্রায় সবগুলোই মাত্র দুই-তিন দিনের বলে মনে হলো। এক জায়গায় দেখতে পেলাম মাটি চাপা দেয়া দুটি লাশের অঙ্গ–প্রতঙ্গের অংশ বিশেষ বেরিয়ে রয়েছে। এগুলো কয়েক দিনের পুরোনো বলে মনে হলো। লাশের পর লাশ। কারো ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। স্থানীয় এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকদের মুখে শুনতে পেলাম অদূরে সাত গম্বুজ মসজিদ ও শিয়াদের ইমাম বাড়ার পশ্চিম দিকস্থ ঢালু এলাকায় আরো বহুশত লাশ পাওয়া গেছে। ওদিক যাওয়া যায় না। এখনো নাকি গুলি ছোড়া হয়। হঠাৎ কান্নার শব্দ পেলাম। পাশে ছিলেন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক মি. ফিনলে। তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কাঁদছেন ভারতীয় একজন সাংবাদিক। আমিও কাঁদছি। কাঁদছে আরো অনেকে। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে অতলান্ত বেদনায় সাগর হয়েছে আমাদের শোকের পৃথিবী।’