মজার স্মৃতির হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ (বাঁ থেকে) ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম তারা, সালেহ চৌধুরী, মাসুক হেলাল (পেছনে), হুমায়ূন আহমেদ ও জনৈক অভিনেত্রী। ১৯৯৫ সালে ‘আগুনের পরশমণি’ ছবির শুটিংয়ের অবসরে
ছবি: সোমেজ

এইসব দিনরাত্রি নামে হুমায়ূন আহমেদের একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়েছিল। নিমেষেই সারা দেশে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এইসব দিনরাত্রি তাঁকে স্বাচ্ছন্দ্যও দিয়েছে। এটা লেখার টাকা দিয়ে রঙিন টিভি কিনেছেন। এইসব দিনরাত্রি নাটকটি নিয়ে পরে উপন্যাসও লিখেছিলেন। অনিন্দ্য প্রকাশনীর নাজমুল হক বইটি বের করেন। বইটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। হুমায়ূন আহমেদকে নাজমুল একটি সাদা গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সে সময় প্রকাশনাজগতে সেটি ছিল বড় ঘটনা।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

২.

হুমায়ূন আহমেদ প্রথমবার মিসির আলি লিখলেন। সেই পাণ্ডুলিপি আমি সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্য নিয়ে গেছি সকালে। মিসির আলির পাণ্ডুলিপি পড়েছি ইলাস্ট্রেশন করার জন্য। বিকেলে হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হুমায়ূন ভাই, মিসির আলি কে?’

গম্ভীর গলায় হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘আমিই মিসির আলি। শোনো মাসুক, আমাকে আঁকবে না। তোমার যা মনে হয়েছে, সে রকম আঁকো।’

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

৩.

তখন সামরিক শাসক এরশাদের জমানা। আমি মিনার মাহমুদ সম্পাদিত বিচিন্তার কার্টুনিস্ট। একদিন হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ফোন করলেন, ‘শুক্রবার আমার বাসায় আসতে পারবে? কথা আছে।’

আমি গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘দেশে যা হচ্ছে! ঘোরের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেলেছি। গল্পটা প্রথমে বিচিত্রায় দিয়েছিলাম, পরে আরও দু–তিনটা সাপ্তাহিকে। কেউ ছাপতে চায় না। তিন মাস ধরে পড়ে আছে। তোমাদের বিচিন্তা তো ৩২ পাতার। এখানে তো আর ছাপা যাবে না।’

আমি বললাম, ‘লেখাটা দিন। কথা বলে দেখি।’

লেখাটা নিয়ে এসে আমি বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদকে দিলাম। মিনার আমার সামনেই বসে লেখাটি পড়লেন। বললেন ছাপতে চাই, কিন্তু ছাপতে হবে ছোট টাইপে। নইলে অনেকটা জায়গা নিয়ে নেবে।

বিচিন্তা ফটোকম্পোজ করে কাগজে পেস্টিং করা হতো। এরপর ম্যাগাজিনের সাইজে ফিল্মে টেনে ছোট করে নেওয়া হতো। গল্পটা নয়–দশ পয়েন্টে টেনে ছাপা হয়। গল্পটা ছিল সেনাশাসক এরশাদ ও তাঁর মন্ত্রী এবং সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। শুক্রবার বিচিন্তা বের হলো। আমি চাপা টেনশনে। বিকেলে খবর পেলাম, ওপর থেকে কিছু টেলিফোন এসেছিল মিনারের কাছে। ওই গল্পটি খুব আলোচিত হয়েছিল। কিছুদিন পর বিচিন্তা বন্ধ হয়ে যায়।

‘অভ্যুত্থান দিবসে চট্টগ্রামের গণহত্যা এবং নিরোর বাঁশী’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদকাহিনি ছাপানোর জের ধরে বিচিন্তা বন্ধ করে দেওয়া হলো। গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য জেল খাটতে হলো মিনারকে। দেখা হলে হুমায়ূন আহমেদ মিনারের কথা জিজ্ঞেস করতেন। মিনার জেল থেকে বেরিয়ে এলে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন।

মিনারকে আমি নিয়ে গেলাম।

হুমায়ূন আহমেদ মিনারের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেলখানার গল্প শুনলেন। একসময় তিনি তাঁর পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার গল্প বললেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল থেকে হুমায়ূন আহমেদ ও রফিক কায়সারকে গ্রেপ্তার করে। প্রথমে চড়থাপ্পড়–লাথি, এরপর এক চেয়ারে মাথা এবং আরেক চেয়ারে পা রেখে পিটিয়ে টানা তিন দিন রেখে দিয়েছিল। শেষে দুজনের হাতের দশ আঙুলে মোটা সুই ঢুকিয়ে রেখেছিল।

এ গল্প হুমায়ূন আহমেদ সচরাচর করতেন না। আগুনের পরশমণি ছবির শুটিংয়ের সময় আমাকে তিনি তাঁর হাতের আঙুলগুলো দেখিয়েছিলেন। দেখলে মনে হয়, আঙুলের মাথায় ছোট একটা আলাদা মাংসের টুকরা। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা আগুনের পরশমণি ছবিতে কাজে লাগিয়েছিলেন। ১৯৭১ উপন্যাসেও আছে সেই অভিজ্ঞতা।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)।
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

 ৪.

একদিন হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়ে দেখি বারান্দায় তিনি ঝিম মেরে বসে আছেন। জানা গেল, তিনি একটা পরীক্ষা করছেন। আনারস খেয়ে দুধ খেলে কী হয়, তা দেখার জন্য তিনি একটি প্রমাণ সাইজের আনারসের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ খেয়ে বসে আছেন। মাঝেমধ্যে এ ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষাগুলো তিনি করতেন। কেউ কিছু বললে সহজে বিশ্বাস করতেন না।

দৈনিক বাংলার ফিচার সম্পাদক সালেহ চৌধুরী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁকে নানাজান বলে ডাকতেন। হুমায়ূন আহমেদ সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার কাছে এসেই বলতেন, ‘নানাজানরে খবর দাও।’ সালেহ ভাইয়ের আরেক অনুরাগী ছিলেন দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদ। হুমায়ূন আহমেদ আর নিয়াজ মোরশেদকে মাঝেমধ্যেই সালেহ ভাইয়ের টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখা যেত।

সালেহ ভাই একটা ছড়ি ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সালেহ চৌধুরীর স্মৃতিচারণামূলক একটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলাম আমি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তোলা সালেহ চৌধুরীর ছবি প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ সে বই নিয়ে আমার কাছে এসে বললেন, ‘নানাজানকে আসতে বলো।’

সালেহ চৌধুরী এলেন। হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখিয়ে আমাকে বললেন, ‘এতে একটা মজার ব্যাপার আছে। বের করো তো।’ আমি ঘাবড়ে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ছবিতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর হাতে ছড়ি, আর স্টেনগানটা পেছনে রাখা।’