কবিতা লেখার জন্য গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন যে কবি

আজ কবি বিনয় মজুমদারের জন্মদিন

বিনয় মজুমদার

বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের পরে কবিতা আর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আশ্চর্য মায়া ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। তাঁর কবিসত্তার সঙ্গে ব্যক্তিক যোগাযোগ ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি। প্রেমে পড়ে কবিতা লেখার খেয়াল বা ভাবনার মধ্য দিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, এটা তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’ পড়লেই বোঝা যাবে। এরপর লিখেছেন ‘গায়ত্রীকে’। তবে এটি ছিল একটি কবিতার পুস্তিকা, মাত্র ১৪টি কবিতার সিরিজ। এ বই আকারে ছোট হলেও এটাই ছিল ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রস্তুতিপর্বের কবিতা। কবি হিসেবে বিনয় মজুমদার বাংলা কবিতায় শুধু এই একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়েই টিকে থাকবেন বহুকাল। মূলত, ‘ফিরে এসো, চাকা’ আর ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ই কবি হিসেবে তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় উঠিয়েছিল। ‘ফিরে এসো, চাকা’ ৭৭টি কবিতার কাব্যগ্রন্থ। অন্যদিকে ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ ছিল ৭টি দীর্ঘ কবিতার গ্রন্থ। এই দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখেই বিনয় মজুমদার বাংলা কবিতার ভুবনে অমর হয়ে থাকবেন আশা করা যায়। তবে এ দুটি কাব্যগ্রন্থের উপস্থাপন, বাক্‌ভঙ্গি, মেজাজ আর প্রকরণ একদমই আলাদা। এ ছাড়া কবির আরও দুটি কবিতার বই বেশ আলোচিত বা বহুলপঠিত। এর একটি ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ আর অন্যটি ‘শিমুলপুরে লেখা কবিতা’। এর মধ্যে কবিতার যে নির্যাস আমরা পাই, তা কবির আত্মজৈবনিক অবদমন থেকে উঠে আসা ব্যক্তিক আত্মনিনাদের নির্মেদ প্রকাশ। ছাত্রজীবনে অমিত মেধাবী মানুষ, কবিতা লেখা আর কবিতাযাপনের ঘোরগ্রস্ততায় ছিলেন আমৃত্যু, একাধিকবার মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়েও জীবন কাটিয়ে ছিলেন। তবে তাঁর ব্যর্থ প্রেম আর কবিতার প্রতি ছিল অদম্য অবসেশন। কিন্তু, ‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশের পর তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কবি। অথচ এই সিরিজ কবিতার ভেতর ছিল ভরপুর অবদমনের রোয়াব। কবি হিসেবে বিনয়ের কাব্যভাষ ছিল একেবারে স্বতন্ত্র। যেমনÑ ‘মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে’। আবার, এই একই কবিতার শেষ লাইনে কবি লিখেছেন, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’। অথবা ‘আকাশ আশ্রয়ী জল বিস্তৃত মুক্তির স্বাদ পায়, পেয়েছিল/এখন তা মৃত্তিকায়, ঘাসের জীবনে, আহা, কেমন নীরব’। অথবা ‘স্বপ্নের আধার, তুমি ভেবে দ্যাখো, অধিকৃত দুজন যমজ’। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে শুধু ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকেই।

বিনয় মজুমদার নিজেই জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কবিতার আঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত প্রেম-অপ্রেম, পাওয়া-না পাওয়ার অনুরণন থেকে সংবেদনশীলতাকে নির্ভার কাব্যিক করে তুলে আনার কৃত কৌশল একান্তই বিনয়ীও ঘরনার। তাঁর ব্যর্থ প্রেম বা একতরফা অবদমন থেকে মাউথ অর্গানের মতো বাজিয়ে সুর তুলে এনে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সর্বজনের মধ্যে। তাঁর গাণিতিক প্রতীকের মতো শব্দের ব্যবহার ছিল সত্যিই বিরল। আবার তাঁর অনেক কবিতা পড়ার সময় মনে হয়, দিনলিপি পড়ছি বা দাঁড়িয়ে আছি কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের সামনে। কবিতার কাব্যিক উপস্থাপনের কারণে দিনলিপির মতো লেখা কবিতাও আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র মতো কাব্যগ্রন্থ যে প্রেম-অপ্রেমকে উপলক্ষ করে এভাবে লেখা সম্ভব, তা বিনয় অধরা অলৌকিক জগতের মতো নিমার্ণ করে দেখিয়েছিলেন। তাঁর চোখ ছিল আসলেই দ্রষ্টার চোখ, অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষমতার বিন্যাস করেছেন কবিতায়। আর গদ্যের অনুরণিত শব্দের ব্যবহার করেছিলেন গাণিতিক বিন্যাসে, সাঁকোর মতো গড়ে তুলেছেন কাব্যিক সত্য, শব্দের দেয়াল ভেদ করে দৃষ্টিগোচর সরলতার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অথচ তাঁর প্রেমজ অনুভূতির প্রগলভ প্রকাশ কবিতায় স্থান পায়নি সেভাবে। তবে বেদনা আর কামনাও যেন আক্ষেপকাতর করে তুলেছে অমসৃণ জীবনের পথ। ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ একটি অভিনব কবিতার গ্রন্থ। এর নামের সঙ্গে অনুভূতিমালা থাকলেও কবিতায় আবেগ, অনুভূতির প্রকাশ খুবই কম আছে বলেই মনে হয়েছে। এ গ্রন্থের কবিতায় গভীর চিন্তা আর উপলব্ধির অভিজ্ঞান পাওয়া যায় বেশি। যেমন ‘পাপড়িরা ফুলে ওঠে, দুলে ওঠে এলোমেলো পারাগকেশর’। অথবা, ‘কালো-কালো সবকিছু ভোরবেলা দেখা দেবে যার-যার আপনার রঙে’। আবার, ‘ছায়াগুলিÑপৃথিবীর অধিবাসীগুলি নড়ে, সঙ্গে সঙ্গে যেতে থাকে যেন শিষ্য হয়ে’। এমন অনেক পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘতর গদ্যভাষিক বয়ান পাওয়া যায়। ‘বিম্ব কিংবা প্রতিবিম্ব কেবলই আলোর দ্বারা সুনির্মিত মূর্তি আর শরীর’। গভীরতর সব চিন্তা আর আত্মনিনাদও প্রকাশ করেছেন বিনয়—‘মোহনা, তোমার যত কাছে আসি, তুমি তত অধিক চওড়া হয়ে যাও’। কিংবা, ‘বহু নিচে সমভূমি, সমতলভূমি নিচে পড়ে আছে দিগন্ত অবধি’।

বিনয় মজুমদার

ব্যক্তিগত জীবনে বিনয় মজুমদার ছিলেন অকৃতদার। কবিতা লেখার জন্য জীবনের চরমতম ঝুঁকি নিয়ে কবিতার শহর কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দুর্গমের দিকে, গ্রামীণ জীবনের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য। তাঁকে কেউ কেউ ‘কবিতার শহীদ’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। ছাত্রজীবনে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর ভালো ভালো চাকরি করার মতো সুযাগ ছিল, খুবই ভালো আয়েশি জীবন যাপন করার সব সুযোগ পায়ে মাড়িয়েছিলেন, শুধুই কি কবিতা লেখার জন্য? এমনটাও কেউ কেউ বলে থাকেন। কলকাতার জীবন গ্রহণ না করে ফিরে গিয়েছিলেন শিমুলপুরের অখ্যাত পৈতৃক ভিটায়। এর পেছনে কী ছিল, কবির প্রিয়তাকে হারানোর বেদনা? আরও সহজ করে যদি বলি, তাহলে গায়ত্রীকে কাছে না পাওয়ার আক্ষেপে নিমজ্জন ঘটেছিল কবির। গায়ত্রী চক্রবর্তীকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন কবি। আবার নিজেই বলেছেন, কাউকে সেভাবে ভালোবাসা হয়ইনি জীবনে। অথচ গায়ত্রী তাঁর ভালোবাসা পায়ে ঠেলে, পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন সমুদ্রপৃষ্ঠের দূরত্ব। বিনয় মজুমদারকে নিয়ে এমন প্রচলিত আখ্যান আমরা অনেকেই জানি। আপাতদৃষ্টে, প্রিয়কে হারানো অথবা না পাওয়ার বেদনা কবির শিমুলপুরের মতো অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকার একমাত্র কারণ ছিল, এমনটা আমাদের মনে হতেই পারে। কিন্তু এটা একমাত্র কারণ মোটেই ছিল না। কবিই লিখেছিলেন,Ñ‘বিনিদ্র রাত্রির পরে মাথায় জড়তা আসে, চোখ জ্বলে যায়’ কিংবা ‘বাতাস আমার কাছে আবেগের মথিত প্রতীক,/জ্যোৎস্না মানে হৃদয়ের দ্যুতি, প্রেম; মেঘ-শরীরের’। মহাকবি দান্তের বিয়াত্রিচের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের গায়ত্রীর একটা জায়গায় মিল আছে। তা হলো, উভয় কবির একজন মানসপ্রিয়া ছিল। আর উভয়ের লেখালেখির অনুপ্রেরণার উর্বর জমিন দখল করে ছিল তাঁদের না পাওয়া প্রেমিকার সরব অথচ অদৃশ্য অনুপস্থিতি। কবিরাও কখনো কখনো পুরাণের মতোই পরাশ্রয়ী হয়ে ওঠেন, আর সেভাবেই লেখার উৎসাহ পেয়ে থাকেন। এতে করে একটা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে অর্থাৎ জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে কবিদের সম্পর্কে কথিত জীবনযাপন, আখ্যান মুখ্য হয়ে ওঠে। বিনয় মজুমদার স্বেচ্ছায় নিঃসঙ্গতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর অনেক কিছুই করার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেভাবে কোনো কিছুকেই জুতসই মনে করেননি। নারীসঙ্গ বর্জন করে ডুবে গিয়েছিলেন কবিতার অন্তর্মহলে। এর সঙ্গে গাণিতিক আর জ্যামিতিক চর্চা নেশার মতো পেয়ে বসে ছিল। বস্তুত, ব্যক্তিগত জীবনে নারীবর্জিত বলে কবিতার পরতে পরতে লুকানো আছে অবদমন আর যৌন অভিলাষ। কবি লিখেছেন,Ñ‘সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে’। এখানে ‘ফুল’ আসলেই রমণীয় নারীর প্রতীক। নারী আর পুরুষের স্বাভাবিক জীবনের অধিবাসী হয়ে উঠতে গেলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র টান থাকবেই। আর তা যদি না-ই থাকে, তবে মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। এমনটা কবির ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে মনে হতেই পারে। কারণ, মানুষ মূলত একা, ভুলবশত একা। তারপরও বিনয় লিখেছেন, ‘দিবালোকে দেখা হলে মনে হয়, এ সকল যুবক-যুবতী/পরস্পর কখনোই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে কাঁদেনি-হাসেনি’। কীভাবে একজন কবি মিথ হয়ে ওঠে, তা বলা খুবই কঠিন। কিন্তু মিথিক মানুষমাত্রেই কবি হয়ে ওঠে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কবি হিসেবে বিনয় মজুমদার এমনই একার সন্ন্যাস নিয়ে মেতে থাকেন, সৃষ্টির উৎসারে। তবু কবি বলেন, ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?/লীলাময় করপুটে তোমাদের সবই ঝরে যায়’। আবারও লেখেন,Ñ‘নানা কুন্তলের ঘ্রাণ ভেসে আসে চারিদিক থেকে।/হৃদয় উতলা হয়, ফুটন্ত জলের মতো মোহে’। এখন মনে হয়, কবিজীবনের অজস্র গল্পের ডালপালা, চারদিকে বিপুলভাবে ছড়িয়ে গেলে, একদিন সেই সব গল্পের বুনন থেকে অচেনা পাখির জন্ম হতে থাকে। এভাবেই কবির কলবর কিংবদন্তির পথে হেঁটে হেঁটে পুরাণের প্রকৃত পাখি অথবা নন্দিত কবি হয়ে বেঁচেবর্তে থাকে মরে যাওয়ার পরও। বাংলা কবিতার ভুবনে এমনই এক কবি ছিলেন, আজও আছেন অদ্ভুত এক উজ্জ্বল মাছ হয়ে বিনয় মজুমদার।