আমার রাগী বাবা ও তাঁর কড়ে আঙুল

প্রিয় আব্বু,

ছোটবেলায় তোমাকে আমি বড্ড ভয় পেতাম! শুধু যে আমি ভয় পেতাম তা না,পরিবারের সবাই তোমাকে বেশ ভয় পেত। তুমি সব সময়ই বেশ রাগী এবং জেদি। অনেক ক্ষেত্রে তোমাকে অসামাজিকও বলা হয়। অদ্ভুতভাবে তোমার এই সবগুলো গুণই আমি পেয়েছি! আম্মু তো সুযোগ পেলেই বলে, ‘বাপের মতো হইছস তুই!’ ছোটবেলায় বুঝতাম না কিন্তু বড়বেলায় আমি মানি যে, ‘আম্মুর কথা আসলেই সত্যি, আমি তোমার মতোই হয়েছি অনেক ক্ষেত্রে!’

ছোটবেলায় প্রতিবারই স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পরপরই আমি এক মাসের জন্য তোমার মুখোমুখি আর হতাম না। অনেকটা লুকিয়ে থাকতাম বলা যায়! বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয় কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এখন বরং আমার মাথায় ঢোকে না, কেন তখন তোমাকে এত ভয় পেতাম! এসব মনে হলে এখন হাসি পায়।

তোমার মনে আছে, ক্লাস ওয়ানে যখন আমার পা কেটে গিয়েছিল, তখন মেজ ফুফু আর ছোট ফুফু আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে দেখেই তুমি একটা থাপ্পড় মেরেছিলে। তুমি যখন আমাকে থাপ্পড় মারলে মেজ আর ছোট ফুফু খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে তুমি একাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলে, ডাক্তার আমার পায়ের কাটা স্থান সেলাই করলেন। তুমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এবং সারা দিন তুমি কিছুই খেলে না।

অদ্ভুত হলেও সত্যি, ক্লাস নাইনের আগ পর্যন্ত আমি তোমার দেওয়া থাপ্পড়টাকেই মনে রেখেছিলাম আমি, তুমি যে খাওনি সারা দিন, কেন খাওনি, সেটা নিয়ে ভাবিইনি কখনো। ক্লাস নাইনে যখন আমার পা পুড়ে গেল তখনো তুমি সারা দিন কিছুই খাওনি। কিন্তু সেদিন আমি জেনেছিলাম, তোমার না খেয়ে থাকার কারণ। তুমি আম্মুকে বলেছিলে, ‘আমার খারাপ কিছু হলে তুমি খেতে পারো না।’

এখনকার মতো ছোটবেলায় জন্মদিনের তারিখ মনে থাকত না। ক্লাস ফাইভে একদিন সকালে তোমার সঙ্গে বসে বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সম্ভবত 'সুপ্রভাত' নাম ছিল। অনুষ্ঠানটায় সেদিন যাদের জন্মদিন, তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল উপস্থাপিকা। হুট করেই তুমি বলে উঠলে, ‘আজ তো তোরও জন্মদিন!’ এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা জন্মদিন সেদিনই এবং সেরা শুভেচ্ছা আমি সেদিনই পেয়েছিলাম,তা–ও তোমার পক্ষ থেকেই!

>জানো আব্বু, ছোটবেলায় যে রকম তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতাম, ঠিক তেমনি এখনো রাস্তায় তোমার সঙ্গে বের হলেই কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতে ভালো লাগে! তোমার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছি কিন্তু তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটার সুযোগ মিস করেছি, এ রকম কমই হয়েছে।

বাসে ঘুমিয়ে পড়ি বলে তুমি সব সময় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দিয়ে আসতে। ভয় পেতে আমাকে একা যেতে দিতে। কিন্তু তোমার ব্যাক টু ব্যাক জার্নি আমার ভালো লাগত না। কেমন যেন কষ্ট লাগত। তাই অনেকটা জোর করেই আমি একা একা চলা শুরু করলাম। তোমার অনুমতি আদায় করতেই আমার তিন বছর লেগে গেল।

এই যে এখন আমি একা একা চলাফেরা করি, এখন কিন্তু আমি বাসে ঘুমাই না। অথচ আব্বু, তুমি তো জানোই না, তুমি আমার সঙ্গে থাকতে বলেই আমি ফেনী থেকে ভাটিয়ারী পর্যন্ত দেড় ঘণ্টার জার্নিও ঘুমিয়ে পার করতাম।

জানো আব্বু, ক্লাস নাইনে তোমাকে অজ্ঞান পার্টি ড্রাগ পুশ করল যেদিন, সেই দিনের থেকে ভয়ংকর দিন বোধ হয় আমার জীবনে আর আসেনি। আম্মু আমাকে ইংলিশ টিচারের প্রাইভেট থেকে নিতে এসেছিল। স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় আমি, সামিয়া আর ছোট আঙ্কেল আম্মুর সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে তোমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তুমি অজ্ঞান ছিলে এবং দুই দিন আইসিইউতে ছিলে। আবার যখন তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে, আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। আম্মু তোমাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিল। পুরো বাসা সামলানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। সেবারই আমি প্রথম জেনেছিলাম মা–বাবা বাসায় না থাকলে কেমন লাগে! দায়িত্ব নিতে শিখেছিলাম। সেই সময়টায় আমি আরেকবার ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম! তুমি ঢাকায় থাকাকালে একবার তোমাকে আমি কল দিয়েছিলাম, তুমি রিসিভ করলে না। তারপর আম্মুকে কল দিলাম, ছোট আঙ্কেলকে কল দিলাম। কেউই রিসিভ করলে না। অনেকবার কল দেওয়ার পরও কেউ কল রিসিভ না করাতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কান্নাকাটি শুরু করেছিলাম এবং কলের পর কল দিতে থাকলাম। ভয়ে আমার হাত–পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর তোমরা কল ব্যাক করলে। কিন্তু জানো, সেই দিনের পর থেকে আমি কাউকে দু–তিনবারের বেশি কখনো কল দিই না। তিনবার কল দেওয়ার পর কেউ রিসিভ না করলে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে।

একবার তুমি আমাকে হুট করেই বলেছিলে, তুই তো তোর মাকে বেশি পছন্দ করিস! এই কথাটা শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। হয়তো আমি তোমার সঙ্গে খুব একটা ফ্রি না, তবুও আমি তোমাদের দুজনের মধ্যে তুলনা করা যায় না কখনোই! তোমার কাছে সরাসরি কোনো জিনিস চাইতে বরাবরই আমার লজ্জা লাগে! তাই সব সময় আমার হয়ে আম্মুই তোমাকে বলে। তোমাকে কখনো সরাসরি ‘আব্বু তোমাকে ভালোবাসি’ বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই আজকে লিখতে বসেছি!

আব্বু তুমি কি জানো, আমাকে তুমি একবারই সরি বলেছিলে! আর সেই সরি শুনে আমি খুব কান্না করেছিলাম। এই বছরেরই জানুয়ারি মাসের একদিন। সেদিন আমি তোমার কলের জন্য রাত ১০টা থেকে অপেক্ষা করছিলাম। সাধারণত তুমি রাত ১০টা থেকে ১২টার মধ্যেই আমাকে কল দাও প্রতিদিন। তুমি কল দেওয়া মাত্রই আমার রুমমেট আপুরা বলে, ‘মীমের কিউট আব্বুটা কল দিয়েছে!’ ক্যাম্পাসে থাকাকালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তোমার সঙ্গে আমার ২০-৩০ সেকেন্ডের বেশি কথা হতো না। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতে, ‘কেমন আছি, খেয়েছি কি না, রাত জেগে পড়িস না, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যা, ব্যস এইটুকুই!’ এই সংলাপটুকু এবং তোমার কল দেওয়ার সময়টা আমার রুমমেট আপুরা জানে বলেই তুমি কল দেওয়া মাত্রই সবাই বুঝে যায় যে তুমি কল দিয়েছ এবং বলে মীমের কিউট আব্বুটা কল দিয়েছে! তাই সেদিনও আমি তোমার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু রাত ১২টা পেরিয়ে গেল! তুমি আমাকে কল দিলে না! আমার কেমন যেন অভিমান হতে লাগল এই ভেবে, কেন তুমি কল দিলে না আজকে! তারপর আমি তোমাকে কল দিলাম। তুমি কল রিসিভ করেই আমাকে বললে, ‘স্যরি মা, ভুল হয়ে গেছে!’ ব্যস্ততার কারণে তুমি কল দিতে ভুলে গিয়েছিলে সেদিন। সেদিন তুমি আমাকে প্রথম সরি বলেছিলে এবং তোমার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমি প্রচুর কেঁদেছিলাম! কেন, আমি জানি না! হয়তো বয়স বাড়ছে, সঙ্গে ভয়-আতঙ্কও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়জন হারানোর সময়ও যে ঘনিয়ে আসছে!

জানো আব্বু, ছোটবেলায় যে রকম তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতাম, ঠিক তেমনি এখনো রাস্তায় তোমার সঙ্গে বের হলেই কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতে ভালো লাগে! তোমার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছি কিন্তু তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটার সুযোগ মিস করেছি, এ রকম কমই হয়েছে। যখনই তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটি, তখন আমার নিজেকে সেই ছোট্টটি মনে হয়! একটা গোল ফ্রক পরে একটা বাচ্চা মেয়ে তার বাবার কড়ে আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছে...।

ভালোবাসি তোমাকে, আব্বু। তুমি সব সময় সুস্থ থাকো। এখনো আমার অনেকবার তোমার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটা বাকি আছে...।
ইতি,
তোমার মীম।

শিক্ষার্থী,
চতুর্থ বর্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]