কবি মরে গেলে...

কোলাজমনিরুল ইসলাম
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হত্যাকাণ্ডের শিকার এক কবি। সেই প্রেক্ষাপটে রচিত এই লেখায় আছে সময়ের শব্দাবলি।

জল ও হাওয়ার কোনো দেশ নেই, নেই সীমানা। বহমানতাই এর অস্তিত্ব। স্বাভাবিকতা। কিন্তু কী আর স্বাভাবিক থাকে বা থাকছে আমাদের এই কালে? ছুরি-কাঁচি হাতে সেই কবেই তো লোকেরা লেগেছে গাছেদের পিছে। তাল তাল কংক্রিট নিয়ে নদী দেখা, নদী মাপা লোকেদের ভিড়ে জল তো কবেই সীমাবদ্ধ হয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে এ সীমার চোখরাঙানি। মেনে নিয়েছে স্থলের মতো করে জলেরও আছে মালিকানা। কিন্তু কবি তো আলাদা। কবিকে বলতেই হয় নির্বাধ জলস্রোতের কথা। তাকে দাঁড়াতেই হয় মুনাফার বাঁধের বিপরীতে। আর এই ‘অস্বাভাবিক’ দাঁড়িয়ে যাওয়ার দায়ে মরে যেতে হয় তাকে।

পিটিয়ে মারার এই কালে কিংবা আকালে একজন কবিকে, বয়সে যে তরুণ, যার চোখ স্বচ্ছ খুব, তাকে নিশ্চুপ করে দেওয়া হলো কত অনায়াসে। একটি খাল ও তার বাঁধ-বেদনা, আর সেই বদ্ধ জলের যন্ত্রণার মাশুল গুনে তার স্বচ্ছ চোখকে হয়ে যেতে হলো সাদা, বাকহীন।

সৈয়দ মুনাব্বির আহমেদ তনন। একজন কবি। তারও আগে একজন মানুষ। ফলে তাঁকে রুদ্ধতার প্রতিবাদ করতেই হতো। যেকোনো রুদ্ধতা, যেকোনো বদ্ধ আবহ কবিমাত্রকেই যন্ত্রণা দেয়। তননও সে যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন হয়তো। তিনি জানতেন না, তাঁর শারীরিক মৃত্যুর বহু আগেই এই এখানে শুরু হয়ে গেছে কবি–ধারণাটির মৃত্যুর আয়োজন।

পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে রসের সঞ্চার করেই শুধু কবি হওয়া যায় না। কবিতা আরও অনেক বড় কিছু দাবি করে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্যের এবং একমাত্র সত্যের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠতে হয় তাকে। সে সত্য হয়তো তখনো সামনে হাজির নয়। সে সত্য হয়তো তখনো প্রলম্বিত কোনো এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের ওপারে টিমটিমে আলো হয়ে একটু দেখা যায়, কি যায় না। সে সত্য হয়তো খুব সুদূরে বসে জিরোচ্ছে আপাতত।

হেমন্ত–বিকেলের তেরছা রোদের মতো সে সত্য হয়তো ঢুকে পড়বে না এখনই ঘরদোরে। কিন্তু কবিকে সে সত্য জানার, তার পথটি চেনার বিদ্যা রপ্ত করতে হয়। তাই তননের পক্ষে ওই খালের বাঁধটি ডিঙিয়ে অন্য অনেকের মতো নির্লিপ্তভাবে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

বাঁধের বিনুনি পাকানো লোকেদের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েও রোদের উৎস খোঁজাটা নিশ্চয় অপরাধ। ফলে কবিকে মরে যেতে হয়। না মরে আর উপায় থাকে না তার। কবি বা কবিবোধের মরে যাওয়ার এই কালে, ঘুমপাড়ানি দিনের এ বাস্তবতায় জেগে ওঠাটাই তো বড় অপরাধ। তনন সে অপরাধ করেছিলেন। চুপ না থাকার অপরাধ। কবির ভূমিকা গ্রহণের অপরাধ।

কারণ, কবি তো তিনিই, যিনি ‘সর্বদ্রষ্টা’ হওয়ার বিদ্যা অর্জনের পথকে বেছে নিয়েছেন। ‘ক্রান্তদর্শী’ এক সত্তা হিসেবে নিজের প্রকাশ ঘটাতে হয় কবিকে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘কবি’ শব্দের অর্থ হিসেবে এই দুটি শব্দের উল্লেখ রয়েছে। বলতে হয়, এই শব্দ দুটি আদতে ‘কবি’ শব্দের অর্থ নয়, কবি চরিত্রটির ভূমিকাকে বর্ণনা করে। কবি প্রেমে বা অপ্রেমে, দ্রোহে বা শান্তিতে বারবার সেই দ্রষ্টার ভূমিকাই নেন, যা ভবিষ্যৎ ‘ক্রান্তি’ সম্পর্কে সচেতন করে। বলে বা লিখে, এমনকি কোমর বেঁধেও এ জন্য মাঝেমধ্যে কবিকে নামতে হয়।

তননও তা-ই করেছেন। কোনো অনুমোদনের তোয়াক্কা করলে তাঁর চলত না। এই অনুমোদনের কালে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী আছে? বাঁধের বিনুনি পাকানো লোকেদের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েও রোদের উৎস খোঁজাটা নিশ্চয় অপরাধ। ফলে কবিকে মরে যেতে হয়। না মরে আর উপায় থাকে না তার। কবি বা কবিবোধের মরে যাওয়ার এই কালে, ঘুমপাড়ানি দিনের এ বাস্তবতায় জেগে ওঠাটাই তো বড় অপরাধ। তনন সে অপরাধ করেছিলেন। চুপ না থাকার অপরাধ। কবির ভূমিকা গ্রহণের অপরাধ।

কবি মরে গেলে পাখিদের পালক ঝরে যায়, বাতাস থমকে যায়, যেন-বা পাথর; কোন এক অসুখে ঘুরে ওঠে জল; রোদের রেখা চিকন হতে হতে মিলিয়ে যেতে চায়—এমন বহু কথা বলা যায় কাব্য করেই। একের পর এক শব্দ জুড়ে এক সুরম্য সৌধ নির্মাণ করা যায়। কিন্তু তাতে সেই লুট হওয়া কবির শেষ শ্বাসটুকুর হঠাৎ পাওয়া ফেরারি স্বভাবে ছেদ পড়ে না কোনো। সেই শ্বাস ঘুরে বেড়ায়, আহাজারি করে।

এই আহাজারি বা না-আহাজারিতে মরে যাওয়া সেই কবির কিছু যায়-আসে না, যদি না সেই শ্বাসের দমকে মানুষের তোলা বাঁধগুলো ভেঙে যায়, যদি না সীমাকে সত্য মানুষ একটু নড়ে ওঠে, যদি না পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি সাজানো কবিগণ একটু সত্য চিৎকারে ‘আহ্’ বলে ওঠে।
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]