কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কেন রসিকতা করেন গোপাল ভাঁড়

গোপাল ভাঁড় ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়—বাংলা লোকসংস্কৃতির জনপ্রিয় দুই চরিত্র। গোপাল ভাঁড়ের অজস্র গল্পে কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল মুখোমুখি। পয়লা বৈশাখের আগমুহূর্তে এই দুই চরিত্রের রসিকতার কার্যকারণ উদ্ধারের প্রচেষ্টা।

গোপাল ভাঁড়ের কল্পিত চিত্র
অলংকরণ: আরাফাত করিম

নিচু হয়ে রাস্তায় কিছু একটা খুঁজছিলেন গোপাল। তাই দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বললেন,

: কী খুঁজছ গোপাল?

: আমার বাবা এখানে হারিয়ে গেছেন। গোপালের উত্তর।

: আমি যদি খুঁজে দিতে পারি, আমাকে তুমি কী দেবে?

: অর্ধেক দেব হুজুর।

‘অর্ধেক বাবা’ নামে গোপাল ভাঁড়ের এ গল্প পড়ার পর বাঙালিকে গোমড়ামুখো বলে সাহস কার! হাসির রাজা গোপাল ভাঁড় একাই এক শ। তাঁর টক-ঝাল-মিষ্টি গল্পগুলো যদি কারও সামনে মেলে ধরা হয়, ওই বান্দা কি আর গোমড়া হয়ে থাকতে পারবে? সুকুমার রায় যখন ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা/ বাড়ি তার বাংলা/ মুখে তার হাসি নাই দেখেছ?’ লিখেছিলেন, সে সময় গোপাল ভাঁড়ের মুখটি তাঁর মনে একবারও ভেসে ওঠেনি, এটা এখন হলফ করেই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তো, গোপালের মুখটি কেমন?

এপার-ওপার বাংলায় গোপাল ভাঁড়ের সংকলনগুলোয় তাঁর যেসব ছবি দেখা যায়, সেখানে আঁকার ভিন্নতা থাকলেও একটি বিষয়ের মিল ষোলো আনা। বরাবরই গোপালের চরিত্রটি হাসিমুখে হাজির। ‘প্রজা’ গোপাল কৃষ্ণনগরের ‘রাজা’ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে একের পর এক রগড় করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। আর ‘গরিব’ ভাঁড়ের কাছে রাজার পরাজিত হওয়ার ঘটনায় আমজনতা হিসেবে মুফতে আমরাও হেসে কুটি কুটি। ৩০০ বছর ধরে গল্পগাথা এবং তাতে আঁকা ছবিতে গোপাল ভাঁড় নিজে যেমন হাসছেন, তেমনি আমাদেরও হাসিয়ে চলেছেন। কিন্তু ভাঁড়ামো করে কেন হাসান তিনি? বাংলার লোকজ রম্যগাথার প্রধান এই চরিত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে টক্কর দিতে চান। কেন?

গোপাল ভাঁড়ের জন্মের পটভূমি ১৮ শতকের কৃষ্ণনগর। এই নগরের নৃপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি বাস্তব ও ঐতিহাসিক চরিত্র। ইতিহাসবিদেরা তাঁকে ‘যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ’ অভিধা দিয়ে নদীয়া পরগনার এ রাজা সম্পর্কে বিস্তর লিখেছেন। তাঁর রাজত্বকালে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ক্লাইভ বাহিনীর কাছে হেরে যান নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এখানে বলা দরকার যে পলাশী ষড়যন্ত্রের সময় কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ইংরেজদের সহযোগী। ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণচন্দ্র পিতা রঘুরামের মৃত্যুর পর মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮ সালে রাজ্যারোহণ করেন। মারা যান ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে, তখন তাঁর বয়স ৭৩ বছর। মীরজাফর, জগৎ শেঠসহ পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্য ক্রীড়নকদের সঙ্গে ইংরেজরা যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তা থেকে বাদ যাননি কৃষ্ণচন্দ্রও।

পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ–এর লেখক রজতকান্ত রায়ের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, সিরাজের পতনের অল্পকাল পর খাজনার ‘টাকা আদায় করার জন্য ইংরেজরা কৃষ্ণচন্দ্রকে অশেষ উৎপীড়ন করল। এমনকি হিন্দু সমাজের প্রধান ধারক ও বাহক এই রাজার জাতি নাশ করার ভয় দেখাল। বুড়ো বয়সে তাঁর জমিদারি অপরিমেয় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল। রাজা মারা যাওয়ার পর তাঁর বংশধরেরা সেই জমিদারি রক্ষা করতে পারলেন না।’ মধ্যযুগের শেষার্ধে সে সময় গোটা বাংলার সমাজ ছিল টালমাটাল। সমাজিক কাঠামো ছিল সামন্ততান্ত্রিক। নদীয়া তথা কৃষ্ণনগরও তার চেয়ে আলাদা ছিল না। এই সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজের প্রেক্ষাপটে গবেষকেরা রাজা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর ৫৫ বছরের রাজত্বকালকে বস্তুনিষ্ঠভাবেই এঁকেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর বিখ্যাত রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে ‘অসীম প্রত্যুৎপন্নমতি’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘গুণগ্রাহিতা ও গুণীগণের উৎসাহদান কার্য্যে ইনি বিক্রমাদিত্যের অনুসরণ করিয়াছিলেন। ইহার রাজসভা সুপণ্ডিত, সুকবি, সুগায়ক ও সুরসিকগণে পূর্ণ ছিল।’ বলা ভালো, অন্নদামঙ্গল কাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর কৃষ্ণচন্দ্রেরই সভাকবি ছিলেন।

গোপাল ভাঁড়, গোপাল ভান্ডারী নামেও যাঁর পরিচিতি, তিনিও কি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ? এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকেরা দুই ভাগে দাঁড়িয়েছেন। কুমুদ নাথ মল্লিকসহ অনেকেই দীর্ঘকাল প্রচারের মাধ্যমে এ তথ্য বেশ পোক্ত করে তুলেছেন যে গোপাল জাতিতে নাপিত, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ এবং তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের পার্শ্ববর্তী শান্তিপুরের বাসিন্দা। আবার নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষ-এ পাওয়া গেল তাঁর আদি নিবাস গুপ্তিপাড়া। সাম্প্রতিককালে সুজিত রায়ও গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে নামে আস্ত একটি বই লিখে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন গোপালের মানব–অস্তিত্ব।

তবে এখন পর্যন্ত রসাল গল্পগুলোর সূত্র ছাড়া ব্যক্তিমানুষ হিসেবে গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় মিলছে না। পলাশীর ষড়যন্ত্রের সময়কার সমাজ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব ও তৎকালের নদীয়ার সমাজকে বেশ নির্মোহভাবে দেখেছেন রজতকান্ত রায়। তাঁর বিবরণ, ‘কোনো সমসাময়িক বৃত্তান্তে গোপাল ভাঁড়ের উল্লেখ নেই।’ আর হোমশিখা পত্রিকায় ‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’ প্রবন্ধে সেই ১৯৫২ সালেই সুকুমার সেন লিখেছিলেন, ‘গোপাল ভাঁড় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক ছিলেন, এই আধুনিক জনশ্রুতি এখন প্রায় ঐতিহাসিক সত্য বলে গৃহীত হতে চলেছে। কিন্তু সত্য কথা বলতে কী, সত্তর-আশি বছর আগে জনশ্রুতিতে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ গোপাল ভাঁড়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।’ এমনকি গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ঐতিহাসিকেরা যেসব যুক্তি সাজিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্যে কিছু কিছু ‘ঘাপলা’ দেখা যায়। এর মধ্যে একটা হলো, ভারতচন্দ্র যেহেতু কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তাঁর রাজত্বের প্রশস্তি করে অন্নদামঙ্গল লিখেছিলেন, তাই এতে গোপাল ভাঁড়ের নাম থাকা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু নেই। তা ছাড়া কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে গোপালের কোনো ছবিও খুঁজে পাওয়া যায় না। সংগত কারণেই ঐতিহাসিকদের মত, গোপাল ভাঁড় নামে কেউ যদি সত্যিই থাকতেন, তবে অন্নদামঙ্গল-এ তাঁকে পাওয়া যেত নিশ্চয়। রাজবাড়িতে পাওয়া যেত তাঁর ছবি বা এ–সংক্রান্ত নথি। সন্দেহ নেই, তাঁদের যুক্তির জোরটা অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি।’

ফলে হালে প্রমাণ সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য: গোপাল নামের যে ভাঁড় হাস্যরসের ফোয়ারা ছোটাতেন, কৃষ্ণনগরের প্রতাপশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিত্যই যাঁর রসের ঘায়ে নাকাল হতেন, তিনি আদতে কোনো একক ব্যক্তি নন, অষ্টাদশ শতকের লোকমানসের সম্মিলিত সৃষ্টি। গোপালের গল্পে কৃষ্ণচন্দ্রের ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকলেও রাজার সাঙাত গোপাল মোটেই ইতিহাসনিষ্ঠ নন। আঠারো শতকপরবর্তী নবগঠিত কলকাতার চিৎপুর রোডের দুপাশের অলিগলি আর শোভাবাজারে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় যে লঘু সাহিত্যের জন্ম, বটতলার সেই সাহিত্যই মানুষের মুখে মুখে ফিরে গোপাল ভাঁড়কে বয়ে নিয়ে গেছে এবং জনসংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অনলাইন-ফেসবুকের ডিজিটালাইজড যুগেও ভাঁড় গোপালের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি পড়েনি, বরং ‘নয়া মিডিয়া’র সুবিধা নিয়ে আমাদের সামনে এখন আরও ঝাক্কাসভাবে হাজির হচ্ছে গোপালের বক্র রসকৌতুক।

গোপাল ভাঁড়ের গল্পগাছার ক্ষেত্রে ‘বক্র রস’ শব্দটি বড় লাগসই। স্মরণ করা যাক, কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের ‘কে বেশি অপয়া?’ গল্পটি।

একদিন সকালে গোপাল দেখা করতে এলেন কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে। মহারাজা তখন নখ কাটায় ব্যস্ত ছিলেন। গোপালের দিকে সহসা তাকাতে গিয়ে আঙুল কেটে গেল তাঁর। গোপালের মুখ দেখে এমন অশুভ হওয়ায় রাজা তাঁকে বললেন অপয়া। দিলেন প্রাণদণ্ড। এরপর গোপাল রাজাকে বললেন, ‘মহারাজ, আমার মুখ দেখে আপনার আঙুল কাটল, তাতে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন। আর আপনার মুখ দেখে যে আমার জীবন যাচ্ছে, এখন বিচার করে বলুন তো, কে বেশি অপয়া?’

কৃষ্ণচন্দ্রের আর কিছু বলার ছিল না, গোপালের যুক্তিপূর্ণ কথায় তিনি যথেষ্টই জব্দ হলেন।

গল্পে গল্পে বহুবার এভাবে রাজাকে ‘জব্দ’ করেছেন গোপাল ভাঁড়। শুধু রাজা কেন, রাজা-প্রজা কেউই তাঁর মসৃণ হুল থেকে নিস্তার পাননি। এ-ও বলতে হবে, গোপালের নামে যেসব গল্প সমধিক পরিচিত, তাতে তাঁর তির অন্যদের অপেক্ষা কৃষ্ণচন্দ্রকেই বেশি নাকাল করেছে। আঘাত নয়, কথার মারপ্যাঁচে কৃষ্ণনগরের অধিপতিকে বারবার বেকুব বানিয়েছেন গোপাল। বাংলা লোকসাহিত্যে ভাঁড় বা বিদূষক হিসেবে তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকাশভঙ্গিটি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বৈকি! এই ‘ইউনিক’ পাটাতনে দাঁড়িয়েই রাজাকে ক্রমাগত কাবু করে চলেছেন গোপাল। আরেকটি গল্পের দৃষ্টান্ত:

রেগেমেগে কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি একটা গণ্ড মূর্খ। বলতে পারো তোমার আর গাধার মধ্যে তফাত কতটুকু?’

জবাব দিতে একমুহূর্ত দেরি হলো না গোপালের। রাজা আর তাঁর মধ্যকার দূরত্ব মেপে ছোট্ট করে তিনি জানালেন, ‘আজ্ঞে মহারাজ, দেড় হাত।’

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মূর্তি
ছবি: সংগৃহীত

এ গল্প বিশ্লেষণ করে রজতকান্ত রায় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ‘সে যুগে সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে উচ্চ-নীচবিশেষ খুবই বিধিবদ্ধভাবে মেনে চলা হলেও সমাজের সব স্তরের লোকজন একজন নেতৃস্থানীয় সমাজপতির আওতায় সমবেতভাবে একই ধরনের নাচ-গান, আমোদ–আহ্লাদ, রসিকতা-কথকতায় অংশগ্রহণ করত। ...ঊনবিংশ শতকের মতো ধনী-দরিদ্রের আলাদা অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি তখনো সে রকমভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি। উচ্চ-নীচ যেমন বিধিবদ্ধভাবে বিশিষ্ট ছিল, তেমনি তাদের সম্পর্কও সহজ ছিল।’

বিদূষকদের নিয়ে লোকজীবন ও অবসরের ভাঁড় শিরোনামে গবেষণালব্ধ একটি পুস্তক লিখেছেন সাম্পান চক্রবর্তী। দুই বছর আগে বের হওয়া এ বইয়ের তরুণ গবেষকও কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে গোপালের রসিকতা নিয়ে রজতকান্তের বক্তব্যে গলা মিলিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এইটুকু সিদ্ধান্ত করা যায় যে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব ছিল না। না বাস্তবে, না লোককল্পনায়। তাহলে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যপাটের সময়কেই গোপাল ভাঁড়ের উদ্ভবের সময়কাল হিসেবে ধরা যেতে পারে, অন্তত লোকগল্পে।’

প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত চির নতুন গোপাল ভাঁড় রহস্য (হাস্যরসের ভান্ডার) গ্রন্থে তিনি দিচ্ছেন চমকপ্রদ এক তথ্য : গোপাল ভাঁড়ের অধিকাংশ গল্পই কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ বয়সে, অর্থাৎ ১৭৮০ সালের দিকে তৈরি হয়েছে। এ ভাষ্যের সূত্রে খানিকটা পেছন ফিরে ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, ১৭৫৭ সালে গোরা সৈন্যদের হাতে পলাশী পতনের পর ইংরেজদের অত্যাচার বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলায় ব্যাপক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই সঙ্গে ১৭৬৮ ও ‘৬৯ দুই বছর টানা অনাবৃষ্টির কারণে নষ্ট হয় খেতের সব ফসল, যা ১২৭৬ বঙ্গাব্দ–ইংরেজি ১৭৭০ সালে গোটা বঙ্গদেশে ভয়াবহ মন্বন্তরের প্রেক্ষাপট রচনা করে। স্বভাবতই নদীয়া অঞ্চল এবং তার রাজধানী কৃষ্ণনগরও এর বাইরে ছিল না। আগেই বলা হয়েছে, কোম্পানি শাসনের শুরুতেই দেনার দুষ্টচক্রে জেরবার হয়ে গিয়েছিল ঐশ্বর্যময় কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কেন রসিকতা করেন গোপাল ভাঁড়? এ প্রশ্নের সুরাহার জন্য তাই সমাজ-ইতিহাসের এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

বাস্তবতা যখন এমন, তখন মুখে মুখে মানুষ গল্প গড়বে। আর যুগসন্ধিক্ষণের সেই গল্পে ‘গাধা’রূপে চিত্রিত হবেন কৃষ্ণনগরের রাজা এবং গোপাল ও কৃষ্ণরাজের মধ্যে তফাত থাকবে দেড় হাত—এই তো স্বাভাবিক। এ কি সমাজের উচ্চকোটির প্রতিনিধি রাজার প্রতি বাংলার নিম্নবর্গীয় লোকমানসের নীরব তামাশা তামাশা খেলা, নাকি গল্পের মোড়কে একধরনের প্রতিবাদও?

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কোনো গল্পেই কৃষ্ণচন্দ্রের দিকে সরাসরি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন না গোপাল। পলাশীর প্রসঙ্গ কিংবা নদীয়ায় মারাঠি বর্গিদের হামলার নিয়েও তিনি নিশ্চুপ। মানুষের মুখ থেকে ধীরে ধীরে উনিশ শতকের বটতলায় জন্ম নেওয়া গোপাল কেবল চটুল বয়ান প্রদর্শন করেন। উপস্থিত বুদ্ধির ঝলক দেখিয়ে, অতঃপর রাজাকে একটু ‘শিক্ষা’ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন তিনি।

নদীয়াসহ বাংলায় গোপাল ভাঁড়ের উত্থান ঘটছে এমন সময়ে, যখন তলে তলে দীর্ঘদিনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভেঙে পড়ছে। রাজধানী ‘কলিকাতা’তে ছুটছে গ্রামীণ মানুষ। সেখানে বিত্তবানদের বাবু সংস্কৃতির সমান্তরালে গ্রামসংস্কৃতির ‘সামান্য’ মানুষেরা প্রতিষ্ঠা করছে ভিন্ন এক ঘরানা। বিদ্যায়তনের শিক্ষিত ব্যক্তিরা এ ঘরানার একটা নাম দিয়েছেন, ‘লঘু সংস্কৃতি’। গোপাল ভাঁড় ওই লঘু সংস্কৃতির জলজ্যান্ত প্রতিভূ। ‘লঘু লোকজন’ যেমন মিলেমিশে থাকে, একইভাবে রাজাকে শিক্ষা দেওয়ার পরও কোনো কোনো কাহিনিতে গোপাল হাজির হন কৃষ্ণচন্দ্রের বিপদ-উদ্ধারকর্তারূপে। আবার কোনো গল্পে তিনিই বিনা বাক্যে মেনে নেন, কৃষ্ণচন্দ্র যা বলছেন:

‘গোপাল, তুমি একটা শুয়োরকা বাচ্চা।’ রেগে গিয়ে বলেন কৃষ্ণচন্দ্র।

তৎক্ষণাৎ গোপাল বলেন, ‘হুজুর, মা-বাপ।’

মৌখিক গল্পের রীতিই তো এমন—অসংস্কৃত, অসংগত, বর্ণিল রঙ্গ-রসিকতার ছদ্মাবরণে মনের কথাটি বলে ফেলা। বিদ্রূপপ্রতিমা ও লঘুতার আড়ালে ক্ষমতাবানকে সত্যিটা জানিয়ে দেওয়া। এ জন্যই বোধ করি একালের ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র গোপাল ভাঁড়কে ডেকেছেন ‘গোপাল বড় ফিচেল বালক’ নামে। অন্যায়-অবিচারকে রঙ্গব্যঙ্গ ও যুক্তিবাণে ঘায়েল করে ক্ষেত্রবিশেষে গোপাল ভাঁড় আদতে সমাজসংস্কার করতে চান, জেগে ওঠেন সাক্ষাৎ বিবেকের মতো!