জেমস জয়েসের উপন্যাস ইউলিসিস নিয়ে এত বেশি বই লেখা হয়েছে যে পশ্চিমা বিশ্বে ‘জয়েস ইন্ডাস্ট্রি’ এখন এক পরিচিত শব্দযুগল। আগে যা ছিল ‘শেক্সপিয়ার ইন্ডাস্ট্রি’, এখন সে জায়গাটাই নিয়েছে ‘কাফকা-প্রুস্ত-জয়েস ইন্ডাস্ট্রি’। তবে সামগ্রিক নৈরাজ্যের বোধ-জাগানো কাফকা কিংবা স্মৃতির পীড়ন নিয়ে হাহাকার করা মার্সেল প্রুস্তকে নিয়ে সে রকম কোনো বিতর্কই কখনো হয়নি, যা হয়েছে জয়েসের বেলায়।
প্রথম থেকেই ইউলিসিস-এর কপালে জুটেছে চরমপন্থী সব বিপরীতার্থক অভিধা। কেউ এ উপন্যাসকে বলেছেন—হয় ভালোবাসা থেকে, না হয় বিবমিষা থেকে—যে, এটা কঠিন ও দুষ্প্রবেশ্য সাহিত্যের প্রধান স্তম্ভ। আর কেউ বলেছেন, এটিই ইউরোপীয় আধুনিক সাহিত্যের শীর্ষবিন্দু—বাস্তববাদী ঘরানার সাহিত্য হিসেবে যেমন, তেমন প্রতীকধর্মী লেখা হিসেবেও। অন্য কারও কাছে এ এক তুমুল আইরিশ লেখা, আইরিশ সাহিত্যিক পুনর্জাগরণের মূল উদাহরণ। আর অনেকেরই মতে, মানবজীবনের আসল রূপটির মহান গাথা হিসেবে এটিই বিশ্বসাহিত্যে এযাবৎকালের সেরা কাজ, যার প্রধান কথা মানবতা ও ভালোবাসা; আবার অন্য শিবিরের কাছে এ বই প্রবল জ্ঞানী এক লেখকের বন্ধ্যা ইন্টেলেকচুয়াল নানা নিরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।
টি এস এলিয়টের বিচারে, ‘এটা সেই বই, যার কাছে আমরা সবাই ঋণী, যার থেকে পৃথিবীর কারোরই মুক্তি নেই।’ অন্যদিকে অ্যান্থনি বার্জেসের বিখ্যাত উক্তি, ‘প্রত্যেকেই এখন জানে যে ইউলিসিস শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস।’ কথাটি আসলে এমন যে প্রত্যেকে বইটি পড়েনি, কিন্তু যে অল্পসংখ্যক মানুষ ৭৫০ পৃষ্ঠার এ বিশাল বই পড়েছেন, তাঁরা এর মধ্যে জীবন বদলে দেওয়া বিশাল ও গূঢ় কিছুরই দেখা পেয়েছেন, যখন কিনা বাকিরা বইটি নিয়ে ওই লোকগুলোর অমন মাতামাতি দেখে ভয় ও বিস্ময়ে নির্বাক। একটা বই অসাধারণ ভালো কিছু না হলে বিশ্বজুড়ে কেন তার ওপরে ১০ হাজার বই লেখা হবে?
নামকরা ঔপন্যাসিক ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড বলেছিলেন, ‘আমরা যেহেতু সবাই লিওপোল্ড ব্লুম (ইউলিসিস–এর নায়ক), কিন্তু আমরা যেহেতু এ উপন্যাস পড়ার আগে পর্যন্ত জানতে পারি না যে আমরা প্রত্যেকেই লিওপোল্ড ব্লুম, তাই আমি বলব আমাদের জীবন দুই পর্বের—ইউলিসিস পাঠের আগের জীবনের আমি, যখন কিনা নিজেকে চিনি না আমি; আর ইউলিসিস পড়ার পরের জীবনের আমি, যে আমার এতক্ষণে জীবনকে চেনা হয়ে গেল।’ আর এলিয়ট বললেন, ‘ইউলিসিস-এর পরে সব ইংরেজি “লিটারারি স্টাইল” অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। এর শেষ অধ্যায়ে জয়েস যে পরম দানবীয় বিস্ময়কে ছুঁয়েছিলেন, তার পরে কীভাবে আর কারও পক্ষে সম্ভব কিছু লেখা?’ এফ স্কট ফিটজেরাল্ড জয়েসকে অন্য উচ্চতায় দেখতেন। তিনি উপন্যাসটি পড়ে বললেন, ‘এটা ভবিষ্যতের মহান উপন্যাস’; অর্থাৎ ইউলিসিস তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগোনো এক সাহিত্যকর্ম।
পেছন ফিরে দেখা
ইউলিসিস-এর নায়ক লিওপোল্ড ব্লুমকে টয়লেট করতে দেখে অথবা সৈকতে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন করতে দেখে ভার্জিনিয়া উলফ বলে দিলেন, ‘চরম নোংরা, আবর্জনার মাল।’ আর ১৯৩০ সালে আমেরিকার ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের রায় পরে আপিল কোর্টে গেলে এক বিচারক—যাঁর নাম ইউলিসিস-এর অনেক চরিত্রের আজব নামের মতোই—মিস্টার লারনেড হ্যান্ড (বাংলায় ‘বিজ্ঞ হাত’) বললেন, ‘জয়েস যেভাবে এটাকে মানবের আত্মার মহাকাব্য করে তুলেছেন, সেটা ফুটিয়ে তোলার জন্য এ বইয়ের বমি আসা আপত্তিকর অংশগুলো বড়ই জরুরি ছিল।’
বিজ্ঞ জয়েস ‘বিজ্ঞ হাতে’ পড়লেন বলে বেঁচে গেলেন, বেঁচে গেল তাঁর ইউলিসিস। ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের অখ্যাত বইয়ের দোকান শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি থেকে বের হওয়া ইউলিসিস অবশেষে ১৯৩৪-এর জানুয়ারিতে আলোর মুখ দেখল আমেরিকায়, আর ১৯৩৬-এ ইংল্যান্ডে।
সে হিসাবে গত ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে গেল ইউলিসিস-এর শতবর্ষ, অর্থাৎ ‘আধুনিক উপন্যাসের মূল শুরুর শতবর্ষ’। কিন্তু ‘ব্লুমস ডে’ ব্যাপারটা কী? এ উপন্যাসের ঘটনা কাল্পনিক এক সাল ও তারিখের—সাল ১৯০৪, তারিখ ১৬ জুন। নায়ক লিওপোল্ড ব্লুম ও অন্য দুই প্রধান চরিত্রের ওই এক দিনের ডাবলিন শহরে ১৭ ঘণ্টার জীবন নিয়ে এ কাহিনি। অতএব ১৬ জুন সাহিত্যবিশ্বজুড়ে পরিচিত ব্লুমস ডে নামে। যেহেতু এবার উপন্যাসটা প্রকাশের এক শ বছরে পড়ল। তাই এ বছরের ১৬ জুনকে দেখা হচ্ছে ব্লুমস ডেরও আসল শতবর্ষ হিসেবে। কিন্তু এ তো গেল মাত্র এক শ বছরের কথা। জয়েস নিজে বলে গিয়েছিলেন অকাট্য সত্য এক বাক্য, ‘আমি এ উপন্যাসে এতগুলো রহস্য ও ধাঁধা ভরে রেখেছি যে ওগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে অধ্যাপকেরা ব্যস্ত থাকবেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেউ অমরত্ব লাভ করতে চাইলে ওটাই একমাত্র পথ।’
‘ইউলিসিস’–এর ঘূর্ণাবর্তে
ইউলিসিস ‘কী’—সে বিষয়ে জয়েস নিজে লিখে গেছেন: ‘এটি দুই জাতিকে (ইসরায়েলি ও আইরিশ) নিয়ে লেখা এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।’ সেই ইউলিসিস যাঁদের পড়া নেই, তাঁরাও এ বই নিয়ে তিনটি জিনিস অন্তত জানেন: ১. উপন্যাসটি পড়া কঠিন; ২. ‘পর্নোগ্রাফিক লেখা’ হিসেবে এটি নিষিদ্ধ ছিল; ৩. হোমারের মহাকাব্য অডিসির ওপরে ভিত্তি করে লেখা।
ইলিয়াড মহাকাব্যের শেষে অডিসিতে গ্রিক বীর অডিসিয়ুস (একই লোকের লাতিন নাম ইউলিসিস) ট্রয়ের যুদ্ধ অন্তে ঘরে ফেরে। কিন্তু পথে নানা বাধার কারণে ওই ঘরে ফেরায় তার লেগে যায় ১০ বছর। তার ঘর ইথাকা দ্বীপে, সেখানে তার অপেক্ষায় আছে ছেলে টেলেমেকাস ও স্ত্রী পেনেলোপি। এই ১০ বছরে টেলমেকাসও বড় হয়ে উঠেছে, সে এখন আছে বাবার অপেক্ষায়, খুঁজছে বাবাকে। সংক্ষেপে হোমারের অডিসি মহাকাব্য এক পুত্রের গল্প, যে তার পিতাকে খুঁজে ফিরছে; আবার এটি এক পিতার গল্প যে তার ঘরে—নিজের স্ত্রী ও পুত্রের কাছে ফিরতে চেষ্টা করছে। একই গল্প জয়েসের ইউলিসিস-এরও। শুধু পার্থক্য, লিওপোল্ড ব্লুম গ্রিক অডিসিয়ুস বা ইউলিসিসের মতো কোনো বীর নয়, এবং তার স্ত্রী মলি ব্লুমের স্বামীর প্রতি সেই বিশ্বস্ততা নেই, যা ছিল গ্রিক মহাকাব্যে স্ত্রী পেনেলোপির স্বামী অডিসিয়ুসের প্রতি।
‘ইউলিসিস’–এর চরিত্ররা
ইউলিসিস ‘কী’—এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে এবার আসি ইউলিসিস ‘কে’-তে। এর তিন প্রধান চরিত্র—স্বামী লিওপোল্ড ব্লুম, তার স্ত্রী মলি ব্লুম ও আরেক তরুণ—নাম: স্টিফেন ডেডালাস। অদ্ভুত গ্রিক নামের এই ছেলে স্টিফেনের বয়স বাইশ, সে লেখক হতে প্রত্যাশী, পেশায় শিক্ষক। উপন্যাসের শুরুতে এই স্টিফেনকে আমরা দেখি ডাবলিনের সমুদ্রতীরবর্তী মার্টেলো নামের টাওয়ারে, সঙ্গে বাক মুলিগান নামের এক আজব বন্ধু (উপন্যাসের অন্যতম ভিলেন চরিত্র) এবং নাক–উঁচু ইংরেজ হায়েনেস, যার নাম দেখলেই আমাদের মনে আসে হায়েনার কথা। স্টিফেন নিজে জানে না, কিন্তু আমরা বুঝি, সে তার জীবনে এক পিতার মতো পিতাকে খুঁজছে। তার নিজের পিতা উপন্যাসের আরেক ভিলেন ধরনের চরিত্র।
এবার মূল নায়ক লিওপোল্ড ব্লুম। বয়স ৩৮, পেশায় বিজ্ঞাপনের বিক্রয়কর্মী, প্রায় নিম্নমধ্যবিত্ত; ধর্ম না–মানা এক ইহুদি সে, অর্থাৎ আয়ারল্যান্ডে বহিরাগত, সবার শ্লেষ ও অবজ্ঞার শিকার। তিনবার তার ক্যাথলিক ধর্মে ব্যাপটিজম হয়েছে, কিন্তু সে মনে-আত্মায় খ্রিষ্টানও না। ব্লুম নিজে জানে না, তবে আমরা জানি সে এই উপন্যাসের অডিসিয়ুস (অর্থাৎ ইউলিসিস)। সে তার ঘরে ফিরতে চাইছে বউ ও ছেলের কাছে, যদিও তার বাস্তবের ছেলে রুডি মারা গেছে পৃথিবীতে দুই সপ্তাহেরও কম দিন বেঁচে থেকে। পুত্র হারানোর এই যাতনা তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ওপরে ঝুলতে থাকা এক বিশাল কালো মেঘ। এখন স্ত্রী মলি ছাড়া তার সংসারে আছে মেয়ে মিলি, সে থাকে দূরে, অন্য শহরে।
তৃতীয়জন মলি ব্লুম। বয়স ৩৪, পেশাদার কনসার্টশিল্পী সে। এই মলিই উপন্যাসের ওই দিনের বিকেল চারটায় ব্লেজেস বয়লান নামের এক কনসার্ট ট্যুর প্রোমোটার লোকের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে নামবে, তা-ও নিজের ঘরের বিছানায়। স্বামী ব্লুম জেনে গেছে, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ঘটবে স্ত্রীর এই গোপন অভিসার। তাই সে এখন চুপচাপ ঘর ছাড়বে, ১৫-১৬ ঘণ্টা ঘুরে বেড়াবে ডাবলিনের রাস্তায় রাস্তায়। এই ঘুরে বেড়ানোর নামই ‘অডিসি’, সোজা বাংলায় ‘অভিযাত্রা’, এ ক্ষেত্রে যা গ্রিক অডিসিয়ুসের তিন হাজার বছর আগের ওই বীরোচিত সমুদ্রযাত্রার বিপরীতে এক ‘ভেড়ুয়া’ স্বামীর ডাবলিন শহরজুড়ে হেঁটে বেড়ানো।
এ ছাড়া আরও আছে উপন্যাসের চতুর্থ প্রধান চরিত্র, সুন্দরী তবে খোঁড়া মেয়ে গেরটি ম্যাকডাওয়েল। বইয়ের বিখ্যাত ‘নাউসিকা’ অধ্যায়ে (১৩তম অধ্যায়) এই গেরটি সমুদ্রসৈকতে ব্লুমকে কাপড় তুলে নিজের সুন্দর পা দেখায়, অন্তর্বাস দেখায়, আর ব্লুম তা দেখে স্বমোহনে মত্ত হয়। আরও আছে মিনা পিওরফয় নামের এক নারী, দীর্ঘ তিন দিন লেবার পেইনের কষ্ট ভোগ করে, যার এখন বাচ্চা হচ্ছে এক হাসপাতালে। ব্লুম সেখানে হাজির, তার মনে পড়ছে নিজের হারানো ছেলে রুডির কথা। আছে প্যাডি ডিগনাম নামের সদ্য মৃত এক মানুষের গল্প।
উপন্যাসের ষষ্ঠ অধ্যায়ের পুরোটা প্যাডি ডিগনামের দাফন নিয়ে। আর এ অধ্যায়েই পরিষ্কার হয়, মৃত্যু ব্যাপারটি আমাদের জীবনেরই অংশ। রক্ত হিম করা প্রহসনে ভরা এ অধ্যায়ের শেষেই মরণ নিয়ে ভাবতে থাকে ব্লুম, কিন্তু ‘উষ্ণ রক্তটগবগ জীবন’-এর লোভে সে দ্রুতই ত্যাগ করে তার মৃত্যুচিন্তা।
ইউলিসিস-এর ‘কে’ প্রসঙ্গে বলার শেষে আর এটুকুই বলতে চাই যে শেষ অধ্যায়ের কোনো দাঁড়ি-কমাহীন ওই ৫০ পৃষ্ঠায় মলি ব্লুমের মাথার মধ্যে ঢুকে মানবজীবনের সবটাই প্রত্যক্ষ করি আমরা। দেখি যে ব্লেজেস বয়লানের যৌন শক্তিতে মলি বিমোহিত, কিন্তু যেভাবে বয়লান তার পেছনে থাপড় মেরেছে, তাতে আঘাত লেগেছে তার নারীত্বের মর্যাদায়...আরও কত কী! বিশ্ববিখ্যাত মনোবিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং জয়েসকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘নারীর মনকে শয়তানের দাদিমা যেভাবে বোঝে, সেভাবেই বোঝেন আপনি; আমি না।’
এবার ‘কোথায়’-এর উত্তর। এক শব্দ—ডাবলিন। জয়েস বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষ তাঁর ইউলিসিস পড়েই ডাবলিন শহরটিকে ফের হুবহু নির্মাণ করতে পারবে।
আট কুঠুরি, নয় দরজা
ইউলিসিস–এর ‘কখন’ প্রসঙ্গে সময়টি তো আগেই বলেছি—১৬ জুন ১৯০৪। এদিনের সকাল আটটা থেকে নিয়ে ১৭ জুন রাত একটা বা দুটোতে গিয়ে গল্পের শেষ। বলে রাখি, এ পৃথিবীর যেকোনো দিনের মতোই এক অতিসাধারণ দিন ছিল সেটি। আমরা দেখলাম ওই দিনে এক বাচ্চার জন্ম হলো, এক লোকের কবর হলো, এক বিখ্যাত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হলো, এক স্ত্রী অবিশ্বস্ত হলো, এক স্বামী অন্য নারীর পা দেখে তার প্যান্ট নিচে নামাল, এক শুঁড়িখানায় ‘সিটিজেন’ নামের উগ্র আইরিশ জাতীয়তাবাদী ও ইহুদিবিদ্বেষী লোকটির সঙ্গে নায়কের প্রায় মারামারি হলো, ডিইজি নামের এক শিক্ষক তার (স্টিফেনের জন্য তিনি এক ‘মিথ্যা পিতা’) জঘন্য ইহুদিবিদ্বেষ দেখাল, আর প্রায় পুরো উপন্যাসে ছায়া ছায়া মঞ্চায়িত হলো শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট, যেখানে প্রিন্স হ্যামলেট নিজের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দ্বিধান্বিত—মনে মনে মৃত পিতাকে খুঁজছে সে, আর সে হতবাক যে তার মা স্বামীর মৃত্যুর খবর বাসি হতে না হতেই চাচার—যে তার পিতার খুনি—বিছানায়।
এ পর্যায়ে আসি ‘কীভাবে’র উত্তরে। জয়েসের বর্ণনাভঙ্গি খণ্ডে খণ্ডে গাথা, বাক্যগুলো সাধারণত ছোট ছোট, আর মনের চেতন-অবচেতন ভাবনার টানা অংশগুলো অনেক দীর্ঘ, যেমন ৯ পৃষ্ঠায় কি ৫০ পৃষ্ঠায় একটিই বাক্য। উপন্যাসের কথকের ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ বা বয়ানের কণ্ঠস্বর এখানে অনন্য। যেমন অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া এক দাওয়াত নিয়ে দেখি তিনজন দিচ্ছে তিন রকমের ভাষ্য। এটিই ত্রিমাত্রিক বয়ান বা ‘প্যারালাক্স’, যা পড়তে গেলে ঘোর লাগে, আর বোঝা যায় যাবতীয় মার্কেস-ফকনার-রুলফো-কোর্তাসার-কাওয়াবাতা-ইশিগুরো-অমিয়ভূষণ- কমলকুমারের পেছনে আসলে দাঁড়িয়ে আছেন কোন জন। আর আছে প্রশ্ন ও উত্তরের ঢঙে লেখা এক পুরো অধ্যায় (অধ্যায় ১৭; সেখানে ৩০৯টি প্রশ্ন ও ৩০৯টি উত্তর; জয়েসের নিজের সবচেয়ে প্রিয় অধ্যায়, আমার সবচেয়ে অপছন্দের তালিকার দ্বিতীয়)। আছে পুরো নাটক হিসেবে লেখা এক পরাবাস্তব অধ্যায়, যেখানে স্টিফেন, ব্লুম ও বন্ধুরা দল বেঁধে যায় ডাবলিনের গণিকাপল্লিতে।
শেষ প্রশ্ন—‘কেন’? ইউলিসিস-এর পাঁচ বড় থিম এ রকম: এক. মানব-মানবীর জটিল সম্পর্ক, বিয়ে যার কোনো সমাধান না দিয়ে বিষয়টিকে বরং আরও ভীতিকরই বানিয়ে ফেলে। দুই. শেষ পর্যন্ত ভালোবাসাই বড় সত্য; নিষ্ঠুরতা-হিংসা-বেইমানি নয়। তিন. তথাকথিত স্বাধীনতাকামী উগ্র রাজনীতি মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার এক ‘পজিশনিং’মাত্র। আর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা জরুরি, কিন্তু ‘নতুন দেশ নতুন মানুষ দেবে কি?’ এক জয়েসবিদ দারুণ বলেছিলেন, ‘ইউলিসিস জাতীয়তাবাদ, ভাষা ও ধর্মের ফাঁদ এড়ানোর গল্প।’ চার. যাবতীয় বিদ্বেষের গোড়ায় আছে মানুষের ক্ষুদ্রতার বোধ, যে ক্ষুদ্রতার ধারণা অপ্রয়োজনীয়, কারণ জীবন অনেক বড়। আর পাঁচ. বীর বলতে কিছু নেই, বীর হওয়ার প্রয়োজনও নেই। কারণ, মানুষ-মানুষই—অল্প সাহস ও বেশি ভয় দিয়ে গড়া, যেহেতু পৃথিবী বিপজ্জনক আর কবর অন্ধকার।
কেন পড়বেন ‘ইউলিসিস’
এখন বলি ইউলিসিস কেন পড়বেন। প্রথম কথা, পড়বেন এর ভাষার অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের কারণে। নিশ্চিত বলতে পারি, পড়া শুরু করলেই আপনি বুঝবেন, এ রকম মোহনীয় ইংরেজি অন্য কারও কলমে আর কোনো দিন পড়েননি। যেমন, ‘আবছায়া সাগরের সাদা বুক...ঢেউসাদা দারুণযুগলশব্দেরা মৃদুপ্রভ জলোচ্ছ্বাসের গায়ে নরম আলোয় চিকচিক’; যেমন, ‘ব্রে হেডের ভোঁতা অন্তরীপ পানি বেড় দিয়ে শুয়ে আছে যেন সে কোনো ঘুমন্ত তিমির নাক-মুখ।’
আর এই ফাঁপা আদর্শ ও বুলি দিয়ে ভরা পৃথিবীতে ইউলিসিস আরও পড়বেন এক দার্শনিক কারণ থেকে। এর প্রথম শব্দ ‘Stately‘ (রাজকীয়’ অর্থে), যার মধ্যে জয়েস লুকিয়ে রেখেছেন ইংরেজি ‘yes’ বা ‘হ্যাঁ’ শব্দটিকে; আর উপন্যাসের শেষ শব্দ সরাসরি ‘Yes’। ডাবলিনের ৭ নম্বর এককেলস স্ট্রিটের বাড়িতে তখন (বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে দামি কোনো বাড়ির ঠিকানা) স্বামীর পাশে বিছানায় শুয়ে অবিশ্বস্ত স্ত্রী মলি ব্লুম। মলি তার বায়ুত্যাগের মধ্যে, অন্য পুরুষের সঙ্গে শয্যার পরে রজস্রাব শুরু হয়ে যাওয়ার মধ্যেই স্বামীকে নিয়ে একা একা ভাবছে এই কথা: ‘তারপর সে আমাকে বলেছিল আমি (বিয়েতে) হ্যাঁ বলব কি না হ্যাঁ যেন বলো আমার পাহাড়ি ফুল তুমি আর আমিই প্রথম তাকে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম হ্যাঁ আর তাকে আমার দিকে টেনে নিলাম যাতে সে আমার দু–স্তনের ছোঁয়া পেতে পারে কী সুগন্ধে ভরা হ্যাঁ আর তার হৃৎপিণ্ড তখন পাগলের মতো ঢিপঢিপ হ্যাঁ আর আমি বললাম হ্যাঁ আমি করব হ্যাঁ।’
ইউলিসিস পড়বেন জীবনকে ‘হ্যাঁ’ বলতে।
‘অডিসি’ থেকে ‘ইউলিসিস’
কেন হোমারের অডিসিকে উপন্যাসের খসড়া কাঠামো হিসেবে বেছে নিলেন জয়েস? জয়েসের মতে, গ্রিক বীর ইউলিসিসই বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে বেশি পূর্ণাঙ্গ মানুষ—‘কমপ্লিট ম্যান’। সে একই সঙ্গে পুত্র, স্বামী, পিতা, প্রেমিক, যোদ্ধা, প্রতিশোধপরায়ণ বীর, সাহসী, ভীরু ইত্যাদি। ব্যাপারটা জীবনচক্রের—পুরুষের জন্ম হয় নারীর গর্ভ থেকে, তারা ঘরে স্ত্রী রাখে, স্ত্রীকে সন্তান জন্মের বীজ দেয়, সন্তান বড় করে, সন্তান হারায়, তারপর পুরুষ-নারী-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান—সবাই যায় কবরে, যে বাঁচে সে শোক করে, একদিন ভাগ্যান্বেষণে সে–ও ঘর ছাড়ে, যায় হয় দূর ট্রয়ের পথে, না হয় রোজকার অফিসের পথে; ওদিকে ঘরে স্ত্রী একাকী হতে থাকে, স্ত্রীকে টোকা দিতে থাকে প্রতিবেশী পুরুষ, কামনা স্ত্রীর মধ্যেও জন্ম নেয়, যেহেতু সে জানে, কাজে গিয়ে সুযোগ পেলে স্বামী অন্য নারীর দিকে কামনার চোখে তাকাবেই; ওদিকে তার পুত্ররা পিতার পাশে দাঁড়াতে পারে আবার না-ও পারে, এরপরই পিতার প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা কিংবা হার মেনে নেওয়া। কিন্তু কবরে যাওয়ার আগপর্যন্ত, সবকিছুর শেষে ঘরটা থাকেই—নিজের ঘর, নিজের বিছানা, যেখানে ফিরতে পারলে মানুষের চিরকাল ভালোই লাগে। অতএব জয়েসের ইউলিসিস-এর সঙ্গে হোমারের অডিসির যদি মিল থাকে, তাতে রহস্যের কিছু নেই।
হোমারের অডিসি বাদে এ উপন্যাসের উৎস বা সূত্র আছে আরও কয়েকটা লেখার মধ্যে, যার প্রধানটা শেক্সপিয়ারের নাটক হ্যামলেট।
এই সব মিলে আপাতদৃষ্টে প্লটবিহীন ইউলিসিস-এ ১৬ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ডাবলিন শহরে ঘটে যাওয়া নানা অ্যাকশনের যে পূর্ণতা আছে, তা হোমারের মহাকাব্যেও নেই। কারও কারও কাছে ইউলিসিস ‘অশ্লীল’ হতে পারে, কিন্তু এই একই কারণে উপন্যাসটি মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি হিসেবে জীবনেরই বিরাট উদ্যাপনরূপে বিবেচিত হয়।
‘ইউলিসিস’
কোনটা পড়বেন
ইউলিসিস-এর কমপক্ষে ১৮ রকমের চেহারা আছে। ১৯২২-এর প্রথম সংস্করণে ভুল আছে দুই হাজারের মতো। পরের সংস্করণগুলোয় সেই ভুল কমেনি, বরং বেড়েছে। কারণ, জেমস জয়েস নিজে ইচ্ছা করে ভুল লিখেছেন বহু জায়গায়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পাঠকের সনাতন চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করা। এ ক্ষেত্রে প্রুফ রিডাররা সেই ‘ভুল’গুলো সংশোধন করে গেছেন বারবার। তাই শেষে গিয়ে যা হয়েছে, তা রীতিমতো কেলেঙ্কারি।
আবার জয়েসও শেষ প্রুফ দেখার পর ছাপাখানায় দাঁড়িয়ে বদলে দিয়েছেন একটা অধ্যায়ের ৪০ শতাংশ—এমন ঘটনাও আছে। যাঁরা তারপরও ইউলিসিস-এর ১৯২২ সালের প্রথম শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি সংস্করণ পড়তে চান (মোট ছাপা হয়েছিল এক হাজার কপি, যার যেকোনোটির দাম এখন এক লাখ ডলারের বেশি, তারপরও পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই), তাঁরা অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিকসের ‘দ্য ১৯২২ টেক্সট’ তকমাযুক্ত ইউলিসিসটি হাতে নিতে পারেন, সঙ্গে পাবেন জেরি জনসনের মনোজ্ঞ এক ভূমিকা।
এ ছাড়া বাজারে আপনি আরও পাবেন ১৯৩৯ সালের অডিসি প্রেস সংস্করণ। এর ভূমিকা লিখেছেন নামকরা ইউলিসিস–বিশারদ স্যাম স্লটে। এই স্যাম স্লটের সম্পাদনায় এ মাসেই বেরিয়েছে টীকা-ভাষ্যসমেত দেড় হাজার পৃষ্ঠার এক ইউলিসিস পাঠ সহায়িকা।
ইউলিসিস-এর পেঙ্গুইন সংস্করণটি অনেক নামকরা—মূল নাম ‘অ্যানোটেটেড স্টুডেন্ট এডিশন’। বইটির খ্যাতি মূলত ডেকলান কিবার্ডের ভূমিকাটির কারণে।
কিন্তু এখন প্রামাণ্য ইউলিসিস ধরা হয়ে থাকে ১৯৮৪ সালের ‘দ্য গ্যাবলার এডিশন’কে। ভিন্টেজ প্রকাশনের এই বই পেঙ্গুইন থেকেও বেরিয়েছে অন্য প্রচ্ছদে এবং ‘দ্য কারেক্টেড টেক্সট-স্টুডেন্টস এডিশন’ নামে। পেঙ্গুইনের সংস্করণে ভূমিকা লিখেছেন বিখ্যাত জয়েস-জীবনীকার রিচার্ড এলমান। অবশ্য গ্যাবলার এডিশন নিয়ে পরে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হলে এলমান এখান থেকে নিজের নামটি প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বইটি আজও বাজারে সহজলভ্য।
আর উৎসাহী কেউ যদি ইউলিসিস-এর ‘দ্য আনকারেক্টেড টেক্সট’ পড়তে চান (১৯২৯ সালের সংস্করণ), তাহলে আপনার ভরসা প্যালাডিন প্রকাশনের ইউলিসিস, যার প্রচ্ছদে বই ও লেখকের নাম সোনালি হরফে লেখা।
এ কথা সত্য, প্রামাণ্য ও সঠিক ইউলিসিস বলে কিছু নেই, আর এর একটা থেকে আরেকটার ফারাকও বেশ বড়। তবে এখন এ উপন্যাস পড়ার জন্য নানা কারণেই গোটা পৃথিবী ভরসা রাখছে দ্য গ্যাবলার এডিশনের ওপর। কিন্তু মূল এডিশনগুলোর মধ্যকার ফারাক যে কেউই বুঝতে কিনতে পারেন ফিলিপ গ্যাসকে ট ও ক্লাইভ হার্ট গ্রন্থিত ইউলিসিস—আ রিভিউ অব থ্রি টেক্সটস বইটি। এখানে বিখ্যাত গ্যাবলার এডিশনেরও অনেক ভুল ধরা হয়েছে।