জীবনানন্দ দাশ: এক মুদ্রাদোষের নাম

কবি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতাকে মূর্ত ও বিমূর্তভাবে কীরূপে অনুভব করেন পাঠক? আজ তাঁর মৃত্যুদিনে এ লেখায় ধরা আছে সেই কথা, একজন মুগ্ধ পাঠকের অনুভব।

কোলাজমনিরুল ইসলাম

জীবনানন্দ দাশ তো এক মুদ্রাদোষের নাম। এ মুদ্রাদোষের সুতোর টানে যে বাঁধা পড়েছে, সে কি আর মাটি-পৃথিবী দেখতে পারে? চ্যাপ্টা ঘড়ির কাঁটায় ঘোরা পৃথিবী? সে তো খোঁজে বোধ, হৃদয়ে ঘাস, শরীরে জলের গন্ধ। জীবনানন্দতে পেল তো মানুষ কেমন অচেনা মানুষের মতন—গঙ্গাসাগর, জারুল, শঙ্খচিল, লক্ষ্মীপ্যাঁচা আর কাকের তরুণ ডিম হয়ে খোঁজে জীবন। জীবনের স্রোতে ভেসে আসা শালিক-ফড়িংয়ের এই মুদ্রাদোষের জীবনে—জীবন আসে, আসে আনন্দ, বিষাদের ছদ্মবেশে। আর হারিয়ে যায় মানুষ?

কমলা রঙের রোদ নামে এক রাজ্য ছিল। জীবনানন্দ দাশ নাকি তার রাজা। মেহগনিগাছের সারি কুর্ণিশ করে, ছায়া ফেলে। ঠিক যেন আসামের শোভনারানী। সেই ছায়ার মায়া বুকে পুরে নিয়েছিলেন শিশিরের জলের মতন। আর ছেড়ে এসেছিলেন রাজ্য। ফেলে এসেছিলেন অনেক অনেক কমলা রঙের রোদ। আবার হেঁটেছিলেন পথ—বুদ্ধের খোঁজে।

দুপুররোদে, ভাতঘুমের ঘোরে, ওই যে তালা-চাবিওয়ালা সুর তোলেন, তিনি কি জীবনানন্দ নন? কে আগে ভেঙেছিলেন বোধের জানালার তালা— একটার পর একটা, অন্য একটা, আরও একটা? জেনেছিলেন আদি জীবন, নতুন করে? ভাগ্যিস তালাগুলো ভাঙলেন তিনি—বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত চোখ আর কালোশিরার অসুখে, নির্জন প্যাঁচার মতন প্রাণে, নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে। ভেঙে ফেললেন সোনার বলের মতো সূর্য আর রুপার বলের মতো চাঁদ। তিনি না থাকলে তারা কোথায় পেত জীবন?

সবার একান্ত ‘আমি’ তিনি। জীবনানন্দ দাশ। তিনি তো আমি হয়ে বলে গেছেন, ‘পৃথিবীতে নাই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি’। তিনি তো আমাদের আমি হয়ে জীবনের ছককাটা খেলার ঘরের গল্প বলে গেছেন। এ জীবনে হেরে গেছি যখন বেহিসাবের ভুলে, তাকিয়েছি তাঁর দিকে। তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন মন্ত্র, ‘হিসেব করে তোমাকে ভালোবেসে আমি যদি জয়ী হতাম—আলো পেতাম না তো।’

সবার একান্ত ‘আমি’ তিনি। জীবনানন্দ দাশ। তিনি তো আমি হয়ে বলে গেছেন, ‘পৃথিবীতে নাই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি’। তিনি তো আমাদের আমি হয়ে জীবনের ছককাটা খেলার ঘরের গল্প বলে গেছেন। এ জীবনে হেরে গেছি যখন বেহিসাবের ভুলে, তাকিয়েছি তাঁর দিকে। তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন মন্ত্র, ‘হিসেবে করে তোমাকে ভালোবেসে আমি যদি জয়ী হতাম—আলো পেতাম না তো।’ আমি কিংবা আমরা তো শিখেছি রাত কেমন লেবুর ফুলের মতো নক্ষত্রের গন্ধ দিয়ে ঘেরা। আমার আমি হয়ে তিনি তো খুঁজে দিয়ে গেছেন আমাকে। যে আমাকে আমি চিনি, তারও অধিক। আমরা সবাই কি এক টুকরো জীবনানন্দ হয়ে বেঁচে থাকি না?

আর জীবনানন্দ পৃথিবীতে এলেন যাঁর কল্যাণে, তিনিও তো কবি ছিলেন—কুসুমকুমারী।

কবি কুসুমকুমারী দাশ কি ভবিষ্যৎ দেখতে জানতেন? তিনিও তো লিখে গিয়েছিলেন সেই মানুষের কথা, যে ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ কি তখন জানতেন তখন তাঁর রুগণ সন্তান জীবনানন্দ—যাঁর পারিবারিক নাম মিলু—হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে যাবেন? ‘সর্বানন্দ ভবন’-এর সবুজে বেড়ে ওঠা সেই মিলু, যাঁর পাড়ার বন্ধু বৃদ্ধ গাছি, রাজমিস্ত্রি, সত্যানন্দ ফকিরের চোখ দিয়ে জীবন সেঁচা ওই মিলু নিজের কাজের মাধ্যমে হবে কালোত্তীর্ণ জীবনের বাসিন্দা—হয়ে উঠবেন জীবনানন্দ দাশ, এতটা কি তিনিও ভাবতে পেরেছিলেন?

তিনি কি জানতেন, কুড়ি বছর ধরে, হাজার বছর পরে—এখনো যখন কোনো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিক আকাশ খোঁজে, খোঁজে একটু ভালো আলো,
অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে চেয়ে থাকা নক্ষত্র তাকে বলে যায়,
‘সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।’

নিজের মুদ্রাদোষের সাম্রাজ্যে, কমলারঙের রোদের মতন আলো হয়ে বেঁচে থাকা সবার ‘একান্ত’ জীবনানন্দ দাশের চলে যাওয়ার দিন আজ—২২ অক্টোবর। কবিকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]