ট্রাম্পের বাটি চালান ও চীনের বাণ

সাতসকালে ঘুম ভেঙে মাত্র চোখ খুলি খুলি অবস্থা। ঠিক ওই সময়ই বেজে উঠল মুঠোফোনটা। এক বন্ধু কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে জানালেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাকি ‘করোনা হয়েছে’। আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি। চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের জন্য একদিকে চালালাম টিভি, অন্যদিকে শুরু হলো মুঠোফোনে ইন্টারনেট দুনিয়ায় খোঁজাখুঁজি। শেষে জানা গেল, আসলেই হয়েছে। তবে জ্ঞানপিপাসু মন জানতে চাচ্ছিল—কেন হলো? কীভাবে হলো? ভাইরাসের এত সাহস হলো কীভাবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা কঠিন কাজ। নানাভাবে জানার চেষ্টা চলল। তবে জানা গেল না। কথায় আছে, জ্ঞানার্জনের জন্য চীন দেশেও যেতে হতে পারে। ট্রাম্পের ‘বাণী’ বিবেচনায় নিলে এই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে গন্তব্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চীন হয়ে যেতে বাধ্য। আর সেই ‘ট্রাম্পীয় প্রবচনগুচ্ছে’ চীনের অবস্থান ওজনদার ট্রাংকের মতোই। তবে চীনের আগেও করোনাভাইরাস নিয়ে আরও অনেক কিছুই বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

করোনা মহামারির শুরুতে করোনাভাইরাসের অস্তিত্বকে ভয়ংকর মানতে একদমই রাজি ছিলেন না ট্রাম্প। গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ট্রাম্প বলেছিলেন, এপ্রিল এলেই যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে যাবে এবং তখনই কমে যাবে মহামারির প্রাবল্য। দেশের প্রেসিডেন্ট যখন বলছেন, মানুষের বিশ্বাস করারও কারণ ছিল। তার ওপর দেশটি যদি প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্র হয়, তবে অন্যান্য দেশেরও টনক নড়তে বাধ্য। তো ট্রাম্প বলে দিলেন, গরমে নাকি এই নতুন ভাইরাস টিকতে পারে না। ভাইরাসটির ওপর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার প্রভাব খুবই নেতিবাচক। অথচ তখনো বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, আগে থেকেই এভাবে বলা যায় না। কিন্তু ট্রাম্প কি আর এসবে কান দেন! এখন দেখা যাচ্ছে, গ্রীষ্ম গেল, বসন্ত গেল, কিন্তু করোনা গেল না।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ট্রাম্প আবার বললেন, ‘করোনা অদৃশ্য হয়ে যাবে। একদিন জাদুর মতোই উবে যাবে করোনা।’ আচ্ছা, এবার কি ট্রাম্পকে করোনাভাইরাসের ‘উবে যাওয়া’ তত্ত্ব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যায়? তাঁর অনুভূতি বা বিশেষজ্ঞ মতামত জানতে পারলে ভালোই হতো।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ট্রাম্প আবার বললেন, ‘করোনা অদৃশ্য হয়ে যাবে। একদিন জাদুর মতোই উবে যাবে করোনা।’ আচ্ছা, এবার কি ট্রাম্পকে করোনাভাইরাসের ‘উবে যাওয়া’ তত্ত্ব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যায়? তাঁর অনুভূতি বা বিশেষজ্ঞ মতামত জানতে পারলে ভালোই হতো।

বিশেষজ্ঞ মতামতের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন আরও গভীরে যাওয়া যাক। গত মার্চের ১৯ তারিখে ট্রাম্প এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, কোভিড-১৯ রোগে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন খুবই কার্যকর। তিনি বলেছিলেন, এটি নাকি ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বাস পোক্ত করতে এ-ও জানালেন, নিজেও নাকি নিয়মিত সেবন করছেন ম্যালেরিয়ার এ ওষুধ! যদিও তাঁর দেশের বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ‘জাদুকরি ওষুধ’ নয় এবং এর কার্যকারিতা পরীক্ষিত নয়। তবে ট্রাম্প তাঁর কথায় অটল। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা বলে দিয়েছেন, এই ওষুধ কোভিড-১৯ রোগে একেবারেই কার্যকর নয়। আচ্ছা, ট্রাম্প কি এখনো হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সেবন করছেন? নিজের কথার মান রাখতেই কিন্তু এ ব্যাপারে ট্রাম্পের ইতিবাচক থাকা প্রয়োজন। তবে যত দূর বুঝি, ট্রাম্প হরেক কথার মানুষ। এক কথায় এত মনোযোগ দিলে কি চলে!

মাস্ক পরা নিয়েও ট্রাম্প কম কথা বলেননি। তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন একদিকে রোগের বিস্তার প্রতিরোধে মাস্ক পরার সুফল নিয়ে প্রচার চালায়, আর অন্যদিকে ট্রাম্প বলেন, ‘এটা ঐচ্ছিক। আমার মনে হয় না, এটি আমি করব। ’ শুধু তাই নয়, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতেও রাজি ছিলেন না ট্রাম্প। তাঁর মতে, প্রতিটা মানুষেরই কিছু স্বাধীনতা আছে এবং মাস্ক পরাটাও ওই গোত্রীয়। মাস্ক পরা বা না পরা নিয়ে ট্রাম্পের যোগ্য সহচর অবশ্য ছিল। সেটি হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা!

তবে জীবাণুনাশক শরীরে ঢোকানোর যে ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, সেটি এক শব্দে ‘অতুলনীয়’। এ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সদা অনুসন্ধিৎসু’ মনের পরিচয় মেলে। তিনি বলেছিলেন, করোনার চিকিৎসায় জীবাণুনাশক শরীরে ঢুকিয়ে ও কড়া আলো ব্যবহার করে দেখা যেতে পারে। ট্রাম্পের কথায়, ‘আমি জীবাণুনাশক দেখেছি, এক মিনিটে এটি ভাইরাস দূর করে, এক মিনিটে এবং এমনকি কোন পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে শরীরে ইনজেকশন দিয়ে জীবাণুনাশক দেওয়া যায় বা প্রায় পরিষ্কার করা যায়?’ এটুকু বলেই থেমে থাকেননি ট্রাম্প। সত্যিকারের ‘উদ্ভাবনী শক্তি’ যাঁদের মধ্যে থাকে, তাঁরা সহজে থামেন না। তেমনি ট্রাম্প বলেছিলেন, ফুসফুসে জীবাণুনাশক পৌঁছে দেওয়ার কথা। কারণ, ওখানেই যে করোনাভাইরাস ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে হোয়াইট হাউস মুখে কুলুপ এঁটে আছে। কেউই জানাচ্ছে না, ট্রাম্প স্যালাইনের বদলে জীবাণুনাশক নিচ্ছেন কি না!

শাশ্বত সত্য বলতে যে কিছু নেই, তার উত্তম উদাহরণ হতে পারে ট্রাম্পের কথামালা। একদা তিনি বলেছিলেন, চীন নাকি খুব দক্ষ হাতে করোনাভাইরাসকে সামলাচ্ছে। সেই ট্রাম্প একসময় করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ উপাধি দিয়ে দিলেন। এটি বলে যখন-তখন খোঁচা দিতেও তিনি ভোলেন না। ট্রাম্পের মতে, এই চাইনিজ ভাইরাস বলাটা বর্ণবাদী নয়। কারণ, নতুন করোনাভাইরাস চীন থেকে এসেছে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। আরও বিশ্বাস করেন যে চীনের উহান থেকে কৃত্রিমভাবে এ ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রচারকারীদের জন্য এ ছিল একদম দিল্লিকা লাড্ডু। যদিও বিশেষজ্ঞরা এসব উড়িয়ে দিয়েছেন বারবার।

অনেক হলো ট্রাম্পের প্রবচন। এবার না হয় শুরুতে তোলা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। ট্রাম্পের কোভিড-১৯ কেন হলো, কীভাবে হলো? কিন্তু ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এর সদুত্তর পাওয়া গেল না। শেষে পথ দেখালেন খোদ ট্রাম্প ও তাঁর তরিকা। ভাবলাম, আমার জায়গায় ট্রাম্প হলে কী করতেন? ট্রাম্প মানেই নতুন কিছু। প্রচলিত পদ্ধতির তিনি ধার ধারেন না। নিশ্চয়ই, তিনি ‘বাটি চালান’ দিয়ে ভাইরাসের তালাশ করতেন। ট্রাম্পের বাণী বিবেচনায় নিলে, সেই বাটি তৈরি হতো চীনা মাটি দিয়ে। আর চীনা মাটির বাটি তো চীনেই যাবে, নাকি? শেষে হয়তো সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাম্প ঘোষণা দিতেন, চীন ‘বাণ মেরে’ তাঁর এই হাল করেছে!

অপেক্ষায় থাকুন। সুস্থ হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনটা বলেও বসতে পারেন। তখন আবার ভিরমি খেলে, দোষ ট্রাম্পের ঘাড়ে চাপাবেন না যেন!

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]