তোমার-আমার চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র!

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
অন্যের চরিত্রের ছিদ্রান্বেষণ আমাদের খুবই প্রিয় চর্চা। নিজের ঘাটতি ভুলে অন্যকে হেয় করতে আমাদের বড্ড ভালো লাগে। সমসাময়িক কিছু প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে এই লেখায়।

অন্যের চরিত্রের ছিদ্রান্বেষণ আমাদের খুবই প্রিয় চর্চা। নিজের ঘাটতি ভুলে অন্যকে হেয় করতে আমাদের বড্ড ভালো লাগে। ঠিক এই প্রবাদের মতো—চালুন কয় সুইরে, তোর ফুটা কত বড়। অন্যকে অস্বস্তি দিতে না পারলে বা আচ্ছামতো অপমান করতে না পারলে আমাদের ভাত বা কাচ্চি বিরিয়ানি—কিছুই হজম হয় না। প্রশ্ন হলো, আমাদের হজমশক্তি বাড়বে কিসে?

বেড়ে যাওয়া দূরের কথা, এই হজমশক্তি আরও কমে যায় যদি এই বঙ্গের পুরুষেরা কোনো নারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করার সুযোগ পেয়ে যান। পেশাগত কারণেই সহিংসতা ও অপরাধের খবর মানুষকে জানাতে হয়। তা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, নারীর প্রতি অপরাধে শুরুতে কিছুটা হইচই হলেও, একপর্যায়ে ভিকটিমের চরিত্র হনন করা শুরু হয়। তাতে নেতৃত্ব দেয় এই দেশের কতিপয় ‘পুরুষ’। অপরাধের শিকার নারীকেই তোলা হয় সমাজের কাঠগড়ায়। বলা হয়, অপরাধীর দোষ হয়তো আছে, কিন্তু তুমিও কম অপরাধী নও। এভাবে অপরাধীর বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান থেকে তথাকথিত সমাজ পিছু হটে এবং ধীরে ধীরে কার্যত অপরাধীর পেছনে দাঁড়ায়।

নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্প্রতি এ দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে। সেই বিক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে ভিকটিমদের পোশাক তত্ত্বও আসছে। এবার তো এক সেলিব্রেটিও সেই তত্ত্বের সমর্থকদের খাতায় নাম লেখালেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পোশাকই যত নষ্টের গোড়া! ধর্ষণ করার ইচ্ছা জেগে ওঠা, ধর্ষণ করা—এসবে দোষ কম। যত দোষ শুধু পোশাকে।

এর আগেও ভিকটিমের পোশাক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছুদিন আগেই সারা দেশ একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। সে সময় হত্যার বিচার চাওয়ার চেয়ে ওই ঘটনার এক ভিকটিমের চরিত্র হননেই বেশি সময় ব্যয় করেছেন নেটিজেনরা। একই কাজ পুরুষ করলে তাঁকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। আর নারী হলেই তাঁকে নৈতিকতার শূলে চড়ানো হচ্ছে। একটি প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিনের চিত্র।

প্রতিদিনের কথা যখন এলই, তখন নিত্যকার ঘটনাগুলো আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। ধরুন, আপনার মা, বোন, প্রেমিকা বা স্ত্রী রাস্তায় বের হলেন প্রাত্যহিক কাজে। একদিন তাঁদের জিজ্ঞেস করবেন অভিজ্ঞতা কেমন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, এই দেশের রাস্তাঘাটে নারীরা কতটা প্রতিকূল অবস্থায় থাকেন। জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, ছেলে বা পুরুষ কর্তৃক কী পরিমাণ উত্ত্যক্তের শিকার হন তাঁরা। আমার পরিচিত এক নারী একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, শুধু পুরুষদের কটু মন্তব্যের জ্বালায় তিনি কামিজের সঙ্গে জিনসের সাধারণ প্যান্ট পরাই ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ এ দেশে সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখলেও নারীরা অহরহ কটু ও অশ্লীল মন্তব্য শুনতে থাকেন। এভাবে জীবন কাটানো কোনো নারীর জায়গায় নিজেকে একটু বসিয়ে দেখতে অনুরোধ করি। আচ্ছা, একজন পুরুষ যদি জিনসের প্যান্ট পরার কারণে দিনের পর দিন নারীদের কটু মন্তব্য শুনতেন, কী করতেন তিনি?

নারীদের উত্ত্যক্ত করার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। উত্ত্যক্ত করাটা এখন ভার্চ্যুয়াল জগতেও আসছে বেশ। যাঁরা একজন নারীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে নিন্দামন্দ করে থাকেন, তাঁরা আদতে ‘বখাটে’। পার্থক্য হলো, প্রচলিত অর্থে বখাটেরা রাস্তাঘাটে বাজে মন্তব্য করে। আর এঁরা করেন মার্ক জাকারবার্গের তৈরি দুনিয়ায়, মার্জিত প্রোফাইল পিকচারের আড়ালে।

তবে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তো দূর অস্ত, ‘শালীন’ পোশাকের তালাশেই আমরা ব্যস্ত। অপরাধ ও অপরাধীর দোষ খোঁজার বদলে ভিকটিমের ব্যাপারে ‘যদি–কিন্তু’ তোলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে বেশ। ওহ্, আমি দুঃখিত। এটি আসলে সমালোচনার পর্যায়ে পড়ে না। একে বলে নিন্দামন্দ। সমালোচনায় যুক্তি থাকে, কিন্তু শুধু পরনিন্দায় তা থাকে না।

লক্ষ করার মতো একটি বিষয় হলো—প্রতিবারই নারী ভিকটিমের ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠেন। সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি পুরুষপ্রধান সমাজে একসময় নারীর মনও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এ দেশে নারীদের টি–শার্ট বা প্যান্ট পরা নিয়ে তাই সবাই প্রশ্ন তোলে। যে ভাষায় এবং যেসব বিষয় নিয়ে নিন্দা চলে, তাতে মনে হয়, এই পৃথিবীতে টি–শার্ট বা প্যান্টের আবিষ্কার হওয়ার পরই তাতে লিখে দেওয়া হয়েছিল, ‘মেড ফর ম্যান’! একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যে সভ্য মানুষের কাজ নয়, সেটি আমরা বুঝতেই চাই না কখনো। ঠিক একইভাবে ধর্ষণের শিকার হওয়া একজন নারীর চরিত্রহননের চেষ্টাও চলে।

অথচ এই আমরাই মুখে বেশ বড় বড় কথা বলি। ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিশ্ব নাগরিক—এসব আমাদের অনেকেরই প্রিয় শব্দ। তবে সেগুলো ব্যবহার করি শুধুই নিজের স্বার্থে। আর অন্যের ক্ষেত্রে দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রবল বিক্রমে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই দেশে সহিংসতার শিকার নারীরা বাদে বাকি সবাই বুঝি ‘সাদা’ মনের মানুষ! সবার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, সেই পবিত্রতায় কোনো খাদ নেই। প্রশ্ন হলো, তবে এই দেশে এত দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, বখাটেপনা আসে কোত্থেকে? তথাকথিত ‘পবিত্র’ চরিত্রের অধিকারীরা দয়া করে জবাব দেবেন।

নারীদের উত্ত্যক্ত করার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। উত্ত্যক্ত করাটা এখন ভার্চ্যুয়াল জগতেও আসছে বেশ। যাঁরা একজন নারীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে নিন্দামন্দ করে থাকেন, তাঁরা আদতে ‘বখাটে’। পার্থক্য হলো, প্রচলিত অর্থে বখাটেরা রাস্তাঘাটে বাজে মন্তব্য করে। আর এঁরা করেন মার্ক জাকারবার্গের তৈরি দুনিয়ায়, মার্জিত প্রোফাইল পিকচারের আড়ালে। নারী–পুরুষ নির্বিশেষে এসব বখাটে ছদ্মবেশে থাকেন।

রাস্তার বখাটেদের চেনা খুব সহজ, কিন্তু এসব ‘সুশীল’ বখাটেকে চেনা কঠিন। চিহ্নিত করে গুনতে শুরু করলে দেখবেন, এদের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়, বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

একদিন কি তবে বখাটেদের রাজত্বেই বাস করতে হবে?

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]