নদীটার নাম মুসি

হায়দরাবাদ নগরীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া মুসি নদী
ছবি সংগৃহীত
এই লেখার মধ্যে আছে ছোট্ট এক ভ্রমণের গল্প, আছে অনুপম এক কাব্যিক বর্ণনা, যা পড়ার পর পাঠক পৌঁছে যাবেন তাঁর নিজস্ব নদীর কিনারে।

আরেক নদী আছে। কী যেন নাম তার? বুকের ভেতর কেঁদে কেঁদে নদীটা কোনো এক নাম না-জানা সমুদ্রে হারিয়ে যায়। পূর্ণিমার আকাশে দগদগে ক্ষতের মতো চাঁদটা অবশেষে ঢেউয়ের ভেতরে ভেঙে ভেঙে চুরমার হতে থাকে। মুসি নদীটা কেন জানি সেই অচেনা নদী আর সেই আকৃতিহীন চাঁদটার কথা মনে করিয়ে দেয়। কান্নার কথাও মনে আসে। নদীর কান্না শুনেছি কত রাত!

মরা আত্রাইয়ের পাড়ে একবার একটা কাটা মুণ্ডু দেখেছিলাম, যখন আমার ছেলেবেলা ছিল। আত্রাই! আত্রাই! তুমি কি মরে যাচ্ছ? কত রাত ভেতরের নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে ভেঙে দিয়ে এই প্রশ্নটাকে আর্তনাদের মতো ধ্বনিত হতে শুনেছি। আত্রাই কেঁদে কেঁদে ফেরে; ভেতরে সেই কান্না আবার জমাট বরফ হয়ে যায় একসময়; অতঃপর উত্তাপের অপেক্ষায় থাকে।

আজকাল খুব বেশি মনে হয়, যে মানুষের কান্না শোনেনি, সে কখনো নদীর ধারে যায়নি। যে নদীকে চেনেনি, সে ডুকরে ডুকরে ওঠা সময়ের কান্না শোনেনি। বনলতা, বড় সাধ হয়, তোমাকে নিয়ে যাই সেই নদীটার ধারে, যে নদীটার নাম আজও জানা হয়নি।

হ্যাঁ, নদীটার নাম মুসি। নামটা প্রথম শুনেছিলাম যোসেফের মুখে। যোসেফই বললেন, একসময় নদীটা হায়দরাবাদ নগরীর পাঁজর ঘেঁষে বয়ে যেত; আর আজ সে বয়ে যাচ্ছে নগরীর বুক চিরে। অর্থাৎ নদীর ওপারের এলাকায় নগরী বেড়েই চলেছে। পুঁজির ফটকাবাজিতে বৃদ্ধি, বিস্তার আর বৈপরীত্যই তো ‘নগরসভ্যতা’র অন্যতম মন্ত্র—পৃথিবীজুড়ে নগরগুলো বাড়তে থাকে, কেবল বাড়তেই থাকে। আর গ্রাম ভাঙনের শব্দ নাম না-জানা সেই নদীটার মতোই কাঁদতে থাকে, কাঁদতেই থাকে। সময়ও শুনে যায়, কেবল শুনে যায় সেই কান্না।

বাড়তে বাড়তে হায়দরাবাদের সহোদর এভাবেই জন্ম নেয়। এর নাম সেকান্দারাবাদ। হাত ধরাধরি করে থাকে তারা। এদের শহরতলি আবার ষোলো মাইল পর্যন্ত এলিয়ে আছে। প্রায় তিরিশ লাখ এদের জনসংখ্যা। দাক্ষিণাত্যের এক মালভূমির ওপর চোখধাঁধানো নেশা-ধরানো ৪০০ বছরের একজোড়া নাচতে-থাকা নগরীর নাম হায়দরাবাদ-সেকান্দারাবাদ।

লোরকার কবিতার সেই চিত্রকল্পটা মনে আসে। সমুদ্রের অতল থেকে নুনমাখা শরীর নিয়ে জেগে উঠেছে এক নারী; সমুদ্র থেকে অনেক ওপরে চলে যাচ্ছে সে; পাস্কালীয় শূন্য স্পেসে মুদ্রা কেটে কেটে নাচতে নাচতে সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু হায়দরাবাদ-সেকান্দারাবাদ মোটেই আতঙ্কিত নয়; তারা আনন্দিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৬০ ফুট ওপরে তাদের শরীর সে কী অটুট! নাচের মুদ্রায় তারা সে কী স্বতঃস্ফূর্ত! অন্ধ্র প্রদেশের বুকের ওপর আলো-নিসর্গ-নদী-মাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে নেচে চলেছে, ভারতের [তখন] পঞ্চম বৃহত্তম নগরী, অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী। তখন বলা হতো, পৃথিবীর সুন্দরতম নগরীগুলোর একটি হায়দরাবাদ।

সেদিন আমরা যাচ্ছিলাম হায়দরাবাদের গোলকোন্ডা কেল্লায়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; বাস ছুটে চলেছে নগরীর রাস্তায়; বাসের ভেতরে আমরা ছিলাম প্রায় কুড়িজন; আমাদের কোলাহল, কথোপকথন, নৈঃশব্দ্য, চিন্তাও ছিল। রঞ্জনার হাসি শুনতে পেলাম; বাসের মাঝখানে জানালাঘেঁষা একটা আসন তখন আমার দখলে, বাইরে তাকিয়েই দেখা যায় ড্রাগস্টোর, সাইনবোর্ড, কলেজ, গাড়ি, ধোঁয়া, হুসেন সাগর, মানুষ—সবই ছুটে চলেছে, সবই ক্ষণস্থায়ী, টুকরো টুকরো, সবই থাকে, আবার থাকেও না। ভালো লাগল, আবার অসহায় বোধ করলাম।

হ্যাঁ, নদীটার নাম মুসি। নামটা প্রথম শুনেছিলাম যোসেফের মুখে। যোসেফই বললেন, একসময় নদীটা হায়দরাবাদ নগরীর পাঁজর ঘেঁষে বয়ে যেত; আর আজ সে বয়ে যাচ্ছে নগরীর বুক চিরে। অর্থাৎ নদীর ওপারের এলাকায় নগরী বেড়েই চলেছে। পুঁজির ফটকাবাজিতে বৃদ্ধি, বিস্তার আর বৈপরীত্যই তো ‘নগরসভ্যতা’র অন্যতম মন্ত্র। পৃথিবীজুড়ে নগরগুলো বাড়তে থাকে, কেবল বাড়তেই থাকে। আর গ্রাম ভাঙনের শব্দ নাম না-জানা সেই নদীটার মতোই কাঁদতে থাকে, কাঁদতেই থাকে। সময়ও শুনে যায়, কেবল শুনে যায় সেই কান্না।

মনে হলো, ওই জানালা হঠাৎ ভেঙে গেল; মনে হলো, বাসের বডিটা খুলে পড়ল, ছুটে চলা বাসের ভেতর থেকে আমি পড়ে গেলাম, শুরু হলো আরেক ছুটে চলা—২৪ আগস্ট উদ্ভাসিত হলো, নোংরা পুড়ে যাওয়া অথচ সুন্দর-শীতল ঢাকার মুখ সামনে এল; বুকের ভেতর দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠল; ২৪ আগস্টে যে কাছে এসেছিল সময়ের আর প্রেমের কবিতা হাতে নিয়ে আর শুনিয়ে শুনিয়ে, সে এখন কি ফিরে গেছে সেই ভয়াল নাম না-জানা শহরে? ...ইঁদুর কেটে ফেলেছে সমস্ত গ্রন্থি, আমার পুরোনো টেবিলের একটা বুড়া থুত্থুড়ে পায়া চলে গেছে ঘুণের দখলে...সংবিধান উইপোকার দখলে, নাকি সংবিধান এখন বিধানের সং? ...পতাকা এখন ইঁদুরের দাঁতে; পার্লামেন্টে মাকড়সার জাল বাড়ছে।

মাকড়সা মানেই ‘ফ্র্যাকটাল’ জ্যামিতি...একবার, মনে পড়ে, ওই জ্যামিতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম...শালার ‘ফ্র্যাকটাল’! ত্রিভুজের দুটো বাহু উড়িয়ে দিয়ে তাকে আস্ত একটা রম্বসে পরিণত করে তিনটে বৃত্তকে এদিক-সেদিক ঠেসে-ঠুসে হাতের ভেতরে একটা বিশেষ শেপ অনুভব করার নান্দনিক-শারীরিক আনন্দের অন্বেষণে তোমার কাছে গিয়েছিলাম হে ‘ফ্র্যাকটাল’ জ্যামিতি! এ-ও বুঝেছিলাম, জ্যামিতি দুটো জিনিস বোঝে ভালো—এক, দেহতত্ত্ব ও দুই, রাজনীতি। হ্যাঁ, রাজনীতি আর দেহতত্ত্ব ছাড়া জ্যামিতি জমে না মোটেই।

‘কী, চুপচাপ যে?’ আমার পাশ থেকেই প্রশ্নটা এল, আনন্দ শর্মার কাছ থেকে। বাসের খুলে-যাওয়া জানালাটা ধপ করে লেগে গেল, বাসের বডিটাও ঝট করে আকৃতি ফিরে পেল; পড়ে যাওয়া ‘আমি’ তখন বাসের ভেতরে জানালার পাশের সিটে বসে আনন্দ শর্মার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কী বলব? হঠাৎ মনে হলো বলি, আমার জিহ্বাটা কে যেন কেটে ফেলেছে গত রাতে। তারপর মনে হলো, এমনই একটা উত্তরকে নিছক পাগলামি ঠাওরাবেন ইংরেজি সাহিত্যের নেপালি শিক্ষক আনন্দ শর্মা। তাই বললাম, না, বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম।
(লেখকের পুরোনো দিনের ভ্রমণকাহিনি থেকে)

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]