‘পথের পাঁচালী’র প্রথম শট

বহু বর্ণিলতায় ভরা লেখক–শিল্পী–সাহিত্যিকদের জীবন। শিল্পী–সাহিত্যিকদের জীবন থেকে নেওয়া ঘটনাবলি প্রকাশিত হবে এই বিভাগে।

কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। খানিক পরপর তিন সহকারীকে এদিক-ওদিক দাঁড় করিয়ে দিলেন সত্যজিৎ—নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর সুবীরকে তাঁরা নাম ধরে ডাকবেন। ডাক শুনে সুবীর সেদিকে তাকাবে, যেদিক থেকে ডাকটা আসছে।

সত্যজিৎ রায় যখন সিদ্ধান্ত নিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমা বানাবেন, তখন তিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করেন।

মাত্র ৭০ হাজার টাকা বাজেটের সিনেমাটির জন্য একজন প্রযোজক খুঁজে বেড়াচ্ছেন দ্বারে দ্বারে। এত কম বাজেটের একটা মুভি, তা-ও প্রযোজক পাচ্ছেন না তিনি। বিচিত্র সব চাহিদা একেকজনের। কেউ বলেন এটা বদলান; কেউ বলেন ওটা বদলান, কেউ বলেন, সিনেমায় স্টার নেই, গান নেই, মারপিট নেই—এত বাজেট কেন?

মজার ব্যাপার হলো, ‘পথের পাঁচালী’র কোনো পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত ছিল না। শুধু একতাড়া কাগজে কিছু নোট আর কিছু স্কেচ। সত্যজিৎ আসলে কখনো পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেননি। প্রতিটি দৃশ্য তাঁর মাথায় এমনভাবে গাঁথা ছিল যে সেসবের দরকার ছিল না।

কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। খানিক পরপর তিন সহকারীকে এদিক-ওদিক দাঁড় করিয়ে দিলেন সত্যজিৎ—নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর সুবীরকে তাঁরা নাম ধরে ডাকবেন। ডাক শুনে সুবীর সেদিকে তাকাবে, যেদিক থেকে ডাকটা আসছে।

একদিকে প্রযোজকের খোঁজ, খরচ বাঁচানোর চিন্তায় নানা উদ্যোগ নেওয়া, এরপর চরিত্রের জন্য অভিনেতা খোঁজা। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন ছিল যে সিনেমাটা বানানো নিয়েই আলাদা উপন্যাস বা আরেকটা সিনেমা বানানো যায়।

তো ‘পথের পাঁচালী’র শুটিং শুরু হলো। সাউন্ড-রেকর্ডিস্টের খরচ বাঁচানোর জন্য শুরুতে এমন কিছু শট দিয়ে সিনেমা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যাতে আদতে কোনো সংলাপ নেই। প্রথম দিনের দৃশ্য ছিল এমন: কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু হাঁটছে।

দিদি দুর্গাকে খুঁজছে সে। খানিক হাঁটবে, এদিক-ওদিক দিদিকে খুঁজবে, এগিয়ে যাবে...
পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের খেলার মাঠে দাদা আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে দেখে সুবীর নামের যে ছেলেকে অপু চরিত্রের জন্য পছন্দ করেছিলেন সত্যজিতের স্ত্রী, দেখা গেল ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ানো সে ছেলেটির হাঁটা মোটেই স্বাভাবিক নয়, আড়ষ্ট।

এদিকে দামি নেগেটিভ খরচ হচ্ছে। সত্যজিতের মাথায় হাত। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। খানিক পরপর তিন সহকারীকে এদিক-ওদিক দাঁড় করিয়ে দিলেন সত্যজিৎ—নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর সুবীরকে তাঁরা নাম ধরে ডাকবেন।

ডাক শুনে সুবীর সেদিকে তাকাবে, যেদিক থেকে ডাকটা আসছে। দাঁড়ানো চলবে না। পথের ওপর এদিক-সেদিক ফেলে রাখা হলো শুকনো ডাল। সেসব লাফিয়ে পার হতে হবে সুবীরকে।

এবার আর ভুল হয় না। সহজাত অভিনয়প্রতিভা নেই, এমন এক ছেলের অনিশ্চিত ভঙ্গির হাঁটা দিয়ে শুরু হয় নতুন এক ইতিহাসের প্রথম পা ফেলা।

সূত্র: সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর পাঁচালি’।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo. com