পোশাকি সম্বন্ধ

হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’ নাটকের একটা দৃশ্যে পার্টি শেষে নাটকের মূল চরিত্র নোরার স্বামী টোরভাল্ট নোরাকে আদর করতে চায়, পার্টি পোশাকে নোরার ট্যারেন্টেলা ডান্স দেখে আট বছরের বিবাহিত স্ত্রীকে সদ্য পরিচিত বাগদত্তা ভাবতে ইচ্ছে করে তার। পার্টির অন্যরা যখন নোরাকে দেখে মুগ্ধ হয়, তখন সে নোরার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে, নিজের স্ত্রীকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে টোরভাল্ট। বিষয়টা খুব রোমান্টিক মনে হচ্ছে না? তবে নোরার কাছে কিন্তু তা মনে হয় না।
নোরা বলে, ওভাবে তাকিও না টোরভাল্ট!

টোরভাল্ট: আমার প্রিয় সম্পত্তির দিকে তাকাব না? যে সুন্দর শুধু আমার, যে সুন্দর শুধু আমার ব্যক্তিগত, আর কারও নয়, তাকে দেখব না?

টোরভাল্ট আদর করতে চাইলে নোরা রাজি হয় না; কারণ দুজনের মানসিক পরিস্থিতি ভিন্ন। সংলাপ থেকেই বোঝা যাচ্ছে একজন ‘স্বামী’ কীভাবে তার ‘স্ত্রী’কে সম্বোধন করছে, সংরক্ষণ করছে, কীভাবেই-বা দেখছে! নিশ্চয়ই অনেকে ভাবছেন, এভাবে দেখলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা যদি না-ই থাকবে, তবে নোরা ওইভাবে দেখতে নিষেধ করত না। ওই যে বললাম, দুজনের মানসিক পরিস্থিতি ভিন্ন। যাঁরা ‘এ ডলস হাউস’ পড়েছেন, তাঁরা জানেন নোরার উপলব্ধিগত ভ্রমণ সম্পর্কে; আর যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্য প্রশ্ন এই, ‘স্বামী’র যখন যা ইচ্ছে করবে, তা-ই বলবে এবং ‘স্ত্রী’র প্রতি ইচ্ছেমতো আচরণ করবে কখন? উত্তর টোরভাল্টের সংলাপের মধ্যেই আছে, ‘আমার প্রিয় সম্পত্তি।’

একজন জীবন্ত মানুষকে সম্পত্তি বানিয়ে ছাড়ল ‘স্বামী’। স্বামী অর্থ কর্তা, প্রভু, মালিক। স্ত্রী শব্দের অর্থ বধূ, রমণী, জায়া। এ দেশে দুজন মানুষের বৈবাহিক সম্পর্কের নাম স্বামী-স্ত্রী!

শিক্ষায়তনে ‘এ ডলস হাউস’ নাটকটি যাঁরা পড়েন, সেই শিক্ষার্থীদের ‘অভিনয়ের প্রস্তুতি’ শিরোনামের একটা কোর্স আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে জানি, এটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে পড়ানো হয়। আমাদের বিভাগে এই কোর্সে লাঠিখেলা, মূকাভিনয়, দড়াওবাজি প্রভৃতি শারীরিক কসরতের চর্চার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থী তার শরীর ও মনকে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত করেন। চর্চার সুবিধার্থে সব শিক্ষার্থীকে একটা নিরপেক্ষ ও আরামদায়ক পোশাক পরতে হয়—কালো ট্রাউজার ও কালো টি-শার্ট। প্রাণশক্তি যাতে ভালো থাকে, সে কারণে সাধারণত এই ক্লাসটি সকালবেলাতেই হয়ে থেকে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের সুবিধার্থে কোর্সের জন্য নির্ধারিত পোশাক পরে ও হাতে লাঠি নিয়েই ঘর থেকে ক্লাসের উদ্দেশে বের হয়। তবে সমস্যাটা হয় নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অজ্ঞানতাবশেই হোক আর অতি আগ্রহের কারণেই হোক, বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অন্য বিভাগের একজন আমাদের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে একদিন বলেই বসলেন, কী স্যার, ডিপার্টমেন্টে কি মেয়েদের লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করছেন? এতে আমাদের সহকর্মীর খুব আত্মসম্মানে লাগল তাঁর বিভাগের মেয়েদের নিয়ে এমন মন্তব্যে! খেয়াল করুন, মন্তব্য যিনি করলেন, তিনি কত সহজেই একটা ডিসিপ্লিনকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। আর আমদের শিক্ষক ব্যথিত হলেন, লজ্জিত হলেন। কিন্তু কেন? লজ্জিত হওয়া উচিত কার?

যেহেতু এটা অফিশিয়াল বক্তব্য নয়, তাই এটা নিয়ে অফিশিয়ালি কিছু করা করা গেল না। কিন্তু আন অফিশিয়ালি মেয়েদের ক্লাসের পোশাক ব্যাগে আনতে বলা হলো এবং বলা হলো, খেলার জন্য যে লাঠি তা এখন থেকে বিভাগেই থাকবে। প্রয়োজনে মেয়েরা আগে আসবে, পোশাক পরিবর্তন করবে এবং ক্লাস করবে। ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আলাদা কিছু ঘটল না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বললাম, মেয়েদের জন্য আলাদা আচরণ নাট্যকলার মতো ডিসিপ্লিন বৈষম্য সৃষ্টি করবে। এর ফলে এখানে শিক্ষার পরিবেশ ও উদ্দেশ্য নষ্ট হবে।

এরপর আমাদেরই এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বললেন, ‘ওরা আমদের ছেলেমেয়ে। কিন্তু মেয়েদের হাতে লাঠি দেখলে ভালো “স্বামী” পাবে না। ওদেরকে তো বিয়ে [মালিকানা] দিতে হবে, ভালো পাত্র [ভবিষ্যৎ মালিক] ওদের পছন্দ করবে না!’ বলা ভালো, যে কথাগুলো আমার সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, তা তিনি খুব আন অফিশিয়ালভাবেই বলেছিলেন।

তাঁর কথায় আমি একটুও অবাক হইনি। ঝগড়া করতে পারতাম, কিন্তু তাতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতৃতুল্য শিক্ষকের মাথা থেকে কি কন্যার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ভূত নামাতে পারতাম, নাকি আমাদের নারী শিক্ষার্থীরাও চিরাচরিত বিধি-নিষেধের অভ্যস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারত? সংগত কারণেই তাই চুপ হয়ে গেলাম। কেননা, আমার নিজেরও তো শিক্ষক হিসেবে অস্তিত্বের প্রশ্ন আছে। আমি কেন ‘শিক্ষার পরিবেশ নষ্টকারী’ ও ‘শিক্ষার্থীদের মাথা নষ্টকারী’ হিসেবে প্রমাণিত হব?

দুই.
একদিন হাঁটছিলাম। পাশ দিয়ে একটা ট্রাক অকারণে ভীষণ শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। আমার মতো এ অভিজ্ঞতা বোধ করি রাস্তায় চলাফেরা করা অধিকাংশ নারীরই আছে। আমি আগে নানাভাবে আক্রান্ত হতাম, মন খারাপ হতো। আর এখন ভাবি, নারীর প্রতি এত বিদ্বেষ বা ঘৃণা কোথা থেকে এল ওই পুরুষদের মধ্যে? (ব্যতিক্রমও যে আছে, সেটিও মাথায় রাখছি) এই ঘৃণার জন্ম কোথায়? ঘৃণার জন্ম তো হয় নিজের কোনো অসন্তোষ থেকে। এত স্বাধীনতা, এত ভোগ থাকা সত্ত্বেও কিসের অতৃপ্তি তাহলে তাদের?!! এত শাস্ত্র-নীতি-বিধান করে পুরুষের জন্য সারা ‘বিশ্ব’ আর নারীর জন্য শুধু ‘ঘর’ নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও নারীর প্রতি কেন এত ঘৃণা?

নিয়ম করে যে ক্ষমতা সম্পর্ক ‘বিবাহ’ নামে নির্ধারণ করা হলো নারী-পুরুষে, তাতে কী লাভ হলো যদি স্বামীকে জিম্মি করে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়? অথবা পাঁচ-পাঁচটি স্বামী থাকা সত্ত্বেও দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের বস্ত্রহরণের মুখোমুখি হতে হয়! আসলে স্বামীর ওপরেও স্বামী থাকে…ক্ষমতার ওপরে ক্ষমতা…

তাই বলতে চাই, সম্পর্কগুলো ক্ষমতা সম্পর্ক না হয়ে সমতা সম্পর্ক হলে যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্ধু হয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা যেত, তেমনি বন্ধুর মতো ভালোবাসার সম্বন্ধ গড়ে উঠত ঘরে-বাইরে।

রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের যে রাজ্য, সেই রাজ্যে রাজাকে কেউ দেখতে পায় না, দেখা দেন না তিনি, বরং এমন ব্যবস্থা করেন যেন সবাই-ই রাজাকে অন্তরে অনুভব করতে পারে, সেই অনুভব প্রেমের অনুভব, বন্ধুত্বের অনুভব, সেই অনুভব নিজেকেই রাজা ভাবার অনুভব। তাই সেই দেশের মানুষ গান গায়, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি স্বত্বে।’ রবীন্দ্রনাথের এমন রাজ্য একটা পরিবার হতে পারে, হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হতে পারে একটি রাষ্ট্র; যেখানে সবাই রাজা, সবাই বন্ধু, সবাই সমান, যেখানে কোথাও কোনো ঘৃণা নেই, আছে কেবল প্রেম।