বুড়ি ও কাবুলিওয়ালা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়া নয়, এখানে আছে অন্য এক কাবুলিওয়ালার মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প

ছোটবেলায় আমাদের এক গল্পবুড়ো ছিল। আমরা তখন ২৬/এ আজিমপুর কলোনির বাসিন্দা। সেই গল্পবুড়োর ছিল চৌকো কালো ফ্রেমের চশমা। এতই পুরু ছিল তার চশমার কাচ, ওর ভেতর দিয়ে তার চোখটা ডবল সাইজের দেখাত। হাতে থাকত বই আর একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। তার মুখেই শুনেছি, ইহুদিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গল্প, হারাধনের গল্প, খুকি ও কাবুলিওয়ালার গল্প। যেসব দিনে সে অফিস থেকে ফিরে সামনের মাঠে পাটি বিছিয়ে বসে গল্প শোনাত, সেসব দিনে মাঠের কোনো খেলাই আমাদের আকর্ষণ করত না। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার শিশুদের মতো আমরা সবাই তার গল্পের আকর্ষণে তার চারপাশে গুটিসুটি হয়ে বসে বিভোর হয়ে শুনতাম। কাবুলিওয়ালার জেলে জীবন পার করার দুঃখটা সবাইকে খুব নাড়া দিয়েছিল।

আমাদের জীবনেও খুকি ও কাবুলিওয়ালার গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, ভাবতে পারিনি। আমাদের বুড়ি ও কাবুলিওয়ালার গল্পের শুরু ১৯৬৯ সালে। বাবা (ড. আশরাফ সিদ্দিকী) তাঁর পিএইচডি শেষ করে দেশে ফেরার পরে আমরা আজিমপুরের পাট চুকিয়ে ধানমন্ডির বাসিন্দা হয়েছি। আমার চার বছরের ছোট্ট বোন রিফফির তখন ছয় বছর বয়স। তবে বাড়িতে তাকে কেউ রিফফি বলে ডাকে না। তাকে সবাই সম্বোধন করে বুড়ি বলে। তখনকার ধানমন্ডিটা একেবারে অন্য রকম। এক বিঘা জায়গার ওপর একতলা সব বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড লন। বেশির ভাগ বাড়ি সাদা। প্রতিটি বাড়িতে আছে লাল বা ম্যাজেন্টা ফুলে ছাওয়া বাগানবিলাস। কোনো কোনো বাসার গেটে মাধবীলতা।

এবারে মা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন। দারুণ এক গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, তোমরা আশপাশের পাড়ার ছেলে। তোমাদের অনেকের বোন আমার ছাত্রী। আমি সাঈদা সিদ্দিকী। আমি বলছি, এক্ষুনি বন্দুক নামাও এবং এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও।’ মায়ের কথায় কিছু ছিল। তারা কিন্তু বন্দুক নামাল এবং একটু পরে তখনকার মতো চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, কেন আজিমপুর স্কুলের ২ হাজার ৫০০ ছাত্রী এই নারীকে এতটা সমীহ করে।

রাস্তাগুলোর একদিকে রাধাচূড়া আর অন্যদিকে কৃষ্ণচূড়াগাছ। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ধানমন্ডি লেক। আমার কাছে ধানমন্ডিকে রীতিমতো স্বপ্নপুরী মনে হতো।

বেশ কয়েকটা বাড়িতে ছিল বিদেশিদের বাস। আমাদের সামনের ডান দিকের বাসাটায় থাকেন মিস্টার লিব্বি, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের পোষা ভীষণ তেজি অ্যালসেশিয়ান কুকুর ইগোর। মিস্টার লিব্বি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। সেই সময়কার ওয়াপদার কোনো প্রকল্পে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। তাঁরা মার্কিন মুল্লুকের মানুষ। সে বাড়িটা আবার বাবার সহপাঠী, একসময়ের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব সাবের রেজা করিম ও তাঁর স্ত্রী ফওজিয়া করিমের। পরবর্তী জীবনে অবশ্য সে বাড়ির কন্যাই আমাদের ঘরে এসেছে কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী হিসেবে। যাকে বলে ‘মেরে সামনে ওয়ালে খিড়কি মে, এক চানসা টুকরে রেহিত হ্যায়!’ সে আরেক গল্প। যা বলছিলাম, সেই লিব্বি সাহেবের একজন বাটলার ছিল। সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, ছিপছিপে গড়নের। গায়ের রংটা কখনো হয়তো ফরসা ছিল। তবে এখন পুড়ে তামাটে। গাঢ় ছাই রঙের চোখগুলো কেমন যেন চিকন করে পাশে ছড়ানো। যখনই দেখা হতো, সেই চোখগুলোয় একটা আন্তরিক আপ্যায়ন থাকত। আর মুখে থাকত স্মিত হাসি। হাসলে তার চোখগুলো আরও ছোট হয়ে যেত। বাংলা বা ইংরেজি দূরে থাক, সে উর্দুও বলতে পারত না। খুব সম্ভব সে ছিল বেলুচিস্তানের, তাই বালুচ ভাষায় কথা বলত। সব সময় কাবুলি পোশাক পরে থাকত বলে আমাদের কাছে তার নাম হয়ে গেল কাবুলিওয়ালা।

এই কাবুলিওয়ালা সারা দিন কিছু না কিছু করছে। আর তা না হলে গেটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে, কড়া পাহারাদারের মতো। সে বাড়ির কুকুর ইগোর ছিল কাবুলিওয়ালার ঠিক বিপরীত। সামনে দিয়ে কেউ হাঁটলেই ঘেউ ঘেউ করে। যাওয়া-আসার পথে হাসি বিনিময় হতে হতে কেমন করে যেন বুড়ির সঙ্গে তার খুব ভাব জমে গেল। বুড়ির স্কুল থেকে ফেরার সময় সে গেটে দাঁড়িয়ে থাকত শুধুই ওর সঙ্গে চোখে চোখে একটু কুশল বিনিময়ের জন্য। সে জানে যে তাদের বাড়ির বাগানের ফুলঝাড়গাছের ঝোপটার একটা শিষ পেলে বুড়ি যেন স্বর্গ পেয়ে যায় হাতে। তাই কোনো কোনো দিন রাস্তা পেরিয়ে এসে বুড়িকে দিয়ে যেত সেই ঝোপের কয়েকটা শিষ। সেগুলো বড় বোন রিমার ছোট্ট কাঁসার কলসির মধ্যে ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে কী তৃপ্তিই না পাই আমরা! কোনো কোনো দিন তো ছিল রীতিমতো পার্টি! কেননা, এ সময় ময়দা বা আটা দিয়ে সুন্দর বেণির মতো প্যাঁচানো পাউরুটি বেক করে তার ছোট্ট বন্ধু বুড়িকে দিয়ে যেত কাবুলিওয়ালা। সে রুটি এত বড়, কিন্তু বুড়ির মনে হতো ওটা তাকে দিয়েছে, অন্যরা কেন ভাগ বসাবে।

সত্তর দশকের শুরুর দিকের ধানমন্ডি।
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের মনে মনে বাড়ির ভেতরটা দেখার শখ ছিল। একদিন সে সুযোগ এসে গেল। লিব্বি পরিবার আমাদের অর্থাৎ বাচ্চাদের নাশতার আমন্ত্রণ জানালেন। মিসেস লিব্বি ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখালেন পুরো বাড়ি। বললেন, তাঁরা কাজের উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে থেকেছেন। তাই তাঁদের আসবাবপত্রগুলো একটু অন্য রকম। সত্যিই তাই। ড্রয়িংরুমের মূল দেয়ালে আড়াআড়ি করে ঝোলানো দুটো বন্দুক। আর এক দেয়ালে নানা দেশের ঢাল-তলোয়ার, টেডি সোফা, পিতলের কারুকাজ করা কালচে কাঠের সেন্টার টেবিল। রান্নাঘরটা দেখার মতো। ঝকঝকে, তকতকে, গোছানো। মাঝ বরাবর বিরাট এক ওভেন। সেই ওভেনে তৈরি রুটি আর অন্যান্য বেকারিই তো আমরা রিফফি বদৌলতে ভোগ করি। এই বাড়িটা একেবারে সামনের দিকে। আর পেছনে বিশাল মাঠ। ওই তো সেই ফুলঝাড়গাছের ঝোপটা! অপূর্ব অপূর্ব! মিসেস লিব্বি জানালেন, এর আগে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করতেন। আমাদের কাবুলিওয়ালা সেখানে তাঁদের বাড়িতে কাজে যোগ দেয়। এত বিশ্বাসী এবং মনিবভক্ত বলে তাঁরা তাকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন।

সময় গড়িয়ে চলল। সত্তরের নির্বাচন হলো। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে চাইল না। চালাল নির্বিচার গণহত্যা। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের কিছুদিনের মধ্যেই লিব্বি দম্পতি নিজ দেশে চলে গেলেন। অবস্থা স্বাভাবিক হলে ফিরবেন। কাবুলিওয়ালা ভাইকেও টাকা দিয়ে গেলেন। যেন সে তার দেশে চলে যায়। কিন্তু সে যায় কীভাবে? তার মনিবের সব মালসামানা তো তেমনি পড়ে আছে। কার কাছে রেখে যাবে সে এসব? তার যাওয়া হলো না। সব গৃহকর্মী চলে গিয়েছিল। বাগান থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি, যেমনটি তার মনিব রেখে গিয়েছিল, তেমনটি গুছিয়ে রাখল। একটা কাকপক্ষীকেও ঢুকতে দিল না ওই বাড়িতে। ব্যতিক্রম শুধু আমরা। আমাদের জন্য তার দ্বার ছিল অবারিত। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে একইভাবে পাহারা দিয়ে গেল সে বাড়ি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দখলদার বাহিনী পরাজিত। আজ আমরা বিজয়ী। সেই সময়টায় আমাদের বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকত টুটু-তানিরা। সকাল থেকে আমরা ঝুড়িভরে বাগানের সব ফুল তুললাম। পেছনের বাগানে প্লাসটিকে মুড়ে পুঁতে রাখা পতাকা, যেটা ২৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত উড়ছিল, তা বের করা হলো। মনে পড়ল কীভাবে এক দিনে বোতাম ঘর স্টিচ দিয়ে লালের ওপর হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্রটা সেলাই করেছিল মঞ্জু খালা, পারভীন আপা ও মা। আমিও দুটো ফোঁড় দিয়েছিলাম! দুই দিন ছাদে লাগানো ছিল সেই ফ্ল্যাগ। ২৫ মার্চ ভোররাতে রুমি ভাই হামাগুড়ি দিয়ে নামিয়ে এনেছিল পতাকাটা। আজ আবার সবাই সেটা নিয়ে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করলাম। বন্দুক হাতে জিপে করে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়-উল্লাস করছে। আমরা সবাই ঝুড়ির ফুলগুলো তাদের জিপের উদ্দেশে ছুড়ে দিচ্ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সহাস্যবদনে আমাদের সেই অভিবাদন গ্রহণ করছিল। বারবার আমরা তাঁদের স্যালুট করছিলাম এবং তাঁরাও স্যালুট দিয়েই তার প্রতি-উত্তর দিচ্ছিল। বিজয়ের কী আনন্দ, কী আনন্দ, স্বাধীনতার কী স্বাদ, তা সেই বয়সেই আমরা অকাতর পান করে যাচ্ছিলাম।

কাবলিওয়ালার বন্ধু সেই ছোট্ট বুড়ি । এখন সে সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারপারসন

ঠিক এর এক কি দুদিন পরে গৃহকর্মী মনসুর দৌড়ে এল, সঙ্গে শুকুর আলীও। মনসুর বাসায় যত না কাজ করে, তার চেয়ে বেশি আমাদের খেলার সঙ্গী। কাবুলিওয়ালা তারও বন্ধু। তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর! ‘দাদিবিসাব, দাদিবিসাব, জলদি চলুইন, জলদি চলুইন! বুড়ির কাবুলিওলাকে মারনের নিগা দুই জিপ ভইরা পোলাইহান আইসে। মাইরা ফালাইল কইল। তওরি নন।’ মা একপ্যাচে শাড়ি পরে ঘুমাতেন। শাড়িটা তখনো সেভাবেই পরা। কাপড় বদলানোর সময় নেই। ওভাবেই দৌড়ে বের হলেন মা। পিছু পিছু আমরা সবাই।

তরুণেরা চলে যেতেই মা আমাদের কাবুলিওয়ালাকে বললেন, ‘তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। চলো আমাদের বাড়ি। এ যাত্রা রক্ষা করতে পেরেছি, পরেরবার নাও পারতে পারি।’ সে তখনো বলছে, তার মনিবের সম্পত্তির কী হবে? মা বললেন, ‘ফেলো তোমার মনিবের সম্পদ। নিয়ে এসো তোমার বাক্সপেটরা।’ ১০ মিনিটের মাথায় সে নিয়ে এল তার সবকিছু। আমরা আমাদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। চারটা কাবুলি স্যুট, চিরুনি, দুটো তিব্বত সাবান, দাড়ি কামানোর সামগ্রী। ব্যস, এই তার সম্পদ। আর সে কিনা নিজের জীবন বিপন্ন করে রক্ষা করতে চাইছে আর এক বিদেশির সম্পদ!

এত সুরক্ষিত বাড়িটার গেটা হাঁ করে খোলা। দুটো জিপ দাঁড়ানো রাস্তায়। এদিক-ওদিক হাঁটছে কিছু যুবক। ভেতর থেকে কথার আওয়াজ আসছিল। সে আওয়াজ অনুসরণ করে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে পাশের প্যাসেজটা ধরে বেডরুমের দিকে ছুটলেন মা। সঙ্গে আমরাও। দেখি সামনে দাঁড়ানো কাবুলিওয়ালা। ফ্যাল ফ্যাল করে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে সে। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিক থেকে তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে এক যুবক। মা নরম করে বললেন, ‘বাবা, তোমরা একে মারতে চাইছ কেন?’ আরেক তরুণ উত্তর দিল, ‘সে কোলাবরেটর। এখানকার বাঙালিদের সম্পর্কে মিলিটারিদের খবর দিত সে।’ বন্দুক হাতে যুবক বলল, ‘খালাম্মা, চলে যান। আমাদের কাজে বাধা দেবেন না।’ তারপরও মা বললেন, ‘বাবারা, তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি জানি, ও খুব নিরীহ লোক। এখানে কাউকে চেনে না। তোমরা আমাদের গর্ব।

এমন কিছু কোরো না, যার জন্য সারা জীবন অনুতপ্ত হবে।’ একজন তরুণ মাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরাতে উদ্যত হলো। বুড়ি ডুকরে উঠল, ‘আমার কাবুলিওয়ালাকে তোমরা মেরো না। প্লিজ! মা, আমার কাবুলিওয়ালকে বাঁচাও।’ এবারে মা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন। দারুণ এক গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, তোমরা আশপাশের পাড়ার ছেলে। তোমাদের অনেকের বোন আমার ছাত্রী। আমি সাঈদা সিদ্দিকী। আমি বলছি, এক্ষুনি বন্দুক নামাও এবং এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও।’ মায়ের কথায় কিছু ছিল। তারা কিন্তু বন্দুক নামাল এবং একটু পরে তখনকার মতো চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, কেন আজিমপুর স্কুলের ২ হাজার ৫০০ ছাত্রী এই নারীকে এতটা সমীহ করে।

তরুণেরা চলে যেতেই মা আমাদের কাবুলিওয়ালাকে বললেন, ‘তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। চলো আমাদের বাড়ি। এ যাত্রা রক্ষা করতে পেরেছি, পরেরবার নাও পারতে পারি।’ সে তখনো বলছে, তার মনিবের সম্পত্তির কী হবে? মা বললেন, ‘ফেলো তোমার মনিবের সম্পদ। নিয়ে এসো তোমার বাক্সপেটরা।’ ১০ মিনিটের মাথায় সে নিয়ে এল তার সবকিছু। আমরা আমাদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। চারটা কাবুলি স্যুট, চিরুনি, দুটো তিব্বত সাবান, দাড়ি কামানোর সামগ্রী। ব্যস, এই তার সম্পদ। আর সে কিনা নিজের জীবন বিপন্ন করে রক্ষা করতে চাইছে আর এক বিদেশির সম্পদ!
তাকে আমাদের গ্যারেজের ওপরতলায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। দু-এক দিনের মধ্যে কে বা কারা এসে লুট করে নিয়ে গেল কাবুলিওয়ালার এত কষ্টে পাহারা দেওয়া মি. লিব্বির সব সম্পত্তি। আমাদের দুটি বাড়ির পরে কোণের বাসাটায় থাকে তালুকদার পরিবার। তালুকদার সাহেব বাবাকে জানালেন, যারা এসেছিল, কেউই মুক্তিযোদ্ধা নয়। তার মুখেই সম্ভবত প্রথম শুনলাম ‘সিক্সটিন রেজিমেন্ট’, অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে এরা সব নব্য মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। এদের হাত থেকে বাঁচাতে কাবুলিওয়ালা ভাইকে জেনেভা ক্যাম্পে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন মা-বাবা।

ধানমন্ডির বাসার ছাদে সাঈদা সিদ্দিকীর কোলে বসা কাবলিওয়ালার বুড়ি। পাশে আমরা দুবোন।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমাদের বড় ভাই রুমি এবং তার বন্ধু সারোয়ার চলে গেল মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের কর্তৃপক্ষের কাছে। সব রকম ব্যবস্থা সেরে তার পরদিন তাকে নিয়ে রেখে আসা হলো জেনেভা ক্যাম্পে। আমাদের মোসলেম ড্রাইভার ভাই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল সঙ্গে, রুমি ভাই আর তার বন্ধু। কদিন পরপর মা খাবার, কাপড়, সাবান ইত্যাদি পাঠাতেন তাকে।

একসময় রেডক্রসের উদ্যোগে প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হলো। রুমি ভাই বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছুটোছুটি করে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করল। প্রথম দফায় যারা গেল, কাবুলিওয়ালা তাদের একজন। মা সেদিন সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার চেয়েও খারাপ পরিণতি হতো আমাদের কাবুলিওয়ালার।

যাহোক, নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারল আমাদের কাবুলিওয়ালা। ৮ থেকে ১০ দিনের মাথায় বা আর কিছু পরে বেলুচিস্তান থেকে এক পোস্টকার্ড এল। অপূর্ব সুন্দর ইংরেজি হস্তাক্ষরে ধন্যবাদ জানানো সে চিঠি। তার ছেলের জবানিতে লেখা আমাদের কাবুলিওয়ালা নিরাপদে তার গ্রামে পৌঁছে গেছে। তার ছোট বন্ধু বুড়ির জন্য পাঠিয়েছে এক ঝুড়ি শুভেচ্ছা।

নির্মলেন্দু গ‌ুণের একটা কবিতা আছে, ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানে তোমার প্রতি আমার অবহেলা’। কবিতাটা পড়লেই বন্দুক তাক করা অবস্থায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কাবুলিওয়ালার অবাক চোখটা ভেসে ওঠে। সেই বয়সেই যুদ্ধ সম্পর্কে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আমাদের হয়ে গেল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আমাদের শত্রু, সে দেশের নীতিনির্ধারকেরা আমাদের শত্রু, কিন্তু সে দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের শত্রু নয়। আমাদের কাবুলিওয়ালা যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যাওয়া এক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]