মাশুক চৌধুরী : একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা

>গতকাল রাতে মারা গেছেন কবি মাশুক চৌধুরী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।
মাশুক চৌধুরীর সঙ্গে কবে কীভাবে বা কার মাধ্যমে প্রথম পরিচয় হয় মনে নেই। তবে ১৯৭০ দশকের, বিশেষ করে শেষার্ধে এমন দিন খুব কমই গেছে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এলাকায়—প্রথমদিকে শরিফ মিয়া ও গফুর মিয়ার ক্যান্টিন ও পরে হাকিম চত্বরে দিনে একবার কি দুবার আমাদের দেখা হয়নি। আড্ডা-আলোচনায় তিনি ছিলেন স্বল্পবাক, নম্রভাষী। কখনো টেবিল চাপড়ে কেউ তাঁকে কথা বলতে দেখেছেন বলে মনে হয় না। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতা মোকাবিলায় আমরা যখন 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি কর্মী সমন্বয় কমিটি' নামক একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুলি, তখন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে আমরা সঙ্গে পেয়েছিলাম। কমিটির পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ৫২ জন সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীর স্বাক্ষরসংবলিত যে বিবৃতিটি সে সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে প্রথম নামটি ছিল মাশুক চৌধুরীর। সমন্বয় কমিটির প্রতিটি সভা ও অন্যান্য কর্মসূচিতে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। যদিও তাঁর সে উপস্থিতিটা হয়তো আমাদের অনেকের মতো সরব বা সক্রিয় ছিল না।
১৯৭৮ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প গঠিত হওয়ার পর পরই আমি একজন গবেষণা সহকারী হিসেবে তাতে যোগ দিই। তখন আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন শেষ করেছি। নতুন প্রকল্প, ফলে সরকারি নানা আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লালফিতার দৌরাত্ম্য অতিক্রম করে অর্থ বরাদ্দ পেতে দেরি হচ্ছিল। হাসান ভাই রোজ মন্ত্রণালয় ঘুরে এসে তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। আমরা কয়েক মাস বেতন পাচ্ছি না, মেস ভাড়া বাকি, খাওয়ার পয়সা নেই। মোটকথা খুবই দুরবস্থা তখন আমার। এ অবস্থায় মাশুক ভাই একদিন কবি সোহরাব হাসানের মাধ্যমে খবর দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠান এবং বোরহান ভাইকে (সাংবাদিক বোরহান আহমদ) বলে নবপর্যায়ে প্রকাশিত দৈনিক 'জনপদ'-এ আমার চাকরির ব্যবস্থা করেন। কিছুদিন পর 'জনপদ' থেকে বোরহান ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রায় সবাই-ই (বন্ধু সৈয়দ মনোয়ার ও সোহরাব হাসানসহ) যখন গিয়ে নতুন পত্রিকা দৈনিক 'দেশ'-এ যোগ দেন, তখনো আমি 'জনপদ'-এ রয়ে যাই। মাশুক ভাইও আরও কিছুদিন 'জনপদ'-এ ছিলেন (ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে এরপর তিনিও মনে হয় 'দেশ'-এ চলে যান)। তিনি শিফট ইনচার্জ, আমি তাঁর সঙ্গে ডেস্কে কাজ করি। আমার তখন প্রায়ই উপোস দিন কাটে, পত্রিকার বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, ফলে দুপুরে খাওয়ার পয়সা থাকে না। মাশুক ভাই সেটা জানতেন বা বুঝতে পারতেন। জোর করে দুপুরবেলায় আমাকে তাঁর সঙ্গে কাছের সস্তার হোটেলে খেতে নিয়ে যেতেন। প্রথমদিকে বলতেন, 'আচ্ছা, খাইয়েন না, আমার সঙ্গে বসবেন। আমি একা যামু নাকি?' পরে এই যাওয়াটা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়। আমাকে নিয়ে যেতে দেখে আরও দু-একজন মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গী হতো। ফলে তাঁদের খাবার বিলও তাঁকে শোধ করতে হতো। এ রকম আরও কয়েকজন মানুষের মতো মাশুক ভাইয়ের সঙ্গেও আমি এক অপরিশোধযোগ্য অন্নঋণে জড়িয়ে আছি। কী করে ভুলি সে কথা?
যতদূর মনে করতে পারি, 'জনপদ'-এ কর্মরত থাকাকালেই মাশুক ভাই বিয়ে করেন। আমি, সোহরাব ও আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আরও কেউ কেউ তাঁর বিয়ের বরযাত্রী হয়েছিলাম। পরে ১৯৮০-৮২ সালে দৈনিক 'গণকন্ঠ'-তে-ও আমি তাঁকে সহকর্মী হিসেবে পাই। কিন্তু তখন আর আগের মতো আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বা আড্ডা-আলোচনার সুযোগ ছিল না। কারণ আমার কাজ ছিল সম্পাদকীয় বিভাগে, যেতাম সকালের দিকে, দুপুরের পরপরই বেরিয়ে আসতাম। মাশুক ভাই বার্তা বিভাগে, যেতেন বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে, রাতে হয়তো পেসটিং অবধি থেকে বাড়ি ফিরতেন। তারপরও যেদিন আমার কলাম লিখে শেষ করতে দেরি হয়ে যেত, আমি যখন অফিস থেকে আমার বাসায় (আসলে মেসে) ফিরছি, র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে কখনো কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তিনি রিকশা থেকেই হাত তুলতেন এবং কুশল বিনিময় করতেন। এর বাইরেও হয়তো কখনো ছফা ভাইয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের (১০৭ নং) কক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এলাকায়, গফুর মিয়ার ক্যান্টিনে বা হাকিম চত্বরে আমাদের দেখা হয়েছে।
১৯৮৪ সালের পর আমার পেশার পরিবর্তন, চাকরিসূত্রে অনেকটা সময় ঢাকার বাইরে অবস্থান ইত্যাদি কারণে অনেকদিন তাঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। ফোনেও যে কথা হতো তা-ও নয়। তবে আমাদের উভয়ের বন্ধুবান্ধব কারও কারও (যেমন সোহরাব হাসান, মহিউদ্দিন আহমদ, আবু করিম, সৈয়দ মনোয়ার, তোহা মুরাদ) কাছ থেকে মাঝেমধ্যে তাঁর খবরাখবর পেতাম। তিনিও তাঁদের কাছে আমার খবরাখবর নিতেন বলে শুনেছি। তাঁর কোনো নতুন কবিতার বই বেরোলে আমাকে পাঠাতেন বা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন (আজ ভেবে খারাপ লাগছে, আত্মদংশনে ভুগছি, আমি তো আমার কোনো বই কখনো তাঁকে পাঠাইনি)।
কয়েক বছর আগে তিনি যখন অসুস্থ অবস্থায় মিরপুরের সিআরপি হাসপাতালে ভর্তি হয়ছিলেন, তখন বোধ হয় সোহরাব হাসানের মুখেই খবর পেয়ে আমি বারদুয়েক সেখানে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। এ ছাড়া বছরে একবার বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায় তাঁর সঙ্গে দেখা এবং স্বল্পক্ষণ কথাবার্তা হতো। এবার ডিসেম্বরেও দেখা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য। সেদিন দেখলাম তিনি অন্য একজনের সাহায্য নিয়ে হাঁটছেন। আমি যখন তাঁকে দেখলাম তখন তিনি একাডেমি গেটের কাছাকাছি, বেরিয়ে চলে যাচ্ছেন। 'মাশুক ভাই, মাশুক ভাই' বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরলাম। তিনি ফিরে তাকালেন, দাঁড়ালেন, তারপর আমার হাতটা ধরে সেই পরিচিত হাসিটা হাসলেন। দু-এক কথায় পারস্পরিক কুশল বিনিময় হলো। বললেন, তাঁকে প্রেস ক্লাবে চলে যেতে হচ্ছে, থাকতে পারছেন না। তখন আমি বা তিনি কেউ কি জানতাম, সেটাই হবে আমাদের এ জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার?