রেক্স, আবুল হাসান ও ক্লান্ত আলোয় ম্লান ছায়া

এই স্মৃতিকথায় আছে পুরোনো দিনের আলো–হাওয়া, আছে কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী আর অকালপ্রয়াত আবুল হাসানের অজানা গল্প।

১৯৭২ সালে কবি শহীদ কাদরী ও আবুল হাসানছবি: লেখক

নবাবপুর রেলগেট। আদি ঢাকা আর হালের ঢাকার অলিখিত বিভাজনরেখা। ফুলবাড়িয়া ঢাকার রেলস্টেশন, মিটার গেজ ট্রেনলাইন পুবে চলে গেছে নারায়ণগঞ্জ ঘাট স্টেশনের দিকে, আর পশ্চিমে কিছুটা গিয়ে ডানে বেঁকে উটের মতো উবু হাতির পুলের ঢাউস ব্রিজের নিচ দিয়ে তেজগাঁও হয়ে চট্টল, সিলেট বা ময়মনসিং। কমলাপুর তখনো হয়নি।

নবাবপুর থেকে এসে গেট ক্রস করতেই হাতের ডানে নবাববাড়ির বিশাল গেট, আজকের বঙ্গভবনের মূল প্রবেশদ্বার, এখন অপরিকল্পিত স্থাপনা, আগাছার জঙ্গল।

গেট এখন দূরে—পুবে। বাঁয়ে প্রেক্ষাগৃহ গুলিস্তান, সিঁড়ি দিয়ে উঠলে ছোট্ট কিউট স্থাপনা নাজ সিনেমা, মূলত হলিউডি ইংরেজি ছবির অপূর্ব প্রক্ষেপণ। একতলায় সুইট হ্যাভেন—আজব স্ন্যাকসের রেস্তোরাঁ, তৎকালীন সিনেমা পথিকৃৎদের আড্ডাস্থল, মনে হয় দোসানীর করা। দক্ষিণের দোতলায় সম্ভবত ঢাকার প্রথম চায়নিজ রেস্তোরাঁ চৌচিনচো, বিদেশি সোমরসও মিলত এখানে! উত্তরে এগোই। ডান দিকে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের কণ্ঠস্বর পল্টন ময়দান। ছিল ওয়ান্ডারারার্স, মোহামেডান, ওয়ারীর ক্লাবঘর। বাঁয়ে প্রথমেই সিঙ্গার, ভাম ফার্মেসি এবং তারপরই পৌঁছে যাব কাঙ্ক্ষিত কাবাব-পরোটা-মোগলাইয়ের সুগন্ধে ম–ম করা রেক্স–এ, এটা সন্ধ্যাবেলা কবি-উবিদের মিলনস্থল। আড্ডা শব্দটির প্রচলন ছিল না বললেই চলে। দীর্ঘাকৃতি শাহি বেশে হুকুমত শাহ, শের শাহর চুনার থেকে আসা, আদবের সঙ্গে বিনয় আর মমত্ব মিক্স করে রেক্সি কায়দায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই বলতাম, হুকুমত একটু পরে, সবাই আসুক।

জবাব তমিজের সঙ্গে, হুকুম জনাব। আমরা কখনো হুকুম করেছি বলে মনে করতে পারছি না। দক্ষিণের টেবিলে কলরবকারী ‘ছাগ’ কতিপয় আমরা, আর উত্তরের টেবিলে?

উত্তরে বিরাজ করতেন...ওরে বাপস! ‘লিজেন্ড’ শব্দটির অপব্যবহার তখন শুরু হয়নি, শুরু হয়নি ‘মুরুব্বি’ কিংবা কলকাতার ‘গুরু’ শব্দের ব্যবহার—এসব বিভাজন। সম্বোধন তখন ছিল, ভাই। সহজ, অকপট। সম্মান দেওয়াটা ছিল ভেতরের, বাইরের নয়। সন্ধ্যা গাঢ় হলেই আসতেন সবার বুড়োভাই। পুরান ঢাকার শায়েস্তা খানের আমলের নিঃসঙ্গ এক দালান থেকে আসতেন তিনি। একা, কিন্তু নিঃসঙ্গ মানুষ নয়, বই-পুস্তকের পাহাড় ছিল তাঁর চিরসঙ্গী, লেখালেখি করতেন না, তবে লেখকদের অনুঘটক ছিলেন, মন-মানসে প্রেরণা দিতেন নবপ্রজন্মকে! এমনকি বিশ্বচলচ্চিত্রে ভান্ডারের দরজাও আমাদের সামনে উন্মোচন করতেন সহজ–সরল বর্ণনে। তাঁদের টেবিলে তুমুল তর্ক লাগলে প্রয়োজনে থামাতেন। সবাই শুনতেনও তাঁর কথা—যেন তিনি ফুটবলের রেফারি, লাল কার্ড, হলুদ কার্ড সর্বদা প্রস্তুত।

আজকের জামানায় হলে বলতাম, ক্রিকেটের আম্পায়ার—হাউজ দ্যাট? আউট, নটআউট। একদিন রাহমান ভাই (শামসুর রাহমান) কাদরীকে (শহীদ কাদরী) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার “বন্দী শিবির থেকে” পড়া হয়েছে?’ কাদরী তাঁর স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে বললেন, ‘আমি তো টয়লেটে কবিতা পড়ি, কদিন যাওয়া হচ্ছে না।’ রাহমান ভাই গোস্যা না করে বললেন, ‘উঁ! আমার পানীয় রসদও শেষ। অনেক দিন ধরব না!’ নির্ভেজাল রস-বাক্যের ঠোকাঠুকি, অন্তরঙ্গ খেলায় ক্যারামের ঘুঁটি ঠকাস, ঠকাস! শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ...কত নাম, কোনটা কুড়াই বলো! কোন মুখটার কথা ভেবে দুদণ্ড কাঁদি বলো?

তবে করোনার কান্নার মধ্যে মেমোরি চিপস থেকে আজ আর কান্নার কথা নয়, বলা যাক মজার কথা—আমাদের দক্ষিণের টেবিল নিয়ে।

তখন মুক্তিযুদ্ধ শেষ। সদ্য প্রাপ্ত স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছি। পুব আর পশ্চিমের অবারিত দ্বার, গগন ললাট চুমে তব পদধূলি। ১৯৭১–এর ডিসেম্বরের ১৬–তে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার পানি আর জলের অনেকে যুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেয়েছিল—অবলীলায়। আমরা তাঁদের খেতাব দিয়েছিলাম সিক্সটিনথ ডিভিশন! সদ্য কলকাতা থেকে ফেরা তরুণ নব্য কবি, আমাদের সংস্কৃতির বলয়ের সদা হাস্যময় ফুরফুরে বিপ্লব দাশ সঙ্গে করে নিয়ে এল কলকাতা থেকে আগত ‘রণাঙ্গনফেরত’ কথিত কতিপয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’কে। ওরা প্রগতিশীল, তাই মাংসে আপত্তি নেই। বড়টাতেও।

আমরা এপ্রিল, একাত্তরে পার করে দিয়েছিলাম ওপার বাংলায়, মাসিমা আর বিপ্লবের প্রবল আপত্তির মুখেও পরিবারের সবাইকে। একজন আজকের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী, প্রশিক্ষক দীপা। আমাদের ঢাকা থিয়েটারেরও বটে। আগত বন্ধুদের কথা ছুটছে, নিরীহ, নিরাপদ তুবড়ির মতো বললে ভুল হবে, ছুটছে মেশিনগানের মতো। কত গান—স্টেনগান, মেশিনগান, ব্রেনগান, আর্টিলারি গান, অ্যান্টিএয়ারক্র্যাফট গান, দম না নিয়ে একনিশ্বাসে বয়ান, যেন ৭৮ আরপিএম ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েসের’ কাটা রেকর্ড। নন-স্টপ। যুদ্ধে সহায়ক বন্ধু ওরা, ওদের উৎসাহেকে বাধা দেয়।

হাসান তার খেরো কাগজে লিখল, ঘোড়ার মাথা! আমাকে দেখাল। হাসানের কোনো কিছু অপছন্দ হলে অস্ফুট করে বলত, ঘোড়ার মাথা। হাসান একসময় আমাদের ‘কাক’ সংকলনের জন্য লন্ডন থেকে তড়িঘড়ি করে পাঠানো সৈয়দ শামসুল হক ভাইয়ের কবিতা পড়ে এটি তার পছন্দ হয়নি তা বলেছিল। এরপর ঢাকায় আসতেই হক ভাইকে বলে বসল, ‘কী ঘোড়ার মাথা কবিতা দিছেন?’ মনে পড়ে, হক ভাই স্নেহের আধিক্যে হাসানকে বলে উঠেছিলেন, ‘থাম থাম, হাসান, দিচ্ছি দিচ্ছি...ওটা তোর দাপটে তড়িঘড়ি লেখা।’

কিন্তু ঠোঁটকাটা কবি, আমাদের ঘড়ির কাঁটার ২৪ ঘণ্টার বন্ধু আবুল হাসানের মুচকি হাসির মুখ থেকে ত্বরিত ফসকে এল, ‘আর বাংকার?’ এতক্ষণ সে টেবিলে ছেঁড়া কাগজে আনমনে আঁকিবুঁকি করছিল, তার এই আঁকিবুঁকি থেকে অনেক কালজয়ী কবিতা উদ্ধার করেছি আমরা—প্রায়শই! তার চোখ চিলের আর কান খরগোশের। কলমে বাংলার বহতা নদী। হৃদয়ে মধুমতি। র‍্যাডক্লিফ বাঁদরের উন্মত্ত ১৯৪৭-এ বন্ধ করা সীমান্ত পাড়ি দেওয়া উন্মুক্ত অদৃশ্য দেয়াল টপকে আসা বন্ধুরা মুহূর্তেই হাসানের প্রশ্নটি লুফে নিল, উইকেটের পেছনের দক্ষ কিপারের ক্যাচ ধরার মতো। উল্লাসে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, প্রথমে পাইনি, কিন্তু শেষ দিকে পেয়েছি বলে মনে ছিল না।

যখন পেয়েছি তখন বাংকার ছুড়েও মেরেছি পাকিস্তানি হানাদারদের দিকে। গ্রেনেড থেকেও শক্তিশালী, বাংকার, বুঝেছেন দাদা!’ হাসান ঈশানের বিদ্যুতের মতো একঝলক হাসি দিয়ে বলল, ‘বুঝছি!’ একগাল হেসে আবার বলল, ‘আর দাদা, রেকি? রেকি ছুড়ে মারেননি?’ (রিকোনাইসেন্স থেকে রেকি, গেরিলাযুদ্ধে বহুল উচ্চারিত সংক্ষিপ্ত শব্দ)
এবার একটু থমকে গেলেন দাদা, কিন্তু চটজলদি সপ্রতিভ জবাব এল, ‘না, রেকি যখন হাতে পেলাম, যুদ্ধ শেষ। খানসেনারা আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে।’ বলেই কাবাব-পরোটার রোলে একটি তৃপ্তির মরণকামড় দিলেন।

উত্তরের উৎকর্ণ টেবিল থেকে হাসি উপচে কিছুটা আমাদের কানেও এল বটে। হাসান তার খেরো কাগজে লিখল, ঘোড়ার মাথা! আমাকে দেখাল। হাসানের কোনো কিছু অপছন্দ হলে অস্ফুট করে বলত, ঘোড়ার মাথা। হাসান একসময় আমাদের ‘কাক’ সংকলনের জন্য লন্ডন থেকে তড়িঘড়ি করে পাঠানো সৈয়দ শামসুল হক ভাইয়ের কবিতা পড়ে এটি তার পছন্দ হয়নি তা বলেছিল। এরপর ঢাকায় আসতেই হক ভাইকে বলে বসল, ‘কী ঘোড়ার মাথা কবিতা দিছেন?’ মনে পড়ে, হক ভাই স্নেহের আধিক্যে হাসানকে বলে উঠেছিলেন, ‘থাম থাম, হাসান, দিচ্ছি দিচ্ছি...ওটা তোর দাপটে তড়িঘড়ি লেখা।’ তারপর দিলেন আরেকটি কবিতা, যার শেষ দুটি ছত্র: ‘কপালে তৃতীয় চোখ, হাতে রক্তহেনা, বুঝি এই বাংলাদেশ মরেও মরে না।’ কালজয়ী এই লেখাটি।

তবে এত কিছু থাকতে ঘোড়ার মাথা কেন? ঘোড়াড্ডিম শুনেছি। রেক্সে একদিন বৃষ্টিমুখর নির্জন সন্ধ্যায় হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার উত্তর ছিল সহজ, আর যুক্তিও সরল, ‘হা হা বুঝলেন না! ঘোড়া চিরকাল গাধার চেয়েও অধম, মাথাটা শূন্য।

শতসহস্র বছর যুদ্ধে রক্ত দিয়েও, সাম্রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেও গাধা বনে রইল, যুদ্ধ শেষে বৃদ্ধ হলে নির্মম মৃত্যুদণ্ড।’ এই কথাটি বুঝি না আজও। কবিদের সব কথা অবশ্য বুঝতেও নেই—এটা রেক্সের শিক্ষা।

তো প্রবল উৎসাহে বিপ্লব আরেক দফা ফ্রায়েড কাবাব-পরোটা অর্ডার করে বসল, ‘হুকুমত, কুছপরোটা নেহি, কাবাব-পরোটা আওর এক দফা।’ মাথা নুইয়ে শেরশাহ বংশের হুকুমত কিচেনের দিকে ধাবিত হলো। আসর জমেছে বইকি!

মন্দ কী? যুদ্ধক্লান্ত মুক্তাঙ্গনে একটু হাসি, একটু মজা!
এই সব স্মৃতি বুকে করেই কেটে গেছে পাঁচটি দশক। তবু বুক থেকে রেক্সের ক্লান্ত আলোর ম্লান ছায়া মেলায় না।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]