লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-১৩: হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিশাল ভুল-বোঝাবুঝি

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

ছবি: অন্য আলো

আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল। সে এক বিশাল গন্ডগোল। এটা ২০০৪ সালের দিকের ঘটনা।
তখন বইমেলা চলছে। একদিন খুব সকালে আমার বাসার ফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। তিনি বললেন, আনিসুল হক, আপনার সঙ্গে হুমায়ূন ভাইয়ের কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো! আমি বললাম।
জাফর ইকবালের সাথে কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো!
না। হয়েছে। হুমায়ূন ভাই ভীষণ রেগে গেছেন। কালকে রাতে তাঁর বাসায় একটা পার্টি ছিল। অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁকে একজন বললেন, আমি আজকে বইমেলায় সময় প্রকাশনীর স্টলে গেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই কোথায় পাওয়া যায়! আনিসুল হক বলল, জাফর ইকবালের বই কোথায় পাওয়া যায়, আমি জানি না। ফরিদ আহমেদ বললেন, আরে ভাই, নিজে খুঁজে নেন না! জাফর ইকবালের বই কোথায় পাওয়া যায়, আমরা কেমন করে জানব! এই কথা শুনে হুমায়ূন ভাই খুব রেগে গেছেন। বলেছেন, আমার না হয় নানা দোষ। কিন্তু আমার ভাই জাফর ইকবাল খুবই সিরিয়াস লোক। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আপসহীন। তাঁকে কেন অপমান করবে? এখনই ফোন করো ফরিদকে (সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী)। আমি দেখব, সে কী করে বইমেলায় বইয়ের স্টল চালায়। আর আনিসুল হক ছেলেটা খুব বেড়ে গেছে, তার বাড় কমাতে হবে। এখনই ফোন করো ফরিদকে। আসতে বলো। এখনই। ...জুয়েল আইচ বলে চলেছেন, সবাই স্তব্ধ। হুমায়ূন ভাইকে থামানো যাচ্ছে না। তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন। দু-একজন তাঁকে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।

আমি বললাম, ঢাকা শহরে যদি কোনো একজন লেখককে আমি খুবই শ্রদ্ধা করে থাকি, তাঁর নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। স্যারের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমি তাঁকে বই উৎসর্গ করেছি। তিনি সব সময় আমার খোঁজখবর নেন। আমিও তাঁর খোঁজখবর রাখি। তাঁর বই কোথায় পাওয়া যায়, এই প্রশ্নের জবাবে আমি কেন বলব যে আমি জানি না। সময় প্রকাশনেই তো জাফর স্যারের বই পাওয়া যায়। শুধু জাফর ইকবাল স্যার কেন, যেকোনো পাঠক এসে যদি যেকোনো লেখকের বইয়ের খোঁজ করেন, আমি খুশি হই, এমনও হয়েছে, আমি নিজে সেই পাঠকের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে অন্য স্টলে দেখিয়ে দিয়ে এসেছি এই দোকানে হয়তো নাসরীন জাহানের বই পাওয়া যায়, বা মশিউল আলমের বই পাওয়া যায়। আমি কোনো দিনও কোনো বইয়ের ব্যাপারে কোনো পাঠককে অসহযোগিতা করি না। এটা আমার স্বভাবের মধ্যেই নাই। আর ফরিদ আহমেদ জাফর ইকবাল স্যারের প্রকাশক। তাঁর বই প্রকাশ করে তাঁর বছরের প্রধান আয়টা হয়। তিনি কখনোই জাফর ইকবাল স্যারকে অসম্মান করে কথা বলবেন না।
জুয়েল আইচ বললেন, তা আমরাও জানি। কিন্তু ওই লোকটা এমনভাবে হুমায়ূন ভাইকে বলল যে হুমায়ূন ভাই বিশ্বাস করেছেন...
আমি খুবই দুর্ভাবনায় পড়লাম।
একটু পরে আরেকটা ফোন। তিনিও রাতের বেলা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বাসার পার্টিতে ছিলেন। ভাই, আপনি জাফর ইকবালকে নিয়ে কী বলেছেন...হুমায়ূন আহমেদ তো আপনাকে দেখে নেবেন...

বিপদ তো! আমি ফরিদ আহমেদকে ফোন করলাম। এর মধ্যে ফরিদ ভাইকেও অনেকে খবরটা জানিয়েছেন। তিনি মহাবিপদগ্রস্ত। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একজন নিয়মিত লেখক। আসলে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল স্যারের বই-ই সময় প্রকাশনীর সুনাম আর আয়ের প্রধান উৎস। ফরিদ আহমেদ বললেন, আমি ইকবাল ভাইকে ফোন করেছিলাম। ইকবাল ভাই বলেছেন, একটা বিষয় নিশ্চিত করুন, আনিসুল হক যেন ব্যাপারটা না জানে। এখন তো দেখছি আপনি জেনে গেছেন।
আমি তখন জাফর ইকবাল স্যারকে ফোন করলাম। স্যার, ঘটনা শুনেছেন!
স্যার বললেন, হ্যাঁ। আমি বলেছি, আনিসুল হক যেন ঘটনা না জানে। কী মুশকিল! আমাকে নিয়ে হুমায়ূনকে কে ভাবতে বলেছে! তারপর বললেন, আনিসুল হক সাহেব, আমি আমার পরিবারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের এই ভাইটি আমাদের নানা বিড়ম্বনায় ফেলছে। আপনি কাইন্ডলি কিছু মনে করবেন না।
আমি বললাম, স্যার, আমি মনে করব না, তা ঠিক। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরপর ফোন আসছে। ঢাকা শহরের অর্ধেক লোক বোধ হয় জেনে গেছে যে আমি জাফর স্যারকে অসম্মান করে কথা বলেছি। তা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্যার ক্ষুব্ধ।
জাফর স্যার বললেন, কী করা যায়।

বিপদ তো! আমি ফরিদ আহমেদকে ফোন করলাম। এর মধ্যে ফরিদ ভাইকেও অনেকে খবরটা জানিয়েছেন। তিনি মহাবিপদগ্রস্ত। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একজন নিয়মিত লেখক। আসলে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল স্যারের বই-ই সময় প্রকাশনীর সুনাম আর আয়ের প্রধান উৎস। ফরিদ আহমেদ বললেন, আমি ইকবাল ভাইকে ফোন করেছিলাম। ইকবাল ভাই বলেছেন, একটা বিষয় নিশ্চিত করুন, আনিসুল হক যেন ব্যাপারটা না জানে। এখন তো দেখছি আপনি জেনে গেছেন।

আমি বললাম, স্যার, একটা কাজ করি। সময় প্রকাশন আপনার বই আর আমার বই অনলাইনে ফ্রি প্রকাশ করেছে। আমার ‘মা’ বইয়ের অনলাইন প্রকাশনার অনুষ্ঠান করি। আপনি তাতে আসেন। ক্লিক করে সেটার উদ্বোধন করেন। কাগজে ছবি প্রকাশ করি।
জাফর স্যার রাজি হলেন। আমরা পরের দিন ধানমন্ডির ব্লুপ্ল্যানেট সাইবার ক্যাফেতে ‘মা’ বইয়ের অনলাইন প্রকাশনার উৎসব করলাম। বইটি উন্মোচন করলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। সঙ্গে থাকলেন ইয়াসমিন হক ভাবি। পরের দিন ‘প্রথম আলো’ বড় করে আমার আর স্যারের হাস্যোজ্জ্বল ছবি প্রকাশ করল।

শুধু তা-ই নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার তাঁর একটা নতুন বই উৎসর্গ করলেন আমার নামে।

হুমায়ূন আহমেদ স্যার সেই উৎসর্গপত্র দেখে বললেন, এহ, দেখছ, কাকে উৎসর্গ করছে!

আমার নামে যে ভদ্রলোক হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে এই সম্পূর্ণ মিথ্যা কথাটা লাগিয়েছিলেন বলে আমি শুনেছি, তিনি একজন চিকিৎসক ও লেখক। যেহেতু আমি নিজ কানে শুনিনি, তাঁর ওপরেও আমার কোনো রাগ নেই। তিনি তো এটা না-ও বলে থাকতে পারেন। আর আনিস নামে সময় প্রকাশনীতে একজন বিক্রেতা কর্মচারী আছে, সে-ও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে থাকতে পারে। কান নিয়েছে চিলের মতো ঘটনা তো ঘটতেই পারে। সেই লেখক-চিকিৎসকের সঙ্গে এখনো আমার দেখা হয়। হলে আমি হাসিমুখে সৌজন্য বিনিময় করি।

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: অন্য আলো

আমার সঙ্গে হুমায়ূন স্যারের রাগটা ছিল একমুখী। আমার শুধু মনে হতো ডন কুইক্সোটের কথা। ডন কুইক্সোট নিজেকে নাইট ভাবত। নাইট হলে লড়াই করতে হয়। সে উইন্ডমিল দেখে সেটাকে শত্রু ভেবে বাতাসে তরবারি ঘোরাত। হুমায়ূন স্যার আমার মতো একটা নখদন্তহীন মানুষকে শত্রু ভেবে তরবারি ঘোরাচ্ছেন।

বছর এক বা দুই কেটে গেল। একদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন কাকলী প্রকাশনের সেলিম ভাই। দুই প্যাকেট মিষ্টি আর দুটো বই নিয়ে। কী ব্যাপার? হুমায়ূন ভাই আপনাকে বই উৎসর্গ করেছেন। তিনি নিজে বলেছেন, আনিসের বাড়িতে বই আর মিষ্টি পৌঁছে দাও।
আমি বইটার উৎসর্গপত্র দেখলাম। আনিসুল হক, শক্তিমান গদ্যকার সুকনিষ্ঠেষু।
কনিষ্ঠ মানে ছোট ভাই। স্যার আমাকে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। আমি খুশি হলাম।

একটা অটোগ্রাফও দিয়েছেন। তাতে লেখা: আনিসুল হক, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। হুমায়ূন আহমেদ।
আমি প্রিমিয়ামের মিষ্টির দোকানে গিয়ে দুই বক্স মালাইচপ কিনলাম। স্যারকে ফোন করলাম। স্যার, আপনার বাসায় একটু আসি!

কেন?
স্যার, একটা অটোগ্রাফ লাগবে।
না না। অটোগ্রাফ তো দিয়েছি।

না স্যার। ওই বই নয়। আমার এক বন্ধু নিউইয়র্কে থাকে। আপনার ভক্ত। তার জন্য আপনার বই কিনে রেখেছি। সেটাতে অটোগ্রাফ নেব।
আচ্ছা আসো।

আমি স্যারের লেখা দুটো বই আর দুই প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে তাঁর ‘দখিন হাওয়া’ বাড়িতে হাজির হলাম।

স্যার বললেন, শোনো, তোমার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। গদ্যকার্টুন বেশ ভালো হয়। এত কৌতুক কই পাও। আরও বললেন, ‘ব্যাচেলর’ খুব ভালো হয়েছে।
আমি বললাম, স্যার, ওটা সরয়ার ফারুকীর কৃতিত্ব?
তা হোক। স্ক্রিনপ্লে তুমি লিখে দিয়েছ তো?
জি, দিয়েছি। কিন্তু গল্পটা ওর নিজের জীবন থেকে নেওয়া।

তবুও তোমার ক্রেডিট আছে। আর শোনো। আমি ‘ফাঁদ’ পড়েছি। বেশ ভালো।
তারপর এলেন আসল কথায়। শোনো, তোমার সম্পর্কে আমাকে একজন মিথ্যা কথা বলেছিল। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, কথাটা মিথ্যা।
আমি বললাম, বাদ দেন স্যার। ওটা আমি মনে রাখিনি।