শঙ্খ ঘোষের জন্য শোক ও ভালোবাসা

প্রয়াত হয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এ লেখা।

বাংলা ভাষার কবি শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত হলেন। কলকাতার হাসপাতাল সূত্রে খবরে প্রকাশ, তাঁর শরীর করোনাভাইরাসের আক্রমণে পরাজিত হয়েছে। ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণকারী শঙ্খ ঘোষ মারা গেলেন ২০২১ সালে, ৮৯ বছর বয়সে। তারপর ভারতীয় গণমাধ্যম ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম কবির মৃত্যুসংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন বয়সের ছবি, বিভিন্ন কবিতা ও কবিতাংশের উদ্ধৃতিসহ সোশ্যাল মিডিয়া শোকার্ত। বিশেষ করে ফেসবুকে ভেসে আছেন শঙ্খ ঘোষ। আমরা বুঝতে পারি, বাংলা ভাষার একজন বড় কবির প্রয়াণ হলো। নক্ষত্র পতন।

বাংলাদেশের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের একটা অনস্বীকার্য সম্পর্ক আছে। তাঁর জন্ম চাঁদপুরে। বাল্যকাল কেটেছে বরিশালের বানারীপাড়ায় এবং পাবনার পাকশীতে। অতঃপর দেশভাগ, কলকাতায় চলে যাওয়া এবং সেই শহরেই তাঁর বিস্তৃতি, কবি হয়ে ওঠা। যদিও সেদিনের পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের জন্মলগ্ন আবহাওয়া লেগে আছে তাঁর লেখায়, তাঁর না-লেখায়, জীবনযাপনে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে কবিতায় শঙ্খ ঘোষের আগমন। সেই হিসাবে কাব্য বা লেখালেখিতে তিনি সময় দিয়েছেন প্রায় সাত দশক। ঢের সময়। অনেকে এত বছর নিজের আয়ুই পান না। শঙ্খ ঘোষ এমন একজন কবি, যাঁর মধ্যে তারুণ্যের ‘অ্যাক্টিভিটি’ ভরপুর। নগরবাসী আধুনিক কবিদের অনেকেই আজ আর জনগণের জীবনের দাবিদাওয়া, বেঁচে থাকাকেন্দ্রিক লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত থাকেন না বা থাকতে চান না, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ ছিলেন, এ লড়াইয়ে তিনি ছিলেন। কবিতার নির্মিতিতে তিনি আঁটসাঁট ও দারুণ, উচ্চ রসবোধসম্পন্ন; তবে এই কবি কেবল তা নিয়েই আত্মঘোরে থেকে সময়টা কাটিয়ে যাননি, বরং তাঁর অনেক কবিতাই মানুষের আকাঙ্ক্ষার স্লোগান হয়ে উঠেছে। প্রাণের শক্তি জুগিয়েছে। নানা রকম নিরীক্ষা করেছেন তিনি কবিতায়। সেই নিরীক্ষা সাফল্যে নিহিত হয়েছে

১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মধ্যে আবার আরও কিছু ভাগাভাগির শিকার হলো, যেমন পাঞ্জাব ভেঙে হলো দুই টুকরা। এক টুকরা থাকল পাকিস্তানে, আরেক টুকরা ভারতে। পাঞ্জাবি ভাষা দুই অংশের পাঞ্জাবিদের জন্যই রয়ে গেছে। দেশভাগের ভেতর দিয়ে বাংলাও ভাগ হয়ে গেল। দুই বাংলাতেই মাতৃভাষা বাংলা। রাজনীতির বাটখারায় কত কী হয়! দেশভাগকেন্দ্রিক যত মানুষ এপার-ওপার হলো, শঙ্খ ঘোষের পরিবার তাদের একটি। বাংলাদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁদের চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া। কলকাতায় জীবন যাপন করলেও জীবনের একটা বড় স্মৃতি তাঁদের বাংলাদেশ। যেমন ঋত্বিক ঘটক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, অরুণ মিত্র, মৃণাল সেন বা আরও অনেক বিখ্যাতজন আছেন। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারও কিশোরগঞ্জ থেকে চলে যাওয়া। এ তো গেল বিখ্যাতদের কথা, লাখ লাখ সাধারণ মানুষ এই দেশভাগের শিকার। যে প্রজন্ম দেশভাগ নিজ চোখে দেখেছে, নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়া স্মৃতি বহন করছে, কবি শঙ্খ ঘোষ তাদের একজন এবং এ কথাও আজ বলার সময় এসেছে, দেশভাগ দেখা প্রজন্ম প্রায় প্রয়াণের পথে। এতে কলকাতায় বসবাসকারী একদা যারা বাংলাদেশের মানুষ, তাদের সংখ্যা শেষ হয়ে আসছে। সেই হিসেবে শঙ্খ ঘোষ আমাদেরই লোক, আমাদেরই সিনিয়র সিটিজেন, ছিলেন, সদ্য লোকান্তরিত হলেন। আমরা আমাদের একজন সুহৃদ হারিয়ে ফেললাম। হারানোর পর শোকার্ত হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা?

একটি অনুষ্ঠানে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে টোকন ঠাকুর।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে কবিতায় শঙ্খ ঘোষের আগমন। সেই হিসাবে কাব্য বা লেখালেখিতে তিনি সময় দিয়েছেন প্রায় সাত দশক। ঢের সময়। অনেকে এত বছর নিজের আয়ুই পান না। শঙ্খ ঘোষ এমন একজন কবি, যাঁর মধ্যে তারুণ্যের ‘অ্যাক্টিভিটি’ ভরপুর। নগরবাসী আধুনিক কবিদের অনেকেই আজ আর জনগণের জীবনের দাবিদাওয়া, বেঁচে থাকাকেন্দ্রিক লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত থাকেন না বা থাকতে চান না, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ ছিলেন, এ লড়াইয়ে তিনি ছিলেন। কবিতার নির্মিতিতে তিনি আঁটসাঁট ও দারুণ, উচ্চ রসবোধসম্পন্ন; তবে এই কবি কেবল তা নিয়েই আত্মঘোরে থেকে সময়টা কাটিয়ে যাননি, বরং তাঁর অনেক কবিতাই মানুষের আকাঙ্ক্ষার স্লোগান হয়ে উঠেছে। প্রাণের শক্তি জুগিয়েছে। নানা রকম নিরীক্ষা করেছেন তিনি কবিতায়। সেই নিরীক্ষা সাফল্যে নিহিত হয়েছে।

সাধারণত তরুণ কবিদের ভাব-ভাষাভঙ্গি নতুন দিনের রোদে ঝলমল করতে থাকে, সে কারণেই তরুণেরা বয়সে জ্যেষ্ঠ কবিদের প্রতি একটা পর্যায়ে আসক্তি হারায়। শঙ্খ ঘোষের বেলায় তা হয়নি। তার মানে কী?

শঙ্খ ঘোষের কবিতার গুণগত ব্যবচ্ছেদ করার জন্য একটা নির্বিঘ্ন পরিসর ও সময়ের দরকার হয়। আশা করি, কোনো দিন সেই সময় ও পরিসর পাব। এখন এই সদ্য বিদায়ী কবিসভায় এ কথাই বলতে পারি, গদ্যে-পদ্যে মিলিয়ে শঙ্খ ঘোষ যে অসামান্য রচনা রেখে গেলেন আমাদের জন্য, তাঁর সমকক্ষ এ মুহূর্তে আর কার নামই-বা বলতে পারি বাংলা ভাষায়?

করোনা মহামারিতে যাঁরা জীবিতদের রেখে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য শোক জানাই। ভালোবাসা জানাই। কবি শঙ্খ ঘোষের জন্যও আমাদের শোক ও ভালোবাসা থেকে যাবে চিরদিন।