সেলিম ভাইয়ের মুখ

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ভাস্কর ও প্রচ্ছদশিল্পী সেলিম আহমেদ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

সেলিম আহমেদের ছবি অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

তখন সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া বা কাজী আবদুল বাসেত স্যার ক্লাস নিচ্ছেন বা ক্লাস নিচ্ছেন কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক কিংবা হামিদুজ্জামান খান, সে হয়তো গত শতাব্দীর মধ্য আশির দশকের দিন। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বা সেদিনের সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে সদ্য চারুকলা ইনস্টিটিউটে উন্নীত মোহময় সেই ভুবনে ছাত্র হয়ে এসেছিলেন সেলিম আহমেদ। ভাস্কর্য বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও তখনকার চারুকলায় একটা প্রাক-স্নাতক সার্টিফিকেট সেশন ছিল। সেই সেশনে ড্রয়িং, স্কেচ, জলরং, ল্যান্ডস্কেপ, বাটিক-বুটিক, কারুশিল্প, সিরামিক বা প্রায় সাতটি আলাদা মাধ্যমেই তিন বা চার বছর সময় ব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নিতে হতো। এতে করে সব বিভাগের ছাত্রছাত্রী প্রায় সব মাধ্যমেই কাজ শেখার প্রশিক্ষণ পেত। আজকের বিখ্যাত গ্রন্থ-প্রচ্ছদ শিল্পী সেলিম আহমেদ বা টেলিভিশন নাটকের অভিনেতা সেলিম আহমেদ, কিছুটা চুপচাপ গোছের মানুষ, যিনি সদ্য প্রয়াত হলেন, তাঁকে নিয়ে আমি এ কারণেই লিখছি কি—আমরা উভয়েই চারুকলায় পড়তাম বলে? সেলিম আহমেদের সঙ্গে আমার খুব একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু অন্য অনেকের সঙ্গেই তাঁর কী নিবিড় সম্পর্ক ছিল, আমি লক্ষ করেছি। তিনি জানতেন, আমি চারুকলায় পড়ালেখা করেছি। আমি জানতাম তাঁর কথা। চারুকলায় বা শাহনেওয়াজ ভবনে সেলিম ভাইদের ব্যাচের আরও কারও কারও সঙ্গে আমার খাতির হয়ে উঠলেও তাঁর সঙ্গে কেন যেন হয়নি।

তবে আমাদের কিছু ‘কমন’ যাতায়াত ছিল। যেমন সেলিম ভাই বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন এবং মূলত তিনি পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত দুটো বইয়ের প্রচ্ছদও করেছিলেন। কী সুন্দর সেই সব কাজ! স্বতন্ত্র। ধ্রুব এষ, মাসুক হেলাল বা সব্যসাচী হাজরার কাজের সঙ্গে কেউ মেলাতেই পারবে না। এটি ভালো লাগত।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট  আবছায়া’ বইয়ের প্রচ্ছদ

সেলিম ভাই কী কারণে যেন আমাকে একটা অতিরিক্ত সমীহ করে তাকাতেন বা তিনি মানুষটাই ছিলেন এই রকম। কত রকম মানুষ সংসারে!

গত বছর আমার দুটি কবিতার বই বের হয়। একটি প্রথমা প্রকাশন থেকে ‘বুদ্‌বুদ পর্যায়ের কবিতা’, অন্যটি পাঠক সমাবেশ থেকে ‘কাপ্তেন, গভীর সমুদ্রে চলো’ নামে। এই বই করার সূত্রেই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ।

বইমেলা তখন শুরু হয়ে গেছে। একদিন ফোনে পাঠক সমাবেশ থেকে ডাকলেন প্রকাশক বন্ধু সাহিদুল ইসলাম বিজু। বললেন, ‘কামাল চৌধুরীর কবিতার বই বেরোচ্ছে, মাসরুর আরেফিনের বই বেরোচ্ছে, আপনার কিছু কবিতা দিন, একটা বই হয়ে যাক।’ সেই বই-ই ‘কাপ্তেন, গভীর সমুদ্রে চলো’। আমি সেলিম ভাইকে ফোন করে বললাম, ‘আপনিই তো প্রচ্ছদ করবেন, যা করবেন, তা নিয়ে আমার কোনো মতামত নেই, শুধু একটু তাড়াতাড়ি হলে ভালো, বইমেলার আজ ১২ তারিখ।’

পরদিন বা তার পরদিন ঠিক মনে নেই, সাহিদুল ইসলাম বিজু জানালেন, প্রচ্ছদ এসে গেছে।

সেলিম ভাই বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন এবং মূলত তিনি পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত দুটো বইয়ের প্রচ্ছদও করেছিলেন। কী সুন্দর সেই সব কাজ! স্বতন্ত্র। ধ্রুব এষ, মাসুক হেলাল বা সব্যসাচী হাজরার কাজের সঙ্গে কেউ মেলাতেই পারবে না। এটি ভালো লাগত।

দেখি, কী সুন্দর একটি কাজ! একটি প্রাচীন বাণিজ্য জাহাজ ভাসছে প্রচ্ছদজুড়ে। তবে জাহাজের তলদেশের রং সুবর্ণ। জানলাম, একজন নারীর মুখ বা কপোলের ইমেজ থেকেই তিনি সুবর্ণ রঙের পাত বানিয়ে তার ওপরে প্রাচীন জাহাজ ভাসিয়ে দিয়েছেন। মুগ্ধ হলাম। এর পরই শিল্পী ও ভাস্কর সেলিম আহমেদের সঙ্গে আমার সরাসরি আলাপ। আর কি তেমন কথা হয়েছে, মনে পড়ে না।

হ্যাঁ, আজিজ মার্কেটের পাঠক সমাবেশে হয়তো আমি প্রবেশ করছি, সেলিম ভাই বেরিয়ে যাচ্ছেন—এমন হয়েছে বেশ কয়েকবার। তখন চোখে চোখে একটা সৌজন্য বিনিময় হয়েই যেত। এভাবেও অনেক বছর চলেছে আমাদের পারস্পরিকতা। দেখতাম, মগবাজারে, যেখানে টেলিভিশন নাটকের অভিনেতারা সন্ধ্যার পর জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন, দেখতাম তাঁকে। তাঁকে দেখতাম শাহবাগ প্রান্তরের এদিকে-সেদিকে। একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রোডাকশনে ক্যারেক্টার দিয়েন।’

চারুকলায় আমি সেলিম ভাইয়ের জুনিয়র। তাই তিনি আমাকে ‘দিয়েন’ বলায় আমার মধ্যেই জড়তা তৈরি হয়েছে।

সুন্দর সুন্দর অর্থবহ প্রচ্ছদ করতেন সেলিম আহমেদ, খুব ভালোবাসতেন ক্যামেরার সামনে অভিনয়। কেমন মায়ায় ভরা চোখে তিনি তাকাতেন, মুখে হাসি লেগে থাকত।

এই হচ্ছেন সেলিম আহমেদ, যিনি হুট করেই চলে গেলেন প্রিয়জনদের ব্যথাহত করে, অশ্রু ঝরিয়ে। হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, তবে এত সহসা চলে যাবেন, ভাবিনি। করোনাকালে আরও কত বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কে জানে!

সেলিম ভাইকে নিয়ে বিশদ কিছু লেখার শক্তি বা জানাশোনা নেই। আমি শুধু দেখেছি তাঁকে, দূর থেকে। দেখলাম, একজন মানুষ কেমন একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকেন, একজন মানুষ থাকতে থাকতেও হঠাৎ কেমন নাই হয়ে যান! একজন মানুষ চলে যান শহর ছাড়িয়ে উপশহরের কোনো গলির দিকে, গলির শেষে কি নির্জনতা! নাকি এখন আর কোথাও নির্জনতা বলে কিছু নেই! চারদিকে অজস্র মানুষ। তবু মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, বড্ড অসময়েই যাচ্ছে। মানুষ হারিয়ে কোথায় যাচ্ছে? মানুষের মুখ হারিয়ে যাচ্ছে। সেই মুখে কত মায়া, কত ভালোবাসা!

প্রিয় সেলিম ভাই, আপনাকে ভালোবাসি, ভালোবাসে কত মানুষ! তারা কষ্ট পাচ্ছে আপনার প্রস্থানে...।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]