১৫ মিনিটের খ্যাতি!

সোশ্যাল মিডিয়া, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব কি আসলেই দিনের পর দিন ‘পারফর্মিং কালচার’কে প্রোমোট করে যাচ্ছে? সবাইকে পারফরমার বানানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

সৃজনশীল লোকজন, বিশেষ করে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পান অন্য সবার চেয়ে একটু বেশিই। কল্পবিজ্ঞান লেখকদের দিকে তাকালে এ নিয়ে সন্দেহ করার অবশ্য অবকাশ থাকে না। অত্যন্ত সফলভাবেই তাঁরা অনেক কিছুর পূর্বাভাস করে গেছেন নিজেদের লেখায়, পরবর্তী সময়ে যেগুলো সত্যি সত্যি আবিষ্কৃত হয়েছে। স্পেস ট্রাভেল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট, রোবট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সেলফোন, ভিডিও কল—এ রকম অনেক কিছুর নামই বলা যায়। কেবল ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কেই তাঁদের কেউ সামান্যতম ধারণা দিতে পারেননি। এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। অসংখ্য আইডিয়ার কথা বললেও এমন জিনিস যে ‘পয়দা’ হতে পারে, সেটা কারও কল্পনায়ই আসেনি।


তবে একেবারেই যে কেউ এমন কিছুর আভাস দিতে পারেনি, তা নয়; অল্প কিছু মানুষ দিব্যদৃষ্টিতে এ রকম কিছু দেখেছিলেন ঠিকই। ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার কথা হয়তো তাঁরা বলেননি, কিন্তু এসবের অভিঘাত কী হতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়ে গেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তাঁদের মধ্যে প্রথম যিনি এটা বলেছেন, তিনি কল্পকাহিনির লেখক ছিলেন না, ছিলেন পপআর্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। নিজের সময়ে সবচেয়ে আলোচিত মার্কিন চিত্রশিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহোল সেই ষাটের দশকে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে সব মানুষই ১৫ মিনিটের জন্য বিখ্যাত হবে।’

অ্যান্ডি ওয়ারহোল

অ্যান্ডির এমন মন্তব্যকে তখন হেঁয়ালি হিসেবেই নিয়েছিল বেশির ভাগ মানুষ। কেউ কেউ হয়তো মাথা ঘামিয়ে বোঝার চেষ্টাও করেছিল, এ কথার মানে কী। ১৫ মিনিটের জন্য বিখ্যাত হওয়া—এটা কী করে সম্ভব! তা-ও আবার যেকোনো মানুষের পক্ষে! যা কিছু করে বিখ্যাত হওয়া যায় নাকি?


অ্যান্ডি ওয়ারহোল অবশ্য নিজের এমন মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার ধার ধারেননি কখনো। তাত্ত্বিক আলোচনায় তাঁর অনীহা ছিল। বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে বরং রকস্টারদের সঙ্গেই সখ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি। জীবনযাপনও করে গেছেন সেলিব্রেটিদের মতো। কিন্তু ইতালিয়ান পণ্ডিত ও লেখক উমবের্তো একো তাঁর ‘মিডিয়া পপুলরিটি’ তত্ত্বে অনেকটা একই সুরে বলেছেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে মানুষ উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু না করেও কেবল মিডিয়ার কল্যাণে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।’ অর্থাৎ মিডিয়ার সাহায্যে, পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে একধরনের জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে। কে কী করল, সেটা বিবেচ্য হবে না।

অ্যান্ডি ও একো—দুজনেই একধরনের ডিসটোপিয়ান সময়ে কথা বলেছেন। এটা মনে করার কারণ নেই যে একজন এলএসডি সেবনের পর কিছুটা বেসামাল হয়ে মন্তব্যটি করেছেন। আর অন্যজন নিঃসন্দেহে পারমিজান পনির আর সাম্বুকা পান করতে করতে গভীর ভাবনায় ডুবে তত্ত্বটি দিয়েছেন। অ্যান্ডির ‘১৫ মিনিটের বিখ্যাত হওয়ার’ মন্তব্যটি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে। একোর মিডিয়া তত্ত্ব নিয়েও হয়েছে বিস্তর আলোচনা। কিন্তু এর সত্যতা মিলেছে সাম্প্রতিক সময়ে।


এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, সোশ্যাল মিডিয়া, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব দিনকে দিন ‘পারফর্মিং কালচার’কে প্রোমোট করে যাচ্ছে, সবাইকে পারফরমার বানানোর জন্য উৎসাহ (আসলে টোপ) দেওয়া হচ্ছে। পারফর্মিং কালচারে যে প্রচুর মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ছে, সেটা টিকটক ভিডিওর ব্যাপক জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে। আর এই আসক্তি এরই মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ততার পর্যায়ে চলে গেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

সব দেখে মনে হয়, যে যা পারে, তা দিয়েই ‘পারফর্ম’ করতে উঠেপড়ে লেগেছে; ‘কনটেন্ট’ বানাতে চাচ্ছে। পারফর্ম করার মতো কনটেন্ট না পেয়ে এক্সিবিশিনিজমেও আক্রান্ত হচ্ছে কেউ কেউ। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। আর এসব করতে গিয়ে নিজের প্রাইভেসি বিকিয়ে দিতেও কার্পণ্য করছে না অনেকেই। যেন ‘ভাইরাল’ হওয়ার রোগে আক্রান্ত একদল মানুষ!


অ্যান্ডি ওয়ারহোল ও উমবার্তো একো—দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করেছেন, উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু না করেই খ্যাতি ও জনপ্রিয় হতে চাইবে ভবিষ্যতের মানুষ,সেই খ্যাতি যত ঠুনকো আর ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন।


সেই দিন কি তবে বেশি দূরে নয়, যখন মিনিটে মিনিটে ‘খ্যাতিমান’ লোকজনের দেখা পাব আমরা? আর সেই সুযোগ থাকবে সবার জন্যই অবারিত?


অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]