একটি সত্য ঘটনা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘একটা বাজে মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে ঘরে আনতে পারি না আমি।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন তুষারের মা।
মায়ের জবাব শুনে মুহূর্তেই রাগের আগুন বুকের মধ্যে ছলকে উঠল। সেই আগুন ঠেলে তুলল বিষাদের ঢেউও। নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে, হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে একবার দাঁত কিড়মিড় করল তুষার। ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’—পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে সাঁটানো স্টিকারের কথাগুলোও মাইক্রোসেকেন্ডের ব্যবধানে ভেসে উঠল বোধের জগতে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধের আগুন জলের ছিটা খেলেও বিষাদ আরও গাঢ় হতে লাগল। মমতাময়ী মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, ওই চোখজোড়া থেকে বেরোচ্ছে ভয়াবহ প্রতিরোধের আগুন। সন্তানের জন্য মমতা আর আগুন কি একসঙ্গে থাকতে পারে মায়ের বুকে, মায়ের বুকে সংরক্ষিত জেনেটিক কোডের গোপন কুঠুরিতে? আকস্মিক তেড়ে ওঠা প্রশ্নবাণ হতবাক করে দিল তুষারকে। উত্তপ্ত বাক্য না ছুড়ে, মাইনাস ডিগ্রিতে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চোখের মণির মতো স্থিত হয়ে, মায়ের চোখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, ‘চৈতিকে বাজে মেয়ে বলছ কেন, মা?’
‘যে বাজে, নষ্টা, তাকে তো তাই-ই বলতে হবে। ওর মায়ের কি ঠিক আছে? শুনেছি, ওর মাও একই রকমের?’
আবারও বিস্ময়ের চড় খেল তুষার। নিজের সহজ-সরল মায়ের মুখ থেকে কী সব শব্দ বেরোচ্ছে! যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসে, ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, সুখী হতে চায়, সেই মেয়েকে নিয়ে এমন মন্তব্য! ‘ছেলের সুখই মায়ের সুখ’—কথাটা কি মিথ্যা? ছেলের বউকে নিয়ে সুখের চেয়ে মায়ের মনে চৈতির ব্যাপারে যে অগ্রিম নেতিবাচক ধারণার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বিষ ছড়াচ্ছে, এই বিষদহনের উৎস কী? মায়ের মিথ্যা উপলব্ধি আর ভুল বিশ্লেষণ নয়?
শীতল কণ্ঠে তবু তুষার জবাব দিল, ‘না জেনেশুনে কারও সম্পর্কে এমন বাজে কথা বোলো না, মা।’
‘জেনেশুনেই তো বলছি। যে মেয়ে বিয়ের আগে ছেলের বাড়ি বেড়াতে আসে, ছেলের ঘরে ঢুকে সারা দিন পার করে, তাকে কি আর ভালো মেয়ে বলা যায়?’
আবার অনন্ত শূন্যে পতন হলো তুষারের। মা আর ছেলের মধ্যে আকস্মিক দাঁড়িয়ে গেল অনতিক্রম্য উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের ওপাশে মা, আর এপাশে তুষার। মাকে চিনতে পারছে না। অচেনা লাগছে। এই অচেনা নারীটিই যে মমতাময়ী মা, ছেলের উন্নতি আর মঙ্গল চিন্তায় যিনি গুনতেন প্রতিটি সেকেন্ড, তাঁকে এখন এককুচি ভাবনার মধ্যে মাতৃত্বের অস্তিত্ব দিয়ে মাপতে পারছে না। আর তখনই সন্তানবৈশিষ্ট্যের ভিত ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। ভেতর থেকে বিষবমির মতো উগরে বেরোল নিষ্ঠুর শব্দবাণ—যা কখনো করেনি, নির্দয় শব্দে তুষার আক্রমণ করল মাকে, ‘ছিঃ! তোমাকে মা হিসেবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। মেয়ে হয়েও আরেকটা সহজ-সরল মেয়ের দোষ দেখছ! চৈতিকে বাসায় আনার প্ররোচনা আর চাপ দেওয়ার জন্য নিজের সন্তানের দোষ দেখছ না! তুমি তো দেখছি মহা স্বার্থপর, মা।’
‘হ্যাঁ। এখন তো মাকে স্বার্থপরই মনে হবে। ওই মেয়ে নিশ্চয় তোমার মাথা গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছে। নিশ্চয় তোমার সম্পত্তির দিকে চোখ গেছে তাদের। মেয়ের মাও নিশ্চয় মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছে তোমার পেছনে।’
লাগামহীন কথার দাপটের মধ্যে মায়ের মুখে নিজের ভালোবাসার মৃত্যুপরোয়ানা শুনল তুষার। মায়ের অচিন্তনীয় অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়ার শেল বিঁধে চুরমার করে দিল পাঁজরের হাড়গোড়। ঘরের মধ্যে পচা গন্ধ ছড়িয়ে যেতে লাগল শব্দঢেউয়ে ভেসে। বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠাতেই এমন ভয়ংকরভাবে খেপেছেন তিনি। অথচ চৈতিকে ঘরে এনে আড্ডা দেওয়ার সময় কখনো কোনো টুঁ শব্দ করেননি। ছেলের বন্ধু—মাও এই বোধের তল থেকে ভেসে উঠে চৈতিকে আপ্যায়ন করেছেন, ভালো ব্যবহার করেছেন। চৈতিও হবু শাশুড়ির ভক্ত হয়ে উঠেছিল। এখন একি ভয়ংকর মাতৃরূপ! গোপনে গোপনে মায়ের মনে আগ্নেয়গিরির মতো লাভা ফুটছিল টগবগ করে, টের পায়নি তুষার। এখন বিয়ে প্রসঙ্গ আসতেই লাভার উদিগরণ ঘটছে। চূর্ণ করে দিচ্ছে নিজের বোধ আর প্রতিরোধের বাঁধ। আকস্মিক সেও প্রচণ্ডভাবে নির্গমন ঘটাল উত্তপ্ত লাভার—
‘চৈতিকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করব না আমি।’
‘তুমিও শুনে রাখো, চৈতি এ ঘরের বউ হয়ে এলে গলায় ফাঁস নেব আমি।’ মায়ের অন্তর্গত স্বগতোক্তির শব্দঢেউ প্লাবিত করল তুষারের বোধসমুদ্র। এপার-ওপারের বাঁধ ভেঙে প্রবল আক্রোশের প্লাবনে ডুবে গেল সে।
দিন পেরিয়ে একসময় স্থিত হয় তুষারের আক্রোশ। বিষাদের নীল সমুদ্রে ডুবে গেল সে সবার অগোচরে।

দুই.
জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল জুঁই। বাসরঘরে একা সে পার করেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। এখনো ঘরে ঢোকেনি আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটি। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রুমের এসি বন্ধ করে জানালার পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সে। মহাশূন্যের আঁধারে ঢলে থাকা চিকন চাঁদ ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে, উড়াল আঁধারের ভয়াল গ্রাস গিলে ফেলছে চাঁদ। তখনই অভিমানের জোনাকির ঝাঁক আচমকা আক্রমণ করল তার মনের সোনালি স্তর। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে...জোছনাকে যেমন গিলে খায় অমাবস্যার রাত্রি, দুর্ভাবনার মেঘও তেমনি গিলতে উদ্যত হয়েছে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা নিজের মধ্যে জেগে ওঠা জোনাকির আলো। সব আলো কি তবে নিভে যাবে? চারপাশে কি কেবল জেগে থাকবে দৈত্যবাহুবিস্তারি দুর্ভেদ্য কোনো অন্ধকার?
আচমকা একটা শব্দ হলো দরজায়। হুক খোলা ভেজানো দরজার দিকে চট করে ঘুরে দাঁড়াল জুঁই। বাসররাতে স্বামীর অপেক্ষায় জ্বলতে থাকা জোনাকির নিবু নিবু আলোর কণা দুমদাম জ্বলে উঠল উৎসারিত আতশবাজির ঝলসানো আলোর মতো।
এবার দরজায় টোকা পড়ল...ঠক ঠক ঠক...
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল জুঁই।
হ্যাঁ। বাসরঘরে ঢুকছে প্রত্যাশিত মানুষটি।
জুঁই ভেবেছিল ঘরে ঢুকেই হয়তো মানুষটি বুকে জড়িয়ে নেবে তাকে; হয়তো পাঁজাকোলা তুলে নিয়ে শুইয়ে দেবে বিছানায়।
না, তেমন কিছুই ঘটল না। পাশ কাটিয়ে খাটের দিকে যেতে যেতে তুষার বলল, ‘দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো। আমার ঘুম আসবে না। রাতে ঘুমাতে পারি না। ঘুম এলেও ভোররাতে ভেঙে যায়। কখনো কখনো উঠি দুপুরের দিকে। আশা করি, ডিস্টার্ব করবে না আমাকে। ঘুমের সময় ঘুমুতে দেবে।’
একি কথা! নতুন বউকে কি বাসররাতে এভাবে কোনো কথা বলতে পারে কেউ! কথার মধ্যে রাগ নেই। ধীরস্থিরভাবে অকপটে যা বলার বলেই খাটের পাশে রাখা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসল তুষার।
ছুরির ঘা খেল জুঁই। কতখানি ক্ষত হলো টের পেল না সে। ধেয়ে আসা নীরব রক্তস্রোতও বাইরে ভিজিয়ে দিল না তাকে। বিড়বিড় করল একবার। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। দরজায় হুক লাগিয়ে গুটি মেরে বসল খাটের কোণে। অনুভূতিশূন্য নববধূ না-বলা কথার মাধ্যমে দেহের ভাষায় জানান দিল, ‘আমিও ঘুমাব না।’
তুষার বলল, ‘দেখো। মা-ই তোমাকে পছন্দ করে এ বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ করে এনেছেন। শাশুড়ির আদরের ঘাটতি হবে না। প্রাচুর্যের অভাব নেই। ইচ্ছেমতো জীবন উপভোগ করতে পারবে এখানে।’
আবার বিষছুরির ফলা ঢুকে যেতে লাগল জুঁইয়ের বুক ফুঁড়ে। রক্তবন্যায় ভেসে যেতে লাগল সে। অন্তর্গত লাল স্রোতে ডুবে যাওয়ার আগেই আকুল চোখে তাকাল পরিচিত হওয়ার বাসনায় অচেনা লোকটির দিকে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই তুষার আবার বলল, ‘আমি যাকে ভালোবাসি, তার নাম চৈতি। আর আমার মা যাকে ছেলের বউ করে এনেছেন তার নাম জুঁই, তুমি। তোমার আর আমার মাঝে চিরজীবনের জন্য শুয়ে থাকবে একটা লাশ। সেটা হচ্ছে মৃত ভালোবাসার লাশ। এ লাশ টপকিয়ে তোমাকে ছুঁতে পারব না আমি, তুমিও ছোঁয়ার চেষ্টা কোরো না আমাকে, কেমন।’
ভোর হলে কচি সূর্য ওঠে। আলো ছড়ায়। তেজ বাড়ে আলোর। সন্ধ্যা এলে তেজ কমে, আঁধারে ডুবে যায় আলো। জুঁইয়ের মনে হলো, তার ভালোবাসার কচি সূর্যটা আঁধারেই ডুবে গেল এখনই, দিনের সূর্য আর দেখবে না কোনো দিন।
শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। শব্দের তোড়ে জাগতিক শব্দও ডুবে যাচ্ছে মধ্যকর্ণের খাদে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। ওপরের দিকে তাকাল জুঁই। ছাদের হুকে আটকে আছে ফ্যান। ঘুরছে। শোঁ শোঁ আওয়াজ আরও তীক্ষ হচ্ছে। আর জীবনতরঙ্গে ডুবে যাচ্ছে সেও। তাকিয়েই আছে সে ফ্যানের দিকে। ঘোরতর আঁধার জেগে উঠল চোখে। আঁধারেই টের পেল, ফ্যান নয়, হুকে আটকে গিয়ে নিজেই শাঁই শাঁই করে ঘুরছে জীবনপাখায়। আর পাখার ঘূর্ণনে ছড়িয়ে যাচ্ছে লাশের গন্ধ। দুর্গন্ধ নয়, লাশ থেকে বেরোচ্ছে সুঘ্রাণ। অন্য রকম ঘ্রাণটি নাকে টেনে বড় বড় চোখ মেলে তাকাল শূন্যে, দেখল নিজেকে খাটের কোণে। চেয়ারের বসা তুষারকেও দেখল। আর দুজনের মাঝে অটল বৃক্ষের মতো দাঁড়ানো একটা লাশও সে দেখল, এ লাশ কার? তুষারের মৃত ভালোবাসার? চৈতির? নাকি নিজেরই? কিছুই বুঝতে পারল না জুঁই...কিছু না।
তুষারও টের পেল না অদৃশ্য এক লাশ বহন করতে গিয়ে বাসররাতেই সে নববধূকে উপহার দিল একটি জীবন্ত লাশ।