ছুতামিতি খেলা

পিঁপড়ার ঢিবির দিকে লাইন দিয়ে খাদ্য নিয়ে পিলপিল করে এগিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ার দল। ঠিক সময়ে খাদ্য সংগ্রহ করে না রাখলে না খেয়ে মরতে হবে। দলপতির নির্দেশমতো কাজ করে চলছে। কেউ লাইনচ্যুত হচ্ছে না। লাইনটা ঠিক জ্যামিতির আইন মেনে এগিয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়ার মুখে সাদা রঙের কোনো খাদ্য। বোঝা যাচ্ছে না, কী সেটা! নীলকে আর্কষণ করতে পিঁপড়ার দল সক্ষম। নীল তখন পরিকে ডেকে বলল, ‘আয় আমরা ছুতামিতি খেলা খেলি।’

পরির শরীরে লাল টুকটুকে ফ্রক। বেণি করে চুল বাঁধা। ঠোঁটে শখ করে লাল রঙের লিপস্টিক নিয়েছে। দেখতে সত্যি সত্যি ছোট ডানাকাটা পরির মতোই লাগছে।

‘কী খেলা ভাই?’ পরি নীলের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল। নীল তখন পিঁপড়াগুলোর দিকেই একমনে তাকিয়ে আছে। তার হাঁটু পর্যন্ত ধুলা লেগে আছে। হাফপ্যান্টের পেছনের দিকটায়ও ধুলা। সাদা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে।

‘যুদ্দ যুদ্দ খেলা।’

এবার পরি তার দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘কেমনে খেলুম, বন্দুক নাই তো?’

‘তুই হাবা। ওই যে পিঁপড়া আছে, ওইডি মনে কর মিলিটারি। আর আমরা মুক্তিযুদ্ধা। এহন ওগো শ্যাষ কইরা দিতে হইব।’

‘মিলিটারিগো তো বন্দুক ছাড়া মারুন যায় না, ওগো কেমনে মারব?’ পরি পিঁপড়াগুলো দেখতে দেখতে আবার প্রশ্ন করে।

‘পাও দিয়া মারবি। একতালা পাড়াবি, যতগুইলা মরে।’

‘আইচ্ছা।’

এ বলেই দুজনে মিলিটারি মারা শুরু করে। পিঁপড়ার ঢিবির ওপর লাফাতে শুরু করে। ভেঙে ফেলে সবকিছু। পিঁপড়াগুলো পালাতে থাকে। কিছু পিঁপড়া ওদের দুই ভাইবোনের পায়ে কামড় দিয়ে ঝুলতে থাকে। তবু তারা থামে না। মিলিটারি সব খতম করা চাই, এমন একটা মনোভাব নিয়ে লাফাতে থাকে যতক্ষণ না তাদের মা এসে ধমক দেয়।

‘এই সব কী! যাও হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসো।’

‘মিলিটারি মারতেছি, মা। না মারলে তো দেশ স্বাধীন হইব না।’ গলায় আবেগ ঢেলে বলে নীল।

‘যা, দুইজনকেই কিন্তু পিট্টি দেব।’ তাদের মা ডান হাত উঁচু করে মারের ভঙ্গি করে। দুই ভাইবোন এতে ভয় পেয়ে দৌড় দেয়। বাড়ির নিচের পুকুরঘাটে চলে আসে।

‘চইলা আয় বলতেছি। মারব কিন্তু…’ পেছন থেকে মা চিৎকার করে বলে। কিন্তু দুজন ততক্ষণে প্রজাপতি ধরার পাঁয়তারা করছে। পরিকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে নীল ধীরস্থিরভাবে প্রজাপতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের আঙুল ধীরে ধীরে প্রজাপতির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং লেজের কাছাকাছি পৌঁছাবার একটু আগেই প্রজাপতি ফুড়ুৎ করে উড়ে অন্য একটা মরা ডালে বসল। নীলের দৃষ্টি এখন মরা ডাল বরাবর।

‘ভাই, তুই পারবি না, আমি ধরুম।’ পরি নিচু স্বরে বলে। সে অবাক হয়ে প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখছিল। তার মনে হচ্ছে, সে পারবে, নীল পারবে না।

‘থাম, এবার পারব।’

প্রজাপতি লেজ নাড়াচ্ছে। হালকা হাওয়ায় প্রজাপতির সাদা-কালো পাখাটি উড়ছে। তবু সে কীভাবে বসে আছে, নীল বুঝল না। সে ধরার জন্য আবারও হাত বাড়াল, কিন্তু প্রজাপতি কীভাবে যেন বুঝে যাচ্ছে, তাকে কেউ ধরতে আসছে। আবার উড়ে গিয়ে পুকুরঘাট থেকে একটু দূরের একটা বাঁশের কঞ্চি, যেখানে খাড়া হয়ে আছে, সেখানে বসল। নীল যদি পানিতে নামে, তবেই প্রজাপতির নাগাল পাবে। ততক্ষণে পরি তার পাশে দাঁড়িয়েছে।

‘ধরতে হইব না। চল যাই।’

‘প্রজাপতিটা খুব খারাপ, ধরা দিলে কী হইব? ছেচ্চর প্রজাপতি ধরা দেয় না।’ নীল একমনে বলে চলে।

সে পানিতে নামে। প্রজাপতি ধরার নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। পরি তাকে আবারও নিষেধ করে। কিন্তু সে শোনে না। নামতে নামতে নীলের প্যান্ট ভিজে গেল। সে পাত্তা না দিয়ে কঞ্চির কাছাকাছি পৌঁছায়। প্রজাপতি আবার উড়ে যায়। এবার কদমগাছের গোড়ায় লকলকে একটা ডালে গিয়ে বসে। নীল ওঠে আসে।

‘চল বাড়ি যাই, ভাই। ওইটা ধরা লাগব না। পরি কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু নীল খুবই একরোখা, সে কিছুতেই যেতে চায় না।’

পরি দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। নীল যায় কদমগাছের দিকে। তার ইচ্ছা, প্রজাপতি ধরে সেটার লেজে সুতা বেঁধে ঘুড়ির মতো ওড়াবে। সে জন্যই এত কষ্ট করছে।

পরি বাড়ি গিয়ে মাকে বলে দেয় নীলের কাণ্ডকারখানা। তার মা দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়। ভয় পায়, নীল তো ভালো করে সাঁতার জানে না, যদি পুকুরে ডুবে যায়। যদিও পরি জানিয়েছে, নীল পানি থেকে উঠে গেছে। তবু তার মনে কু ডাক দেয়।

দ্রুত পুকুরের কাছে আসতেই দেখেন চারপাশে কেউ নেই। পুকুরের পানি তিরতির করে ঢেউ দিচ্ছে শুধু। পরি জানায় কদমগাছের কথা। কিন্তু কদমগাছের আশপাশে কোনো কিছু নেই। নীলের মা দ্রুত এদিক–সেদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। পাঁচ মিনিটের মাথায় সে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

নীলের মা কাঁদছে। পাড়াপ্রতিবেশী জড়ো হয়েছে। সবাই তার কান্নাকাটি দেখে। কিন্তু নীলকে কেউ খুঁজতে যায় না। নারীরা তার কান্না থামানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার স্বামীকে খবর দিতে যায় ফজল। নীলদের পাশের বাড়িতে থাকে। হালচাষ করে মেছের আলীর বাড়িতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে। বিপদ–আপদ হলেই সবাইকে খবর দেওয়া তার অভ্যসে পরিণত হয়েছে।

দ্রুত পদক্ষেপে হেঁটে যায় ফজল। নীলের বাবার নাম মিজান খান। বাজারে তার মুদিদোকান। ব্যবসাও বেশ রমরমা। ফজল তার দোকানের সামনে গিয়ে বলে, ‘মিজান ভাই, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো। তোমার বউ আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিছে।’

মিজান বলেন, ‘যাক, এবার দুই মাস পর কান্নাকাটি করতেছে। আস্তে আস্তে নীল ও পরিকে ভুলে যাবে হয়তো।’

ফজল বলে, ‘তুমি না গেলে থামবে না, চলো।’

দোকানের কর্মচারীকে রেখে মিজান ফজলের সাথে বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেন। আকাশ তখন মেঘলা। যেকোনো সময় ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দুজনেই দ্রুত হাঁটে। হুট করেই ইলশেগুঁড়ি শুরু হয়ে যায়।

বৃষ্টিও যেন তাদের তাড়া দেয় দ্রুত বাড়িতে যাওয়ার জন্য।