বশবর্তী

১.

বিশ্বময় মারি আর মড়ক, দুর্ভিক্ষের আগাম পদধ্বনি, বন্ধুরা ফেসবুকে এই সময়টার নাম দিয়েছে ‘করোনা-কাল’, ‘করোনা-ক্রান্তি’ ইত্যাদি। শুয়ে শুয়ে উত্তাল সিলিংফ্যান দেখতে দেখতে বেলাল বউয়ের দিকে ফিরে বলল, ‘ক্রান্তি শব্দটাই ভালো, কী বলো, কেমন দাঁতের তলায় কাঁকরের মতো বিন্ধে। এমন করে না বিন্ধলে, এমন করে আসলেই ক্রান্তিকাল না হয়ে উঠলে কি আর আমরা এইভাবে ঘরে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে যেতাম?’

শাহনাজ ব্লাউজের হাতায় টাক দিচ্ছিল সুচসুতোয়, সে গিঁট দিতে দিতে মুখের কাছে তুলে সুতোটা দাঁতে কাটতে কাটতে বলল, ‘বিলাতি বন্ধুর সাথে কথা বলে জনাবের খুব মেজাজ ভালো হয়েছে মনে হয়? শব্দ-টব্দ নিয়ে মাথা ঘামাইতেছ!’

আজ অনেক দিন পর ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু (আর পরে কিছুকাল সহকর্মী) তন্ময়ের সাথে ভিডিও-কলে কথা বলে সত্যি বেলালের ভালো লাগছে। ছুটির দিনের স্পেশাল নাশতার মতো ভালো। তাদের বিয়েতে তন্ময় এসেছিল নাকি, শাহনাজের অবশ্য মনে নেই তার চেহারা।

—এমন দেশে থাকে সে, যেখানে প্রতি তিনজনে একজন পুরুষ একা একাই থাকে কইল, তো ফোন ধরে আর ছাড়তেই চায় না! 

—আমাদের মতন একগুষ্টি লোকজন একসাথে নাই, ভালোই তো, দোকানে গিয়ে একগাদা বাজারের চিন্তা নাই, একশোবার হাত ধোয়ার দরকার নাই! শাহনাজ চোখ সরু করে নতুন সুতা পরাতে থাকে সুচে।

বেলাল গা মোচড়াল—আহা নাজু, তন্ময়ের ভাগ্য! আজকে ওর সাথে কথা বলতেছিলাম যখন-তখন ওর বউয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, রবীন্দ্রসংগীত গাইতেছিল মেয়েটা। ‘আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে, ব্যাকুল কর হানি বারে-বারে...’

—অ। ‘রোদনভরা এ বসন্ত’, তন্ময়রে বিয়ে করে সারল না, অলরেডি রোদনভরা এ বসন্ত গাইছে?

—আরে, কী গলা মেয়েটার, কাঁদুনি গলা না, ব্যথায় ভরে আসা ঝিম ধরে আসা গলা। নাম নাকি মঞ্জরী। একবার এসে সে তন্ময়রে চা দিয়ে গেল, আমার আর জসীমের একেবারে তাক লেগে গেল। এই তোমার মনে আছে, অ্যান্টেনাতে সরা ফিট করে আমরা যে ইন্ডিয়ার দূরদর্শন দেখতে পাইতাম?

—মনে থাকবে না কেন? গানও মুখস্ত হয়ে গেছিল আমাদের ‘সীতা-রাম চরিত অতি পাবন’, ‘রামায়ণ’-এর সীতারে আমাদের কী পছন্দ ছিল! সত্যিকারের সীতার মতো দেখতে সেই নায়িকা।

—ঠিক ঠিক। সেই সীতার মতন দেখতে তন্ময়ের এই সেকেন্ড বউ। সেই রকম মিষ্টি। কপালের চুলটা ওইরকম ঘনায় থাকে, থুতনিটা সরু, আধাপাকা পেয়ারার মতো।

শাহনাজ ছোট্ট শ্বাস ফেলে স্বামীর দিকে তাকায়, ‘ইসস, বন্ধুর বউরে দেখে কাব্য শুরু হয়ে গেল! আর আমিও শুনতেছি! কী কপাল আমার!’ এই ছদ্ম-শ্বাস বেলাল চেনে, সে পা বাড়িয়ে পায়ের কাছে বসে বসে সেলাই করা শাহনাজের শ্রোণির তলায় পা ঢুকিয়ে দিল, বলল, ‘মন আর শরীর সকলি আপনার কাছে প্রকাশ্য হে মহারানি, এমন সোয়ামি আপনি আর কই পাবেন?’

—আহা আহা, আমারে একই দলে খেলতে নিয়ে রাখলা, যেন পরের গোলপোস্টে শান্তি করে গোল দিয়ে আসতে পারো!

ফুটবলবিষয়ক আলাপ এগুলো না, কারণ, বেলাল দুই পা দিয়ে শাহনাজের কোমর জড়িয়ে ধরেছে। কাবাডি?

—সত্যি বললাম নাজু। তন্ময়ের এখনকার বউ দেখতে সেইকালের ‘ইমামি’র অ্যাড করা নায়িকাদের মতো গোলাপি।

—এর মধ্যে কত কী বলে ফেলছ! সীতার মতো মিষ্টি, ইমামির মতো গোলাপি, কচি পেয়ারার মতো...

অন্তরীণ থাকবার অসুবিধে হচ্ছে সম্প্রীতি অতি দ্রুত অভিমানে এবং অভিমান দ্রুত বিবাদে পৌঁছে যায়। সেটা বেলালকে ভোগায়, শাহনাজকে ভোগায় কি না বোঝা যাচ্ছে না, আজকাল সে-ই তো জেতে, গোলাপি-টোলাপি বলে বেলাল হয়তো শাহনাজের মনের ব্যথা উসকে দিয়েছে, শাহনাজ গাঢ় শ্যামবর্ণা। বসে বসে টাক দেওয়া সুতোটা খুলছে টেনে টেনে, হাতের আঙুলগুলো খাটো খাটো, নখ রাখে না আর, অভিজ্ঞ সেতার-সরোদবাদকদের যেমন নখ উড়ে যায়—তেমনি করে রান্নাঘরে ক্রমাগত কাজ করে যাওয়া মানুষেরও নখ-টখ থাকে না। বেলাল শাহনাজের হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবল, চামড়ার তলায় যেন উত্তাপ আছে, এই চামড়া ঘুর্ণায়মান, এই চামড়া বারবার নবায়িত একটা জীবন্ত বস্তু। প্রসঙ্গ সামান্য বদলাল সে, ‘তুমি তো তন্ময়কে দ্যাখো নাই। প্রথম বিয়েটা সে যারে করেছিল, সে ছিল আমাদের সব্বার ক্রাশ। নাম দিলশাদ, দিল। মানে আমরা পাঁচ বন্ধুর পাঁচজনই ডাকতাম দিল। শ্যামলা একটা মেয়ে, কিন্তু কী সেক্স অ্যাপিল! (নাজুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ইতিউতি) সেই রকম রুচি, ওই “সানন্দা”র পাতার মেয়েদের মতন মরা-মরা রঙের শাড়ি পরত, শুকনা মরিচ কালারের লিপস্টিক আর কালো রুপার গয়না (নাজু মুখে কাপড় দিয়ে হাসছে), লেখাপড়ায় ভালো ছিল, ডিবেট-টিবেট করত, আমাদের ভেতর একটা সাইলেন্ট প্রতিযোগিতা ছিল যে এই মেয়েরে কে বিয়ে করবে! আমাদের তুড়িতে উড়ায় দিয়ে সেই মেয়ে তন্ময়রেই বিয়ে করল। কিন্তু বিয়ের পরে আর তন্ময় তারে পছন্দ করত না! কইত, কী মেয়ে রে...সারা বছর এই এক চিকন সিঁথা করে মাথা আঁচড়ায়, এই সব মরা মরা কালার পরে...আর এই মুরগির গু কালারের লিপস্টিক। আরে বেক্কল, দিলশাদ যে মডেলদের মতো চুল ঝামড়ায় রাখে না কপালে এইটা তুই আগে দেখস নাই!’

হাতের সুতোটা কুণ্ডলী পাকিয়ে নিয়ে শাহনাজ বেলালের পায়ের আঁটুনি সরিয়ে দিয়ে  উঠল, ‘হাতে পাইলে তোমাদের আর কাউরে ভাল্লাগে না!’

—হাহহাহহা, সবাই কি বেলাল নাকি, যার হাতে পাইলেই ভালো লাগে!

বেলালের কথার জবাবে শাহনাজ কটাক্ষ করল যেন, কিন্তু হাসল। বেলালকে আজ কথায় পেয়েছে। সে বলতেই থাকল, ‘তন্ময় আর আমি একই ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করতাম তুমি তো জানো। বিকালে তন্ময় দেখি ফোন দিত বাসায়, আমরা শুনতাম—ডাল আছে? কিসের ডাল? না কালকে পাতলা ডাল খাইছি আজকে ডাল-ভর্তা খাব। চিকন চালের ভাত বসায় দিয়ো। চিকেন কী রকম আছে? শুখা করে ফেলো। এই সব আমরা শুনতাম। লাগত বুয়ার সাথে কথা বলতেছে। ভাবতে পারতাম না, আমাদের পাঁচজনের দিল এখন তার ঘরে বসে বুয়াবেটির মতন অর্ডার শুনতেছে।’ 

—আহাহা, এখন বুয়া আসে না জানে, তারপরেও কে আমাকে আলুভাজি দিয়ে আটার রুটি খাব, শলার মতো চিকন চিকন...এই সব বলে যন্ত্রণা করে? কে বলে কালকে ভাজি খাইছি, আজকে ভাজি আছে তো কী হইছে, হালুয়া করো?

—আহা নাজু, এ তো অনুনয়। আর সেটা ছিল হুকুম। দুইয়ে তফাত আছে তো! অনুনয় করলে ফরসা-দিলে খোশমেজাজে করা যায়, আর হুকুম করলে সেটা পালন করার আগেই মন বিগড়ায়!

—দুইয়েতেই কিন্তু কাজটা আমারই করতে হয়। সেটা মনে রাখবেন জনাব!

—কেন, লাস্ট টাইম আমি আলু ছিলে দিছি!

২.

এখন করোনাবন্দী জীবনে তন্ময়ের সাথে প্রায়ই কথা হয় বেলালের। জসীমেরও। গৃহবন্দী জীবনের চমৎকারিত্ব নিয়ে তন্ময় কথা বলে। হাসে এবং বেলাল আর জসীমের বোরডাম দেখে। তন্ময়ের সাথে বেলালের সময়ের তফাৎ ঘণ্টা পাঁচেকের, গরমকালে পাঁচ আর শীতকালে ছয়, বলে রাখে তন্ময়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বেলাল আর জসীম। তন্ময়ের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে তাদের তো বেলা গড়িয়ে যায়।

প্রথম তারা মৃত্যু আর পরিসংখ্যানের কথা বলে, কত লোকে পালে পালে মরছে চীনে, ইরানে, ইতালিতে, আমেরিকায়—এই সব বলে। মানুষের হঠকারিতার কথা বলে। করোনা রোগী বাপকে মাঠে মরতে দিচ্ছে লোকে, করোনা রোগী সন্দেহে মাকে ফেলে আসছে বনে। যেন বেলাল-জসীম-তন্ময়ের পৃথিবীর সব আড়াল খসে পড়ছে। তারপর তারা দ্যাখে আর শোনে সামান্য আড়ালে জানালায় বসে সে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে হুবহু ঋতু গুহর মতো গলায়, যার নাম মঞ্জরী। রামানন্দ সাগরের সেই ‘রামায়ণ’-এ দেখা অশোকবনের সীতার মতো একটিমাত্র গেরুয়া বসনে বিনা-প্রসাধনে অত্যুজ্জ্বল সেই মেয়ে। তার বাগানে ফুটেছে সুনির্বাচিত মরসুমি ফুল, কিচেন গার্ডেনে অজস্র আনাজ আর হার্ব, ঘুরে ঘুরে দেখায় তন্ময়। মাঝে মাঝে মঞ্জরী এসে চা-কফি দিয়ে যায় তন্ময়কে, তখন সামান্য কথা হয়, ভাবিইইইইই বলে হামলে পড়ে বেলাল আর জসীম, মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কর্মযোগী, স্বামী-অন্তঃপ্রাণ...তন্ময় অনেকক্ষণ কথা বলছে দেখলে সে এসে তন্ময়ের কাঁধ ম্যাসাজ করে দেয়, হাতের আঙুলগুলো মোমে-মাজা নিখুঁত, গোলাপি নখগুলোয় কামনার মতো দগদগে লাল নেলপলিশ। তন্ময়ের বউকে দেখবার জন্যই যেন বারবার ফোন দেয় তারা। বেলাল আর জসীম। তন্ময় বোঝে না তা নয়। কিন্তু সুখাদ্য খাওয়ার এবং সুবেশ পরিধানের আনন্দ দেখানোয়, সেই রকম করে সে যেন এই দেখানোতেও আমোদ পায়। বলে, ‘কিছুই আমার ভাবতে হয় না দোস্ত, বিশ-পঁচিশ দিন আগে অর্ডার না দিলে আজকাল গ্রোসারি ডেলিভারি পাওয়া যায় না, সেটা কখনোই আমার মনে করিয়ে দিতে হয় না। সে-ই ক্লকওয়ার্কের মতো মনে করে অর্ডার দিয়ে দেয়। এখন তো আমাকে বের হতেই দেয় না।’

অশোকবনের সীতার সাথে এক বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দী থাকবার প্রসঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যে প্রসঙ্গ আসবার, সেটা আসে, দীর্ঘদিনের বন্ধু এরা, আড়াল কোথায়! তন্ময় বলে আর হাসে, বেলাল আর জসীম শোনে আর সামান্য হাসে। বলে, ‘তোরা ঝগড়া করিস না দোস্ত?’

—ইচ্ছা হলে করি তো। তারপর দোস্তি পাতাই...(তন্ময় আবার সেই প্রসঙ্গে যেতে চাইছে, যেখানে গেলে নাকালভাবে বেলাল আর জসীম শুধুই হাসবে) আপাদের সাথে খেলতে গিয়ে যা যা শিখেছিলাম সবই করি, জনমের ভাব জনমের আড়ি, এমনি ভাব ছিল বুড়ো আঙুল আর জনমের ভাব তর্জনী...জনমের ভাব করতে হয় বিশেষ বিশেষ সময়ে ইত্যাদি।

ফোন রাখবার পরে তন্ময় বউকে ডাকে। বন্ধুদের ঈর্ষান্বিত করবার আনন্দে তার ঘাড়ের কাছে রক্ত ছলছল করছে, বিস্ফারিত চোখ। মঞ্জরী এসে দাঁড়ায় কাছে—পরনে দিলশাদের ফেলে যাওয়া সিল্ক, সে তাকিয়েই বুঝতে পারে তন্ময়ের প্রেম পেয়েছে, এই সব সময়ে তন্ময় তার কাছে খোঁচাখুঁচি প্রত্যাশা করে, মাথা ঘামিয়ে মজার জবাব দেয় মঞ্জরী—শরীর জাগাবার মতো দুই-অর্থের কথাবার্তা বলে। তন্ময় তার গাল দুটি দুহাতে চেপে রেখে মুখের দিকে তাকায়, একটি অর্থহীন প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি সুখী হয়েছ মঞ্জরী?’ মঞ্জরী ‘আহাআআ কী কথা’ বলে রঙ্গ করে না, রঙ্গতামাশা তার স্বভাবের মূলসুর নয় ঠিক। নীলমণিলতার ফুলের মতো প্রগাঢ় নীল আলো ঝলসায় তার প্রেমের ভারে ভারাক্রান্ত আয়তচোখে, যেন একটু ভেবে নিয়ে সে বলে, ‘তোমার সুখই আমার সুখ।’

—আহা আমার সোনামণি, তোমাকে নিয়ে আমার সুখের অন্ত নেই!

—তাহলে তো আমারও সুখের অন্ত নেই! হাসে মঞ্জরী, আলো-আলো হয়ে যায় তার মসৃণ মুখ।

৩.

এখন নিশ্চয়ই বেলাল শাহনাজের কাছে, জসীম নীলুফারের কাছে ফেরত গেছে, গিয়ে ভাবছে মঞ্জরীর রূপের কথা গুণের কথা পতিপরায়ণতার কথা...রাতের ভাত খেতে খেতে ভাবছে, মশারির তলায় গিয়ে অবিরাম ভাবছে, ভাবতে গিয়ে তাদের অন্তরীণ জীবন আরও কত তিক্ত হয়ে উঠছে, বাসি তরকারির বাটির মতো করে তারা ঠেলে ফেলে দিচ্ছে তাদের বউদের, ভাবতে ভাবতে খাটো একটা হাসি হাসে তন্ময়। মঞ্জরী তার নাক টেনে দিয়ে বলে, ‘খুব দুষ্টু!’

—আজকাল মনের কথা বুঝতে পারো নাকি মঞ্জরী?

—বুঝিয়ে দিলেই বুঝব! ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে বলে মঞ্জরী, তার ফোলা ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে গেছে। চোখের চাউনি উজ্জ্বলতর-স্থির। এই মেয়ের যেন চোখের রং বদলায় মনোভাবের বদলের সাথে সাথে।

—আমার মনে এখন তোমার শরীর ছাড়া কিচ্ছু নেই! এটা বুঝতে পারছ?

—বুঝতে পারছি। সাধারণত তোমার মনে আমার শরীর ছাড়া কিচ্ছু থাকে না। নিটোল গলায় বলল মঞ্জরী, এতটুকু বিষাদ নেই, কাঁদুনি নেই, অভিমান নেই। বলেই সে তন্ময়ের চোখের মণি ডাইলেট করা দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুঝে ফ্যালে তন্ময় এখন রাগ করেছে, মাঝে মাঝে মজার জবাবগুলো আর শুনতে চায় না তন্ময়, শুধুই অনুবর্তিতা চায়।

সাধারণত তন্ময়ের বন্ধুদের নিয়ে তার অনুমান সত্য হয়, তারা সত্যি মঞ্জরীকে নিয়ে ভাবে, তন্ময়ের সৌভাগ্য নিয়েও ভাবে, ভাবে আর প্রসঙ্গক্রমে ছাড়া অন্য কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই বলে বিরক্তও হয়ে ওঠে ঘরে, কিন্তু ঠিক তখন জসীম আসলে রাত জেগে নীলুফারের গান শুনছিল। নীলুফারের বিয়ের আগের নাম নীলিমা দাশ। সে মৃদু গলায় গাইছিল, ‘গায়ে হলুদমাখা দেখতে বাঁকা মুনির মন ভুলায়, সে যে রা রা করে কান্না করে ধা বলতে পড়ে ধুলায়...কেমন তার শঙ্খপঙ্খ (সাঙ্গোপাঙ্গ), বাজায় মধুর মৃদঙ্গ, তারে দেখলে উঠে প্রেমতরঙ্গ, দিদি লো ঘরে থাকা দায়…কোন রূপসীর হৃদ্‌বাগানের মনকোষের ভোমর, সে যে তারে ছেড়ে কেমন করে বেঁধে রাখে কলেবর’, মৃদু গলায়, কারণ জসীমের মা এইসব হিন্দুয়ানি গান শুনলে অনর্থ করবে। কিন্তু নীলু গাইবে, নীলু কুমকুমের টিপও দেবেই। আড়ালে।

আর বেলাল তাদের মেয়ে ইশমামকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলছিল, ‘এই যে আম্মু আর আমার মাঝখানে ইংরেজি “এ” অক্ষরের মাঝখানের ডাঁটির মতন শুয়ে থাকো আর আমাদের খাট থেকে দুই দিকে ঠেলে ফেলে দাও এটা কি ঠিক? বড় হচ্ছ না তুমি?’

ইশমামও জবাব দিচ্ছে, ‘আমি “এ”র মাঝখানের ডাঁটি না আব্বু, আমি এইচের মাঝখানের ডাঁটির মতো শুই।’

তাদের রূপচাঁদ লেইনের বাসাটা থেকে বের হয়ে সুত্রাপুর বাজারের দিকে যেতে হেমেন্দ্র দাস রোড, সেই রোডের মাথায় একটা পুরির দোকান ছিল, সেই দোকানের প্রসঙ্গ উঠল ইশমামকে ছোট ছোট চাপড় মেরে মেরে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে, বেলাল খেদ করে বলছিল, ‘নাজু, ওই রকম ডালপুরি আর খাইলাম না জীবনে। মনে আছে প্রত্যেক দিন একই গান বাজাইত দোকানে, “মিলতি হ্যায় জিন্দেগিমে মুহব্বত কাভি কাভি”?’

—হ্যাঁ। মনে নাই আবার! মালা সিনহার গান। একবার আমরা চার দিন ঘর থেকে বের হই নাই, চার দিন ডালপুরি আর চা খেয়ে থাকছি, আর ফ্লোরে ঘুম! নিচু গলায় বলে শাহনাজ, সেই চার দিনের আরও অনেক গল্প আছে, শুধু তাদের।

—এহ, চা আর ডালপুরি। আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পাতার বিড়ি খাইছিলা, সেটা কী?

—দোকান আবার খুলবে। আবার ডালপুরি খেতে পারবা! শাহনাজ বেলালের গায়ে হাত রাখে, সান্ত্বনার।

এইসব গার্হপত্যের গল্প তন্ময় জানে না।

সে জানে তার বন্ধুরা মঞ্জরীকে দেখে গিয়ে ডোরাকাটা সুতির মশারির তলায় শুয়ে উশপিশ করছে। একদিন যেমন দিলশাদকে দেখে করত। কিন্তু আসল গল্প না জেনেও, মশারি আজকাল ওরাও খাটায় না জেনেও ছাই এসে জড়ো হয় তার প্রাপ্তির ফুলকিতে। তখন মঞ্জরীর ঘাড়ের তলায় হাত বাড়িয়ে তন্ময় আলগোছে চিপটা খুলে রেখে দেয় দিলশাদের ফেলে যাওয়া স্যামসোনাইট মেকআপ-বক্সের ভেতর (বিয়ের সময়কার তত্ত্বে পেয়েছিল দিলশাদ), এখন আর মঞ্জরী ঠাট্টা করে কোনো জবাব দেবে না। এখন সে শুধুই সেক্স রোবট, অনুবর্তিনী, আর তন্ময় সুন্দরের অধিপতি, রাজা, লুটেরা, দস্যু, ধর্ষক।

—আমি তোমাকে প্রথম পেয়েছিলাম বার্সেলোনায়, এক ঘণ্টায় নব্বই ইউরোতে। এশীয় ডলের খুব চাহিদা ছিল সেই ব্রথেলে। মনে আছে তোমার?

—হ্যাঁ, তুমি আমাকে ব্রথেলে পেয়েছিলে।

—অন্ধকার একটা করিডোর দিয়ে অনন্তকাল হাঁটতে হাঁটতে তারপর তিন দেয়ালে আয়না দেওয়া একটা ছোট্ট ঘরে আমি তোমাকে দেখলাম। বার্থ-ক্যানাল দিয়ে আলোয় বের হয়ে আসার মতন...

—হ্যাঁ, আমার ঘরে তিন দিকের দেয়ালে আয়না ছিল, বিছানার মুখোমুখি দেয়ালে টিভি, টিভিতে...

—বাহ, গুড। যেন থামিয়ে দিল তন্ময় মঞ্জরীকে, ‘তোমার চোখে ছিল ঝালরের মতো পল্লব, তোমার চুলের রং ছিল কমলা, এখনকার মতো কালো না, কিন্তু এই রকম রেশমের মতোই।’ তন্ময় তারিফের চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে মঞ্জরীর চুলে থাবার মতো করে হাত রাখে। ‘আর কালো-নীল-সবুজ মারবেলের মতো চোখের মণি। এক শ রকমের শরীর থেকে তোমাকে আমি বেছে বেছে সাজিয়েছিলাম, আমার যেমন চাই, যেভাবে চাই।’

—হ্যাঁ, আমার চুল এখন কালো রেশমের। আমার চোখে ঝালরের মতো পল্লব। আমার মারবেলের মতো চোখের মণি। তুমি যখন যেমন চাও। যেভাবে চাও।

—ঠিক। আমি যা চাই। আমার মাথায় কোনো চাপ তৈরি হবে না, আমার নিয়ন্ত্রণে, স-ব। আমি প্রভু। (হাসে তন্ময়) ‘নিসর্গ লুণ্ঠনের অনন্ত অধিকার আমার।’ এ রকম একটা কবিতার লাইন আমার বন্ধু জসীম লিখেছিল, জানো?

—জেনে সুখী হলাম। বলেই মঞ্জরী আহ্‌ শব্দ করে ওঠে, তন্ময় তার গায়ে হাত দিলেই...মানে তার সেন্সরে হাত পড়লেই সে কাতরায়, তার থার্মোপ্লাস্টিক রাবারের স্তন দুলে ওঠে, সে এভাবেই ম্যানুফ্যাকচার্ড।

১৮/০৪/২০২০