সেবার নানাবাড়ি বেড়াতে গেছি স্কুল বন্ধের সময়। তখন বোধ হয় সিক্স-সেভেনে পড়ি। ঠিক মনে নেই। নানাবাড়ি গিয়ে আমি খুব স্বাধীন। আব্বাও আসেননি। আব্বাকে যমের মতো ভয়ে পেতাম। আব্বা নেই বলে যা মন চায়, করছি। নানার বাড়িতে একটা কাজের লোক ছিলেন—হোসেন মামা। আমার চেয়ে বছর দশেক বড় হবেন। তিনি আমাকে একদম বন্ধু বানিয়ে ফেললেন। জীবনের অর্ধেক শিক্ষা ধরতে গেলে তিনিই আমাকে দিলেন। সাঁতার শেখালেন; গাছে চড়া, ঘুড়ি ওড়ানো শেখালেন; সাইকেল চালানো শেখালেন; লাটিম ঘোরানো, ঘাস কাটা শেখালেন; গরুকে খাওয়ানো শেখালেন; আরও কত কিছু যে শেখালেন! এমনকি বিড়িটানাও শেখালেন!
একদিন তিনি বললেন, ওহাব মুন্সী মারা যাচ্ছেন।
আমি জানি না ওহাব মুন্সী কে? মানুষ কীভাবে মারা যায়, তা-ও আমি জানি না। আমার মনে হলো, মানুষ বোধ হয় এভাবেই মারা যায়, মৃত্যুর আগে চারদিকে খবর দিয়ে যায়। হোসেন মামা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে যাকে সামনে পেলেন, তাকেই খবরটা দিলেন, ওহাব মুন্সী মরতাছে। জবান বন্ধ অইয়া গেছে।
নানা শুনে খুব আফসোস করলেন—আহারে, ওহাব মুন্সী অনেক দিন বিছানায় পইড়া ছিলেন। অখন তয় মরতাছে। যাক, আল্লায় রহম করুক। মরণটা যেন শান্তিমতো অয়।
আসরের নামাজ পড়ে নানা তাকে দেখতে গেলেন। আমিও সঙ্গী হলাম। গিয়ে দেখি বিশাল পালংয়ের মাঝখানে লম্বা হয়ে এক লোক শুয়ে আছেন। মানুষ না বলে কাষ্ঠখণ্ড বলাই ভালো। শরীরে হাড্ডি ছাড়া মাংস কিছু নেই। একটা কাঁথা দিয়ে অর্ধেক গা ঢাকা। বুকের ছাতির হাড্ডিগুলো গোনা যায়, এমন অবস্থা। কেমন হাঁপাচ্ছেন লোকটা। চোখ ঘুরিয়ে একে-তাকে দেখছেন। রা করার শক্তি নেই। তাকে ঘিরে পরিবারের লোকজন। একজন ডাক্তারও আছেন পাশে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন, আর টানাটানি করে লাভ নেই। সবাইকে খবর দেওয়া হোক।
এ কথার অর্থও আমি তখন বুঝিনি। অসুস্থ হলে যে মানুষকে হাসপাতাল নিতে হয়, এটা অনেক পরে জেনেছি। মরতে নিলেও তো হাসপাতাল নিতে হবে। তখন সেই উপায় ছিল না। কুমিল্লার নিভৃত এক গ্রামে আমার নানার বাড়ি। রাস্তাঘাটেরও ঠিক ছিল না। যমে-মানুষে টানাটানি লাগলেও ঘর থেকে কাউকে বের করার উপায় নেই। এখন যেমন মানুষ হাসপাতালে গিয়ে আইসিইউতে মরে, তখন এমন ছিল না। মানুষ মরত ঘরেই, পরিবার-আত্মীয়-স্বজনে ঘেরা অবস্থায়।
আমি আর নানা সন্ধ্যার আগেই চলে এলাম। রাতে ভাত খেতে বসে নানির সঙ্গে নানা আলাপ করলেন, ওহাব মুন্সী মনে অয় রাইতটা টিকত না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরঘাটে মুখ ধুতে গিয়ে হোসেন মামার কাছে শুনলাম, ওহাব মুন্সী তখনো মরেনি। সেদিন সারাটা দিন আমি হোসেন মামার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম। তার সঙ্গে সকালে গরুর জন্য ঘাস কাটলাম, আড়ংয়ে গেলাম, দুপুরে ধানখেত দেখতে বিলে গেলাম, নদীতে সাঁতার কাটতে গেলাম, বিকেলে ফুটবল খেলা দেখলাম। সবখানেই একটা খবরই শুনলাম, ওহাব মুন্সী মরতাছে।
মানুষ খুব আনন্দের সঙ্গেই একে অপরকে খবরটা দেয়—শুনছ, ওহাব মুন্সী তো মরতাছে।
যে আগে থেকেই খবরটা জানে, সে আবার টিপ্পনী কেটে বলে, অহনো মরে নাই!
খবরটা আর ‘ওহাব মুন্সী মারা যাচ্ছে’-এর মধ্যে থাকল না, এখন খবর হবে—তিনি মারা গেলেন।
আমার খুব অদ্ভুত লাগল। একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, তাকে ঘিরে সারা গ্রামে আলাপ। আড়ংয়ে গিয়ে শুনেছিলাম, এক জেলে বলছিলেন, ওহাব মুন্সীর জবান বন্ধ হইয়া গেছে শুইনা আমারই জবান বন্ধ হইয়া গেছে। আড়ংয়ে আইলে কাহায় বড় মাছটা নিত। দুপুরে বিলে গিয়ে শুনেছিলাম, এক কৃষক বলছেন, ওহাব মুন্সী অহন জব বন্ধ কইরা পইড়া রইছে! আইল এক আঙুল বেশি কাটছিলাম দেইখা সারা বিল মাথায় তুলছে! যা মুখে আইছে কইছে! অহন কই গেল হেই জবান? বিকেলে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে পোলাপানের মুখে শুনেছিলাম, মেয়েমানুষ দেখলেই ওহাব মুন্সী চোখ ট্যারা কইরা চাইয়া থাকত। এখন কই গেল হেই চোখ? মাগরিবের নামাজ পড়তে নানার সঙ্গে মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব দোয়া করলেন, আল্লাহ যেন ওহাব মুন্সীকে শেফা দান করেন। আর হায়াত শেষ হয়ে গেলে যেন ভালোয় ভালোয় উঠিয়ে নেন। আর যেন কষ্ট না দেন। এই মসজিদের কাজে তিনি নানা সময় দান করেছেন। শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, একজন মানুষের কত বিচিত্র রকম চেহারা থাকে! কতজন তাকে কতভাবে বিচার করেন!
সেদিন সন্ধ্যার পর নানার সঙ্গে আবার ওহাব মুন্সীকে দেখতে গেলাম। তখন বাড়িভরা লোক। আমরা আর ঘরে ঢুকতে পারলাম না। গ্রামের লোকজন উঠানে বসে আছে ওহাব মুন্সীর মরার অপেক্ষায়। এক মুরব্বি খুব আফসোস করে বললেন, আহারে, মানুষটা মরতাছেও না। আত্মাটা কষ্ট পাইতাছে।
লোকসম্মুখেই একজন মন্তব্য করলেন, ওহাব মুন্সী যেই পাপ করছে, হেতার আত্মা বার অইব হোগা দিয়া।
বাজে কথা বলায় মাঝবয়সী লোকটিকে বকলেন এক মুরব্বি। আমার তো তখন কৌতূহলে দম বন্ধ হয়ে মরার অবস্থা। রাতে আমি হোসেন মামাকে ধরলাম, মামা, আত্মা কেন ওহাব মুন্সীর হোগা দিয়া বের হবে?
হোসেন মামা বললেন, থাউক, তুমি ছুইটকা মানুষ, কুকথায় কান দিয়া কাম নাই।
আমি ধরলাম, বলেন না...বলেন।
হোসেন মামা বললেন, তুমি বুঝবা না, তা-ও কই। যৌবনকালে ওহাব মুন্সী নানা কুকাম করছে। এই ধরো বাজারের মেয়েমানুষের কাছে গেছে।
বাজারের মেয়েমানুষ মানে কী?
এই যে কইলাম বুঝবা না!
বুঝাইয়া বলেন।
তোমার বয়স হয় নাই বুঝবা কেম্নে!
কী মুসিবত! আমি বুঝতে চাই, কিন্তু বয়সের কারণে বুঝব না। কিসের সঙ্গে কী সম্পর্ক, তা–ও জানি না। এতটুকু বুঝলাম যে ওহাব মুন্সী কিছু খারাপ কাজ করেছেন। তাই তার আত্মা বের হবে পায়খানার রাস্তা দিয়ে। আরও শুনলাম, পুণ্যবান মানুষের আত্মা নাকি বের হয় মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে, কারও নাকি চোখ দিয়েও! একটা মৃত্যু ঘিরে যা শিক্ষা পেলাম, তা আমার বয়স অনেক বাড়িয়ে দিল।
পরদিন শুনলাম, ওহাব মুন্সী তখনো মরেননি। সেদিন সারা দিন আমরা ওহাব মুন্সীর বাড়িতে। সারা গ্রামে একটা উৎসব শুরু হয়েছে। নারীরা বাচ্চা কোলে দূর দূর থেকে আসছে ওহাব মুন্সী কীভাবে মারা যাচ্ছেন, সেটা দেখার জন্য। জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ওহাব মুন্সীর ছেলেমেয়েরা যতটা পারছে লোকজন তাড়াচ্ছে। লোকজনের কাছে ওহাব মুন্সীর কিছু ভালো কথাও শুনলাম। কার কার বিপদে নাকি তিনি সাহায্য করেছেন। কাকে গোপনে টাকা দিয়েছেন। বিপদে তার কাছে হাত পেতে কেউ কোনো দিন নিরাশ হয়নি। মানুষটা বদমেজাজি, বদ স্বভাবের থাকলেও দিলদরিয়া ছিলেন।
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, শুধু বুঝতে পারছিলাম, ওহাব মুন্সী মারা যাচ্ছেন, আর এই গ্রামে তিনি অনেক দিন ধরে বেঁচে ছিলেন। তাকে সবাই চেনে। বেশ বিখ্যাত লোক। মরতে বসে এখন আরও বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তার বাড়ি ঘিরে লোকের জমায়েত দেখে কোত্থেকে এক আইসক্রিমওয়ালা আর মুড়ালিওয়ালা এসে বসেছে। পোলাপান আইসক্রিম আর মুড়ালি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। বড় মানুষেরাও দেখি বসে বসে আইসক্রিম ও মুড়ালি খাচ্ছে। আমিও একটা আইসক্রিম খেলাম।
আমরা ওহাব মুন্সীর বাড়ির আশপাশেই ঘুরঘুর করছিলাম। ছেলেরা এটা-সেটা খেলছিলাম। নারী-পুরুষেরা যার যার কাজ করছিল। কেউ বসে জাল বুনছিল। কেউ বসে কাঁথা সেলাই করছিল। নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল জগৎ-জীবনের সব কিছু নিয়ে। একদল চলে যেতেই আরেক দল আসছিল। ফলে ভিড়টা সব সময় একই রকম ছিল। হঠাৎ হঠাৎ শুনি, এই তো ওহাব মুন্সী মারা যাচ্ছেন। আর আমরা হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাই। মৌমাছির মতো সবাই গিয়ে ওহাব মুন্সীর বাড়ি ঘিরে ধরি। ভালো করে দেখার জন্য অনেকে গাছে, ঘরের চালে পর্যন্ত উঠে বসে। জানালা দিয়ে, দরজা দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, এর-তার কাছে যা শুনি, এই তো ওহাব মুন্সী মারা যাচ্ছেন, দম গেল বলে। কিন্তু দম আর যাচ্ছে না। ডাক্তার আসছেন। হুজুর এসে আগেই তওবা পড়িয়ে গেছেন। তা-ও কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেককে দেখলাম, ওহাব মুন্সীর মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিরক্তও হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাড়ির লোকজন। তাদের কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরমতো এক নারীকে প্রায়ই দেখতাম, নাচতে নাচতে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাচ্ছে, পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারছে হাঁটতে হাঁটতেই, আর গজগজ করছে, বুইড়া সারা জীবন জ্বালাইছে, মরার সময়ও জ্বালাইতাছে। মরতে বইসাও মরে না।
শুনেছিলাম, সেই সুন্দরী নারী ওহাব মুন্সীর দ্বিতীয় ঘরের মেজ ছেলের বউ। ওহাব মুন্সী দুটো বিয়ে করেছিলেন। দুই ঘরে তার বেশ কজন ছেলেমেয়ে, আট-দশজনের ওপর তো হবেই। তারা বেশ বড় বড়, নাতি-নাতনি মিলিয়ে বাড়িভরা লোক। মৃত্যুমুহূর্তে সবাই এসে হাজির হয়েছে। বাড়িতে প্রায় জিয়াফত লেগে গেছে। ডেগ ডেগ খাবার রান্না হচ্ছে। বাইরের লোকজন সুযোগ পেলে খেয়ে নিচ্ছে। বেশ একটা উৎসব–উৎসব ব্যাপার।
এর মধ্যে ওহাব মুন্সীর কবরও খোঁড়া হলো। হোসেন মামার কাছেই শুনলাম, কবর খুঁড়ে রাখলে নাকি তাড়াতাড়ি মৃত্যু হবে। কিন্তু তিন দিন চলে গেল তার মৃত্যুর লক্ষণ নেই। বরং কিছুটা যেন তরতাজা হয়ে উঠছেন বলে শুনলাম। তিন দিন পর আমি হোসেন মামার সঙ্গে তাকে দেখতে গেলাম। বিকেলবেলা। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছি, দেখি, তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। কী রকম অন্ধকার দুটো চোখ! আমি এমন ভয় পেলাম যে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এলাম।
সে রাতেই ওহাব মুন্সী মারা গেলেন। পরদিন তার জানাজায় প্রচুর লোক হয়েছিল। আমিও জানাজা পড়তে গিয়েছিলাম নানার সঙ্গে। শুনলাম, লোকজন বলাবলি করছে, আল্লাহ বোধ হয় ওহাব মুন্সীকে মাফ করেছেন। পাপের শাস্তি হয়তো দুনিয়াতেই দিয়েছেন। তার আত্মা কোন দিক দিয়ে বেরিয়েছে, এটা আর শুনতে পারিনি।
শুধু মনে আছে, ওই বিকেলে দেখা তার সেই চোখ দুটোর কথা—কী ভাবলেশহীন, শূন্য দুটো চোখ!