কেন মেয়েটি ম বগির টিকিট চেয়েছিল

‘ম বগির একটা টিকেট দ্যান।’

স্টেশনমাস্টার রহমত আলী প্রথমে ভড়কে যায়। গলাটা খুব চড়া। একটা ধমকের সুর ছিল। তার চেয়ে বড় কথা রেলের টিকিট করতে কেউ বগির নাম ধরে বলে না। এসি, নন-এসি এই সব ক্যাটাগরি বলে।

‘কী হলো, ম বগির টিকেট নাই?’

‘না।’

‘শ্যাষ?’

‘ম বগি নাই।’

‘মানে?’

‘রেলে ম বগি থাকে না। বড়জোর ড–ঢ পর্যন্ত।’

‘ড দিয়া কি ডাব? ঢ দিয়া ঢোল?’

মেয়েটি মুখ ভেংচিয়ে কাউন্টার থেকে সরে যায়। রহমত মাথা উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। আলুথালু শরীর। শাড়িটা আলগোছে কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। গায়ের রং মিডিয়াম। স্বাস্থ্য ভালো। রহমত এত ডিটেইল খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করত না। কিন্তু দেখতে হচ্ছে। কারণ, মেয়েটা সন্দেহজনক। রহমতের দুটো সন্দেহ। এক. সে খারাপ মেয়েছেলে। দুই. সে সিআইডির লোক।

প্রথম সন্দেহটা নিয়ে রহমত ভাবতে শুরু করে। মেয়েটার বেশভূষা খুব একটা সে রকম না হলেও কথা বলার ধরন, হাতে চুড়িটুড়ি যেভাবে পরেছে, মুখেও যে রং-পাউডার মেখেছে, তাতে একটু সন্দেহ করাও যায়। আর ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যখন নাড়াচাড়া করছিল, তখন চটচট আওয়াজ হয়েছে। একটু প্লাস্টিকের মতো। কনডমের প্যাকেট হতে পারে। এই টাইপের মেয়েরা অনেক সময় কনডমের প্যাকেট নিয়ে ঘোরে।

মেয়েটা এখনো রহমতের দৃষ্টিসীমায় আছে। এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। রহমত লক্ষ করল, মেয়েটার পায়ে একটা চপ্পল। পায়ে আলতাও লাগানো। ভারী নূপুর। রাস্তার খারাপ মেয়েরা বেশির ভাগ সময় খালি পায়ে থাকে। বড়জোর চপ্পল-টপ্পল পরে। কাজ শেষে তাড়াহুড়োর মধ্যে জুতা-স্যান্ডেল নেওয়ার সময় থাকে না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তবে আরেকটা কারণ আছে। তারা এমনিতেই কিছু কিছু চিহ্ন রাখে, যেগুলো দিয়ে বোঝা যাবে যে তারা বিশেষ কিছু। স্পেশাল। একবার শহরের চিপা গলিটার মুখে রাত্রিবেলা এক মেয়ে রহমতের চামড়ার স্যান্ডেলটা নিয়ে চলে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার পথে রহমত পেরেশান হয়ে একটু বসেছিল। সেদিন সন্ধ্যা থেকে ঝুম বৃষ্টি। বাসায় গিয়ে খেয়ে আসবে। রাতে ফের ডিউটি আছে। গলির শেষ মাথার বন্ধ দোকানের সামনেটায় একটা বেঞ্চিতে রহমত বসেছিল আধভেজা হয়ে। একটা সিগারেট ফুঁকছিল। এমন সময় মেয়েটা এসে বেঞ্চির কোনায় বসল। রহমতকে অবাক করে দিয়ে সে–ও একটা সিগারেট ধরাল। যাবার সময় রহমতের স্যান্ডেল জোড়া নিয়ে গেল। রহমত বলে, এটা তো ছেলেদের জুতা। আমার কি ছেলেপেুলে নাই নাকি? একগাল হেসে মেয়েটা চলে গিয়েছিল।

কিন্তু সমস্যা হলো, এই মেয়ের মধ্যে অস্থিরতা নেই। তাকানোর মধ্যে একটা ধীরস্থির ব্যাপার আছে। খারাপ মেয়েরা সে রকম হয় না। তাদের চোখ থাকে অস্থির। হাসি থাকে খুব কৃত্রিম। রহমতের দিকে দূর থেকে তাকিয়ে মেয়েটা একবার হাসলে সে দেখতে পায়, তার হাসিটা সাবলীল। একদম ফ্রেশ। নাহ, মাথাটাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় পয়েন্টটা নিয়ে ভাবতে শুরু করল রহমত। সে শুনেছে, সিআইডির লোক নানান বেশ ধরে কাজ করে। হতে পারে কোনো মহিলা সিআইডি। ভাবতেই রহমতের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। যদিও রহমতের ভয়ের কারণ নেই। ক্রাইম-টাইমের ধারেকাছেও সে নেই। স্টেশনের সবাই তা জানে। শহরেও তার বদনাম নেই। শুধু টিকিটের দালালি করেই চাইলে ম্যালা টাকা করতে পারত। তা সে করেনি। ঘণ্টাবাদক ইদ্রিসও টুকটাক করে কিছু টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। সিআইডির লোক দোকানদার, রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সি ড্রাইভার—নানা রূপ ধরে শুনেছে। কিন্তু এ রকম রংঢংওয়ালা একটা মেয়ের সাজে আসবে, এত দূর বিশ্বাস হয় না। অবশ্য হতেও পারে। ক্রাইমের ধরনধারণ যদি এত পাল্টায়, তাকে ধরার কারিকুরি তো বাড়বেই। কিন্তু কথা হলো, এই স্টেশনে সিআইডি আসবে কেন? এসে রহমতের সঙ্গে তাদের কী! রহমত তো আর ব্যাংক লুট করেনি। কারও টাকা মেরে খায়নি। রহমতের কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই যে উল্টাপাল্টা কিছু লিখবে। একবার এক বন্ধু তার অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। প্রোফাইলে ছবি দিয়েছিল রহমতের বউয়ের। রহমত তার এহেন ফাজলামিতে অপমান বোধ করে। পরে আরেকজনকে বলে বন্ধ করে ফেলে অ্যাকাউন্টটা। কিন্তু ট্রেনের রেগুলার কোনো প্যাসেঞ্জার এভাবে এসে স্টেশনমাস্টারের কাছে বগির নাম ধরে টিকিট চাইতে পারে না। চাইলেও ম বগি বলবে কেন? যেটা কোনো ট্রেনেই নেই! তাহলে বিষয় কী? রহমত ভাবতে চেষ্টা করে। চাকরিজীবনে তার নামে কখনো কোনো মামলা হয়নি। সে রকম কোনো কেসও নেই। এই স্টেশনে তার কলিগ মোশাররফ। সে খুব একটা সুবিধার নয়। বছরের অনেক দিন এটা–সেটা বলে ছুটি কাটায়। কই জানি চলে যায়। কই গিয়ে কী গোলমাল বাধিয়ে এসেছে কে জানে!

‘জ বগির টিকেট আছে?’

‘জ?’

‘জি।’

‘আচ্ছা, আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’

‘কী?’

‘রেলের সব বগিই সমান। খালি এসি আর নন–এসি আলাদা। আপনি কি এসি বগি চাচ্ছেন?’

‘এসি?’

ভুরু কুঁচকে মেয়েটা এমনভাবে বলে যেন এসি কী সেটাই সে জানে না। এটা ভান নাকি সত্যি! সিআইডির লোক হলে এ রকম করতে পারে। আর ওই টাইপ মেয়ে হলেও করতে পারে। ওরা হলো ভানের দিঘি। সারা অঙ্গে ভান টলমল করে।

‘জ বগিও নাই?’

‘জ বগিতে কী?’

‘জিন্দেগি। হা হা হা।’

মেয়েটা অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে। তার হাসি আর থামেই না। রহমত বিব্রত হয়। ইদ্রিস দরজার আড়াল থেকে দেখছে। এর স্বভাব ভালো না। এই হাসাহাসির গল্প আর পাঁচ-দশটা জায়গায় বয়ান না করলে তার ভাত হজম হবে না।

‘আসলে আপা, এখন কাউন্টারে টিকেট থাকেই না। অনলাইন চালু হওয়ার পর বেশির ভাগ টিকেট অনলাইনেই চলে যায়। কাউন্টারে যা থাকে, তা দুই-এক দিনেই শেষ।’

‘তাইলে কী করব?’

‘আপনে যাইবেন কই?’

‘মানুষ কই যায়?’

রহমত একটু চমকে ওঠে,Ñকথাটা শুনে নয়, তার বলার ধরন আর চোখের তীক্ষ্ণ তাকানোটা দেখে। মেয়েটা আসলে কে? কাউকে ডেকে যে জিজ্ঞেস করবে, তা–ও হয় না। গল্প বানাবে লোকজন। বলবে, মিয়া, কাহিনি নিজে কইরা ফালাইছ, এখন ন্যাকা, না? ইদ্রিস খালি কাশে। তার মানে, সে গল্পের একটা প্যারা মনে মনে লিখে ফেলেছে। রহমত একবার রাগী চোখে তাকালে সে চলে যেতে থাকে। রহমত ডাকে।

‘ইদ্রিস।’

‘জি স্যার।’

‘তোমার কাছে টিকেট আছে?’

‘ছুটি তো পাইতেছি না স্যার। পাইলে তো দেশে যাইতামই। এখন কিয়ের টিকেট থাকব?’

‘কথা প্যাঁচাইবা না, বুঝছ। রাখছ কি না কও?’

‘জি না স্যার।’

‘যাও, ঘণ্টা বাজাও।’

ইদ্রিস চলে যায়। মেয়েটার হাতে পাঁচ শ টাকার একটা নোট। সে নোটটা দেখিয়ে রহমতকে বোঝাতে চাচ্ছে, তার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে। সে রহমতকে খুশি করবে।

‘স্ট্যান্ডিং নিয়ে নেন।’

‘স্ট্যান্ডিং কি ম বগিতে আছে?’

‘ম নাই।’

এবার রহমত রীতিমতো বিরক্তও হয়। এই বিরক্তি ঠিক মেয়েটার ওপর না, সে যে তাকে বুঝে উঠতে পারছে না, বিরক্তিটা এই কারণে।

‘দাঁড়ায়া যাব?’

‘জি। তবে কপাল ভালো থাকলে পায়াও যাইতে পারেন। অ্যাটেনডেন্সরে বইলেন।’

‘আপনেগো কি সব ইংলিশ? এসি, স্ট্যান্ডিং, অ্যাটেনডেন... দেশ তো এক্কেরে ইংলিশদেশ কইরা ফালাইছেন! দ্যান, একটা ইস্টেন্ডিং টিকেটই দ্যান। আপনের নাম কয়া কারও সিটে বইসা পড়ব। ও, কী নাম জানি আপনের?’

‘রহমত আলী।’

রহমতের সন্দেহ এবার দুই নম্বর পয়েন্টে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। বাজে মেয়েছেলের কারও নামধামে কাম থাকার কথা না। তাহলে কি সিআইডি...? মোশাররফ কি কোনো কুকাম কইরা আসছে? নাকি ওই রাতের ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েছেলের সাথে শোয়াশুয়ি নিয়ে সিআইডি কি সার্চ করবে? সে তো আর ডোনাল্ড ট্রাম্প না।

‘দ্যান!’

টিকিটটা নিয়ে পাঁচ শ টাকার একটা নোট তার হাতে দেয় মেয়েটা। রহমত বাকি টাকা ফেরত দিতে গেলে মেয়েটা বলে, ‘লাগবে না। ছেলেমেয়ের লিগা কিছু কিনা নিয়েন।’

‘ন্ না না!’

‘রাখেন না ভাই। মন চাইছে।’

রহমত অস্বস্তিতে পড়ে।

‘আইচ্ছা ভাই, ট্রেইনে কি আসলেই ম বগি নাই?’

উত্তরের আশা না করে টিকিটটা ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে মেয়েটা কিছু দূর গিয়ে দাঁড়ায়। মুঠোফোনে একবার নিজের ছবি তোলে। সেলফি। ফোনে কল আসে। সে রিসিভ করে। তার কথা দূর থেকে শোনা যায় না। তবে সে রেগেমেগে কী জানি বলছে। এ মেয়ে সবাইকে ধমক দিয়ে কথা বলে নাকি! কথা বলতে বলতে মেয়েটা অন্যদিকে চলে যায়। রহমত কষ্টেমষ্টে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সে আপাতত তার দৃষ্টিসীমার বাইরে। ইদ্রিস তাকে লক্ষ করছে। রহমত টের পায়। একবার গলাখাঁকারি দেয়। ইদ্রিস বিব্রত হয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আরেক প্যাসেঞ্জার আসে। রহমত বলে, ‘টিকেট নাই। কোনো গাড়ির কোনো টিকেট নাই।’

‘সব বেলেকে দিয়া দিছেন?’

রহমত রেগে তাকালে লোকটা চলে যায়।

মেয়েটা কথা বলতে বলতে আবার আসে। কার সাথে এত কথা! জামাই? হতে পারে। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে নাকি? দিনের বেলা বিয়ের আসর হবে কীভাবে! না, হতে পারে কাল রাতে বাসরঘর থেকে পালিয়েছে। কোথাও লুকিয়ে ছিল। এখন ট্রেনের সময় ধরে এখানে এসেছে। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে পালিয়ে আসার সে রকম ভয়ডর তো দেখা যায়নি। চোখে কোনো চোরামি ছিল না।

মেয়েটা কাঁদছে। রহমত দেখে, মেয়েটা স্টেশনের দেয়াল ঘেঁষে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। রহমত খানিক অসহায় বোধ করে মেয়েটার জন্য। লোকজন পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। কোথাও গিয়ে গোপনে কাঁদতে পারত। তার চোখের সামনে এসে কাঁদছে কেন! মেয়েটা কি রহমতের কাছে কোনো সাহায্য চায়? ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। রহমত সংবিৎ ফিরে পায়। তার রোজকার কাজে মন দেয়। যাত্রীদের হুলুস্থুল লেগে যায়। মেয়েটা ওভাবেই বসে থাকে। রহমত তাকে ডেকে বলবে যে ট্রেন এসেছে, তার আগেই মেয়েটা চমকে তাকায় ট্রেনের দিকে। সে ট্রেনের দিকে ছুটে যেতে থাকে। রহমত তার রুম থেকে বের হয়। দাঁড়িয়ে দেখে। মেয়েটা দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে ওঠে। রহমত একবার বলতে চেয়েছিল, ট্রেন তিন-চার মিনিট থাকবে, দৌড়ানোর কিছু নেই। ট্রেন ছেড়ে গেলে রহমতের বুকের ভেতরটা কেন জানি খালি খালি লাগে। ইদ্রিস তাকে আড়চোখে দেখতে দেখতে অন্যদিকে চলে গেল। রহমত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে। ট্রেন যে কত বিচিত্র মানুষকে নিয়ে যায়।

সেই রাতে আধো স্বপ্নে চেনা না চেনার মতো করে রহমত বোধ হয় মেয়েটাকে একবার দেখল। বৃষ্টি হচ্ছিল। মেয়েটা স্বপ্নে কাঁদছিল কি না, কে জানে! টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মেয়েটার কান্না ঠিকঠাক শোনা যায়নি।

পরের দিন স্টেশনে আসতে একটু দেরিই হয়ে যায় রহমতের। ঘুম ঠিকমতো হয়নি। পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে ইদ্রিস। রহমত আসামাত্র সে পত্রিকাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘স্যার! লাস্ট পাতাটা পইড়েন। খবর আছে!’

রহমত তার দিকে একবার তাকিয়ে পত্রিকা নিয়ে নিজের টেবিলে চলে যায়। পত্রিকাটা মেলে শেষ পাতায় চোখ বোলায়।

‘ট্রেন থেকে লাফিয়ে যুবতীর আত্মহত্যা।’

ছবিটার দিকে তাকায় রহমত। মেয়েটিকে চিনতে তার অসুবিধা হয় না। শরীরটা যেন অসাড় হয়ে আসে। নিশ্চুপ বসে থাকে রহমত।

‘স্যার, ওই মেয়েটা কি আপনের পরিচিত ছিল?’

ইদ্রিসের দিকে তাকিয়ে রহমত নিজের অজান্তেই না-সূচক মাথা নাড়ায়।

‘ইদ্রিস!’

‘জি স্যার।’

‘মেয়েটা খালি ম বগির টিকেট খুঁজছিল, বুঝছ! আমি কই ম তো কোনো বগি নাই। সে বলে, নাই ক্যান? আচ্ছা ইদ্রিস, ম দিয়া আসলে কী? দুর! তোমারে জিজ্ঞাস করছি, তুমি ক্যামনে বলবা!’

ইদ্রিস চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে আসে। রহমত পত্রিকাটার ওপর তখনো ঝুঁকে ছিল।

‘স্যার!’

রহমত ইদ্রিসের দিকে তাকায়।

‘ম দিয়া মরণ।’