সম্পর্ক

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আরে, কে এইটা! শহিদুল না? শহিদুল না হয়ে যায়ই না। শহিদুলকে চিনব না, তা হয় না।

ও কারওয়ানবাজারে কী করে? কোনো কাজে এসেছে বোধ হয়। ওর পেছন পেছন হাঁটা ধরলাম। পেছন থেকে চোখ চেপে ধরব, যেমন করে ধরতাম ছোটবেলায়, ও নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারবে না, কে!

রাস্তা পেরিয়ে শহিদুল একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। দুপুরবেলা। ও ভাত খেতে ঢুকেছে নিশ্চয়ই। এখন গেলে বিলটা আমাকেই দিতে হবে। আমার অফিস যেহেতু এই অঞ্চলেই।

মাসের শেষ। আমার পকেটে আছে দেড়-দু শ টাকা। দুজন খেতে গেলে পাঁচ শ টাকার কমে হবে না। আমিও কিছু খেতেই নিচে নেমেছি। পাশের এক টি–স্টলে ঢুকলাম। এখান থেকে শহিদুলকেও খেয়াল রাখা যাবে, কখন বেরোয়। বেরোলেই ধরব।

মেট্রোরেলে উঠব বলে আমি সামনে এগিয়ে যাই। দেখি, এক বিল্ডিংয়ের নিচে শহিদুল দাঁড়িয়ে আছে। আমার ইচ্ছা করে, শহিদুলের কাছে যাই, গিয়ে বলি, কী রে, হারামি, কী করছ এরো খাড়াইয়া!

কলা-রুটি খেয়ে চায়ের অর্ডার দিলাম। শহিদুল আমার জ্যাঠাতো ভাই। তিন বছর হলো ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। করোনার সময় প্রায়ই ভিডিও কল দিত। আমি বিরক্ত হতাম। অনলাইন দেখলেই হয়েছে, রাত–দিন নেই, যখন-তখন কল করে বসত। অনেক সময় ধরতাম না। কী আর বলব ওর সঙ্গে এত কথা! মাথামোটা লোকেদের সঙ্গে এমনিতেও আমার খুব বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না। তা–ও সম্পর্কের জোরেই কিছু কথাবার্তা বলতাম। ও জিজ্ঞেস করত, বাড়িতে যাই না কেন? গ্রামের কী কী পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যে—সব বলত। বলতাম, পরিস্থিতি একটু ঠিক হলে এবার যাব। ওর কথায় গ্রামের স্মৃতি ফিরে আসত, শীত এলে যেমন করে ফিরে আসে পরিযায়ী পাখি।

গ্রাম ছেড়েছি ছোটবেলায়। গ্রামে লেখাপড়ার পরিবেশ ভালো ছিল না। তা ছাড়া আব্বা একা থাকতেন ঢাকায়, মেসে, কষ্ট হতো, খাওয়াদাওয়ার; তাই পুরো পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। ঢাকায় এসে আমি নাইনে ভর্তি হলাম নারিন্দা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। তার পর থেকেই একরকম গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন। একসময় বছর বছর যেতাম, আস্তে আস্তে সময়ের দূরত্ব বাড়তে লাগল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যেতাম দু–চার বছর পরপর; তখনো দাদি বেঁচে ছিলেন বলেই যাওয়া; তারপর, দাদি মারা যাওয়ার পর এবং আমিও চাকরি–বাকরিতে ঢুকে যাওয়ার পর, আমার সংসারজীবন শুরু করার পর, আট-দশ বছর আর যাওয়া হয়নি।

করোনাকালে গৃহবন্দী হয়ে থাকার সময় বাড়ির কথা খুব মনে পড়ত। ইচ্ছা করত, এক্ষুনি বাড়িতে ছুটে যাই, পুকুরে নেমে সারা দুপুর সাঁতরাই, পাঁচ নম্বর ডিয়ার বলটা নিয়ে বৃষ্টিভেজা মাঠে দৌড়াই আর শহিদুল, হামিদুল, মোসাদ্দেক, মহসিন, রাশেদ, রেজা, দীপু, রুমিদের সঙ্গে দিনভর, রাতভর আড্ডা দিই। যদিও ওরা কে কোথায় আছে, জানতাম না।

শহিদুলই আমাকে খুঁজে বের করে ফেসবুকে, খোঁজ দেয় অন্যদের; হামিদুল আর মোসাদ্দেক আছে সৌদিতে; রাশেদ গেছে ইতালিতে; দীপু, রুমির খোঁজ নেই; রেজা থাকে ঢাকাতেই, সাভারে কী একটা কোম্পানিতে চাকরি করে; শহিদুলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে রেজাকে তখনই আমি একবার কল করেছিলাম; বলেছিলাম, বেঁচে থাকলে দেখা হবে। বেঁচে আছি দুজনই; কিন্তু, দেখা হয়নি আর।

ভিডিও কল দিয়ে শহিদুল নানা কথা বলত, দেশ–গ্রাম, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কথা। পাঁচ-সাত দিন আমার ভালোই লাগে। পরে বিরক্তি ধরে যায়। নিজের জীবন নিয়েই তখন নানা সংকট। করোনার মাঝামাঝি চাকরিটা চলে যায়। ধারদেনা করে চলতে হয়। স্বামীবাগের তিন রুমের বড় বাসাটা পাল্টে তখন সেই মানিকনগরে গিয়ে দুই রুমের ছোট্ট একটা বাসা নিতে বাধ্য হই। করোনার আগেই আব্বা মারা গিয়েছিলেন, ফলে দুই রুমেই হয়ে যায়; এক রুমে আমি আর সুরাইয়া থাকি ছেলেটাকে নিয়ে, অন্য রুমে মা থাকে সুমাইয়াকে নিয়ে।

চাকরি গেলেও এদিক-ওদিক নানা রকম লেখালেখি করে আমার চলছিল কোনোরকম। এর মধ্যে শহিদুল ভিডিও কল দিয়ে একদিন ওর নিকেতনের বাসা দেখাতে লাগল। বিরাট বাসা, চারটা রুম, দুটো বারান্দা, বিরাট রান্নাঘর। রাতদুপুরে আমি লিখতে বসেছিলাম, ভাবলাম, কেন ফেসবুকে ঢুকলাম আর শহিদুলই-বা কী শুরু করল!

গুলশানে একটা বিদেশি কোম্পানিতে স্টোররুমে চাকরি করে শহিদুল। লকডাউনে বাড়িতে বসে থাকলেও ঠিকমতো বেতন পায়, তবে আলগা ইনকাম নাকি কমে গেছে! আলগা ইনকাম কী রকম? ও বলে, ‘এত লেখাপড়া শিখ্যা কী করলি! তোরার মতো লেখাপড়া জানলে ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি কইরা ফেলতাম।’

শহিদুলের মধ্যে একটু দেখানো স্বভাব আছে ছোটবেলা থেকেই। একটা নতুন শার্ট গায়ে দিলেও গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটত। মনে আছে, ঈদের সময় একবার নতুন কেড্স পরে সারা দিন জুতার দিকে তাকিয়ে হাঁটল। মোটাবুদ্ধির লোক হলে যা হয়! এই জন্যই আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ওদের সঙ্গ খুব একটা ভালো লাগত না। বাড়িতে যেতাম না কী আর সাধে!

ইন্টার পাস করে শহিদুল আর লেখাপড়া করেনি। ও ফুলেফেঁপে উঠেছে—এ খবর আগেই জানতাম। চুরি না করে ঢাকা শহরে শহিদুলের মতো ছেলের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার আর কী উপায় আছে! আর আমি দু–পয়সার সাংবাদিক, তা–ও তখন চাকরি নেই। আব্বা মারা যাওয়ার পর জায়গাজমি ভাগাভাগি নিয়ে আমাদের কিছু ঝামেলাও হয়েছিল, ফলে সে রাতে আমাকে কেমন যেন এক রিরংসায় পেয়ে গেল। ওর বাসাটাসা দেখে, ওর দেখানো ভাব দেখে আমি বললাম, আব্বা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে দুবছর বিছানায় পড়ে রইল, একদিন দেখতে এলি না? একদিন একটা ফোন দিলি না?

আব্বার লাশ গ্রামে নিয়ে যাওয়ার পর ও অবশ্য বাড়ি গিয়েছিল, কবরস্থানে লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় ও আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, কাকারে আমি একবার দেখতে গেলাম না কেরে, জানি না। কেরে আমি গেলাম না!

আমি আর কিছু বলিনি তখন। ঢাকায় আমাদের বাসায় থেকেই শহিদুল ইন্টার পাস করেছিল। আব্বা ছিলেন তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট। ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের তিনি নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন। এমনও শুনেছি, ভাতিজা-ভাতিজির টানে তিনি বিয়েও করতে চাননি। ঢাকায় থেকেও যে আমাদের পরিবারটা আর দাঁড়াতে পারল না, তার কারণ ওই ভাতিজা-ভাতিজি টানতে গিয়েই আব্বার কোমর ভেঙে গিয়েছিল।

তো সে রাতে আমি শহিদুলের ওপর সব ঝাল ঝাড়লাম, এত দিন একটা খবর নেই, এখন অনলাইন দেখলেই কল করছ! আমি ব্যস্ত কি না, তা না জাইনাই বাসা দেখাইতে শুরু করছস! আমার মা–বাপে কি কম করছে তোর জন্য! না আসস, একবার ফোন করলেও তো পারতি! এহন আমারে দুই দিন পরপর ফোন করছ কী মনে কইরা!

আরও কী কী বলেছিলাম মনে নেই। শহিদুল ম্লান হেসে বলেছিল, ‘চিকন একটা বাঁশ দিয়া দিলি রে!’

তারপর শহিদুল আমাকে ফেসবুকে ব্লক করে দেয়। আর ওর চেহারাও দেখি না। করোনার পর আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। জ্যেঠির কাছে শুনলাম, শহিদুল নাকি এখন বাড়িতেও যায় না ঠিকমতো। দু–চার মাস পরপর চাইলে কিছু টাকা পাঠায়।

শহিদুলকে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেও আমার ভেতর একটু আগের টানটা আর থাকে না। ওর সঙ্গে আর দেখা করতে ইচ্ছা করে না। গলিটা পেরিয়ে ও একদিকে চলে যায়, আমিও অফিসে চলে আসি।

দুদিন পর সন্ধ্যায় ওকে আবার দেখি কারওয়ান বাজার মোড়ে, ফুটপাতে কাপড় বেচার দোকানে কাপড় দেখছে। ও আবার এখানে কেন? কোনো বন্ধুর সঙ্গে কি দেখা করতে এসেছে? ভাবি, আজ দেখা হতে পারে, টি–স্টলে বসে একটু চা-টা খেলাম, খবরটবর নিলাম। একটু এগিয়েই আমার মনে হয়, দোকানটা আসলে ওরই। কাপড় ভাঁজ করার ভঙ্গি দেখেই এটা আমার মনে হয়। একটু অপেক্ষা করে দেখি, টালি খাতা খুলে ও কী দেখছে।

আমি আর না এগিয়ে পেছাই। ভাবি, ও হয়তো লজ্জা পাবে। ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা যে ছোট কাজ, তা নয়, কিন্তু, ওর যে হামবড়া ভাব, সব সময় নিজেকে বড় করে দেখাতে চায়, নিজের এই সামাজিক অবস্থার পতনে হয়তো আমার সামনে সংকোচ বোধ করবে।

আমি বাসায় চলে যাই। সকালে অফিসে যাওয়ার পথেও ওকে দেখি, গলায় কাপড় মাপার ফিতা ঝুলিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চাকরিটা গেল কী করে! এখন কোথায় থাকে! গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু, আমি নিজেকে আড়াল করে অফিসে চলে যাই।

ওর দোকানটা যেখানে, আমরা সে মোড়েই চা-টা খেতে যাই, অফিসের কলিগরাসহ। আমি দু–চার দিন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু মাহফুজ আর রিপন ভাই জোরাজুরি করলে না গিয়েও পারি না। টি–স্টলের এককোনায় বসে ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে আমি শহিদুলকে দেখি, কাস্টমারদের কাপড় দেখাচ্ছে, কাপড় মেপে দেখাচ্ছে, দামাদামি করছে; কেমন বয়সের ছাপ পড়ে গেছে ওর চোখে–মুখে, ক্লান্ত; দাড়ি কাটে না কদিন! কী অবস্থা ওর বাসার? মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। শুনেছি সে কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কেমন চলছে এখন শহিদুলের সংসার? এই ব্যবসায় চলে? না, চলার কথা নয়। সামনে ঈদ। ভালোই আয় বোধ হয়। অন্তত আমার চেয়ে তো ভালো। গত মাসে আমার বেতন হয়নি, এ মাসেও কবে হবে, জানি না। পত্রিকাগুলোর অবস্থা খারাপ, বেশির ভাগ পত্রিকা অফিসেই এখন নিয়মিত বেতন হয় না। এ বয়সে আর কোথায় যাব চাকরির খোঁজে? হয়তো ওর মতো ফুটপাতে একটা কাপড়ের দোকান নিয়ে বসাই ভালো।

একদিন অফিসে যাওয়ার পথে দেখি, কারওয়ান বাজার মোড় একেবারে ছাফা ফকফকা। ফুটপাতের দোকান তো বটেই, গলির ভেতরের দোকানগুলো পর্যন্ত নেই। কী ব্যাপার! শুনি, হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে নাকি কোন হোমরাচোমরা আসবেন। শহিদুলের জন্য খারাপ লাগে। দোকান উঠিয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে। আর কি বসার সুযোগ পাবে?

শহিদুলের নম্বরটা নেই। থাকলে কল করে খবর নিতাম। ভাবি, এরপর দেখা হলে কথা বলব।

দুদিন পর আবার ফুটপাতের দোকানগুলো আগের মতোই যার যার জায়গায় বসে পড়ে। শহিদুলকেও দেখি। কিন্তু, কেন যেন আমার আবার ওর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করে না। নিজেকে আড়াল করে আমি অফিসে যাই-আসি। ফুটপাত দিয়ে গেলে যদি মুখোমুখি পড়ি, এই জন্য রাস্তায় নেমে যাই। তা–ও দু–একবার ফুটপাত দিয়ে যেতেই হয়, রাস্তায় ভিড় বেশি থাকলে। দু–একবার ওর পাশ দিয়েই যাই, হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে। একবার ও আমার দিকে তাকিয়েও চিনতে পারে না। নাকি চিনেও না চেনার ভান করে!

ছোটবেলায় কী মধুর সম্পর্ক ছিল শহিদুলের সঙ্গে! চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাই হলেও আমরা সমবয়সী, একই বিছানায় ঘুমিয়েছি, গলাগলি করে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঘুরেছি, ঝগড়াঝাটি, মারামারিও করেছি। আমাদের বাসায় থাকার সময়ই একবার রাগ করে শহিদুলের সঙ্গে মাসখানেক কথা বলিনি। মা জানতে পেরে আমাদের দুই ভাইকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। মিল হওয়ার পর দুই ভাইয়ের সে কী পিরিত! সারা দিন সারা শহর ঘুরে নীলক্ষেত থেকে বিরিয়ানি খেয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরেছিলাম বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ভিজতে ভিজতে।

বর্ষাটা এবার খুব দ্রুতই শুরু হলো। মার্চ মাস থেকেই নিয়মিত বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে ফুটপাতের দোকানগুলো বন্ধ রাখতে হয়। একদিন সন্ধ্যার পর বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় হেঁটে যেতে যেতে শহিদুলের দোকানের দিকে তাকাই, দেখি, শহিদুল নেই। মেট্রোরেলে উঠব বলে আমি সামনে এগিয়ে যাই। দেখি, এক বিল্ডিংয়ের নিচে শহিদুল দাঁড়িয়ে আছে। আমার ইচ্ছা করে, শহিদুলের কাছে যাই, গিয়ে বলি, কী রে, হারামি, কী করছ এরো খাড়াইয়া! আয়, নীলক্ষেতে গিয়া বিরানি খাইয়া হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টিতে ভিজি।