ক্যাফে মনোলগ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক পাওনাদারের টাকা ফেরত দিতে গতকাল হাতিরপুলে গেলাম। হাতিরপুলের চৌরাস্তাটা পার হতে বাম সাইডে প্রথমেই পড়ে একটা ফার্মেসি। নাম রহিম ফার্মেসি। ফার্মেসিটার পাশে রফি নামের এক বাদামঅলা বাদাম বিক্রির জন্য আস্তানা গেড়েছে। কথাবার্তায় সে বেশ পটু। অন্য সবার মতো হেঁটে হেঁটে বাদাম বিক্রি করে না। ওর কাছ থেকেই প্রায়ই বাদাম কিনে চাবাতে চাবাতে বাসায় ফিরি।

আমাকে দেখেই সে জিজ্ঞাস করে, ‘স্যার বাদাম দিব কডা?’ বলি, পাঁচ টাকার। বাদামঅলারা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করে। বিশেষ করে যাদের নিজের একটা ভ্যান জোগাড় করার সামর্থ্য হয়েছে। তারাই টিকে থাকার জন্য বাদাম বিক্রিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।

রফির বাদাম ভ্যানের চাকার কোল ঘেঁষে পাশেই মাটিতে বসে আছে দুজন মহিলা। তাদের সাথে কথাবার্তায় যা জানা গেল—ওদের একজনের নাম তহুরা। আরেক জনের নাম আরজুদা। দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। তাদের বাড়ি জামালপুর। জড়োসড়ো দুজনেই আমাকে দেখে কেমন যেন হুদাই খুশি। যেন তারা বহুদিন ধরেই আমাকে চেনে।

আমি এমনিই কথার খাতিরে বলি, ‘কী খবর, ভালো আছ তো?’

তহুরা বলে, ‘এই নেন, আঙুর খাইবেন?’

আমি বলি, ‘না, না, কোথায় পাইলা?’

আমাকে আঙুর খাইতে বলে ফকিরনিটা! তা–ও আবার ফকিরের ভিক্ষা মাগা মাটির ওপর পচাধচা কুড়িয়ে পাওয়া আঙুর!

তহুরা বলে, ‘ওই যে ফলঅলায় দিছে। বালা, এই একটা নাহয় খাইয়া দেখেন। কী মিষ্টি!’

সাথে বসা মাটিতে তহুরার সখি ফকিরনি আরজুদা বলে, ‘এই যে রুটিগুলা বেকারিঅলা দিছে।’

আমি বলি, ‘পচা না তো? খেয়ে পেট খারাপ করবে, দেখ!’

সে হেসে বলে, ‘না, না, তাজা। খাইবেন?’

আমি বলি, ‘নাহ!’

আগ বাড়ায়ে কাউরে ফাজলামি করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞাস করার করণে যে শাস্তি, তা–ই পাইলাম আজ । এ ধরনের শাস্তি আমি আগেও পাইছি। শালা, আক্কেল হয় না আমার! মনে মনে বলি।

ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি, সত্যিই ওরা ঢাকার পেশাদার ফকিরনি না। চেহারা, কথা বলার ধরন অন্তত তা–ই বলে।

তাদের হাতের কাছে মাটিতে দুটি ব্যাগ। মাটিতে বসা ওরা। দুই ফকিরনি সখি। ফকিরফাকড়া ছাড়া মাটিতে অত মাখামাখি করে কেউ বসে নাকি!

বললাম, ‘কবে আসলা তোমরা?’

‘এক মাস হইল।’

‘জামালপুরে কে আছে?’

তহুরা বলে, ‘হামার পোলার বাসায় থাকি। ছেলের বউ আছে। মেয়েও আছে একটা। চলতে কষ্ট হয়। এখন আমার ওষুধবড়ি কিননের টাকাপয়সা নাই। এর লাইগা ঢাকায় আসছি। মানষের কাছে কিছু চাইয়াচিন্তা নিয়া আবার কয়দিন পর চইলা যামু! আমরা দুজন আগেও এমন আসছি।’

রফির বাদাম ভ্যানের চাকার কোল ঘেঁষে পাশেই মাটিতে বসে আছে দুজন মহিলা। তাদের সাথে কথাবার্তায় যা জানা গেল—ওদের একজনের নাম তহুরা। আরেক জনের নাম আরজুদা। দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। তাদের বাড়ি জামালপুর। জড়োসড়ো দুজনেই আমাকে দেখে কেমন যেন হুদাই খুশি।

আমি বলি, ‘রাতে কই থাকো?’

‘ওই তো মানিকনগর!’

‘বালিশ, মশারি আছে?’

‘হ, আছে। হেইয়ানে রাখছি। রাস্তার গাড়ির শব্দে রাতে ঘুম হয় না!’

আমি ওদের বলি, ‘জামালপুর ফিরে যাও। তোমরা ফিরলে আবার দেখা হবে!’

‘কেমনে?’

‘আল্লাহ চাইলে!’

বাদাম মুখে দিয়ে আমি বলি, ‘তাইলে যাই।’ আরজুদা বলে, ‘তহুরার কাহিনি হুনলেন, আমার কাহিনি যে হুনলেন না!’

বুঝলাম, এরা এক–দু কথা বলে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে!

আমি আরজুদাকে বলি, ‘তহুরাকে এই ১০ টাকা দিলাম আর ওর কাহিনিটা শুনলাম। তোমার কাহিনি শুনব, তোমাকেও দিব ১০ টাকা। এখন শুনব না, তুমি আবার জামালপুর থেকে পরেরবার ফিরে আসার পর শুনব।’

মাথায় ভালো রকমের গোলমাল আছে, বোঝাই যাচ্ছে। তা না হলে চিনেজানে না আমার মতো একটা লোকের সাথে তারা দিব্যি আলাপ জুড়ে দিল! নাকি সমস্যাটা আমারই। হয়তো আমার চেহারা, পোশাক-আশাক, চালচলন খুবই শ্যাবি, তাই ফকিরনি দুজন ভাবছে, ‘লোকটা আমাদেরই মতো।’

যাহোক, আমার কথায় আরজুদা খুশি হয় না। আরজুদা হুড়মুড়িয়ে বলে, ‘আমি আপনেরে ৫০ টাকা উল্টা দিমু, যদি আপনি আমার কাহিনি হুনেন।’

আমি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিই, ‘আমার তো এত টাকার অভাব পড়ে নাই যে তোমার টাকা নেব!’ বললাম তো, ‘আমি শুনব পরে। এখন ব্যস্ত।’

ওর সখি তহুরা বলে, ‘আপনি একটু হুনেন হের কাহিনি। অর্ধেক হুনেন।’

আমি বলি, ‘চারআনাও শোনার টাইম নাই।’

‘আমিই কইবাম আরজুদার কাহিনি,’ তহুরা বলে।

আরজুদা দাবির স্বরে বলে, ‘না আমার কাহিনি আমি কইবাম।’

বিরক্তি প্রকাশ করে বলি, ‘আরজুদা তোমার কাহিনি তহুরা কেন বলতে চায়?’

‘নিজের কাহিনি কওনে হোয়াদ নাই। অন্যের আজব কাহিনি হুনাইতে আমার ভালা লাগে,’ তহুরা বলে।

আমি বলি, ‘তহুরা আরজুদার কাহিনির শুধু আজব অংশটুকু বলো।’ সে বলে, ‘আরজুদা আমার মতো ফকিরনি। কিন্তু হে যখনে অর পোলার বাসায় জামালপুরে যায়, সন্ধ্যাবেলা জানলার কিনারে গিয়া খাড়ায়। দুতালায় বারান্দায় খাড়াইয়া বাতাসে টেকা উড়াইতে থাকে। নিচে মেলা ফকির-ফকিরনি একপাল পোলাপান ওই মহল্লার, জড়ো হয়, নিচে তখনে বাতাসে উড়াল টেকা ধরে তারা।

ছেলে মেয়ে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো। ফলে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেতে ততটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। বিকেল হলেই বাসা থেকে একা একা বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। যেসব গলিতে হাঁটাচলা করেছি গত পঞ্চাশ বছর। এখন একেকদিন পুরোনো একেক এলাকায় বেরিয়ে পড়ি। গলিগুলোতে ধীরে ধীরে হাঁটি।

‘আর হে ঢাকায় আইলে শাহবাগের ফুলের দোকানে যায়। ৪ কেজির মতো গোলাপ ফুল কিনে। তা দিয়া ফুলের বালিশ বানায়। হেই বালিশেই রাইতে নাক ডাইকা ঘুমায়।’

আমি হেসে বলি, ‘তাইলে খোঁজ নিয়ে দেখ, আরজুদার রক্তে কোনো জমিদারের রক্ত আছে। ভাগ্যদোষে সে আজ ফকিরনি।’

তহুরা বলে, ‘না না। আপনে হের কাহিনি যেইদিন হের জবানে হুনবেন, পুরাই অবাক হইবেন।’

মনে হলো তহুরাকে বলি, ‘তোমাকে আর ওর হয়ে ওর কিসসা বলার হেকমত দেখাতে হবে না। আমি ওর জবানেই শুনব পরে।’

আমি ভেগে পড়ার জন্য হুড়মুড়িয়ে বলি, ‘শুধু মজার না, অবশ্যই তার সব চাইতে কঠিন করুণ কাহিনিও আশা করি তার মুখেই শুনব। আমার কথা কোনো দিন মিস হয় না!’

আরজুদা আর তহুরার কাটা কাটা কথা শুনে আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল!

আরে ফকিরনিদের পুরা কাহিনি শুনতে গেলে তো আজ ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করব!

আন্দাজ করলাম, এই আরজুদা ফকিরনিটার একটা বড় খায়েস মনে হয় পয়সার বিনিময়ে লোকজনকে তার নিজের জীবনের কাহিনি শোনানো।

২.

মোটামুটি বছর দশেক পরের ঘটনা।

আমিও যথেষ্ট বুড়িয়ে গেছি। আমার ডায়াবেটিস আর প্রেসার ধরা পড়েছে। আগের চেয়ে হাঁটাচলা বাড়িয়ে দিয়েছি। বেশ কয়েক বছর হলো রিটায়ার করেছি। খাওয়াদাওয়ায় আগের তুলনায় অনেক রেসট্রিকশন। ছোটবেলার কিছু অভ্যাস আজও ছাড়তে পারিনি। হয়তো তা কোনো দিনও সম্ভব না।

আচার-ব্যবহারের বাইরেও কিছু জিনিস আছে মানুষ ছাড়তে পারে না। তার মধ্যে পড়ে অতীতের প্রতি মায়া আর ভবিষ্যৎ-ভীতি। এর মধ্যে যেটা আমাকে হরদম পীড়া দিচ্ছে, তা হলো এ শহরে আমার চেনাজানা পুরোনো গলিপথগুলোর প্রতি পিছুটান। এ যেন আমার ভেতর আমারই জমিয়ে রাখা বাসিফুলগুলো তাদের যৌবন ফিরে পেতে শুরু করেছে।

ঢাকা শহরে কতবার যে বাড়ি বদল করলাম। কম বেতনের চাকরির কারণে শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে কোথাও পুরোনো বাড়িতে সস্তায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার গরিবি অভ্যাস ছিল আমার। বাড়ি ভাড়া খাত থেকে যাতে কিছু টাকা বাঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের বিনোদনে কিছু পয়সা খরচ করতে পারি। সস্তায় বাড়ির আশায় কত না এলাকায় থাকতে হয়েছে, তার হদিস নেই। আর সেই সূত্রে চিনপরিচয় হয়েছে শহরের কত না রাস্তাঘাট আর অলিগলি দোকানপাটের সাথে। শহরের গলিগুলোর কোনোটি আবছা, কোনোটি আঁকাবাঁকা। কোনোটা ফেরিঅলার তরকারিঅলার ডাকে সকালবেলা থেকেই গমগম করতে থাকে। কোনোটা এত নিরিবিলি সুনসান যে একটা ছোট বেলি ফুল বাতাসে ঝরে পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যায়। কোনোটা কোথাওবা একটুখানি বেঁকে গিয়ে ইচ্ছে করেই যেন ফুরিয়ে গেছে। আবার কোনোটা হয়তো একটু মোড় নিয়ে দুধার কেটে বেরিয়ে গেছে। একটা জিনিস গভীরভাবে খেয়াল করলে ধরা পড়বে যে প্রতিটা গলিই আলাদা। সব গলিই ইউনিক।

বছর চারেক হলো স্ত্রীর কঠিন নিউমোনিয়া হওয়ায় তাকে আর বাঁচানো যায় নাই। ছেলে মিঠু আর মেয়ে মিলি চলে গেছে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে। ওরা ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো। ফলে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেতে ততটা সমস্যায় পড়তে হয়নি।

বিকেল হলেই বাসা থেকে একা একা বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। যেসব গলিতে হাঁটাচলা করেছি গত পঞ্চাশ বছর। এখন একেকদিন পুরোনো একেক এলাকায় বেরিয়ে পড়ি। আর সেই সব এলাকায় টুকটুক পায়ে গলিগুলোতে ধীরে ধীরে হাঁটি। খেয়াল করলাম—যেসব বাড়িতে থেকেছি, সেগুলোর অনেকগুলোই এখন আর নেই। অনেকগুলোই বড় বড় আকাশছোঁয়া বিল্ডিং হয়ে গেছে। কেমন যেন ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন ফিলিংস হয়!

একসময় ব্যস্ততার কারণে সময়ের বোধটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সময় ও আমি যে দুজন তা বুঝতে পারতাম না। আমি এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছুই দেখি। উদ্যানে অনেকক্ষণ ধরে গগন শিরিষের মাথার ওপর একদল কাকের ঘুরপাক খেতে দেখলাম। ওদের গোনার চেষ্টাও করলাম। পরে দেখলাম, এগারো কি বারো হবে ওরা সংখ্যায়। ওরা কেন এ রকম অকারণ ওড়ে? বহুকাল আগেও দেখতাম, কোনো একটা বিন্দুকে কেন্দ্র সাব্যস্ত করে কাকেরা ছোট ছোট জেট প্লেনের মতো বৃত্তাকার উড়তে থাকে আকাশে। বয়স বাড়লে মানুষের আগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায় ধীরে। ভাবনাগুলো কেমন যেন স্থায়ী হয় না। যেন ভাবনাগুলোর কোনো খুঁটিটুটি নেই। এমনিই উদয় হয় এমনিই শিশিরের মতো ঝরে যায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না তখনো।

মনে হয় এখন একটা বড় গাছের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কত কত পাতা ঝরে, হাঁ করে তাকিয়ে থেকে গুনতে মন চাইলে তা–ও পারব।

হাঁটতে হাঁটতে একটু ক্লান্ত লাগছিল। ভূতের গলিতে একটা দোকানের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম। এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল। পাশের একটা টংঘরের সামনে একটা কালো কুকুর শুয়ে ছিল। লেজ নাই। কয়েকটা মাছি ওকে খুব বিরক্ত করা শুরু করল। কুকুরটা শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে শূন্য থেকে উড়ন্ত ওই মাছির একটাকে কামড়ে ধরল। আগে কখনো এ রকমভাবে কোনো কুকুরকে মাছি ধরতে দেখিনি। ঘটনাটা হয়তো পুরোনো। কিন্তু আমার কাছে নতুন করে গুরুত্ব দাবি করল।

আমার এক বন্ধু নাম বদরুল। থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। সেদিন ফোনে কথা হলো। কথা প্রসঙ্গে ও বলল, ‘আলমগীর, আয়ু বাড়াও! সকালের দিকে লম্বা হাঁটাহাঁটির পর একটা নিরিবিলি জায়গায় এসে বসে ধ্যান করবা। তারপর সেখান থেকে সোজা বাসায় ফিরে আসবা। বুড়োদের ঘরের বাইরের দুনিয়ার সব দৃশ্যের সাথে বেমানান লাগে!’

ওর কথা পরস্পরবিরোধী হলেও আমার মনে ধরেছে। তবে কারও কোনো কথা আমি সারা জীবনই গুরুবাক্য হিসেবে মানিনি।

রমনার উদ্যানে যে বিশাল ছাতিমগাছটা আছে, ওটার নিচে বসার জন্য বড় ছাতা আর বেঞ্চের ব্যবস্থা আছে। আমি পার্কের বেঞ্চটাতে সকালে বা বিকেলে এসে বসি। ওটাকেই যেন কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব কী, গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি প্রতিটি ফুলের দিকে। ডালের দিকে। গাছরা মাটিকে বিশ্বাস করে কত সুস্থির এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে সারা জীবন। তারা শিকড়বাকড় ছড়ায়ে ফুলে–ফলে পাতায়-লতায় নিজ রাজ্য বিস্তার করে বসে। তাই ওদের আর হাঁটতে হয় না, কোনো কেন্দ্র খুঁজে বেড়াতে হয় না! ওদের খাদ্য-খাবার নিজের থেকেই এসে ওদের কাছে ধরা দেয়।

এখন উদ্যানে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশ দেখছি। একটা দলছুট মেঘ ভেড়ার মতো দূরে কয়েকটা মেঘকে ধরার চেষ্টা করছে। ওই মেঘগুলোর কোনো ছায়া পৃথিবীতে এসে পড়ছে না। শালিখ আর কাকের ঝগড়া পার হয়ে বাতাসে ভেসে আসছে কোনো একটা চুপচাপ নাম না-জানা ফুলের গন্ধ। এখানে কোনো সরকার, রাষ্ট্র নাই, আছে শুধু নিজ ভাবনার অধীনতা। বিপরীত বুদ্ধি যদিও ইশারায় বলছে, পৃথিবীর কেহই নজরদারির বাইরে নয়। কোথাও ওত পেতে আছে চরম এক শত্রু। পা ফেলো সাবধানে।

বাদামঅলা রফি ওদের পক্ষে সাক্ষী দেয়। বলে, ‘স্যার হে আপনেরে ১০০ টাকা তার কাহিনি শোনার জন্য দিতে চাইছিল আট-দশ বছর আগে। তারপর যতবারই ঢাকা আসছে। আপনার কথা জিজ্ঞাস করছে। স্যার অরা ফকিরনি হইতে পারে, কিন্তু গরিব না!’ আমার কিন্তু ওদের কথা একদম মনে নাই। রফির কথার ওপর নির্ভর করা চলে।

বয়স হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা পরিযায়ী পাখির মতো উড়ে যায়। আমাদের মতো বুড়োরা তখন কোথায় কার কাছে গিয়ে মনের দুটো কথা বলবে! শোনার কারুরই সময় নাই।

এই দেশেও বিদেশের মতো একদিন অনপেমেন্টে জীবনের গল্প শেয়ার করার জন্য ক্যাফে খোলা হবে হয়তো। মানুষ টাকার বিনিময়ে তার কষ্টের কাহিনি কোনো ধৈর্যশীল রসিক শ্রোতাকে শুনিয়ে আনন্দ পাবে। হয়তো সাময়িক তার কোনো শিকড় খুঁজে পাবে বাতাসের ভেতর। হয়তো তার গল্পগুলো বলতে বলতে চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে। আর পেইড শ্রোতা এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে তত দিনে। বেকারের দেশে এইটাও একটা কর্ম হিসেবে দেখা দেবে তখন। কথক-শ্রোতার দিন আবারও ফিরবে আমার বিশ্বাস।

বাসায় ফিরে পুরোনো ছবির কয়েকটা অ্যালবাম বের করি। অ্যালবামগুলোর ওপর জমানো ধুলো ঝাড়ছি। ধুলোগুলো লেপ্টে গেছে। যেন দিনে দিনে এই অ্যালবাম তাদেরও স্মৃতি! তাই খাবলে ধরে বসে আছে।

অ্যালবাম ঘেঁটেও বেশ কিছু সময় কাটানো যেতে পারে, বেশ বুঝলাম। যত ছবি দেখি ততই মনে হচ্ছে—সবই তো এই সেদিন ঘটে গেল। আগে কারও হাতে অ্যালবাম দেখলে বিরক্ত হতাম। অ্যালবামের ভেতর কিছু ছবি পেলাম আমার ছেলের আর মেয়ের। ওদের মায়ের সাথে আমার কিছু সাদাকালো যুগের ছবি। পুরোনো দিনের ছবিগুলোই সময়কে আমার কাছে প্রকট করে তুলছে। চাকরি নামের ডাইনিটা আমার আয়ুর নব্বই ভাগ ছিনতাই করেছিল। আর বিনিময়ে ছ্যাবড়া হিসেবে আমার হাতে কয়টা পেনশনের টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, আবার আরেকটা শৈশব শুরু করি। হোক সেটা বুড়োদের শৈশব!

৩.

আজ শনিবার। বিকেলে হাতির পুলের দিকে যাব। দশ বছর আগে থাকতাম ওই দিকটায়। ওই এলাকাটার যে যে গলিতে বাসাভাড়া করছিলাম, সেই গলিগুলো ধরে এদিক-ওদিক ঘুরব। কত দিন যাই না!

আসলে ছেলেমেয়েদের স্কুল পরিবর্তনের সাথে সাথে বাসা পরিবর্তন করেছি বেশি। কখনো কখনো চড়া ভাড়ার কোনো বাসায় হয়তো উঠতে বাধ্য হয়েছি। এক বছরের মাথায় হয়তো সে বাসা ছেড়ে কম দামের বাসা খুঁজে নিয়েছি। কম দামের বাসাভাড়ার বাড়িঅলাদের ব্যবহার দেখেছি ভালো হয়। ভাড়াটেদের ধরে রাখতে চায়।

এই হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে কত কত সময় তরকারিঅলার সাথে খাতির থাকায় বাকিতে তরকারি কিনেছি। এই বাজারের কসাইরা বুড়া গরু জবাই করত। ফলে গোস্তের দাম কম হাকত। তাহের গোশত বিতান থেকে সস্তায় গরুর গোস্ত কিনতাম। একবারে বেশি গোস্ত নিলে দাম কম রাখত। বাকিটাকিতে কিনলে পয়সার জন্য পিড়াপিড়ি করত না। কখনো কখনো গরুর কলিজার দামে অল্পস্বল্প ছাড় দিত। পয়সা দিতে গেলে বরং বলত, ‘আরে সাহেব, নিয়া যান, আপনের পয়সা দেওন লাগব না!’

ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা আমার প্যান্টের পকেটেই জড়োসড়ো হয়ে আছে। অ্যাজমাসলটাও নিতে হবে। হাতিরপুল বাজারের পশ্চিম দিকটায় বড় একটা ফার্মেসি ছিল। হ্যাঁ, ওই দিকটাই তো যাচ্ছি। রহিম ফার্মেসি।

ওই তো আগের মতোই আছে। শুধু লোকজন পাল্টে গেছে। আমার জরুরি ওষুধটা নিলাম। পাশে একজন কে যেন আমাকে ডাকছে।

‘স্যার, স্যার!’

‘কে?’ পেছন ফিরে দেখি। চেনা চেনা লাগছে।

‘আমি রফি।’

‘রফি?’

‘এইখেনে বাদাম বিক্রি করি আমি। আসেন। আপনি আমারতে বাদাম কিনতেন। স্যার, এখন কোন এলাকায় থাহেন? আপনার একটা খবর আছে।’

রফি, হ্যাঁ এর কাছ থেকেই বাদাম কিনতাম।

‘তুমি এখনো বাদাম বিক্রি করো?’

‘স্যার, এই কাজটা ছাড়তি পারলাম কনে! ছাড়তি কষ্ট হয়, মায়া লাগে।’

রফি তার বাদামের ভ্যানের দিকে আমাকে আসতে বলে। আমি যাই।

সন্ধ্যার অন্ধকার সব দিকে রাতের চেহারা নিয়েছে। রহিম ফার্মেসির পাশেই তার বাদামের ভ্যানটার কাছে দুইটা মেয়েলোক। জইফ বুড়ি। তড়াক করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমাকে দেখেই ওরা যেন আকাশের চান হাতে পেল। বুঝলাম না। এত খুশি হবার কী আছে! তারা আমার কানের দিকে আর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে।

আমি বুঝতে পারছি বোধ হয়। আমার ডান কানটা জন্মগতভাবেই বেখাপ্পা রকমের ছোট। তা ওইটা ঢাকবার জন্য আমি বড় চুল রাখতাম। আপনা কাটা কান ঢেকে রাখার মতো। বড় ঝাঁকড়া চুল দিয়ে খুদে কানটা মুরগিছানার মতো মায়ের পালকের আশ্রয়ে ঢাকা থাকত। কখনো কখনো বর্ষা শেষের পাপড়িখসা কদমের মতো বিশ্রি বের হয়ে পড়ত। আমার ডান গালে একটা কাটা দাগ আছে। ছোটবেলায় রান্নাঘরে বটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে আমার গাল কেটে যায়! সে কী রক্তপাত! সেলাই ব্যান্ডেজ কত কী করতে হয়েছিল। সেই থেকে ডাবা একটা দাগ আমার গালে চির বাসা বেঁধেছে।

যে কারও পক্ষে আমার চেহারা মনে রাখা তাই খুব সহজ। আমার বদখত চেহারারাটা চিনতে কাউকে তার স্মৃতির অন্ধকার পৃষ্ঠায় বেশি হাতড়াতে হয় না। কিন্তু এই দুজন অপরিচিত মহিলার চাওয়া কী আমার কাছে?

আমাকে তাদের স্মৃতির সাথে মিলায়ে নিচ্ছে। হয়তো আমাকে চিনত আগে কোনোভাবে।

তাদের একজন মহিলা কাঁচুমাচু বলল, ‘আমার নাম আরজুদা। আপনে জবান দিছিলেন, আমার কাহিনি হুনবেন। কই, আর দিকে পাও রাখলেন না, আর হুনলেনও না।’

আমি বললাম, ‘আজগুবি আবদার রাখো তো। কবে? কেন তোমার কিসসা শুনতে যাব বা কেন?’

আরেকজন বুড়ি বলল, ‘স্যার আমাগো বাড়ি জামালপুর। আমরা ঢাকা আসি কয়েক মাসের লাইগা। কিছু ভিক্ষাটিক্ষা করি। তারপর আবার চইলা যাই। আমার নাম তহুরা। আপনি আমার জীবনের কাহিনি হুনছেন একদিন। আরজুদার কষ্টের কাহিনি আপনারে হুনাইবে।’

বাদামঅলা রফি ওদের পক্ষে সাক্ষী দেয়। বলে, ‘স্যার হে আপনেরে ১০০ টাকা তার কাহিনি শোনার জন্য দিতে চাইছিল আট-দশ বছর আগে। তারপর যতবারই ঢাকা আসছে। আপনার কথা জিজ্ঞাস করছে। স্যার অরা ফকিরনি হইতে পারে, কিন্তু গরিব না!’

আমার কিন্তু ওদের কথা একদম মনে নাই। রফির কথার ওপর নির্ভর করা চলে। এত ছোট প্রতিশ্রুতিও মানুষ মনে রাখে!

আমি অবহেলার স্বরে বললাম, ‘ঠিক আছে শুনব, আজ না। আগামীকাল আসো এই সময়। সব শুনব।’ ‘আইবেন কিন্তু। আপনেরে টেকা দিব, দ্যাহেন হেই ট্যাকা অখেনেও লগে লগে রাখছি,’ আরজুদা বলে।

ভরসা দেওয়ায় তখনকার মতো কোনো রকমে তার মুখে কুলুপ আঁটা গেল।

হঠাৎ আমার মাথায় আইডিয়াটা চমকে উঠল। আরজুদা ফকিরনিটা যে তার একান্ত গল্প শোনাতে চায়, এইটাকে মানবিক ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে দেখলেই তো এই লাইনে একটা দরোজা খুলে যায়। আজকাল ছেলেমেয়েরা মোটিভেশনের অনেক বই–পুস্তক কেনে, ভিডিও দেখে। কিন্তু কথক ও শ্রোতার ফিজিক্যাল উপস্থিতিটা আসলে গুরুতরভাবে সেইখানে নাই হয়ে আছে। এই জায়গায় কাজ করা হয় নাই। আমার মনে হয়, ঢাকায় এ ধরনের একটা সেন্টার বা ক্যাফে খুললে খারাপ হয় না। আমি তো নিজেই আমার অবসর সময়ের সুযোগে এই উদ্যোগ নিতে পারি। বিদেশে এই সব কত কিছুই তো উদ্ভট দিব্যি ব্যবসা বলে চালিয়ে দিচ্ছে! কত টাকা যে পাবলিকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমি তো আমার কাজ শতভাগ সততার সাথেই করব। সবার চোখে বুড়োকালে কোনো একটা কর্মের ভেতর মাথা গুঁজতে পারাটাই যেন বিশাল ক্রেডিটের ব্যাপার।

আমার মেয়ে রাতে ফোন দিল আমেরিকা থেকে। বলল, ‘বাবা, আমি আগামী মাসেই দেশে ফিরব। ভাবছি, আমাদের দেশেই আমি প্র্যাকটিস করব।’ আমি একটু হতাশ হয়েই বললাম, ‘কিরে বিদেশে থাকার আগের সব প্ল্যান কি বানে ভেসে গেল নাকি!’

ভাবলাম, মেয়ে দেশে ফিরলে আমাকে হয়তো এ বুড়ো বয়সে আর একা থাকতে হবে না। ওকে খুশি করার জন্য ওর কথায় তাল দিয়ে বললাম, ‘তুই দেশেই আয়। এই দেশে বিদেশের মতো ডিসিপ্লিন জিনিসটা নাই বটে। তবে এখানে অনেস্টলি লেগে থাকলে যেকোনো কাজের বরকত বেশি।’

আমার ক্যাফের আইডিয়াটা ওর সাথে শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না। শুনে ও খুশিতে বাগবাকুম।

মিলি বলল, ‘থামো বাবা, আগেই বলে রাখলাম। ক্যাফের নামটা কিন্তু আমিই দিব। নইলে তুমি আবার পুরোনো আমলের খ্যাত্‌ টাইপের একটা বাংলা নাম হাজির করবা!’

ক্যাফে দিতে গেলে যে যাবতীয় খরচপাতি তা নিয়ে আমি আমতা–আমতা করলে ও বলল, ‘আব্বু, তুমি ভীষণ ভীতুই রয়ে গেলে, রিস্ক নেওয়াটা শেখো। আর নিজেকে এত নিঃস্ব ফকির মনে করো না তো! হিসাবি লোক হিসেবে খ্যাতি বজায় রাখার চেষ্টা করো না আর!’

আমার মেয়ে এ দেশে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছে। তারপর কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে একটা কোর্স শেষ করেছে। এ লাইনে আরও অনেক ডিগ্রিটিগ্রি নিয়েছে। সে ভীষণ বাস্তববাদী টাইপের মেয়ে। ওর ক্যারিয়ার নিয়ে আমার বেশ ভরসা হয়।

ছেলে মিঠুর সাথে এ বিষয়ে শেয়ার করে লাভ নেই। তবু করলাম।

টাকার বিনিময়ে সে তার কিসসা–কাহিনি শোনাবেই। ওর জিদ দেখে বোঝা গেল, ফাওতে কোনো কাজ যে হয়, তাতে তার বিশ্বাস নাই। এই ক্যাফেতে কথকের মুখে বলা কাহিনি রের্কডিং করা হবে। কেউ নিজের বলা কাহিনিটা চাইলে নিয়ে যেতে পারবে। হোম সার্ভিসও চালু করব পরে।

‘বাবা, সম্পদ বাড়ানোর লোভ করো না। যা কিছু গরিব মানুষের কাজে লাগে না, সেই সম্পদ মাটির ঢেলা!’ এই বলে হাসতে থাকল। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন আমেরিকাতে গিয়েও ওর মাথা থেকে গেল না! তা মিঠুর কথায় আমার অন্তর একটু কেঁপেই উঠল, কোনো প্রলোভনের ভেতর পড়তেছি না তো!

রমনা উদ্যানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আকমলের সাথে দেখা হয় প্রায়ই। আমার সাথে শতায়ু অঙ্গনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখা হলো আজ। আমি আর মিলি মিলে ক্যাফে বসানোর আইডিয়াটা ওর সাথে শেয়ার করার সাথে সাথে ও এত জোরে হেসে উঠল যে উদ্যানের জ্যাকারান্ডা ও বাওবাবগাছের ডালে বসা গোটাকয় চড়ুই পাখি ভয়ে উড়াল দিল। আর দেরি না করে আমার কাছ থেকে সে হনহনিয়ে লেকের দিকে চলে গেল। আমাকে এত দিন নিছক আহাম্মকই ঠাউরে এসেছে! কতজনকেই এ জীবনে গাছ ভেবে বেয়ে উঠেছি, সবাই অপ্রয়োজনীয় বিছাপোকা ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছে। এ আর নতুন কী!

যে যা–ই বলুক, আমার সম্বল যা–ই হোক, বাপে-মেয়ে মিলে একটা ক্যাফে খুলব। নাম হবে ‘ক্যাফে মনোলগ’। মিলিই এই নাম ফাইনাল করে এক মাস আগে জানিয়েছিল। আমি অবাক হলাম ওর তোড়জোড় দেখে।

নামটা খুব মানানসই হয়েছে রে! মিলিকে ক্যাফের নামকরণটার জন্য তারিফ করলাম। মাত্র আর কয়টা দিন পরেই তো ও দেশে ফিরবে।

আমাদের প্রথম কাস্টমার হবে জামালপুরের আরজুদা। শোনা হয়নি, ওকে কথা দিয়েছিলাম ওর কাহিনি শুনব।

যত বড়ই হোক ট্রেন লাইনের মতো লাম্বা, শোনা হবে তার দুঃখের কাহিনি। আমার বিশ্বাস আমাদের কাহিনি শোনার নতুন ক্যাফেতে ও কোনো ফিস মওকুফ চাইবে না। টাকার বিনিময়ে সে তার কিসসা–কাহিনি শোনাবেই। ওর জিদ দেখে বোঝা গেল, ফাওতে কোনো কাজ যে হয়, তাতে তার বিশ্বাস নাই।

এই ক্যাফেতে কথকের মুখে বলা কাহিনি রের্কডিং করা হবে। কেউ নিজের বলা কাহিনিটা চাইলে নিয়ে যেতে পারবে। হোম সার্ভিসও চালু করব পরে। মিলি এটাও জানাল।

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, মিলির সাথে আমার দ্বন্দ্ব বাধল কে প্রথম কাস্টমার হবে—এ নিয়ে।

সে বলল, ‘আমরা ছেলেমেয়ে দুজনই তোমার জীবনের কোনো ঘটনাই কখনো শোনার আগ্রহ দেখাইনি। অথচ কত মহান মহান লোকের জীবনী তুমি আমাদের পড়িয়েছ। “আমার শৈশব-কৈশোর ঘটনাময়”—একদিন শুধু এইটুকুই হিন্টস দিয়েছিলে। আমি ও মিঠু তা কখনো কানে তুলিনি। তোমার পুরা জীবনাটাই আনসাং রয়ে গেল!’

বুকে এলেও মুখে বলিনি, গাঁওগেরামের চাষারা এত দিন যা যা করে আসছে, এখন দেশের পয়সা খরচা করে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে তাই বিদ্যা হিসেবে অর্জন করে বিশাল গৌরবে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, ডাঁট দেখায়। আমাদের মাটি ফুঁড়ে বের হওয়া পুরোনো সব দেশি জ্ঞানগম্যি নিজ পায়ে ডলেটলে সাগরে ছুড়ে ফেলে ফের সেই জিনিসকে খোঁজ করতে ডুবুরি লাগিয়েছে পুরা দুনিয়া। লোকাল নলেজের সাথে হ্যান্ডশেক করতে চাচ্ছে গ্লোবাল নলেজ। দো-আঁশলা জিনিসের কদর বাড়ছে দিন দিন।

আস্তে করে মিলিকে বলি, ‘আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ো না, মা। আমার মনে হয়, যার জীবনের দুঃখ বেশি তার কাহিনি শোনা দিয়েই শুরু করা উচিত আমাদের। সে ক্ষেত্রে জামালপুরের আরজুদাই প্রেফারেন্স পাবে।’

আমার বাম চোখটা কাঁপছে সকাল থেকে। পুরুষ মানুষের বাম চোখ কাঁপা খারাপ লক্ষণ। আমার এমন মনে হচ্ছে কেন, জামালপুরের ফকিরনি আরজুদার পাহাড়পরিমাণ কিসসা-কাহিনি বলা পর্যন্ত বাঁচবে তো! হঠাৎ আমার বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল! যদিও আমি এসব সংস্কারটংস্কারে বিশ্বাস করি না! অন্য কেউ হলে মানত করে বসত। এ দেশে প্রথম যে আইডিয়া জেনারেট করে তাকে সবাই ছাইচাপা দিতে চায়। আমি মিলির সাথে আরজুদার কথা আগেই শেয়ার করেছি।

মিলি বলে, ‘না, যে ভীষণ একা, তার কাহিনিই আগে শোনা উচিত। তাকে দিয়েই শুরু করব।’

তখন দুপুর। আমি একা জানালায়। জানালার আকাশে একটা চিল উড়ছে। চিলেরও একটা দুঃখের কাহিনি থাকতে পারে!

কারও জীবনের কাহিনি শোনার আগেই শোনার মানদণ্ড নির্ধারণ করা আদৌও ঠিক কি না, চিলটার গোত্তা দেখতে দেখতে ভাবছি।