আর অশান্তি ভালো লাগে না। ঘরে অশান্তি, বাইরে অশান্তি। না, ঘরে অশান্তি নাই। উইলিস বাড়ৈ একা। বহু বছর ধরে একা। ঘরে বরং ইঁদুরের আনাগোনা আছে। তারা কোনো প্রকার অশান্তি করে না। টিকটিকি আছে। তারা নিরীহ। উইলিস বাড়ৈর চেয়ে কম নিরীহ। পোকা ধরে খেতে পারে। উইলিস বাড়ৈ মানুষ না হয়ে টিকটিকি হলেও কখনোই এই কাজটা করতে পারত না। একে– তাকে ধরে খেয়ে ফেলার মধ্যে সে কোনোকালে নাই। যারা আছে, তারা অবশ্য খেয়ে দিতে পারত উইলিস বাড়ৈকে। কিন্তু উইলিস বাড়ৈ টিকটিকির থেকেও নিরীহ, এই বিবেচনা করে হয়তো দেয় নাই। যার যে রকম বিবেচনা।
টিক টিক টিক।
টিকটিকির নাম টিকটিকি কে রাখল?
ইঁদুরের নাম ইঁদুর কে রাখল?
মশার নাম মশা কে রাখল?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক ফুলের, গাছের নাম রেখে গেছেন। টিকটিকি, ইঁদুর, মশার নাম রাখেন নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোই নেশাপানি করতেন। সিগারেট, পাইপ ফুঁকতেন গোপনে। মদ্যপানে অনীহা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেউ মাতাল দেখেছে? মাতাল হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বাংলা সিনেমার গান করতেন, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই/ মানুষ যদি মোরে নাই বলো/ বেইমান বলো বেইমান!’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সুন্দর মানুষ কোনোকালে এই পৃথিবীতে জন্মে নাই। সুদীপা বলেছে। সুদীপার কথার দাম আছে। এক শীতকালে এসেছিল সুদীপা। গল্প-গাছা করে কিছু উৎপাত ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে মাথায়। উইলিস বাড়ৈ সুদীপাকে মনে করে এখনো। সুদীপা লরেন্স রোজারিও। সুদীপার ঘ্রাণ উইলিস বাড়ৈর ঘরে থেকে গেছে।
‘আপনি কি সারা জীবন এই বাসায় থাকবেন?’
‘সারা জীবন কত বছরে হয়?’
‘আপনার আশির কমে হবে না। অশীতিপর হয়ে আপনি মরবেন। তত দিন কি এই বাসায় থাকবেন?’
‘কেন?’
‘আমি আর একবার আপনার সঙ্গে দেখা করব।’
সেটা কবে, সুদীপা বলে যায় নাই। সত্যি কি উইলিস বাড়ৈ অশীতিপর হয়ে মরবে? উইলিস বাড়ৈর বয়স এখন আটচল্লিশ। এই বয়সে অনেকে মরে যায়। এই বয়সের আগেও মরে যায়। উইলিস বাড়ৈর বন্ধু বিজন মানকিন নেশা করে সাতাশ বছর বয়সে মরেছে। কিছুদিন আগে কুয়াশা গোমেজ মরেছে। মফস্সলের কবি কুয়াশা গোমেজ। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরেছে। কুয়াশা গোমেজের কবর হয়েছে লোকাল খ্রিষ্টান সিমেট্রিতে। কবরে পাহারা বসিয়ে রাখতে হয়েছিল কিছুদিন। একদল মানুষ আছে, যারা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের লাশ চুরি করে।
সুদীপার কথা উইলিস বাড়ৈ মোটামুটি বিশ্বাস করে নিয়েছে। ধরে নিয়েছে, সে অশীতিপর হয়েই মরবে। কেন? সুদীপা কি জ্যোতিষী জিন ডিকসন? সুদীপার কি উইলিস বাড়ৈর কথা মনে আছে আদৌ? উইলিস বাড়ৈ মনে রেখে বসে আছে কেন? এগারো মাস লিডিয়া ছিল উইলিস বাড়ৈর সঙ্গে। অসন্তুষ্ট, অসুখী লিডিয়া। তারা বিয়ে করে বসেছিল কেন? চার্চ থেকেই ‘দোষী বাতাসে’ পেয়েছিল লিডিয়াকে। রূপবতী রাজকন্যা মুহূর্তে রাক্ষসী রূপতরাসী হয়ে উঠেছিল। অথচ বার্টি কাকা তার সঙ্গে মোটেও বাজে কোনো রসিকতা করে নাই। কোর্টকাছারি করে নাই তারা। পরস্পরের সম্মতিক্রমে বিচ্ছেদ। তবে লিডিয়াকে কড়ায়–গন্ডায় আট লাখ টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। সামাজিকভাবে অপদস্থ, অসম্মানিত হতে হয়েছে উইলিস বাড়ৈকে। উইলিস বাড়ৈ বুঝে গিয়েছিল, স্বর্গে তাদের জুড়ি বানানো হয় নাই। নরকের রসুইঘরে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগারো মাস ‘সহে না যাতনা’ গেছে। লিডিয়ার হাঁপ ধরে গিয়েছিল, উইলিস বাড়ৈর হাঁপ ধরে গিয়েছিল। কিছুদিন মহান ম্যাডক্যাপ ছিল উইলিস বাড়ৈ। মনোবিদ এনামুল সাদেকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করেছিল। এনামুল সাদেক ইউটিউবার। নিয়মিত ইউটিউবে তাকে ফলো রাখতে বলেছিলেন। উইলিস বাড়ৈ অশান্তির কারণে পারে নাই।
সুদীপা এখন থাকে লন্ডনে। স্টোরিটেলার। গল্প শোনায়। কী গল্প শোনায় বাচ্চাদের? ফেসবুকে সুদীপার সঙ্গে নাই উইলিস বাড়ৈ। রিমঝিম সুদীপার প্রচুর ভিডিও শেয়ার দেয়। রিমঝিমের সঙ্গে আছে উইলিস বাড়ৈ। কিন্তু সুদীপার ভিডিওতে কখনো লাইক দেয় না বা কমেন্ট করে না।
কলবেল বাজল।
দরজা খুলে উইলিস বাড়ৈ যাকে দেখল, ঘুণাক্ষরেও তাকে আশা করে নাই।
লিডিয়া।
লিডিয়া বলল, ‘ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?’
‘সন্ধ্যা দেখি।’
লিডিয়া ঘরে ঢুকে বলল, ‘সন্ধ্যা না তুমি জানালা দেখো। হলুদ বিল্ডিংয়ের ছয়তলার জানালা। হেঁটেফিরে গোসল করে এখনো ড্রেস চেঞ্জ করে নাই মহিলা?’
‘মহিলা সুইসাইড করেছে।’
‘তাই নাকি? ঠিক করে নাই। তোমার সমস্যা হয়ে গেল।’
‘আমরা এখন আর একসঙ্গে থাকি না, লিডিয়া। অচেনা একজন মানুষ সুইসাইড করেছে, তার সম্পর্কে বিষোদ্গার না করলে আর। তুমি জানো, এসবের কখনো কোনো মানে ছিল না।’
‘সাধু পুরুষ তুমি।’
‘না, আমি দুশ্চরিত্র। তুমি কেন এসেছ, বলো।’
‘তোমার ঘাড় মটকাতে, সাধু পুরুষ।’
লিডিয়া খিলখিল করে হাসল। গুজবাম্প হলো উইলিস বাড়ৈর।
লিডিয়া এ সত্যি?
উইলিস বলল, ‘তুমি মরো নাই?’
‘না, সাধু পুরুষ।’
চার–ছয় দিন ধরে নিউজ ছিল মিডিয়ায়—উদ্যোক্তা তরুণী খুন। বুটিক শপ সারেঙ্গির স্বত্বাধিকারী, লিডিয়া ডি কস্তা (২৭) তাঁর নাখালপাড়ার বাসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সবুজ নাইলনের দড়ি গলায় পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মৃত লিডিয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর হত্যাকারী হয়তো। সেই হত্যাকারী ধরা পড়ে নাই। পেশাদারি কাজ। আট–দশটা খুন করে এরা হয়তো একটায় ফেঁসে যায়। ছাব্বিশটা খুন করেও ধরা পড়ে নাই, এ রকম খুনিও দেখেছে উইলিস বাড়ৈ। পূর্ব রাজাবাজারের ‘ভাই’ শাকিলের শাগরেদ ইয়েলো মাসুম। বয়স ছাব্বিশ হয় নাই, ছাব্বিশটা খুন করে বসে আছে তখনই। ষোলো বছর বয়স থেকে লাইনে। রেললাইনের ধারের মাদক ব্যবসায়ী আকারুলকে খুন করেছিল শ্বাস রোধ করে। সবুজ নাইলনের দড়ি গলায় পেঁচিয়ে। আকারুল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে লিডিয়া হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর মিল কেউ খতিয়ে দেখে নাই। ইয়েলো মাসুমকে কন্ট্র্যাক্ট করেছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের দালাল বাতেন মামা। উইলিস বাতেন মামাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল। পরিচ্ছন্ন ডিল। ইয়েলো মাসুম দেড় লাখ নিয়েছে। বাতেন মামা দালালি বাবদ পঞ্চাশ রেখেছে। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের একজন বয়স্ক অফিসার বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
‘আপনি আর বিয়ে করেন নাই?’
‘না।’
‘আপনার এক্স ওয়াইফ খুন হয়ে গেলেন। আপনার কোনো ধারণা আছে, কেন তাঁকে খুন করা হয়েছে?’
‘না। ডিভোর্সের পর আমাদের আর যোগাযোগ ছিল না।’
‘ডিভোর্স?’
‘দুই বছর আগে হয়েছে।’
‘মিউচুয়াল ডিভোর্স?’
‘জি।’
‘আপনার এক্স ওয়াইফের ফাদার আপনাকে খুব পছন্দ করতেন।’
‘জি।’
উইলিস বাড়ৈকে তার প্রাক্তন স্ত্রী লিডিয়া ডি কস্তা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়ানো যায় নাই।
আট বছর পর সেই লিডিয়া ফিরেছে। কেন?
লিডিয়া না লিডিয়ার ইলিউশন? মায়া? ধরতে পারছে না উইলিস বাড়ৈ। লিডিয়ার বয়স সাতাশ এখনো?
উইলিস বাড়ৈ বলল, ‘বাতি জ্বালাই।’
‘না!’
‘কফি বানাব।’
‘অন্ধকারে বানাও।’
‘চোখে কম দেখি।’
‘আমি বানাচ্ছি।’
তবে কিচেনের দিকে গেল না লিডিয়া। বলল, ‘আমি...।’
‘বলো।’
‘তুমি পরে আর বিয়ে করো নাই।’
‘তুমিও করো নাই।’
‘আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
‘ভয় পেয়ে বাতেন মামাকে ধরলে?’
‘বাতেন মামাকে তুমি চিনতে?’
‘কী করে চিনব বলো তো? আচ্ছা, আমরা ভালো থাকি নাই। আমি তোমার অনেক টাকা নিয়ে গেছি। এর জন্য তুমি...আমি ভাবি নাই। কফি খাও।’
‘কফি!’
কফি কখন বানাল লিডিয়া? মগ ধরে আছে।
উইলিস কফির মগ নিল। চুমুক দিল।
‘চিনি ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে। তোমার কফি?’
‘আমার আর পানাহার নাই। বেঁচে থাকাটা কী রকম উইলিস? স্টোরিটেলার তোমাকে বলে গেছে, তুমি অশীতিপর হয়ে মরবে। তুমি সেটা বিশ্বাস করে আছ। বেঁচে আছ, উইলিস। রবীন্দ্রনাথের “সে” পড়ো এখনো।—আমি হতে চেয়েছিলাম একখানা দৃশ্য সবটুকু জুড়ে।—আমি আর কিছু পড়ি না। দৃশ্য হয়ে গেছি। অথচ অ-দৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা বলো? স্টোরিটেলার ফিরবে মনে করো তুমি? সে কি দৃশ্যের গল্প বলতে পারে? দৃশ্যের জন্ম কী
করে হয়?’
মানুষ মরে দৃশ্য হয়ে যায়?
আমরা যাইনি ম’রে আজো—
তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়
—জীবনানন্দ দাশ
মানে কী? মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে কিছু যোগসূত্র আছে দৃশ্যের জন্মের? লিডিয়া মরে দৃশ্য হয়ে গেছে? এ কে তবে?
কফিটা চমৎকার। উষ্ণ ও তরল লাগছে উইলিস বাড়ৈর। আর কী রকম একটা লাগছে। রিমঝিম রিমঝিম। সেটা কি মগজে? বুকের ভেতরে? রক্তকণিকায়? বোঝা যাচ্ছে না। ধরা যাচ্ছে না। ‘তারে ধরি ধরি সন্ধান করি/ ধরতে
গিয়ে আর পেলেম না...।’ সত্যি মনে হচ্ছে লিডিয়াকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেশাপানি করতেন। অর্থাভাবে জীবনানন্দ দাশ নেশাপানি করতে পারেন নাই। জীবনানন্দ দাশ কখনো কফিশপে বসে কফি খেয়েছেন? অধিকতর উষ্ণতা নিয়ে কেন এখানে এখন বসে আছে লিডিয়া?
উইলিস বাড়ৈ কফির মগ রেখে উঠল। লিডিয়াকে টানল। লিডিয়াকে চুমু খেতে খেতে হলুদ বিল্ডিংয়ের ছয়তলার জানালা দেখল। মহিলা হেঁটে ফিরেছে। শাওয়ার নিয়ে এখন ড্রেস চেঞ্জ করছে। এই দৃশ্য কতজন দেখছে? কতজন অন্ধকার থেকে দেখছে? আরে! এত ঠান্ডা কেন লিডিয়ার জিহ্বায়? উইলিস বাড়ৈর লিপ্সা ও জিহ্বা অবশ হয়ে যাচ্ছে সেই ঠান্ডায়! আরে! লিডিয়া কি টেনে নিচ্ছে নাকি উইলিস বাড়ৈকে?—টেনে নিচ্ছে সেই ঠান্ডার ভেতরে...।
তিন দিন পর উইলিস বাড়ৈর মৃতদেহ তার ঘরের দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হলো। তিন দিন ধরে উইলিস বাড়ৈকে দেখা যাচ্ছে না, উইলিস বাড়ৈ ঘরের দরজা খুলছে না এবং উইলিস বাড়ৈ ফোনকল রিসিভ করছে না দেখে লোকাল থানায় খবর দিয়েছিল লোকজন।
দরজা ভেঙে পুলিশ বাহিনীর যে কজন সদস্য উইলিস বাড়ৈর ঘরে ঢুকেছিল, মিডিয়াকে তারা বলেছে, উইলিস বাড়ৈর ঘরে ঢুকে তারা কুঁকড়ে গিয়েছিল যমঠান্ডায়। অথচ উইলিস বাড়ৈর ঘরে এসি নাই। জানালা খোলা ছিল। যে জানালা থেকে সেই হলুদ বিল্ডিংয়ের ছয়তলার জানালা দেখা যায়। উইলিস বাড়ৈর লাশ জমে ছিল ঠান্ডায়, পচন ধরে নাই।
উইলিস বাড়ৈর কবর গোপনঘাটে হয়েছে। গুগল আর্থে গোপনঘাট দেখায় না। তার মানে এই না যে গোপনঘাট নাই। আছে একটা লেয়ারে। সেই গোপনঘাট বরফের মতো ঠান্ডা। নিয়ত সেখানে দৃশ্যের জন্ম হয়।