নাইতে যাবি কে কে

শুক্রবার। সকাল নয়টা। চৈত্র মাসের শেষ প্রায়। ঠা ঠা রোদ। আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশেই এবার একই অবস্থা। তীব্র তাপদাহে হাঁসফাঁস করছে সবাই। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরটা একটা জ্বলন্ত চুল্লিতে রূপান্তরিত হবে। পরিস্থিতি এমন যে কাকেদের স্বাভাবিক ডাকও শোনা যাচ্ছে না, হল্লাহাটি দূরস্থান। গাছের ডালে ডালে, ছায়ায় ছায়ায় জিরোচ্ছে হয়তো ওরাও। বাঁচোয়া এই যে ধানমন্ডিতে বেশ কিছু সবুজ এখনো আছে। আর আছে লেকটা। এক হাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে গলার ঘাম মুছতে মুছতে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে এই সব ভাবছিল রেণু। বাজারের ব্যাগ কোনোমতে কিচেনের মেঝেয় ফেলে দিয়ে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করল সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাফ লিটারটাক পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলল। এত তেষ্টা পেয়েছিল!

পুরো বাসা সুনসান। না, কেউ জাগেনি এখনো। পুত্র ও কন্যা শুক্রবারে সপ্তাহের বাকি ছয় দিনের সকালের ঘুম উসুল করে নেয়। রোজ সকাল সকাল অ্যালার্মের ডাকে উঠতে হয় বেচারিদের। এই একটা দিন বেশ বেলা করেই ঘুমোয়। রেণুর বর উঠবে আরও দেরিতে। দুপুর নাগাদ। এর মধ্যে ছুটা বুয়া এসে তার কাজ করে গেছে। অর্থাৎ বাসা মোছা, বাসনকোসন ধোয়া—এই সব। এই ছুটির দিনেও রেণুর ছুটি নেই। এক্ষুনি কিচেনে ঢুকতে হবে। নাশতা বানাতে হবে। দুপুরের রান্নাও সেরে ফেলবে সে একই সাথে। একা হাতে সব করতে হবে চিন্তা করতেই আগাম ক্লান্তি ভর করে ওর শরীরে। ক্লান্তিটা কাটাতে সোফায় গা এলিয়ে দেয় সে।

মিনিট পনেরো ঝিমোয় রেণু। তারপর আলস্য ঝেড়ে উঠে পড়ে। কিচেনে ঢুকে এককাপ কড়া দুধ–চা বানিয়ে নেয়। উইদাউট সুগার। চা হাতে বেডরুম পেরিয়ে ব্যালকনিতে চলে আসে। দুটো শালিক ব্যালকনির এককোণে ঝোলানো পাত্রে রেখে দেওয়া চাল খুঁটছিল। রেণুকে দেখেই উড়ে গেল তারা। নিমেষেই হারিয়েও গেল রাস্তার উল্টো দিকের জামরুলগাছের নিবিড় পত্রালির আড়ালে। মোড়ায় বসে চায়ে চুমুক দেয় রেণু। টবের নীলমণি লতায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। ঝলমল করছে রোদে। এ বাসায় আসার বছরখানেকেই এই ব্যালকনিকে বেশ একটা কুঞ্জবন গোছের চেহারা দিতে পেরেছে রেণু। ব্যালকনির মেঝেতে রাখা এবং গ্রিলে ঝোলানো টবে টবে বিবিধ ফুলের চারা, অর্নামেন্টারি প্ল্যান্টস। এই কুঞ্জবন একপ্রকার ঠান্ডা, নিঝুম নিরালার শান্তি দেয় রেণুকে। দিনের শুরুর কিংবা দিনের শেষ—চা-টা রেণু ব্যালকনিতেই খেতে পছন্দ করে—কখনো মোড়ায় বসে, কখনো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। এখানে বসেই কখনোসখনো সিগারেটও ফোঁকে। তখন অবশ্য বেডরুমের দরজার ছিটকিনিটা তুলে দেয়। পাছে বাচ্চাদের কেউ এসে পড়ে! বাচ্চাদের সামনে সিগারেটের সংকোচ ঝেড়ে ফেলতে পারেনি এখনো।

চায়ের অর্ধেকটা অবধি খেয়ে আম্মাকে ফোন করে রেণু। পয়লাবারেই পাওয়া গেল আম্মাকে। সাধারণত যায় না।

‘আমি তোরে ফোন দিতে নিছিলাম,’ ফোন ধরেই বলে আম্মা। উত্তেজিত যে বোঝা যায় স্বরেই, ‘তুই তো আবার ইয়োগা ক্লাস শেষে বাজারটাজার কইরা একবারে বাসায় ফিরিস। অই জন্যই একটু দেরি করতেছিলাম।’

‘বুয়া পাইলা? আমি একা একা কত করব, আম্মা? অফিস করা লাগে। দুই বেলা রান্নাবান্না করা লাগে। পারতেছি না আর। তোমার নাতি-নাতনি আর জামাইয়ের স্বভাব তো জানোই। এদের খাওনদাওন, এই–সেই—এর নখরা সামলাব, না অফিস সামলাব কও?’ একনাগাড়ে বলে যায় রেণু।

‘বুয়া তো পাইছি। খানিক আগে আবদুল্লাহপুরে নামছে। তোর সেজ মামির বাসায় কাম করে যে বুয়া, সে–ই ম্যানেজ করছে। আমার বাসায় এখন অরা। এখনই ড্রাইভাররে দিয়া তোর বাসায় পাঠায়া দেব নাকি বুয়ারে?’

‘হ, পাঠাও। আইসা পারলে আইজই কামেও লাগুক। অস্থির হইয়া গেছি আমি!’

ফোন কেটে দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রেণু। পাঁচ বছরের পুরোনো বুয়া চলে যাওয়ার পর এই সপ্তাহ দুয়েকেই নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সত্যি সত্যিই! থ্যাঙ্ক গড যে অবশেষে একজনকে পাওয়া গেছে। পারমানেন্ট একটা বুয়া ছাড়া সংসার চালানো অসম্ভব তার পক্ষে। একচুমুকে বাকি অর্ধেক চা শেষ করে রেণু। চা–টা জুড়িয়ে গিয়েছিল। তবু খেতে খারাপ লাগল না। চা শেষে ঘরে ঢুকে সিগারেট আনে রেণু। বেশ আয়েশ করেই সিগারেটটা টানে। লেকের দিক থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে আসে, ‘মেঘ হও, মেঘ হও!’ রেণু চিনতে পারে ডাকটা। লেকের আড়ে কিংবা দিঘে উড়তে উড়তে ডাকছে মেঘ হও মাছরাঙা। ডাকটা বড্ড মিঠে ঠেকে কানে। বিশেষত মেঘচিহ্নহীন এই সকালে।

সাড়ে দশটা নাগাদ কলবেল বাজল। প্রায় সাথে সাথেই ঘেউ ঘেউ ডাকে বাসার নীরবতার চৌদ্দটা বাজিয়ে কিচেনে, রেণুর কাছে, ছুটে এল লিও। রেণুর পোষা তিব্বতি স্প্যানিয়েল লিও। ভীতুর ডিম একটা। কলবেল বাজলেই আঁতকে ওঠে বরাবরই। এবং ছুট লাগায়। লিওকে শান্ত করতে কোলে নেয় রেণু। কিচেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা খোলে। মুখোমুখি দাঁড়ানো ড্রাইভার হানিফ সালাম দেয়, ‘এই যে আপনের বুয়া, আপা। বুইঝা নেন।’ একগাল হেসে বলে।

হানিফ দরজা থেকেই বিদায় নিলে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জড়োসড়ো নতুন বুয়াকে স্পষ্ট দেখা যায়। চল্লিশের কাছাকাছি একহারা গড়নের শ্যামলা এক মহিলা। চোখমুখে রাত জাগার ক্লান্তি। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রেণু চোখের ইশারায় ঢুকতে বলে তাকে। ইশারা বুঝে বুয়া ভেতরে ঢোকে। ভীত হরিণীর মতো ইতিউতি চায়। হাতের ব্যাগ কোথায় রাখবে, দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি বসবে, বসলে কোথায় বসবে—সম্ভবত এসব চিন্তা করে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে স্থাণু হয়ে।

‘আরে, দাঁড়ায়া আছেন ক্যান? আসেন।’ বলে সারভেন্টস রুমের দিকে এগোয় রেণু, ‘এইটা আপনার ঘর। ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে নেন। ততক্ষণে আমি রুটি সেঁকে আনি। নাশতা করবেন।’

বুয়া মাথা নাড়ে। হ্যাঁ-সূচক।

রুটি সেঁকা হলে বুয়াকে ডাকে রেণু। মহিলা এখনো তার ঘরের চৌকিতেই বসে আছে। রেণুকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে, ‘হাতমুখ ধোয়া নাগিল হয় অ্যাকনা। কোনটে ধুইম, বুবু?’, ‘পিশাবও নাগছে।’ —জুড়ে দেয় সাথে। মুখ নামিয়ে।

‘ওহহো, আমারই ভুল হইছে।’ বলতে বলতে বুয়াকে বাসার কমন ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয়।

একগ্লাস দুধ নিয়ে বুয়ার সামনের চেয়ারে বসে রেণু। কার্ব এড়াচ্ছে সে আজকাল। বুয়া ধীরে রুটি ছেঁড়ে, ডিমের খানিকটা নেয়, মুখে দেয়, চিবোয় আর ঘন ঘন পানি খায়। রেণু তাকিয়ে আছে দেখে একরকম জবাবদিহির স্বরে বলে, ‘হামরা চরুয়া হইলেও ভাতের অব্যাস, বু। তিনবেলা ভাত খাই। ভাতার কোনো দিন আটা আনে নাই হাট থাকি। যতই আকালি দিন হউক, চাউল আনছে। কাউন কি গমের ভাত খাই হাউস করি।’

বুয়ার কথায় মুচকি হাসে রেণু, ‘বাহ! আপনার স্বামী তো তাইলে সুখেই রাখছে আপনারে!’

—ভাতার বাঁচি থাকলে কি আর ঢাকা শহরত কাম কইরব্যার আইসা নাগে, বু! মোর গুষ্টিত কেউ কোনো দিন ঢাকাত আইসে নাই! বলতে বলতে চোখ মোছে বুয়া, ‘তিস্তার চরের মানুষ হামরা। চরুয়া জইন্যে কায়েমত বিয়াশাদি কমে হয়। তারওপর বাপ–দাদা জালুয়া। সাগাইসোদরের ভিতরতে বিয়া হয় হামারগুলার। বাও এক বেটি দেখি বাড়িতেই বিয়া দিছিল চাচাতো ভাইয়ের সাথে। একে আইগনা-খুলি হামার। এ ঘর, ও ঘর।’

শুরুর আড়ষ্টতা কাটতেই হড়বড় করে কথা বলতে থাকে মহিলা। না, স্বামী অনাদর করেনি তার। মাছ ধরে যা রোজগার করেছে, চাহিদা অপূর্ণ থাকেনি কোনো। চরে ধান ফলে কম। তাই বলে ভাতের কষ্ট হয়নি। মাছ বেচা টাকায়ই চাল এসেছে ঘরে, কাপড় এসেছে। ইদানিং নদী দূরে সরে যাচ্ছে। মরেই যাচ্ছে আসলে। নতুন চর জাগছে। পুরোনো চর আর চর নেই তাদের। রীতিমতো কায়েমই হয়ে উঠেছে। ধানের চাষও হচ্ছে। তারাও দশ–বিশ মণ ধান বেচতে পারছিল। মুশকিলটা হলো অন্য জায়গায়। মরা তিস্তার বুকে খালি চর আর চর। কয়েকটি ক্ষীণ ধারা দূর দূর দিয়ে বইছে কোনোমতে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া সেসবে পানি থাকে না। মাছ থাকবে কোত্থেকে! ফলে বুয়ার জবানিতে, ‘ভাতার মোর পাগলা হইল অভাবোত পড়ি। ধান বেচায়া আর কয় টেকা হয়, বু! ঢাকাত ইশকা চলাবার আসিল। আর বাড়ি ফিরিল না। মাইনষের মুখত শুনছোম একসিডিং হয়া মরচে বোলে!

‘ছোট বেটি আর দুধের ছাওয়া ব্যাটাটাক মায়ের হিল্লায় থুইয়া ঢাকাত আইনো, বু। তিনটা প্যাট বুড়া মাও–বাপ, শ্বশুর-শাউড়ি কোটে থাকি পালবে? দেওরেরা তামার নিজের ঘরে সংসারে সামলেবার পায় না। তামাক দোষ দিব্যার নই। দোষ মোর কপালের!’

বুয়াদের গল্প প্রায় কাছাকাছি। সবারই। রেণু শুনে অভ্যস্ত এসব। বুয়ার গল্প থামাতে খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে ইশারা করে। মাথা ধরে গেছে, ‘খাওয়া শেষ করে একটু রেস্ট নেন বুয়া। জার্নি করে আসছেন। একটু ঘুমায়া নেন পারলে।’

দুপুরে শাওয়ার নেওয়ার আগে সারভেন্টস রুমে উঁকি দিল রেণু। দেখল, নতুন বুয়া গুটিসুঁটি মেরে ঘুমোচ্ছে। ডাকতেই বিছানায় উঠে বসে পড়ল।

‘গোসল করে ফেলেন, বুয়া। দুপুর হয়ে গেছে। খাবেন না?’ বলে রেণু।

বুয়া তৎক্ষণাৎ বিছানার একধারে রাখা কাপড়ের ব্যাগ থেকে শাড়ি-গামছা বের করে হাতে নেয়। রুম থেকে বেরোনোর মুখে দরজায় দাঁড়ানো রেণুকে জিজ্ঞেস করে, ‘নদী কোটে? ম্যালা দূর নাকি, বু?’ রেণু পয়লা প্রশ্নটা বুঝতে পারে না। বুয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ‘আগে তো নদী হামার বাড়ির বোগলত আছিল। অ্যালা দূরত চলি যাওয়াতে গাও ধোয়া ক্যাচালে হইছে। বিয়ানকার আন্দাবাড়ি, খাওয়াদাওয়া করিয়া বাইর হইলে ফিরি আইসতে আইসতে জোহরের ওয়াক্ত হয়া যায়।’ বুয়া একমনে বলে যায়।

রেণু বিরক্ত হওয়ার বদলে হেসে ফেলে। বলে, ‘এইখানে ধারেকাছে নদী নাই বুয়া। কিছুটা দূরে থাকলেও সে নদীতে কেউ গোসল করতে যায় না। ওয়াশরুমে যান। গোসলটা সেরে খেতে আসেন।’

ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়ালে চোখ বুজে আসে রেণুর। ভাইয়ের জন্মের পর মাস কয়েক নানির কাছে থাকতে হয়েছিল তাকে। শহরের একা বাসায় আম্মার পক্ষে তাদের দুই ভাই–বোনের যত্ন নেওয়া কঠিনই ছিল বিধায় ওই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পদ্মাপাড়ের নানিবাড়িতে কাটানো ওই মাস কয়েকের স্মৃতি ভুলেই গিয়েছিল সে। রেণুর মনে পড়ে, রোজ দুপুরে পাড়ার কুঁচো–কাঁচার দল নদীতে গোসল করতে যেত। সে–ও ওই দলে ভিড়েছে কত কত দিন! শুরুতে নদীতে নামতে ভয় পেলেও দিন কয়েকেই রপ্ত করেছিল সাঁতার। ওইটুকুন বয়সেই! সে কুঁচো–কাঁচাদের দলে কারা ছিল? কী যেন নাম ওদের? হনুফা, সালমা, খাদিজা, মেহের, আজিজ, বদরু—পরপর সবার নাম মনে পড়ছে। এ বাড়ি–সে বাড়ির উঠান পেরোনোর কালে ওরা গলা উঁচিয়ে ডাকত, ‘নাইতে যাবি কে কে?’

শাওয়ারের জলপতনের ঝিরঝির শব্দ ছাপিয়ে সেই পুরোনো ডাক কানে বাজতে থাকে তার।