ছখিনা বিবি কি বেঁচে আছে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুপুররোদে দেড় মাইল হেঁটে সদর অব্দি এসে রীতিমতো হাঁপাতে শুরু করেছিল ছখিনা বিবি। বয়স তো কম হলো না। মনে পড়ে যুদ্ধের আগেই ফ্রক ছেড়ে ওড়না ধরেছিল, দুধ তো গজিয়েছিলই, মাসিকও মনে হয় শুরু হয়ে গেছিল। সেই হিসাবে বয়স তার ৭০ বা তার বেশিই হবে। তা এ বয়সে এত দূর পায়ে হাঁটা সত্যি ভীষণ কষ্ট। তা ছাড়া পথঘাট আজকাল সব ভালো করে চেনেও না। ছখিনা বিবির নিজের বলে তো কেউ নাই, পাড়ার ছেলে আজিজ্যাকে এত দিন ধরে বলেকয়ে হাতে–পায়ে ধরে রাজি করিয়েছে। ‘ও সোনা আমার। ও নাতি আমার। একবার সরকারি অপিসে নিয়ে যাবি আমারে? কী যে হলো, বুঝলাম না, সাত মাস হয়া গেল, আমার টেকা দেহি দেয় না। আল্লা জানে আমার নাম কাডি দিল নাকি?’

অনেক দিন ধরে বলতে বলতে অবশেষে কলেজপড়ুয়া আজিজের সময় ও দয়া হয়েছে। আগের দিন বিকেলে এসে বলে গেছে, ‘কাইল বিয়ান বিয়ান রেডি হয়া থাইক্কো নানি। আমারও একটা কাম আছে শিক্ষা অফিসে। হেরপর তোমারে সমাজসেবা অফিসে নিয়া যামু নে।’

তা রেডি হবার আর কী আছে? ছখিনা বিবির আছেই দুখানা শতচ্ছিন্ন সুতি শাড়ি। গাঁয়ের বড়লোকেরা ঈদের সময় জাকাতে যা দেয়, তা–ই দিয়ে সারা বছর চলে। এ বছর দুটি শাড়ি পেয়েছে ছখিনা। একটা সাদা আর গোলাপি পাড়, আরেকটা ফুল ফুল ছাপা। আজকের জন্য ছাপা শাড়িটাই বেছে নিয়েছে। এটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। ব্লাউজটা ছেঁড়াখোঁড়া, তাই শাড়ির বড় আঁচল দিয়ে মাথা–পিঠ ঢেকে, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল গলিয়ে আজিজের সাথে সকাল থাকতেই রওনা দিয়েছিল। এই সকালবেলাতেই মাথার ওপর গনগনে রোদ। আর কী যে গরম! গাঁয়ের মাটি যেন তেতে উঠছে। একটু পরপর থেমে পড়তে হচ্ছিল তাকে। মাটিতে বসে পড়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বিরক্ত হচ্ছিল আজিজ। এত সময় লাগালে হবে নাকি? একটা অটোরিকশা নেবার মুরোদও তো নাই। তো এভাবে বারবার থেমে থেমে হাঁচড়পাঁচড় করে দুপুর ১২টা নাগাদ সমাজসেবা অফিসে পৌঁছে দেখে, সমাজসেবা অফিসার কাদের সরকার তখনো আসেননি। কোথায় জানি ইন্সপেকশনে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। এদিকে তেষ্টায় বুক–গলা শুকিয়ে কাঠ। শেষ পর্যন্ত অফিসের বারান্দাতেই সটান শুয়ে পড়ল ছখিনা বিবি।

‘আরে আরে, অ্যাই বুড়ি, করে কী? এইখানে হুতছো ক্যান?’

একজন পিওন গোছের লোক চেঁচিয়ে তেড়ে এল। ‘অ্যাই ওঠো ওঠো। এইটা হুতবার জাগা নাকি?’

ছখিনা বিবি জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘আর পারি না বাপ। এট্টু পানি। এট্টু পানি দেন।’

পিয়নটার দয়া হলো একটু, একজন আয়াকে ইশারা করে বলল পানি এনে দিতে। আয়া একটা টিনের গ্লাসে পানি এনে দিলে ছখিনা বিবি আধশোয়া হয়েই ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে একটু ধাতস্থ হলো। আজিজ ছেলেটা তাকে এখানে দিয়ে চলে গেছে নিজের কাজে। বলে গেছে, ‘নানি, কাম শেষ কইরে তুমারে নিয়া যামু নে।’

‘তা তুমার কাজটা কী?’ বলে উঠল পিয়নটা। ‘এট্টু ওইদিকে সইরা শোও দেখি। ছারে আইসা পড়ব অহন। দেখলে রাগ করব। অহন কও, কিয়ের লাইগা আইছ?’

‘আমার ভাতা বন্ধ হয়া গেছে বাজান।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ছখিনা বিবি, ‘মাসে মাসে ছয় শ টেকা পাইতাম, ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেরম্যানের বাড়িত কাম করতাম না? হ্যায় আমারে কার্ড কইরা দিছিল। গত সাত মাস ধইরা টেকা পাই না। ক্যান আমারে বাদ দিল তাই জানতে আইছি।’

স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন কুলে আর কেউ নাই ছখিনা বিবির। সন্তান হয়েছিল একটা, সে অল্প বয়সে পানিতে ডুবে মারা যায়। স্বামীটা মরল জ্বর–কাশিতে। তারপর এ–বাড়ি ও–বাড়ি ঝিগিরি করেই কাটত। বয়স হলে সেই কাজেও আর কেউ নেয় না। তো ইউপি চেয়ারম্যানের বউকে ধরে এই বয়স্ক ভাতার কার্ডটা করিয়ে নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। মাসে মাসে ৬০০টা টাকা পেত, বাকিটা এদিক–ওদিক থেকে চেয়েচিন্তে চলত। তা সেটাও গেল বন্ধ হয়ে। এখন তো না খেয়ে মরার উপক্রম। কিন্তু সরকার তার ভাতা বন্ধ করল কেন? তার কী দোষ? সে তো নিয়ম করে চেয়ারম্যান সাহেব যখন যাকে ভোট দিতে বলেছেন তাকেই ভোট দিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কখনো কখনো তারা বলেছে, ‘কষ্ট কইরে তুমার ভোট দিতে যাতি হবে না নানি। তুমার হয়া আমগো পোলাপান দিয়া আসবে নে।’

তা সে তো আরও ভালো। এই বুড়ো শরীরে ভাঙা হাঁটু নিয়ে চলাফেরা করা কষ্ট। কেউ যদি তার হয়ে কষ্ট করে ভোটটা দিয়ে আসে, তাহলে তো আরও ভালো হয়। তাই বয়স্ক ভাতা কার্ড করার সময় তার ভোটার আইডি কার্ড চেয়ে নিয়ে গেছিল চেয়ারম্যান। বলেছিল, ‘এইডা আমার কাছে থাকুক। বন্যায়, ঝড়ে, সাইক্লোনে আমি তোরে রেশন তুইলে দিব নে। তুই ভোটার কার্ড দিয়া কী করবি? অ্যাঁ?’

ছখিনা বিবি সানন্দে দিয়ে দিয়েছে। তার দরকার টাকা। মাঝে মাঝে চাল, তেল, নুন। ভোটার কার্ডে তার কাজ কী? কিন্তু এখন সেই ইউপি চেয়ারম্যানও যেন কোথায় পালিয়েছে। থানায় তার নামে নাকি বিস্তর মামলা। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কারা যেন হামলা করেছিল, সব ভাঙচুর করে দামি জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। সেই সাথে ছখিনা বিবির ভোটার আইডি কার্ডখানাও গেছে হারিয়ে। যদিও কার্ডখানা তেমন দামি বস্তু নয় মোটেও। কিন্তু এখন সে কী করে বাঁচে?

‘ভোটার আইডি কার্ড হারাইছেন ক্যান?’ সমাজসেবা অফিসার কাদের সরকার ধমকে উঠল। ‘কাগজপত্র ছাড়া আমি কেমনে খুঁজমু? এই সব কি সহজ কথা নাকি, অ্যাঁ?’

ছখিনা বিবি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ‘আমনের দুইটা পাওত ধরি ছার। দুনিয়াত আমার কেউ নাই। টেকা না পাইলে খামু কী? এট্টু দেখেন ছার।’

‘আরে আমার এত সময় আছে নাকি? এই উপজেলায় বাইশটা গ্রামের আট শ জন বুড়াবুড়ি বয়স্ক ভাতা পায়। আমি এখন সগ্লের নাম ধইরে খুঁজমু নাকি? যান, ভোটার আইডি লয়া আসেন। আসল না থাকলে ফটোকপি বা ছবি একটা কিছু হইলেই হবে।’

কাদের সরকার ধমকে রুম থেকে বের করে দিলে ছখিনা বিবি বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে রইল। দুপুর নাগাদ আজিজ কাজ শেষ করে এসে দেখে, সে বারান্দায় ওভাবেই চুপচাপ বসে আছে। সবকিছু শুনে আজিজ নিজেও ভেতরে গেল একবার খোঁজ নিতে। অফিসার তাকেও ধমক দিয়ে বিদায় করলে সে ফিরে এসে বলল, ‘চলো নানি যাই গা। চেরম্যানের বাড়ি তুমার ভোটার আইডি কার্ড আছে কি না খোঁজ নেও।’

‘চেরম্যান তো সেই কবে থিকা নাই। কই গেছে কেউ জানে না।’ ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থেকে ছখিনা বলে।

‘চেরম্যানের বউরে কও। সে খুঁইজা দেখুক। হয়তো কোথাও পইড়া আছে ঘরে কোনাকাঞ্চায়।’

ছখিনা বিবি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বিবিসাবও বিপাকে পড়ছে। সারা দিন খালি কান্দে। স্বামী কই আছে, খোঁজ জানে না। নতুন নতুন পোলাপান আইসা রোজ নাকি বিরক্ত করে। টেকা চায়। গহনা চায়। নাইলে ঘরত আগুন লাগাইয়া দিব ডর দেখায়।’

‘তাইলে আর কী করবা। অহন চলো, যাই।’

ছখিনা বিবি মাথা নাড়ে, ‘তুই যা নাতি। আমি যামো না। আমি এইহানেই থাকব। দেখি তারা কী কয়।’

‘এইডা কী কও? কতক্ষণ থাকপা? এইটা তো অপিস।’

আজিজ আরও কিছুক্ষণ সাধাসাধি করে, কিন্তু ছখিনা বিবি অনড়। সে কিছুতেই যাবে না। এর শেষ দেখেই ছাড়বে। অগত্যা আজিজ বাড়ির পথে রওনা দেয়।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। অপিসের লোকজনের ব্যস্ততা আর শেষ হয় না। ইদানীং নতুন নতুন নেতাদের আগমন এসব অফিসে। ঘন ঘন চা–নাশতা আসে। নতুন নতুন হম্বিতম্বি শোনা যায়। নতুন নতুন মানুষ। এই সবই বসে বসে দেখে ছখিনা বিবি। খিদেয় পেট জ্বলছে। কাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। চোখে অন্ধকার দেখছে এখন। তবু সে এখান থেকে যাবে না।

বিকেল চারটার দিকে পিয়নটা এসে আবার খেঁকিয়ে ওঠে—‘কী অইছে? অহনতরি যাও নাই? ছারে না কইছে আইডি কার্ড লয়া আসতে?’

ছখিনা বিবি শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘কই যামো। আমার কিছু নাই। কই খুঁজুম এই সব? আমার খালি আমি আছি।’

পিয়নটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলে, ‘ভিত্রে আসো। ছারে ডাকতাছে। বড় যন্তনা করতেছ।’

ছখিনা বিবি প্রায় অন্ধকার ঘরে ঢুকে দেখে সাহেব একটা সবুজ রঙের রেজিস্ট্রি খাতা খুলে বসেছে। মাথা তুলে তাকে দেখে বলল, ‘কোন গ্রাম কইছিলেন?’

‘নুরুল্লাপুর গেরাম। ৭ নম্বর ওয়ার্ড। আমার নাম ছখিনা বিবি।’

অফিসার চশমাটা পরে আঙুল দিয়ে এক এক করে খুঁজতে থাকে। তারপর বিড়বিড় করে বলে, ‘ছখিনা বিবি? নুরুল্লাপুর? স্বামী মৃত মোকলেসউদ্দিন?’

‘হ, হ।’ যেন বিপুল অন্ধকারে একটুখানি ফিকে আলো দেখতে পেয়েছে, এমন ভাবে ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বলে ছখিনা বিবি।

ছখিনা বিবি তো মারা গেছে! এই যে, গত নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ। এই জন্য কার্ড বাতিল হয়ে গেছে।

শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ছখিনা বিবি। মারা গেছে? সে কবে মারা গেল? কীভাবে মারা গেল? দিব্যি সে এদের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ঈদের সময় জাকাতে পাওয়া ফুল ফুল ছাপা শাড়ি—সেই সকাল থেকে বারান্দায় বসে আছে, আর এরা বলছে সে মারা গেছে? সকালবেলা দেড় মাইল পথ তাহলে কে হেঁটে এল? তার লাশ নাকি?

‘এইডা কী কন ছার? আমি কেমতে মরলাম? কুনদিন মরলাম?’

‘এই যে পষ্ট লেখা। ছখিনা বিবি, বয়স ৬৮ বছর, স্বামী মৃত মোকলেসউদ্দিন, গ্রাম নুরুল্লাপুর, ৭ নম্বর ওয়ার্ড, লালপুর উপজেলা বিগত ৮ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করায় তার কার্ড বাতিল করা হইল।’

এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ছখিনা বিবি। ‘এই সব কী কইতেছেন ছার? আমি মরি নাই। এই যে আমি বাঁইচ্যা আছি। আমনে আমার গেরামের লোকরে জিগ্গাস করেন। মরলে তো লাশ দাফন হইত। ও আল্লা, কে আমার এত বড় সব্বোনাশটা করল?’

পিয়ন আর আয়া দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কিছুক্ষণ। কী আশ্চর্য ব্যাপার! ছখিনা বিবির চিৎকার উপস্থিত লোকজন কান খাড়া করে শুনছে। এখানে আজব কিছু ঘটছে। আজব জিনিসের প্রতি এই দেশের মানুষের খুবই আগ্রহ। তারা কেউই আর এ জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে না। সবাই মজা দেখছে এখন। নুরুল্লাপুর গ্রামের ছখিনা বিবি জীবিত না মৃত, কী ফয়সালা হয় দেখা যাক।

কাদের স্যার মোটা বইটা বন্ধ করে বললেন, ‘আপনের চেয়ারম্যান এখন আর নাই। উনি পলাতক। এখন নতুন নতুন নেতা বাইর হইছে। তারা নতুন তালিকা করবে। নিজেদের লোকজনকে ভাতা দিবে। যারা কিনা তাদের সময়মতো ভোট দেবে, তেমন মানুষের লিস্ট করবে। আপনারে তো তারা চিনে না।’

‘ভোট?’ ছখিনা বিবির চোখ ভরে পানি আসে। এইটা কোন কথা? ভোট তারা যাকে দিতে বলবে সে তো তাদের দিতে এক শ বার কেন দুই শ বার রাজি। তাই বলে তার নাম কেন কাটা যাবে? তার চেয়ে বড় কথা, তাকে মেরেই ফেলবে কেন?

জানা গেল, মৃত্যুর খবরটা কেবল রটনা নয়, তার ডেথ সার্টিফিকেটও কারা যেন জমা দিয়ে গেছে। তার মানে এটা প্রমাণিত যে সে সত্যি মারা গেছে। এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নাই। এই শেষ বিকেলে ছখিনা বিবির এই একই সাথে মরে যাওয়া ও বেঁচে থাকার অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে বেশ ভিড় জমে গেছে সমাজসেবা অফিসে। দিব্যি জলজ্যান্ত একটা মানুষ, তাও বলে ডেথ সার্টিফিকেট আছে! কী আজব দেশ রে বাবা! লোকজন মাথা নাড়ে, এই দেশে অসম্ভব বলে কিছু নাই।

কাদের স্যার মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমাদের কিছু করার নাই ছখিনা বিবি। মরার কাগজপত্রসুদ্ধ দাখিল করা। মরা মানুষরে আমরা আবার বাঁচামু কেমনে?’

‘কিন্তু আমি তো মরি নাই!’ আর্তনাদ করে উঠল ছখিনা বিবি, ‘আমি তো জেতাই আছি।’

‘আরে আপনি বুঝতে পারতেছেন না। আমাদের কাগজপত্রে আপনি আর নাই। তাই ওই কার্ডটা আরেকজনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হইছে।’

‘এইডা কী কন ছার?’ ছখিনা বিবির মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দশা হয়। বুড়ি আয়াটা কোনোমতে তাকে ধরে বসায়। সে এবার মাথা চাপড়াতে থাকে, ‘আমি মরি নাই ছার! বিশ্বাস করেন, দেখেন এই যে আমার হাত–পাও। এই যে চোউখ–মুখ। এই যে মরার পেট। এই পেটডার লাইগাই তো যত ঝামেলা। খালি খিদা লাগে। খিদা লাগলে পেটডা জ্বলে। পেট না থাকলে তো আর এইহানে আইতাম না। আপনে কিছু একটা করেন ছার। সত্যি কলাম আমি মরি নাই।’

বিকেল পাঁচটায় অফিস ছুটি হয়ে গেলে সবাই একে একে চলে যায়। ছখিনা বিবি তখনো বারান্দায় মরার মতো পড়ে থাকে। তার শীর্ণ শরীরটার দীর্ঘ ছায়া পড়ে উঠানে। মরে গেলে কি তার ছায়া পড়ত? হায় আল্লাহ, তার মরে যাওয়াই বোধ হয় ভালো ছিল। কিন্তু আল্লাহ তো তার মরণ এখনো দেয় নেই। চাইলেই তো আর যখন তখন মরে যাওয়া যায় না।

সন্ধ্যা নামলে নিজেকে টেনে তুলে গাঁয়ের পথে রওনা দিল ছখিনা বিবি। আকাশে আধখানা মলিন চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় গাঁয়ের পথ দেখা যায় কি যায় না। ছখিনা বিবি সকালের মতোই হাঁচড়পাঁচড় করে উষ্টা খেতে খেতে নিজের ভাঙা কুটিরের দিকে ভূতের মতো হেঁটে যায়। সে কি তবে সত্যি মরে গেছে? এই শরীরটা কি তার, নাকি সে শেওড়াগাছের পেতনি হয়ে গেছে এত দিনে? কী আশ্চর্য ব্যাপার, মরে গেল অথচ সে একটু টেরও পেল না?

এ ঘটনার ১০ দিন পর জেলা সদর থেকে একজন জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক কীভাবে খবর পেয়ে যেন ছখিনা বিবির সংবাদ নিতে নুরুল্লাপুর গাঁয়ে এসে পৌঁছান। একে ওকে জিজ্ঞেস করে বুড়ির ভিটা অব্দি এসে তিনি দেখেন, ভিটায় একটা নেড়ি কুকুর কেবল বসে আছে। কোথাও কাউকে আর দেখা যায় না। অচেনা লোক দেখে পাশের বাড়ি থেকে আজিজ নামের তরুণ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কারে চান? আপনে কে?’

‘আমি শেখর। দৈনিক সময়ের কথার সাংবাদিক। এইটা ছখিনা বিবির বাড়ি? যাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা কার্ড বাতিল করা হয়েছে?’

‘জি, এইটাই ওনার বাড়ি।’

‘উনি কোথায় বলতে পারবেন? আমি ওনার ইন্টারভিউ করতে আসছি। সমাজসেবা অপিসেও গেছিলাম। সব সংবাদ সংগ্রহ করেছি। কারা এই কাজ করছে তা–ও বের করেছি।’

আজিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নানি তো নাই। নানি মইরা গেছে।’

‘মানে?’

‘ডেথ সার্টিফিকেটে যে তারিখ লেখা ছিল, তার সাত মাস তিন দিন পর নানি আসলেই মারা গেছে। এখন আর কুনো সমস্যা নাই।’