পান-পানি জর্দা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

উত্তরের বাড়ির বুড়ির কথা মনে পড়তেই রাহেদার দীর্ঘশ্বাস আসে, মোটাসোটা দেহটা হিম হয়ে যায় আর সে হাতের সুই-সুতা ফেলে দিয়ে কাঁথার ওপরেই শুয়ে পড়ে! বুড়ি বলে, ‘নারীজন্মে ক্ষয় ছাড়া কোনো জয় নাই।’

বাইরে গ্রীষ্মের দুপুর। খোলা জানালা দিয়ে হলহল করে ঘরে ঢুকছে গরম বাতাস আর ঘুঘু পাখির গলা। সুরটা এত করুণ! এসব শুনতে শুনতে, ভাবতে ভাবতে রাহেদা বালিশ ছাড়া আধা সেলাই করা কাঁথাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। দুঃখ, অপমানে তার ভেতরটা থেঁতলে গেছে। এখন আছে শুধু একটা অন্ধবিশ্বাস। হাকিম রায় দেওয়ার আগে অবশ্যই তার মতো অসহায় নারীর কথা বিবেচনা করবেন। আর যতবারই এই চিন্তাটা করে, ততবারই যেন পাশ থেকে তাইজুর মা বিদ্রুপের গলায় জানতে চায়, ‘আর যদি হাকিমের হুকুমে তালাক বহাল রয়?’ এ সময় ঘুমন্ত রাহেদার মোটা মোটা বেমানান ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। বোঁচা নাকের পাশে টলমল করতে দেখা যায় এক ফোঁটা অশ্রু।

রাহেদার মা কী একটা দরকারে মেয়ের ঘরে এসে দেখেন অভাগীর বেটি বালিশ ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়েছে! তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলেন, ‘এই নিষ্পাপ রে একটু রূপ দিলে কী এমন ক্ষতি হইত গো আল্লাহ!’

দুঃখ, অপমানে তার ভেতরটা থেঁতলে গেছে। এখন আছে শুধু একটা অন্ধবিশ্বাস। হাকিম রায় দেওয়ার আগে অবশ্যই তার মতো অসহায় নারীর কথা বিবেচনা করবেন। আর যতবারই এই চিন্তাটা করে, ততবারই যেন পাশ থেকে তাইজুর মা বিদ্রুপের গলায় জানতে চায়, ‘আর যদি হাকিমের হুকুমে তালাক বহাল রয়?’

রাহেদা সরল, সৎ আর ধর্মপ্রাণ। থলথলে মোটা আর কদাকার চেহারার জন্য বোধ করি এইচএসসি পরীক্ষার পরও তার বিয়ের জন্য কোনো প্রস্তাব এল না। তার নিজের মা-বাবাও ধরেই নিয়েছিলেন যে তাঁদের কুশ্রী মেয়েটাকে কেউ নেবে না। কিছুদিনের মধ্যেই রাহেদাকে বাপের সংসারের কাজ আর নামাজ-কোরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। অবসরে নকশিকাঁথা সেলাই করে। মাসে মাসে পাইকার বাড়ি এসে নগদ টাকা দিয়ে নিয়ে যায়। কামাই মন্দ না।

‘পুরুষ মানুষের কাছে গুণের চেয়ে রূপের কদর বেশি’—এ কথা মনে হতেই রাহেদার মায়ের চিনচিন করে ব্যথা ওঠে। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে গিয়ে থমকে দাঁড়ান। বিছানা থেকে একটা বালিশ এনে মেয়ের মাথার নিচে গুঁজে দিতে দিতে আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এই হইল মেয়েলোকের নসিব!’

একটু পরে কলা নিতে আসেন রাহেদার বাবা। তিনি কলা ব্যবসায়ী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঁচা কলা কিনে এনে রাহেদার রুমের কোনার দিকে জড়ো করেন, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে মেশিন দিয়ে ওষুধ দেন, রাতারাতি কাঁচাকে পাকা করেন। লোকটার সাদা দাড়িতে বাজারের ধুলা, কপালের ঘাম। তিনি ঘুমন্ত মেয়েকে একনজর দেখেন। বুকটা অসার লাগে। তাকাতে ভয় হয়। পাঁচ বছরের চেষ্টা আর নগদ তিন লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন একটা বাটপারের সাথে। এখন ঘরের মেয়ে ঘরেই ফিরে এসেছে। মাঝ থেকে তিন লাখ টাকা...রাহেদার বাবার বুকটা গ্রীষ্মের দুপুরের মতো জ্বলে।

রাহেদার মগজের সবুজ সুতাটা ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে; স্বপ্নের মতো কতকগুলো দৃশ্য দেখে: কাল তার বিচারের রায়। স্বামী তাকে কিল-লাথি দিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। চলে আসার সময় পেছন থেকে হুকুমের সুরে বলেছিল, ‘তর বাপের কাছতে দশ হাজার টাকা আনবি, না আনতে পারলে আর আইছ না।’ রাহেদার বাবা কতবার টাকা দেবেন? টাকা দিয়ে সব পাওয়া গেলেও পুরুষ মানুষের মন পাওয়া যায় না—এই সত্য বিবেচনায় রাহেদার হিসাবি বাবা নারী নির্যাতনের মামলা করেছিলেন। বাপ-বেটি প্রায় তিন বছর আদালতের বারান্দা দিয়ে খুব ছোটাছুটি করেছেন। আগামীকাল সেই মামলার রায়।

ঘুমের মধ্যেই রাহেদা বাঁ হাত দিয়ে তার উঁচু কপালটা একটু ঘষাঘষি করে। শ্বশুরবাড়িতে উনিশ-বিশ হলেই তার শাশুড়ি মুখ মুচড়ে বলত, ‘গোঁজকপাইল্যা হস্তিনী নারী, থপথপাইয়া হাঁটে আর স্বামীর আয়ু খায়।’

উত্তরের বাড়ির বুড়ির কাছে পুরুষ মানুষ অবুঝ কিংবা বিচারবুদ্ধিহীন পাগলা ষাঁড় হলেও রাহেদার কাছে পুরুষ মানে নষ্ট মানুষ। সুযোগ পেলেই মেয়েলোকের বুকের দিকে তাকায়। তার জীবন নামক ভান্ডতে এসব গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয়। তার অভিজ্ঞতাগুলো বলে, নারীর জীবনে শুধু পরত পরত অন্ধকার আর শূন্যতা ছাড়া কিচ্ছু নেই। বাবা-ভাই-স্বামী...সত্যি বলতে কেউ তার আপন নয়।

রূপ নেই বলে রাহেদা অবহেলায় বড় হয়েছে। তার জীবনে ভালোবাসার কোনো স্মৃতি নেই। ছেলেরা কোনো দিন তার দিকে দুবার তাকায়নি। যৌবনের শুরুতেই এসব আবিষ্কার তাকে ঠেলে দিয়েছিল ধর্মের দিকে।

মা মনে মনে চাইতেন রাহেদা তার মেজ ভাইয়ের সঙ্গে গার্মেন্টে চাকরি করুক। বাবা তো ভাত খেতে বসে প্রায়ই বলতেন, ‘লেখাপড়াত লাভ নাই। এই ডিজিটাল যুগে কলা বেইচ্যা বাঁচুন যায়?’

সুই-সুতা নিয়ে কাজ শুরু করলে রাহেদার শিল্পীমনটা জেগে ওঠে। জ্বলাধরা মনটা তখন বাবুই পাখির মতো বুননে ডুব দেয়। স্বামীর বাড়িতে তার শোবার ঘরটা ঝকঝক করত। অবসরে সে প্রাচীন বুড়িদের মতো যত্ন করে নকশিকাঁথা বুনত। লাউ-শিমের বীজ রুয়া, মাচা ঠিক করা—সবখানে রাহেদার লক্ষ্মী হাত নীরবে চলছে।

রাহেদা ঘুমের মধ্যে বাঁ থেকে ডান দিকে পাশ ফেরে। তার ভারী ভারী বুক উঁচু থেকে সামনের দিকে ঢলে পড়েছে। লাউয়ের মতো বড় বড় হাত-পা সারা কাঁথা দখল করে রেখেছে। একটু দূর থেকে দেখলে, মাংসের একটা স্তূপ মনে হয়। তবু তার ঘুমন্ত আত্মার মধ্যে একটা সুন্দর মন প্রার্থনার ভঙ্গিতে জেগে থাকে। সে ভালোবাসে ঘর আর কাজ। হাদিস-কোরআন, সত্য ও সুন্দর। ভীতু, লাজুক আর চাপা স্বভাবের রাহেদা স্বামীর ভালোবাসাটা সব সময় নীরবে উপভোগ করত। স্বামী তাকে বারবার আদর করুক, বুকে উঠে যতক্ষণ ইচ্ছা মর্দামি করুক। সে চাইত স্বামীর প্রেম। স্বামী চাইত টাকা। রাগে গড়...ড় গড় করে বলত, ‘টাকা দে মুটকি-চুতমারানি, আমি তরে টাকার লাইগ্যা বিয়া করছি।’

সুই-সুতা নিয়ে কাজ শুরু করলে রাহেদার শিল্পীমনটা জেগে ওঠে। জ্বলাধরা মনটা তখন বাবুই পাখির মতো বুননে ডুব দেয়। স্বামীর বাড়িতে তার শোবার ঘরটা ঝকঝক করত। অবসরে সে প্রাচীন বুড়িদের মতো যত্ন করে নকশিকাঁথা বুনত। লাউ-শিমের বীজ রুয়া, মাচা ঠিক করা, গাইয়ের দানাপানি, মাছ কোটা—সবখানে রাহেদার লক্ষ্মী হাত নীরবে চলছে।

স্কুলে পড়ার সময় রাহেদার এক হিন্দু বন্ধু ছিল। নাম তার রূপা দাশ। বন্ধুর কাছ থেকে সে তাদের ধর্ম বিষয়ে যতটুকু জেনেছে তাতেই সে বুঝতে পারে—সব ধর্মই সত্য-সুন্দর আর প্রেমের কথা বলে।

মানুষটা যতই নষ্ট হোক, হাকিম হুকুম দিলে সে টাইট হতে বাধ্য। রাহেদাও হাসিমুখে তার স্বামীর ঘরে গিয়ে উঠবে। যত ইচ্ছা মদ-গাঁজা টানুক, তার দেহটাকে যতভাবে পারে ভোগ করুক। কিল-থাপ্পড় দিলে সে হজম করবে। পরনারীর সাথে যত ইচ্ছা শুয়ে থাকুক, রাহেদার কোনো অভিযোগ থাকবে না। বুড়ি বলে, সবুরে মেওয়া ফলে। এই কথাটা ঠিক না ভুল? কঠিন বাস্তবতা রাহেদাকে ধন্দে ফেলে। মনে খটকা লাগে। অভিজ্ঞতার নিষ্ঠুর আগুনে ঝলসানো যুক্তিগুলো তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। ভেংচায়!

ঘুমের মধ্যেই রাহেদা ছায়া ছায়া দৃশ্যগুলো দেখতে থাকে: বুড়ির জন্য ছেঁচা পান–সুপারি নিয়ে ঘরে আসে তাইজুর মা। কালো আর শক্ত শক্ত গতর-গড়নের মাঝবয়সী নারী। তাইজুর মায়ের নাম উঠলেই পাড়ার মানুষ বলে, ‘খরদজ্জাল মাগি। কয়দিন পরে পরে লাং বদলায়।’

তাইজুর মায়ের চওড়া কপালের দিকে কয়েকটা সাদা চুল ছাড়া সব বুঝি ঠিকঠাক? দাহাবাজ মেয়েলোক। থপথপ করে হাঁটে। হাঁসের মতো বাকবাক করে কথা কয়। যৌবনে চার–চারটা পুরুষের ঘাড় মটকে চলে গিয়েছিল ঢাকায়। অনেক বছর মেসে মেসে রান্না করেছে। ধান্দাবাজি, নষ্টামির মধ্য দিয়ে জীবনটাকে সে ভোগ করছে ইচ্ছেমতো। বয়স পড়তে শুরু করলে গ্রামে ফিরে আসে। বন্ধ্যা মেয়েলোকটাকে কেন যে মানুষ তাইজুর মা বলে ডাকে, সে-ও এক রহস্য!

রাহেদার দিকে চোখ পড়তেই তাইজুর মা ফুঁসে ওঠে, ‘এই রকম জামাইয়ের মুখে পেশাব কর, মা। মাওনা-জৈনা-গাজীপুরে কতকত ফ্যাক্টরি...কয় ফোঁটা ল্যাড় ছাড়া ব্যাডা-মাইনষের কী আছে?’

তাইজুর মায়ের ভাষণে রাহেদার মনটা খানখান হয়ে যায়। তার জন্য দুনিয়ার কোথাও শ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা নেই! মনটা যখন আর মানে না, কষ্টে বুকটা যখন ফেটে যেতে চায় তখন রাহেদা আসে বুড়ির কাছে। বুড়ি একটা আশা। ধনে-জনে, দীর্ঘ আয়ু, চিকন বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতায় এই পাড়াতে বুড়ি একটা বটগাছ। রাত পোহাতেই বুড়ির বাড়ির গাছে গাছে গান গায় পাখপাখালি, খাওয়ার লোভে আসে বিলাই-কুকুর আর রাহেদার মতো দুঃখীরা যায় মনের ঘায়ে সান্ত্বনার মলম লাগাতে। মনের দুটো কথা বলতে না বলতেই তাইজুর মা চিকার মতো দুর্গন্ধ ছড়ায়। শহরে-বাজারে চরাট করে আসা এই মেয়েলোকটাকে দেখলেই রাহেদা তার বড় শরীরটাকে ছোট করে ফেলতে চায়। যতটা সম্ভব বুকটুক আড়াল করে ফেলে। মহিলা প্রথমেই তার বুকের দিকে তাকায়। রাহেদার হাদিস-কোরআন বলে, তাইজুর মায়ের মতো মেয়েলোকেরা কামুক পুরুষের চেয়ে কম না। তাদের সামনেও পর্দা করা উচিত।

একটু রূপের জন্য মাঝেমধ্যে রাহেদার বুকটা খাঁ খাঁ করে। বিশ্বাসের ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে চায়! রাতের পর দিন, শীতের পর আসে বসন্ত। গাছেরা পাতা বদলায়। সাপেরা নতুন চামড়া গায়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। পাখিরা দল বেঁধে দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে যায়।

পরদিন দুপুর। ইতর-বাটপার আর মামলাবাজ মানুষে গিজগিজ করছে জজকোর্ট। গত তিন বছর কোর্টের বারান্দা, মুহুরি-উকিল...চিনতে চিনতে রাহেদার চেনা পৃথিবীটাই উধাও! চিন্তা-চেতনাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন তার নিজের জীবনটাকেই অদ্ভুত লাগে; সংসারের রিতি-নীতিগুলোকে মনে হয় আচাভুয়া। তাই মাঝেমধ্যে বিদ্রোহের আগুন তার ছোট ছোট অসুন্দর চোখ দুটোতে জ্বলজ্বল করে।

তার জন্য দুনিয়ার কোথাও শ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা নেই! মনটা যখন আর মানে না, কষ্টে বুকটা যখন ফেটে যেতে চায় তখন রাহেদা আসে বুড়ির কাছে। বুড়ি একটা আশা। ধনে-জনে, দীর্ঘ আয়ু, চিকন বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতায় এই পাড়াতে বুড়ি একটা বটগাছ।

কোর্টের গেট পেরিয়ে দুই পাশের সারি সারি রেস্টুরেন্টগুলোর একটাতে বাবার সঙ্গে রাহেদাকে বেহাল দশায় বসে থাকতে দেখা যায়। ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের মেয়েটা তার জন্মদাতার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসে। বাপকে বুঝি একটু খুশি খুশি লাগে! মোহরানার সঙ্গে খোরপোষ বাবদ স্বামীর কাছ থেকে সে মোটা টাকা পাবে। অনেক দিন ধরেই তার বাবা একটা ফিকিরে ছিলেন। কিছু টাকা মজুদ আছে, আর কিছু জোগাড় হলেই তার বড় ভাইকে বিদেশে পাঠাবেন।

রাহেদার বাবা হাত–মুখ ধোয়ার জন্য বেসিনের দিকে চলে যান। ফাঁকা ফাঁকা রেস্টুরেন্টে সে বসে আছে। চারপাশে শুধু ধান্দা, চালবাজি, রক্তের সম্পর্কের মধ্যেও স্বার্থ দাঁত উঁচিয়ে আছে!

হঠাৎ রাহেদার সামনের টেবিলে একজন তরুণ এসে বসেই ডাল-ভাতের আদেশ দেয়। শুধু ডাল-ভাত! ময়লা জিনস আর লাল গেঞ্জিতে তাকে শ্রমিকের মতো লাগে। এই ছেলেটার সঙ্গে রাহেদার বাবার পরিচয় হয়েছে আদালতেই। নারায়ণগঞ্জের একটা কারখানায় সে চাকরি করত। বাড়িতে ঘর করার জন্য তিলে তিলে কয়েক লাখ টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে বউ পালিয়ে গেছে প্রেমিকের সঙ্গে। তাই বেচারাকেও বউয়ের সঙ্গে মামলা লড়তে হচ্ছে। কথায় কথায় একদিন রাহেদার বাবার কাছে বলেছিল, আর কোনো দিন সে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করবে না। সুন্দরের মধ্যে বান্দর।

শক্তপোক্ত দেহের মানুষটার মধ্যে একধরনের বুনো তারুণ্য আছে। বসেই কামুক চোখ দুটো সে রাহেদার বুকের দিকে তাক করে ফেলে। আগের দিনের মতো দিন থাকলে ভয়-লজ্জায় রাহেদা কুঁকড়ে গিয়ে আড়াল করে ফেলতে চাইত। কিন্তু আজ হাকিমের হুকুম শোনার পর থেকে তার ছোট ছোট চোখ দুটোতে এই মেঘ তো একটু পরেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কড়া রোদ!

ছেলেটা তাকিয়েই আছে! নিশ্চয়ই তার বাবার কাছ থেকে মামলার রায়টাও শুনে থাকবে। রাহেদার শরীরটা শিরশির করে ভেঙে আসছে। সে হিতাহিত ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোরকার গোপন পকেট থেকে মোবাইল বের করে খামাখাই নম্বর টেপাটেপি শুরু করে। কালো আর গরিবি চেহারার হলেও ছেলেটার চওড়া কপাল, ভাসা ভাসা চোখ। ভালো লাগে। খাঁচায় বন্দী পাখিটা কী এক আশায় পাখা ঝাপটায়, মাছরাঙার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়!

নম্বর টেপাটেপি করে রাহেদা ছেলেটার মন বুঝতে চায়। ছেলেটা ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বাঁ হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা স্মার্টফোন বের করে। তারপর রাহেদার চোখে চোখ রেখে সে-ও খামাখাই মোবাইল টেপাটেপি শুরু করে। এতেই রাহেদার কান দুটো গরম হয়ে যায়। বুক ঢিপঢিপ করে। সে নিশি পাওয়া মানুষের মতো তার টেবিল থেকে গলা বাড়িয়ে, ফিসফিস করে নিজের মোবাইল নম্বর ছেলেটাকে বলে দেয়। তরুণও কারিন্দা পুরুষ, রাহেদার বলে দেওয়া সংখ্যাগুলো পুতপুত করে লিখেই প্রেমিকাকে একটা মিসড কল দিয়ে দেয়।

রাহেদার বাবা গিয়েছিলেন বেসিনে হাত-মুখ ধুতে। তিনি ফিরে এসে ব্যাগ থেকে গামছা বের করে দাড়ি-মুখ মুছতে মুছতে রাহেদাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা, ভাতের লগে কী খাইবা, মাছ না গোশত?’

রাহেদার বাবার পেছনের টেবিল থেকে প্রেমিক পুরুষটি এখনো তার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে। আচানক ভালো লাগায় রাহেদার বুক কাঁপতেই থাকে। দেহমনে কেমন জানি একটা নেশা নেশা ভাব চলে এসেছে।

রাহেদার বাবা আবার জানতে চান, ‘মাছ না গোশত?’

রাহেদার কাছে তার বাবার গলা মিষ্টি লাগে! আদালতের রায়ে তার বাবা খুব খুশি? মেয়ের জন্য একটুও রোদন নেই! রাহেদার ভারী শরীরটা আরেকবার কেঁপে ওঠে। জীবনের সব সম্পর্কগুলো অর্থহীন অসারতায় চোখের সামনে দুলতে থাকে। ছোট ছোট কালো চোখ দুটো ছলছল করে। সে পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। সেখানে নোংরা আবর্জনার স্তূপ। তার মধ্যে ঝকঝকে তরুণ একটা ধুতুরাগাছ। সাদা ফুলগুলোতে স্বর্গের হাসি!

রাহেদার বাবা আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘কী খাইবা মা?’

বিরক্তিতে সে বোরকার নেকাবটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলে। তারপর সামনে বসা ছেলেটার চোখে চোখ রেখে দ্বিধাহীন গলায় বাপকে জানায়, ‘ভাতটাত কিচ্ছু লাগত না, খালি এক গেলাস ঠান্ডা পানি আর বেশি কইরা জর্দা দিয়া এক খিলি পান।’