মেজর সাদুল্লাহ খানের সামনে একটা ছেলে বসা। বয়স বড়জোর আঠারো। কলেজে পড়ে সম্ভবত। এই বয়সে ছেলেপেলেদের রক্ত একটু গরমই থাকে। এরও আছে। রক্ত বেশি গরম হলে অবশ্য নানা রকম সমস্যা হয়। অনেক সময় সেই সব সমস্যার পরিণতি ভালো হয় না। এরও মনে হয় ভালো কিছু হবে না। সাদুল্লাহ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করল, ‘তুমহারা নাম ক্যায়া হ্যায়?’
ছেলেটাও উত্তর দিল নিরাসক্ত ভঙ্গিতে, ‘সালাহউদ্দিন।’
ছেলেটার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি দেখে ভেতর ভেতরে একটু অবাক হলেও বুঝতে দিল না সাদুল্লাহ খান। এ ধরনের ছেলেরা জেরার প্রথম দিকে বেশ কঠিন একটা ভাব দেখায়। কিন্তু জেরা যখন শেষ হয়, তখন এদের বেশির ভাগই হয় ভেঙে পড়ে, না হয় মারা যায়। আর এই ভাঙার কাজটা বেশ ভালোই পারে সাদুল্লাহ খান। এ জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তার বেশ নামডাকও আছে। কঠিন কারও কাছ থেকে কথা বের করতে ব্যর্থ হলে ডাক পড়ে তার। এমন কত ছেলেপেলের মুখ খুলে ফেলল। সালাহউদ্দিনও ব্যতিক্রম হবে না।
ছেলেটা যে বেশ কঠিন, তা তার চেহারার বর্তমান অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কথা বলানোর জন্য এর আগে একদফা চেষ্টা করা হয়েছে। মারের চোটে তার ডান চোখটা ফুলে গিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নিচের দিকের ঠোঁটের বাঁপাশটা কেটে গিয়ে রক্ত জমাট বাঁধতে ধরেছে।
ছেলেটাকে ধরা হয়েছে নিজের বাড়ি থেকে। এ জন্য অবশ্য একটু বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছে। বাবাকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে ক্যাম্পে। আর তাতেই কাজ হয়েছে। সুড়সুড় করে হাজির হয়েছে বাড়িতে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার সময়ই ধরা হয়েছে ওকে। এখন কথা বের করার পালা। স্বাভাবিকভাবেই শুরু করে সাদুল্লাহ খান।
‘ক্যায়া তুম মুক্তি হো?’
‘হু।’ উত্তরটা এল খুব সরল ভঙ্গিতে। কথা ঘোরানোর কোনো চেষ্টাই নেই। একটু অবাকই হলো সাদুল্লাহ খান। সাধারণত এরা শুরুতে মিথ্যা বলে। তারপর একটু একটু করে সত্য বলা শুরু করে। কিন্তু এই ছেলে প্রথমেই স্বীকার করে ফেলল!
‘তুমহারা ওউর সাথিলোগ কাহাঁ হ্যাঁ?’
‘জানু না।’
‘ঝুট বোলতা হ্যায়!’ একটু চিৎকার করেই বলল সাদুল্লাহ খান। ভয় দেখানোর একটা প্রাথমিক চেষ্টা।
সালাহউদ্দিন চুপ করে রইল। ওর চোখে কোনো ভয় নেই। এবার সাদুল্লাহ খান টেবিলে একটা চাপড় দিল।
‘তুমহারা ক্যাম্প কাহাঁ হ্যায়?’
নীরবতা।
ছেলেটার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি দেখে ভেতর ভেতরে একটু অবাক হলেও বুঝতে দিল না সাদুল্লাহ খান। এ ধরনের ছেলেরা জেরার প্রথম দিকে বেশ কঠিন একটা ভাব দেখায়। কিন্তু জেরা যখন শেষ হয়, তখন এদের বেশির ভাগই হয় ভেঙে পড়ে, না হয় মারা যায়। আর এই ভাঙার কাজটা বেশ ভালোই পারে সাদুল্লাহ খান।
‘বাত কর! নেহি তো...’ হুমকি দিতে গিয়ে থেমে গেল সাদুল্লাহ খান। এ ধরনের হুমকি বোধ হয় এখন আর কাজ করবে না। তবে সময় লাগবে না বেশি। ধৈর্য ধরতে হবে। সালাহউদ্দিনের মতো কঠিন ব্যক্তিদের মুখ খোলানোর নানা কৌশল জানা আছে তার। প্রথমেই খুব বেশি চাপ দিলে কাজ হয় না। আস্তে আস্তে চাপের মাত্রা বাড়াতে হয়। আগুনের তাপ যেমন ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়, ঠিক তেমনি।
‘তুমহারা বাপ কা কোয়ি পাতা হ্যায়?’ সাদুল্লাহ খান জিজ্ঞেস করল।
এই প্রশ্নে সালাহউদ্দিনের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল। সাদুল্লাহ খান বুঝল, দুর্বল জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে।
‘কেমন আছে আব্বা?’ সালাহউদ্দিন জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক হ্যায়। লেকিন ইয়ে তুম পার মনহাসির হ্যায় কে ও কাব তক ঠিক রেহতা হ্যায়...’
সালাহউদ্দিন চুপ করে রইল। তার মুখে একধরনের দৃঢ়তা।
সাদুল্লাহ খান বুঝতে পারে, এই ছেলেকে ভাঙতে সময় লাগবে। তবে অসম্ভব কিছু নয়।
‘লে জাও ইসকো।’ সাদুল্লাহ খান দুজন সৈন্যকে নির্দেশ দিল।
২.
ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর ক্যাম্প। অক্টোবর মাসের ১১ তারিখ। শীত আসি আসি করছে। সন্ধ্যা হয়ে এল। সালাহউদ্দিনকে একটা অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। হাতে বেড়ি, পায়ে শিকল। ঘরে একটা ছোট্ট জানালা। সেখান দিয়ে শেষ বিকেলের আলো আসছে। সালাহউদ্দিন চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের জাবরহাট ক্যাম্পে থাকার সময় খবরটা পায় সে। বাবাকে ইপিআর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি সেনারা। গভীর রাতে এক সহযোদ্ধাকে জানিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয় সালাহউদ্দিন। ১১ থেকে ১২ মাইল যে সে কীভাবে পেরিয়ে এল, নিজেই বলতে পারবে না। দরজাটা মা খোলেন। এত দিন পর পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা। সবার মনে আনন্দ। কিন্তু সেটা ছাপিয়ে বাবার গ্রেপ্তারের বিষয়টাও মাথায় ঘুরছিল সবার। কোনোরকমে রাতটা পার হতে না হতেই পরদিন সকাল ১০টায় সালাহউদ্দিনদের বাড়ি ঘিরে ফেলল পাকিস্তানি সেনারা। রাজাকাররাই দিয়েছে ওর গ্রামে ফেরার খবর। পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল এক ক্যাপ্টেন সরফরাজ খান। তাকে মা বলেছিলেন, ‘মোর সালাহউদ্দিনক ছাড়ে দে। উয়ার বদলি মোক লে যা।’
সরফরাজ হেসে বলল, ‘ইয়ে নেহি হো সাকতা।’
শেষ চেষ্টা হিসেবে একদৌড়ে ঘরের ভেতর থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে এলেন মা। ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘মোর বাপক মারিস না, খালি এইডা কথা কহে দে।’
কোরআন শরিফ ছুঁয়ে ক্যাপ্টেন কথা দিল, ‘ঠিক হ্যায়, নেহি মারুঙ্গা।’
বিদায় নেওয়ার সময় মায়ের চোখে জল ছিল। আর ছিল গর্ব।
‘তুই যেইডা ঠিক মনে করিস, ওইডা কোরেক বা। আল্লাহ তোর সাথে আছে।’
মায়ের কথাগুলো মনে পড়ল সালাহউদ্দিনের। নিজের দেশ, নিজের মানুষের জন্য যে যুদ্ধ, সেখানে ভয় পাবার কিছু নেই। মৃত্যু সবারই হবে। কিন্তু কীভাবে মরবে, সেটাই আসল কথা। কাপুরুষের মতো, নাকি বীরের মতো!
ওর ভাবনার সুতা কেটে গেল দরজা খোলার আওয়াজে। দুজন সৈন্য এসে ওকে টেনে তুলল। আবার সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।
এবার সাদুল্লাহ খানের পাশে আরেকজন অফিসার বসে আছে। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি।
‘দেখো, আমি তোমাকে একটা শেষ সুযোগ দিচ্ছি। তোমার সঙ্গীদের সম্পর্কে বলে দাও। কোথায় তাদের ক্যাম্প, কতজন আছে, কী পরিকল্পনা—সবকিছু। তাহলে তোমাকে আর তোমার বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
‘মুই কিছু জানু না।’
পুরো ক্যাম্পে তখন শোনা গেল সালাহউদ্দিনের আর্তচিৎকার। কিন্তু সে যথারীতি মুখ খুলল না। ‘ইয়ে তো বহুত পাগল হ্যায়!’ অন্য অফিসারের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ল। এ কথা শুনে সাদুল্লাহ খান রেগে গেল। পুরো বিষয়টাকে ব্যক্তিগতভাবে নিল সে। এত দিনের সুনাম তার নষ্ট হতে চলেছে। এই মুক্তির মুখ খোলানোই যাচ্ছে না।
সাদুল্লাহ খানের চোখ সরু হয়ে এল।
‘ইয়ে দেখতা হ্যায় কিতনা জিদ্দি হ্যায়,’ পাশের অফিসারকে বলল, ‘ইসকো সবক সিখানা পারেগা।’
পাশে বসে থাকা অফিসার মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল।
শুরুটা হলো লাথি-ঘুষি দিয়ে। তারপর বৈদ্যুতিক শক। সালাহউদ্দিনের মুখ থেকে আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু বের হলো না।
‘বোলো! তুমহারা দোস্ত কাহাঁ হ্যায়?’
‘জানু না।’
আবার চলল লাথি-ঘুষি। রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু সালাহউদ্দিন অনড়। এভাবে চলল কিছুক্ষণ। অত্যাচারকারীরাও হাঁপিয়ে উঠল। সালাহউদ্দিনের অবস্থাও খারাপ। সারা শরীরে ক্ষত। দুই চোখই ফুলে গেছে। ঠোঁট কেটে গিয়ে ঝুলছে। কিন্তু মুখ বন্ধ।
ধূমপানের বিরতির পর আবার শুরু হলো অত্যাচার। এবার যোগ দিল মেজর সাদুল্লাহ খান। হাতে মাছ ধরার একটা বড়শি। মাঝারি আকৃতির।
‘ইয়ে দেখ রাহে হো? জানতে হো ইয়ে ক্যায়া হ্যায়?’
সালাহউদ্দিন উত্তর দেওয়ার আগ্রহ বোধ করল না।
সাদুল্লাহ খান বড়শিটা সালাহউদ্দিনের চোখের সামনে নিয়ে দোলাল। ‘তোমাদের এখানে এটা দিয়ে মাছ ধরাটা বেশ জনপ্রিয়। তবে আজ এটা দিয়ে মাছ নয়, তোমার চোখ তুলব। বিষয়টা দারুণ হবে না?’
দুজন পাকিস্তানি সেনা চেপে ধরল সালাহউদ্দিনকে। আর ধীরে ধীরে ওর বাঁ চোখের মণিতে বড়শিটা ঢুকিয়ে দিয়ে সাদুল্লাহ খান দিল একটা টান।
পুরো পাকিস্তানি ক্যাম্পে তখন শোনা গেল সালাহউদ্দিনের আর্তচিৎকার। কিন্তু সে যথারীতি মুখ খুলল না।
‘ইয়ে তো বহুত পাগল হ্যায়!’ অন্য অফিসারের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ল।
এ কথা শুনে সাদুল্লাহ খান রেগে গেল। পুরো বিষয়টাকে ব্যক্তিগতভাবে নিল সে। এত দিনের সুনাম তার নষ্ট হতে চলেছে। এই মুক্তির মুখ খোলানোই যাচ্ছে না। না, এভাবে হবে না। হাতের আঙুলগুলো কাটতে হবে। তবে ছুরি দিয়ে নয়। করাত দিয়ে। ধীরে ধীরে। যেন করাতের একেকটি দাঁত ওর আঙুলগুলোর হাড় অনুভব করতে পারে। সেভাবেই কাটা হলো সালাহউদ্দিনের হাতের আঙুলগুলো। একটি একটি করে। অসহ্য ব্যথায় বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল সালাহউদ্দিন। পানি ঢেলে বারবার গানো হলো। সাদুল্লাহ খান চাইছিল, পুরো প্রক্রিয়ার সময় যেন জ্ঞান থাকে ওর। পুরোটাই অনুভব করতে হবে ওকে।
‘বোলো!’
‘না।’
খুন চেপে বসল সাদুল্লাহ খানের মাথায়। এবার পেরেক আনতে বলল। বড় বড়। সালাহউদ্দিনের দুই হাতে সেগুলো ঠুকে দেওয়া হলো একটা একটা করে। তারপর দুই পায়ে। রক্ত ঝরছে। ব্যথায় সালাহউদ্দিন কাতরাচ্ছে। কিন্তু মুখ খুলছে না। এভাবেই তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো।
‘ইয়ে মর জায়েগা লেকিন বোলেগা নেহি,’ একজন সেপাই বলে উঠল।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিল সাদুল্লাহ খান। আর চেষ্টা করে লাভ নেই। এ ছেলে কথা বলবে না। এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কথা বলতে হবে কর্নেল জহির খানের সঙ্গে। কর্নেল সাহেবকে পাওয়া গেল তাঁর অফিসেই। সালাহউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের পুরো ঘটনা খুলে বলা হলো তাঁকে।
‘স্যার, ইয়ে লাড়কা কুছ নেহি বোলেগা।’
‘তো মার দো।’
‘মারনা তো আসান হ্যায়। লেকিন মুঝে এক আইডিয়া আয়া হ্যায়। দো হাজার সাল পেহেলে রোমান টাইম পার মুজরিমো কো ইস তারা কি সাজা দেতে থে।’
‘কেয়া?’
‘ক্যাম্প মে দো শের হ্যায় না? উসকে সামনে তামাম শেহেরকে সবকো বুলাইয়ে। ফির দেখনা কেয়া হোতা হ্যায়।’
কর্নেল একটু ভাবলেন। তারপর মুচকি হাসলেন।
‘গুড আইডিয়া। ইয়ে অর মুক্তিকে লিয়ে এক সবক হোগা।’
৩.
শুক্রবারের সকাল। ১২ নভেম্বর। ঠাকুরগাঁও শহরে মাইকে ঘোষণা হলো, সবাইকে ইপিআর ক্যাম্পে আসতে হবে। একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। পাকিস্তানি বাহিনীর ঘোষণা। অগ্রাহ্য করবার কোনো সুযোগ নেই। লোকজন আসতে শুরু করল ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে। অনেকেই বুঝতে পারছে, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ক্যাম্পের মাঠে একটা বড় খাঁচা। সেখানে দুটো বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ক্ষুধার্ত। কয়েক দিন ধরে খাওয়ানো হয়নি ওদের।
সালাহউদ্দিনকে টেনে আনা হলো। ওর অবস্থা ভয়াবহ। হাঁটতে পারছে না। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। বাঁ চোখের জায়গাটা ফাঁকা। কিন্তু তার মুখে একটা শান্ত ভাব।
সাদুল্লাহ খান মাইকে বলল, ‘ইয়ে দেখো! ইয়ে এক গাদ্দার হ্যায়। মুলক কা দুশমন হ্যায়। ইসকো সাজা মিলনি চাহিয়ে কি নেহি?’
সালাহউদ্দিনকে খাঁচার দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। হাত বাঁধা। পা বাঁধা। কিন্তু চোখে কোনো ভয় নেই। উপস্থিত লোকজন বুঝে গেছে, ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে! কিন্তু কিছু করার নেই। ওদের এখন বাধ্য হয়ে দেখতে হবে এই জঘন্য ঘটনা।
হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে বলল সাদুল্লাহ খান। প্রাণ বাঁচানোর জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়াদৌড়ি করছে, দৃশ্যটা বেশ আনন্দদায়ক হবে।
দরজা খুলে সালাহউদ্দিনকে দ্রুত ছুড়ে ফেলা হলো খাঁচার ভেতর। মাটিতে পড়ার পর আর ওঠার চেষ্টা করল না সে। সেই শক্তি আছে বলেও মনে হচ্ছে না তার। অভুক্ত বাঘ দুটো এগিয়ে এল। একটা বাঘ সালাহউদ্দিনকে শুঁকল। তারপর হঠাৎ থাবা মারল সালাহউদ্দিনের বুকে।
‘মা গো!’ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল সালাহউদ্দিনের মুখ থেকে।
দ্বিতীয় বাঘটাও এগিয়ে এল। দুজন মিলে সালাহউদ্দিনকে টানাটানি করতে লাগল। খিদের জ্বালায় একটা জ্যান্ত মানুষকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল বাঘ দুটো। রক্ত ছড়িয়ে পড়ল খাঁচার ভেতরে।
দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে ফেলল। কেউ ফুঁপিয়ে উঠল। এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। কিন্তু রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনারা হাততালি দিতে লাগল।
‘সাবাস! সাবাস!’ চিৎকার করে বাঘগুলোকে উৎসাহ দিতে লাগল ওরা।
সাদুল্লাহ খান কিন্তু দূর থেকে সব দেখেছে। একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। হাতে থাকা সিগারেটটা ধরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হাত কাঁপছে। পেশাগত জীবনে এই প্রথম তার হাত কাঁপল। অনেক মানুষ মেরেছে সে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কেউ কেঁদেছে, কেউ মিনতি করেছে, কেউ গালাগাল দিয়েছে। কিন্তু এই ছেলেটা...এই ছেলেটা কিছুই করেনি। শুধু শেষ মুহূর্তে মাকে ডেকেছে।
দরজা খুলে সালাহউদ্দিনকে দ্রুত ছুড়ে ফেলা হলো খাঁচার ভেতর। মাটিতে পড়ার পর আর ওঠার চেষ্টা করল না সে। অভুক্ত বাঘ দুটো এগিয়ে এল। একটা বাঘ সালাহউদ্দিনকে শুঁকল। তারপর হঠাৎ থাবা মারল সালাহউদ্দিনের বুকে। ‘মা গো!’ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল সালাহউদ্দিনের মুখ থেকে।
তৃতীয়বারের চেষ্টায় সিগারেটটা ধরানো গেল। একটা লম্বা টান দিল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিচুস্বরে নিজেকেই যেন বলল, ‘ইয়ে লড়কা... ইয়ে লড়কা পাগল থা।’
এ কেমন পাগলামি? মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া? নির্যাতনে ভেঙে না পড়া?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিলদার ইয়াকুব খান বলল, ‘স্যার, আপ ঠিক হ্যায়?’
সাদুল্লাহ খান কিছু বলল না। শুধু সিগারেটে আরেকটা টান দিল। দূরে খাঁচার ভেতরে বাঘ দুটো এখনো ব্যস্ত। কয়েক দিন ধরে না খাওয়া। পেট ভরে বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে ওরা। মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে মাংস নিয়ে চলল ঝগড়া। দর্শকদের দেখার সাধ মিটে গেছে। তারা চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিঃশব্দে কাঁদছে। পেছন ফিরে কেউ তাকাচ্ছে না। এমন বীভৎস দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি তারা।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব শেষ। সালাহউদ্দিন আর নেই। সালাহউদ্দিনের কোনো অস্তিত্বই যেন ছিল না। শুধু মাটিতে পড়ে আছে ওর পরনের রক্তমাথা পোশাকগুলো।
সাদুল্লাহ খানের মনে হলো, এই দৃশ্য কোনো দিন সে ভুলবে না। এই আঠারো বছরের ছেলেটার চোখের সেই দৃঢ়তা ভুলবে না। সেই নিরাসক্ত ভঙ্গি ভুলবে না। বিস্বাদ লাগছে সিগারেটটা। শেষ হওয়ার আগেই ছুড়ে ফেলল। খানিকটা ক্ষোভে ওটাকে পায়ে মাড়াল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল। অফিসে ফিরতে হবে। আজকের ঘটনার পুরো রিপোর্ট লিখতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ মনে হলো, এ রকম পাগল ছেলে আরও আছে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। হাজারে হাজারে। যারা মৃত্যুকে ভয় পায় না। যারা নির্যাতনে ভাঙে না। যারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য প্রাণ দিতে পারে। এ রকম পাগলদের সংখ্যা বেশি হলে পাকিস্তান ভাঙবেই। এটাকে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না।
এই চিন্তা মাথায় আসতেই সাদুল্লাহ খানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কিন্তু পা ফেলতে গিয়ে থমকে গেল। মনে হলো পা দুটো ভারী হয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
হাবিলদার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, সব ঠিক হ্যায়?’
‘ঠিক হ্যায়।’ উত্তর দিয়ে সাদুল্লাহ খান হাঁটতে থাকে। কিন্তু তার মনের ভেতরে কথাগুলো ঘুরপাক খাওয়া শুরু হয়ে গেছে—‘হাম হার জায়েঙ্গে। জরুর হার জায়েঙ্গে।’